রাজু ভাস্কর্য ও ঢাকা গেইট সুরক্ষা এবং শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণের ‘নিশ্চয়তা’ দিয়েই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর দিয়ে মেট্রোরেলের পথ নেওয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ।
Published : 27 Jan 2016, 08:25 PM
ক্যাম্পাসের ভেতর দিয়ে মেট্রোরেল নেওয়ার বিরোধিতা করে একদল শিক্ষার্থীর আন্দোলনের মধ্যে বুধবার ‘ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (ডিএমআরটিডিপি)’ কর্তৃপক্ষ এক সংবাদ সম্মেলনে একথা জানায়।
প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ মেট্রোরেলের (এমআরটি-৬) বিভিন্ন কারিগরি দিক উপস্থাপন করে শব্দ দূষণে ক্ষতির আশঙ্কা নাকচ করেছে।
মেট্রোরেল প্রকল্পের অগ্রগতি জানাতে রাজধানীর ইস্কাটনে প্রবাসী কল্যাণ ভবনে এই সংবাদ সম্মেলন ডাকা হয়, যার মূল অংশ ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের বিরোধিতার জবাব দেওয়া।
সেই সঙ্গে একটি ভিডিও দেখানো হয় সংবাদ সম্মেলনে। এতে ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকায় চলাচলের ক্ষেত্রে মেট্রোরেল যে নগরবাসীকে অনেক স্বাচ্ছন্দ্য দেবে এবং সড়কে গাড়ি চলাচল যে বিঘ্নিত করবে না, তা তুলে ধরা হয়।
অনেক কাজ ইতোমধ্যে বাস্তবায়ন হয়ে গেছে জানিয়ে প্রকল্প পরিচালক মো. মোফাজ্জেল হোসেন সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, “এ পর্যায়ে যদি আবার রুট চেঞ্জ করতে যাই, তাহলে অনেক পেছনে ফিরে যেতে হবে, প্রকল্প অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়বে।”
তিনি বলেন, মেট্রোরেলের রুট নিয়ে ২০১০-১১ সালে অনেক আলোচনা-পর্যালোচনা হয়েছে। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকা হয়ে রুট হওয়ার কথা থাকলেও তখন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পরামর্শে তা টিএসসির পাশ দিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
উত্তরা থেকে মিরপুর-ফার্মগেইট হয়ে মতিঝিল পর্যন্ত রুটে টিএসসি এলাকার পরিবর্তে শাহবাগ থেকে মৎস্য ভবন দিয়ে রেলপথটি নেওয়ার দাবি জানিয়েছে আন্দোলনকারীরা।
মৎস্য ভবন এলাকার ওই রুটে আঁকাবাঁকা রাস্তায় নানা সীমাবদ্ধতার কারণে রেললাইন নেওয়া সম্ভব নয় বলে জানান প্রকল্প পরিচালক মোফাজ্জেল।
“ট্রেনে টার্নিং নেওয়ার জন্য একটা বড় জায়গা দরকার, সেটা মৎস্য ভবন এলাকায় নেই। এ ধরনের দ্রুতগতির যানবাহন দিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে কমপক্ষে ২০০ মিটার রেডিয়াস দরকার। ওখানে ৯০ ডিগ্রিরও কম রেডিয়াস রয়েছে।”
সংবাদ সম্মেলনে মেট্রোরেলের শব্দ ও কম্পনরোধে নেওয়া ম্যাস স্প্রিং সিস্টেম (এমএসএস) এর ব্যাখ্যা দেন প্রকল্প পরিচালক। তার সঙ্গে ডিএমআরটিডিপি প্রকল্পের অন্যতম পরামর্শক ড. নজরুল ইসলামও ছিলেন।
টিএসসির স্টেশন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় মেট্রোরেল স্টেশনের কারণে টিএসসি এলাকায় জনসমাগম বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে শিক্ষার্থীদের উদ্বেগের জবাব আসে সংবাদ সম্মেলন থেকে।
প্রকল্প পরিচালক বলেন, স্টেশনের সঠিক অবস্থান হচ্ছে- টিএসসির এটিএম বুথ থেকে শুরু করে দক্ষিণে বাংলা একাডেমির গেইটের আগে এসে শেষ হবে। সাধারণত স্টেশনগুলো হয় ১৮০ মিটার দৈর্ঘ্যের।
“সাউন্ড ব্যারিয়ার ওয়াল থাকবে মেট্রোরেলের পুরো এলাইনমেন্ট জুড়ে। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাসহ ১৯ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার দীর্ঘপথের বিভিন্ন এলাকাজুড়ে শব্দ ও কম্পননিরোধী ম্যাস স্প্রিং সিস্টেম (এমএসএস) থাকবে ছয় কিলোমিটার জায়গায়। ফলে ক্যাম্পাস এলাকায় কম্পন কিংবা শব্দদূষণজনিত কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।”
মোফাজ্জেল বলেন, “আমরা স্টাডি করে দেখেছি- কিছু কিছু জায়গায় যে শব্দ এখন আছে, মেট্রোরেলের সাউন্ড তার চেয়েও কম হবে। ফলে এটি মানুষের কানে আসবে না।
“উদাহরণস্বরূপ বলা যায়-শাহবাগের যে সাউন্ড এখন আছে, সেটা মেট্রোরেলের সৃষ্ট সাউন্ডের চেয়ে বেশি। ফলে সেখান দিয়ে কোচগুলো গেলে অনেক সময় বোঝাও যাবে না।”
ঢাকা গেইট-রাজু ভাস্কর্য ‘নিরাপদ’
কারিগরি তথ্যের বরাত দিয়ে প্রকল্পের অন্যতম পরামর্শক নজরুল ইসলাম বলেন, রাজু ভাস্কর্য থেকে মেট্রোর দূরত্ব ৬৩ ফুট। ভাস্কর্য থেকে ১৩ ফিট উঁচু দিয়ে যাবে রেললাইন। দুই স্থাপনার সেন্টারের দূরত্ব হবে ২১ মিটার।
“ফলে রেলের কম্পনের কারণে এই স্থাপনার ক্ষতির আশঙ্কা খুবই কম।”
নজরুল বলেন, “জাপান স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী, দ্রুতগতির ভারী ট্রেন অতিক্রম করার ক্ষেত্রে লাইনের পিয়ার (ভারকেন্দ্র) থেকে সাড়ে ১২ মিটার দূরত্বের মাত্র ৬০ ডেসিবেল ভাইব্রেশন হয়। পিয়ারের মাধ্যমে ভাইব্রেশনটা সঞ্চালিত হয়।
“সেক্ষেত্রে বর্তমান নকশা অনুযায়ী, রাজু ভাস্কর্য ও মেট্রোলাইনের পিয়ারের দূরত্ব ২১ মিটার। এ থেকে বোঝা যায়, কোনো প্রযুক্তির ব্যবহার ছাড়াই রাজু ভাস্কর্য কম্পনের মুখে পড়বে না, ভাস্কর্যটি পুরোপুরি নিরাপদ। এর পরও এখানে এমএসএস প্রযুক্তি তো থাকছেই।”
প্রকল্প এলাকাজুড়ে থাকা সব ধরনের ঐতিহাসিক স্থাপনার নিরাপত্তার ব্যবস্থাও করা হয়েছে বলে জানান প্রকল্পের কর্মকর্তারা।
প্রকল্প পরামর্শক নজরুল বলেন, “ঢাকা গেইট একটা ইস্যু ছিল। প্রথম যে রুট করা হয়েছিল সেই সময় পিয়ার থেকে ঢাকা গেইটের দূরত্ব ছিল ৬ থেকে ৭ মিটার, সেটা একটা সমস্যা ছিল। ফলে ওই ডিজাইন চেঞ্জ করা হয়।
“সাধারণত ৩০ মিটার দূরত্বে পিলার দেওয়ার নিয়ম থাকলেও ঢাকা গেইটের কাছে দুই পিয়ারের দূরত্ব রাখা হয়েছে ৪০ মিটার। এর ফলে মেট্রোলাইনের পিয়ার থেকে ঢাকা গেইটের দূরত্ব দাঁড়াবে প্রায় ১৪ মিটার।”
স্পেশাল শক অ্যাবজর্ভার এমএসএস না থাকলেও এই দূরত্বে স্থাপনা নিরাপদ দাবি করে তিনি বলেন, “তবুও এখানে পৃথিবীর সর্বোচ্চ প্রযুক্তির অ্যাবজর্ভার থাকছে। এটা বসালে ভাইব্রেশনটা আরও কমে যাবে, ৫৫ এর মতো হবে। ন্যাচারাল ভাইব্রেশনও ৫০ ডেসিবলের মতো থাকে।”
এমএসএস সম্পর্কে ধারণা দেন মেট্রোরেল প্রকল্পের অন্যতম পরামর্শক নজরুল।
“এমএসএস এক ধরনের শক অ্যাবজর্ভার। মোটর-সাইকেলের চাকার পাশে যে স্প্রিং থাকে, সেটা গর্তে চাকা পড়ার পর ধাক্কা সামলায়-এটা সে ধরনের একটা সিস্টেম। এটা রবারের ম্যাটের মতো, বসানো হবে ট্র্যাকের নিচে। এর অফিসিয়াল নাম হচ্ছে প্লডিং ট্র্যাক প্লেট, মানে ট্র্যাকটাকে ভাসিয়ে রাখার একটা যন্ত্র।”
'অত্যন্ত ব্যয়বহুল' এই এমএসএস শব্দ দূষণ ও কম্পন কমাতে সহায়তা করবে বলে জানান তিনি।
জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সাধারণ শিক্ষার্থীদের’ ব্যানারে ‘মেট্রোরেলের রুট বদলাও, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাঁচাও’ ব্যানারে কর্মসূচি পালন করেন কয়েকশ শিক্ষার্থী। কয়েকজন শিক্ষকও তাদের সমর্থন জানান।
মেট্রোরেল হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের জিন প্রকৌশল, সিএসই, অণুজীব বিজ্ঞান ও সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড রিসার্চ বিভাগ সরাসরি হুমকিতে পড়ার পাশাপাশি রাজু ভাস্কর্যও তার চিরচেনা সৌন্দর্য হারাবে বলে দাবি করেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা।
এই ট্রেনের শব্দে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার ও দোয়েল চত্বরের পাশে অবস্থিত বিজ্ঞান লাইব্রেরিতে লেখাপড়া ব্যাহত হবে বলেও দাবি তাদের।