অনুপ চেটিয়াকে হস্তান্তর, সঙ্গে গেল দুই সহযোগী

বাংলাদেশে ১৮ বছর কারাবন্দি থাকার পর উত্তর-পূর্ব ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার নেতা অনুপ চেটিয়াকে ভারত সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকও ভারত প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 Nov 2015, 04:52 AM
Updated : 11 Nov 2015, 02:07 PM

তার দুই সহযোগী বাবুল শর্মা ও লক্ষ্মীপ্রসাদ গোস্বামীকেও একইসঙ্গে ফেরত পাঠিয়েছে বাংলাদেশ।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছেন, “সাজা শেষ হয়ে যাওয়ায় আইন মেনেই অনুপ চেটিয়া ও অন্যদের ফেরত দেওয়া হয়েছে।”

আসামের স্বাধীনতার লক্ষ্যে দুই দশকেরও বেশি সময় সশস্ত্র তৎপরতা চালানো ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসামের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক অনুপ চেটিয়া, যার আসল নাম গোলাপ বড়ুয়া। ৪৮ বছর বয়সী এই বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতার বিরুদ্ধে হত্যা, অপহরণ, ব্যাংক ডাকাতিসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। 

আট বছর আগে বাংলাদেশে অনুপ চেটিয়ার সাজার মেয়াদ শেষ হলেও তাকে হস্তান্তরের বিষয়টি এতোদিন আটকে ছিল। বলা হচ্ছিল, আসামি প্রত্যর্পণ চুক্তি না থাকায় তাকে ফেরানো যাচ্ছে না।   

নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর সাত খুনে প্রধান আসামি নূর হোসেনকে ফেরত পেলে বাংলাদেশ চেটিয়াকে দেবে- এমন আলোচনার কথাও এর মধ্যে গণমাধ্যমে এসেছে।     

শেষ পর্যন্ত ২০১৩ সালে দুই দেশের মধ্যে বহিঃসমর্পণ চুক্তি হলেও তার আওতায় অনুপ চেটিয়ার হস্তান্তর হয়নি বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

তিনি বলেন, “এটা বন্দি বিনিময় চুক্তির মাধ্যমে হয়নি। তাদেরকে ছেড়ে দেওয়ার আগে সেদেশের রাষ্ট্রদূতকে জানানো হয়েছে। এখন ছেড়ে দেওয়ার পর তারা নিয়ে গেছে।”

১৯৯৭ সালের ২১ ডিসেম্বর ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকার একটি বাসা থেকে অনুপ চেটিয়া ও তার দুই সহযোগীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরপর তাদের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে বাংলাদেশে অবস্থান এবং অবৈধভাবে বিদেশি মুদ্রা ও একটি স্যাটেলাইট ফোন রাখার অভিযোগে তিনটি মামলা হয়।

পরে তিনটি মামলায় চেটিয়াকে যথাক্রমে তিন, চার ও সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয় বাংলাদেশের আদালত। ২০০৭ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি তার সাজার মেয়াদ শেষ হয়। বাবুল ও লক্ষ্মীপ্রসাদও এসব মামলায় সাজা খাটেন।

২০১২ সাল থেকে অনুপ চেটিয়া ছিলেন গাজীপুরের কাশিমপুরে হাই সিকিউরিটি কারাগারে। সেখান থেকেই ব্যাপক গোপনীয়তার মধ্যে বুধবার ভোররাতে তাকে নিয়ে যান ভারতীয় হাই কমিশনের কর্মকর্তারা।  

এক্ষেত্রে এতোটাই গোপনীয়তা বজায় রাখা হয় যে ভারতের গণমাধ্যমে হস্তান্তরের খবর আসার পরও বুধবার দুপুর পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বিষয়টি স্বীকার করা হয়নি।     

সকালে ভারতের জাতীয় বার্তা সংস্থা প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া দেশটির কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে অনুপ চেটিয়ার হস্তান্তরের খবর দিলে বিষয়টি বাংলাদেশের গণমাধ্যমে আসে।

এরপর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পক্ষ থেকে ভারতের পররাষ্ট্র দপ্তরের কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারাও বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

কিন্তু বেলা সোয়া ১১টায় ঢাকার মিরপুরে এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেন, “আমার কাছে কোনো তথ্য নাই।”

ভারতীয় গণমাধ্যমের খবরের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, “এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না।”

দেড় ঘণ্টা পর ওই অনুষ্ঠান শেষে কামালই হস্তান্তরের কথা সাংবাদিকদের কাছে স্বীকার করেন।

পরে সচিবালয়ে ফিরে তিনি সাংবাদিকদের ব্রিফ করলেও কোন পথে কীভাবে তিন ভারতীয়কে ফেরত পাঠানো হয়েছে- সে তথ্য তিনি দেননি। 

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “বর্ডারের বিষয় আসবে কেন? আমরা কারাগার থেকে ছেড়ে দিয়েছি। কীভাবে গিয়েছে বা কীভাবে রিসিভ করা হয়েছে সেটা পরের বিষয়।

“বিজিবি সদস্যদের উপস্থিতিতে বিএসএফের কাছে চলে যাওয়াকে যদি হস্তান্তর মনে করেন, তবে তাই। আজ ভোরে তারা ভারতে চলে গেছেন।”

স্বাভাবিকভাবেই চেটিয়াকে ফেরানোর ক্ষেত্রে কোনো শর্ত ছিল কি না, তার বদলে নূর হোসেনকে ভারত ফেরত দিচ্ছে কি না- সে প্রশ্নগুলোও আসে। 

উত্তরে মন্ত্রী বলেন, “ভারত আমাদের বন্ধুপ্রতীম দেশ। কারও বিনিময়ে দেওয়া নেওয়া হয়নি। সাজার মেয়াদ শেষ, আদালতের নির্দেশ ছিল, আমরা ছেড়ে দিয়েছি।”

কাশিমপুর কারাগারের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, ‘উপরের’ নির্দেশনা অনুযায়ী তারা কেবল অনুপ চেটিয়াকে মুক্তি দিয়েছেন। ভারতীয় হাই কমিশনের কর্মকর্তারা সে সময় ছিলেন। এরপর কীভাবে তাকে ভারতে নেওয়া হয়েছে সে বিষয়ে তাদের কিছু জানা নেই। 

সিলেট পুলিশের একটি সূত্র বলছে, সকালে তামাবিল দিয়ে বিজিবির সহায়তায় তিন ভারতীয়কে সীমান্ত পার করা হয়। তবে বিজিবির মাধ্যমে এর সত্যতা নিশ্চিত করা যায়নি।     

ভারতীয় গোয়েন্দা বিভাগের একজন কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, চেটিয়াকে দিল্লি নেওয়া হয়েছে আকাশপথে।

সেখানে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে এই উলফা নেতাকে আসাম পুলিশের হাতে দেওয়া হতে পারে বলে দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।  

সাজার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ২০০৫, ২০০৮ ও ২০১১ সালে বাংলাদেশে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে আবেদন করেন অনুপ চেটিয়া। শরণার্থীর মর্যাদা পাওয়ার জন্য ২০০৮ সালে জাতিসংঘেও তিনি চিঠি লেখেন।

এরপর সাজার মেয়াদ শেষ হলেও আশ্রয়ের সেই আবেদনের কারণে হাই কোর্টের নির্দেশে আটকে থাকে তার মুক্তি। হাই কোর্টের আদেশে বলা হয়েছিল, রাজনৈতিক আশ্রয়ের বিষয়টি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তাকে কারাগার থেকে ছাড়া যাবে না।

এরই মধ্যে ভারত সরকারের চাপে উলফার অবস্থান দুর্বল হতে থাকে। উলফা চেয়ারম্যান অরবিন্দ রাজখোয়াসহ বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতা বাংলাদেশে আটক হন। ২০০৯ সালের শেষ দিকে তাদের ভারতে হস্তান্তর করা হয়। সরকারের সঙ্গে শান্তি আলোচনার শর্তে তারা মুক্তিও পান।

উলফার সামরিক প্রধান পরেশ বড়ুয়া আসামের স্বাধীনতার দাবিতে সশস্ত্র আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে অনড় থাকলেও সাধারণ সম্পাদক অনুপ চেটিয়া সরকারের সঙ্গে সমঝোতার পক্ষে সমর্থন দিয়েছেন বলে ২০১৩ সালে ভারতীয় গণমাধ্যমে খবর আসে।

ওই সময় অনুপ চেটিয়াও বাংলাদেশে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য করা আবেদন প্রত্যাহার করে ভারতে ফেরার আগ্রহ দেখান।

বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো ওই চিঠিতে বলা হয়, “২০০৭ সালে আমার কারাদণ্ডের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও এখনো আমাকে বন্দি জীবন কাটাতে হচ্ছে। আমাকে আর কতদিন এভাবে জেলে কষ্ট পেতে হবে? এর আগে আমি রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছিলাম। কিন্তু এখন আর আমি সেটা চাইছি না। আমাকে মুক্তি দিন এবং দেশে ফিরে যাওয়ার সুযোগ দিন।”

এরপর বিভিন্ন ফোরামে চেটিয়ার হস্তান্তর নিয়ে কথা উঠলেও নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের আসামি নূর হোসেন কলকাতায় গ্রেপ্তার হওয়ার পর বিষয়টি নতুন গতি পায়।   

গতবছর সেপ্টেম্বরে ঢাকায় দুই দেশের স্বরাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকে অনুপ চেটিয়ার বিনিময়ে নূর হোসেনকে ফেরানোর বিষয়ে মতৈক্য হয় বলে গণমাধ্যমে খবর আসে। কিন্তু নূর হোসেনের বিরুদ্ধে ভারতীয় আদালতে পাসপোর্ট আইনের মামলার কারণে বিষয়টি আটকে থাকে।  

শেষ পর্যন্ত গত অক্টোবরে ভারত সরকার ওই মামলা তুলে নেয় এবং আদালত নূর হোসেনকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর অনুমতি দেয়।

নূর হোসেনকে ফেরানোর পথ তৈরি হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই অনুপ চেটিয়ার প্রসঙ্গটি ফিরে আসে। এর এক মাসের মাথায় ওই উলফা নেতাকে বাংলাদেশ ফিরিয়ে দিল।

পিটিআই লিখেছে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র ‘মোদীর ব্যক্তিগত’ উদ্যোগ এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘একক সিদ্ধান্তে’ শেষ পর্যন্ত অনুপ চেটিয়ার হস্তান্তর সম্ভব হয়েছে।

আর কলকাতার আনন্দবাজার লিখেছে, “এ দিন সকালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দীপাবলির শুভেচ্ছা জানিয়ে ফোন করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সন্ত্রাসবাদ রুখতে তার ভূমিকার প্রশংসা করে মোদী তাকে অভিনন্দন বার্তাও জানিয়েছেন।”