এটিএম জালিয়াতি: সিসি ক্যামেরায় ‘বিদেশির ছবি’

গ্রাহকের তথ্য চুরি করে ক্লোন কার্ড বানিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া চক্রে বিদেশি যোগসাজশ রয়েছে বলে সন্দেহের কথা পুলিশকে জানিয়েছে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি) কর্তৃপক্ষ।

লিটন হায়দারবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 Feb 2016, 07:19 PM
Updated : 15 Feb 2016, 05:45 AM

এই ঘটনায় বনানী থানায় বেসরকারি ব্যাংকটির করা মামলার এজাহারের সঙ্গে একটি এটিএম বুথের সিসি ক্যামেরায় ধারণ করা ছবিও তারা জমা দিয়েছে, যাতে একজন ‘বিদেশির মুখাবয়ব’ ধরা পড়েছে বলে তাদের দাবি।

এই সন্দেহের কথা জানিয়ে ওই বিদেশির বাংলাদেশ থেকে পালানো ঠেকাতে পুলিশকে বিমান, নৌ ও স্থলবন্দরগুলোতে নজরদারি চালাতে ব্যাংকটির পক্ষ থেকে পুলিশকে অনুরোধ করা হয়েছে।

শুক্রবার রাতে ইউসিবি কর্তৃপক্ষ মামলা করে, যার তদন্ত ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে বলে ঢাকা মহানগর পুলিশের গুলশান জোনের সহকারী কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ইউসিবি কর্তৃপক্ষ এজাহারের সঙ্গে বুথের সিসিটিভিতে ধরা পড়া কিছু ভিডিও ফুটেজ দিয়েছে।”

বনানী থানার ওসি মো. সালাউদ্দিন খান জানান, বনানী এলাকায় ইউসিবির কিছু এটিএম বুথে ‘স্কিমিং ডিভাইস’ বসিয়ে গ্রাহকের গোপনীয় তথ্য চুরি করা হয়।

“তদন্তের স্বার্থে এখনই অনেক কিছু বলা যাচ্ছে না। পুলিশ ওই চক্রটিকে ধরতে কাজ করছে,” বলেন তিনি।

গত বৃহস্পতি ও শুক্রবার গ্রাহকের অজ্ঞাতসারে কয়েকটি ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তোলাসহ নানা ধরনের ‘ভুতুড়ে ট্রানজেকশনের’ ঘটনা ঘটার পর এই জালিয়াতির বিষয়টি বেরিয়ে আসে।  

তিনটি ব্যাংকের ছয়টি বুথে ‘স্কিমিং ডিভাইস’ বসিয়ে গ্রাহকের ব্যক্তিগত তথ্য চুরির পর কার্ড ক্লোন করে টাকা তুলে নেওয়ার তথ্য পাওয়ার কথা ইতোমধ্যে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তকারীরা।

থানায় মামলাটি করেন ইউসিবি কার্ডের ব্রাঞ্চেস কন্ট্রোল অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ডিভিশনের হেড অব ফ্রড কন্ট্রোল অ্যান্ড ডিসপিউট ম্যানেজমেন্ট মাহবুব উল ইসলাম খান।

মামলায় তিনি বলেছেন, তাদের বনানীর একটি এটিএম বুথের নিরাপত্তা প্রহরীকে মিথ্যা পরিচয় দিয়ে যান্ত্রিক ত্রুটি সারানোর নাম করে গত ৭ ফেব্রুয়ারি ঢুকেছিলেন এক ব্যক্তি।

“ওই ব্যক্তি সকাল ১০টা ৪২ মিনিটসহ বিভিন্ন সময়ে ঢুকে আমাদের বুথে স্থাপিত এটিএম মেশিনের কম্পিউটারের তথ্যাদি সংগ্রহ করার নিমিত্তে কার্ড ডাটা কপি করার যন্ত্র (স্কিমিং ডিভাইস) স্থাপন করে।”

“পরবর্তীতে অজ্ঞাতনামা এই আসামি অবৈধ প্রযুক্তি ব্যবহার করে এটিএম মেশিনের কম্পিউটার সিস্টেমে অবৈধভাবে প্রবেশের মাধ্যমে কপিকৃত ডাটা দিয়ে ট্রানজেকশন করতে সমর্থ হয়।”

ঢাকার একটি এটিএম মেশিন

বাংলাদেশজুড়ে প্রায় সাত হাজার এটিএম বুথের মাধ্যমে ব্যাংকগুলো সেবা দিচ্ছে। এগুলোতে সিসি ক্যামেরা রয়েছে।

বুথের মধ্যে থাকা সিসি ক্যামেরায় ধারণ করা চিত্রে অপরাধীরা ধরা পড়েছে দাবি করে মাহবুবের এজাহারে বলা হয়, পুনরায় ওই আসামিকে দেখলে তিনি ও তাদের বুথের প্রহরী চিনতে পারবেন।

“আসামির ছবি প্রিন্ট করে এই এজাহারের সঙ্গে সংযুক্ত করে দিলাম। উক্ত অজ্ঞাতনামা আসামির মুখাবয়ব দেখে বিদেশি মনে হওয়ায় সে যেন পালাতে না পারে, সেজন্য সকল বন্দরে ছবি পাঠানোর অনুরোধ করছি।”

এজাহারে বলা হয়, অজ্ঞাতনামা ওই আসামি ১১ ফেব্রুয়ারিসহ কয়েকটি দিন ও সময়ে জালিয়াতির মাধ্যমে অন্তত সোয়া লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। তার সঙ্গে সংঘবদ্ধ একটি দল জড়িত বলে সন্দেহ হচ্ছে।  

ইউসিবির মতো ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেডের (ইবিএল) গুলশান এলাকার দুটি বুথ থেকে এভাবে গ্রাহকের তথ্য চুরি হয়েছে।

মাইক্রোচিপের নিরাপত্তা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসা প্রযুক্তি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ফাইবার এট হোম এর চিফ স্ট্র্যাটেজি অফিসার সুমন আহমেদ সাবির বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এই ধরনের জালিয়াতি বিদেশে প্রায়ই ঘটে থাকে।

“৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে ব্যাংকের লোক, বুথের নিরাপত্তারক্ষী বা সুপার শপের কর্মীরা জড়িত থাকেন। নিরাপত্তারক্ষী সতর্ক হলে এটিএম বুথে স্ক্যানার বা ক্যামেরা বসানো সহজ নয়।”

তিনি বলেন, ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে এভাবে টাকা চুরি করতে হলে প্রথমে কোনো একটি কার্ডের সমস্ত তথ্য নিতে হয়। এ জন্য দরকার হয় একটি স্ক্যানার, যাকে ‘স্কিমিং ডিভাইস’ বলা হচ্ছে।

অস্ট্রেলিয়ায় একটি এটিএম মেশিনে বসানো জালিয়াতদের স্কিমিং ডিভাইস

এটিএম মেশিনে কার্ড রিডারের কাছাকাছি কোথাও ক্ষুদ্র এই স্ক্যানার বসাতে হয়। কোনো কার্ড মেশিনে ঢোকানো হলে তার ম্যাগনেটিক স্ট্রিপ থেকে গ্রাহকের সমস্ত তথ্য ওই স্ক্যানার কপি করে ফেলে। পরে স্ক্যানার থেকে পাওয়া তথ্য একই ধরনের চিপ সম্বলিত আরেকটি ফাঁকা কার্ডে ভরে দিলেই তৈরি হয়ে যায় ক্লোন।

এই কার্ড দিয়ে টাকা তুলতে দরকার হয় গ্রাহকের পিন নম্বর। ওই পিন চুরির জন্য এটিএম মেশিনের কি বোর্ড, স্পিকার, দুই পাশ বা উপরের ছায়চ্ছন্ন জায়গায় বসানো হয় অতিক্ষুদ্র ক্যামেরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, জালিয়াতরা ছয়টি বুথে ‘স্কিমিং ডিভাইস’ ও ভিডিও ক্যামেরা বসিয়ে রেখেছিল, যার মাধ্যমে তারা বুথে ঢোকানো কার্ডের তথ্য ও পিন নম্বর জেনে গেছে। এরপর ডুপ্লিকেট কার্ড তৈরি করে তারা টাকা তোলার কাজটি সেরেছে। 

এসব কারণে ব্যাংকগুলোকে এন্টি স্কিমিং ডিভাইস স্থাপন, নিয়মিত ভিডিও ফুটেজ পর্যবেক্ষণ এবং এটিএম বুথে যেন কোনোভাবে বাইরের কেউ কোনো যন্ত্র বসানো বা মেরামতের কাজ করতে না পারে, সে বিষয়ে সজাগ থাকতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী  পরিচালক শুভঙ্কর সাহা রোববার বিকালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রাথমিক তদন্তে আমরা নিশ্চিত হয়েছি, ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেডসহ তিনটি ব্যাংকের ছয়টি বুথে এই জালিয়াতি হয়েছে।”

জালিয়াতির ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে ‘ব্যাংকের দায় চিহ্নিত’ করার বিষয়েও বাংলাদেশ ব্যাংক প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছে বলে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।