এক মাসের ব্যবধানে নির্যাতনের মাধ্যমে দুই শিশু হত্যার যে দুটি ঘটনা পুরো বাংলাদেশকে নাড়িয়ে দিয়েছিল, তার বিচারে ছয় জনের সর্বোচ্চ সাজার রায় দিয়েছে আদালত; বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে আরও ছয়জনের।
Published : 08 Nov 2015, 06:45 PM
সিলেটে ১৩ বছরের সামিউল আলম রাজনকে পিটিয়ে হত্যার মামলায় প্রধান আসামি কামরুল ইসলামসহ চার জনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন মহানগর দায়রা জজ আকবর হোসেন মৃধা।
আর খুলনায় ১২ বছরের রাকিব হাওলাদারকে নির্মম কায়দায় হত্যার দায়ে মহানগর দায়রা জজ আদালতের ভারপ্রাপ্ত বিচারক দিলরুবা সুলতানা মোটর ওয়ার্কশপ মালিক ওমর শরিফ ও তার সহযোগী মিন্টু খানকে একই সাজা দিয়েছেন।
গত ৮ জুলাই সিলেটের কুমারগাঁওয়ে চুরির অভিযোগ তুলে ১৩ বছরের শিশু রাজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। হত্যাকারীরাই সেই নির্যাতনের ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়, যা নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড় ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
এরপর মাস না ঘুরতেই ৩ অগাস্ট খুলনার টুটুপাড়া কবরখানা মোড়ের একটি ওয়ার্কশপে মোটরসাইকেলে হাওয়া দেওয়ার কমপ্রেসার মেশিনের মাধ্যমে মলদ্বারে হাওয়া ঢুকিয়ে হত্যা করা হয় রাকিবকে।
সিলেটের জালালাবাদ থানা এলাকার বাদেয়ালি গ্রামের রাজন রিকশা ভ্যানে করে সবজি বিক্রি করত। আর রাকিব কাজ করত খুলনার পিটিআই মোড়ের এক মোটর গ্যারেজে। তাদের নির্মম হত্যার খবর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও শিরোনাম হয়।
রাজন হত্যার ঠিক চার মাসের মাথায় রোববার একই দিনে চাঞ্চল্যকর এ দুই মামলার রায় আসে। আইনজীবীরা বলছেন, এত দ্রুত হত্যা মামলার রায় আসার ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরল।
রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে তা দ্রুত কার্যকর করার দাবি জানিয়েছেন রাজনের বাবা আজিজুর রহমান ও মা লুবনা আক্তার। তবে রাকিবের মামলার রায়ে এক আসামি খালাস পাওয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করেন ওই শিশুর মা লাকি বেগম।
অন্যদিকে দুই মামলাতেই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করার কথা জানিয়েছেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা।
রায় উপলক্ষে কড়া নিরাপত্তার মধ্যে দুই নগরীর আদালতেই বিপুল সংখ্যক মানুষের ভিড় জমে। রাজন হত্যার ১১ আসামিকে হাজির করার সময় আদালতের বাইরে তাদের দিকে জুতাও নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। আর খুলনার আদালত চত্বরে স্লোগান ওঠে, ‘ফাঁসি ফাঁসি ফাঁসি চাই, ফাঁসি ছাড়া দাবি নাই।’
সিলেটে রাজন হত্যার দেড় মাসের মধ্যে তদন্ত শেষ করে ১৬ অগাস্ট ১৩ জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সুরঞ্জিত তালুকদার।
অভিযোগ গঠনের পর ১ অক্টোবর সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। ৩৮ জন সাক্ষীর মধ্যে ৩৬ জন সাক্ষ্য শুনে মাত্র ১৭ কার্যদিবস বিচারিক কার্যক্রম শেষে আদালত রায় ঘোষণা করে।
রায়ে আসামিদের মধ্যে কামরুল ইসলাম, ময়না চৌকিদার, তাজউদ্দিন আহমদ বাদল ও জাকির হোসেন পাভেল আহমদের ফাঁসির আদেশ হয়েছে।
নূর মিয়ার হয়েছে যাবজ্জীবন সাজার রায়। কামরুলের এই সহযোগীই রাজনকে নির্যাতনের দৃশ্য ভিডিও করেন, তারপর ছড়িয়ে দেন ইন্টারনেটে।
কামরুলের তিন ভাই মুহিত আলম, আলী হায়দার ও শামীম আহমদকে সাত বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত। এক বছর করে দণ্ড হয়েছে দুলাল আহমদ ও আয়াজ আলীর।
এক বছর করে কারাদণ্ড হওয়া দুইজনকে এক হাজার টাকা করে এবং দণ্ডপ্রাপ্ত অন্যদের ১০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। অনাদায়ে তাদের আরও ২ মাস কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে।
আসামিদের মধ্যে জাকির হোসেন পাভেল এবং কামরুলের ভাই শামীম আহমদ মামলার শুরু থেকেই পলাতক। অপরাধে সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত না হওয়ায় ফিরোজ মিয়া, আজমত উল্লাহ ও রুহুল আমিনকে খালাস দিয়েছে আদালত।
এরমধ্যে সেই নির্যাতনের ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে প্রবাসীদের সহযোগিতায় সৌদি আরবে আটক হন কামরুল। সরকারি পর্যায়ে যোগাযোগের মাধ্যমে ১৫ অক্টোবর তাকে দেশে ফিরিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়।
রায় উপলক্ষে রোববার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কড়া নিরাপত্তার মধ্যে গ্রেপ্তার ১১ আসামিকে আদালতে হাজির করা হয়। এসময় রাজনের খুনিদের ফাঁসির দাবিতে স্লোগান দেয় হাজারো মানুষ। আসামিকে লক্ষ করে তাদের অনেকে জুতাও নিক্ষেপ করেন।
রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে রাজনের বাবা আজিজুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, “দ্রুত রায় ঘোষণা হওয়ায় আমরা খুশি।”
মা লুবনা আক্তার বলেন, “রায় কার্যকর হলেই আমার ছেলের আত্মা শান্তি পাবে।”
এ আদালতের পিপি মফুর আলী বলেন, “প্রত্যাশিত রায়ই হয়েছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে এই রায় ঘোষণা বিচার বিভাগের দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।”
অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী হাবিবুর রহমান হাবিব জানান, পূণাঙ্গ রায় পর্যালোচনা করে তারা উচ্চ আদালতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেবেন।
গত ২৫ অগাস্ট রাকিব হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা খুলনা সদর থানার এসআই কাজী মোস্তাক আহমেদ তিনজনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেন। ৫ অক্টোবর অভিযোগ গঠনের পর ৩৮ জনের সাক্ষ্য শুনে মাত্র ১০ কার্যদিবসে আদালত বিচার-প্রক্রিয়া শেষ করে।
মামলার তিন আসামির মধ্যে শরীফ মোটর্সের মালিক ওমর শরীফ ও তার দূরসম্পর্কের চাচা মিন্টু মিয়াকে মৃত্যুদণ্ড দেন বিচারক। আর শরীফের মা বিউটি বেগমকে খালাস দেওয়া হয়।
শরীফের মোটর ওয়ার্কশপে মোটরসাইকেলে হাওয়া দেওয়ার কম্প্রেসার মেশিনের মাধ্যমে মলদ্বারে হাওয়া ঢুকিয়ে হত্যা করা হয় রাকিবকে। এক সময় ওই ওয়ার্কশপে কাজ নিলেও ছেড়ে দিয়ে পরে অন্য গ্যারেজে কাজ নেওয়ায় তাকে এই পৈশাচিক কায়দায় হত্যা করা হয় বলে তদন্তে বেরিয়ে আসে।
লাশের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, কম্প্রেসার মেশিনের মাধ্যমে দেওয়া বাতাসের চাপে কিশোর রাকিবের পেটের ভেতরের নাড়ি, মলদ্বার, মুত্রথলি ফেটে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়।
ঘটনার পরপরই শরীফ, মিন্টুকে ধরে পুলিশে দেয় স্থানীয় জনতা। পরে বিউটি বেগমকেও পুলিশ গ্রেপ্তার করে। পরে তিন আসামিই রাকিবকে হত্যার বর্ণনা দিয়ে আদালতে জবানবন্দি দেন।
অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ দিলরুবা সুলতানা রোববার জনাকীর্ণ আদালতে আসামিদের উপস্থিতিতে মাত্র ৩ মিনিটের মধ্যে রায় ঘোষণা করেন।
এদিকে রায় শোনার সঙ্গে সঙ্গে আদালতের বাইরে উৎসুক জনতা উল্লাসে ফেটে পড়ে। দ্রুত ফাঁসি কার্যকরের দাবিতে আদালতের বাইরে মিছিলও হয়।
রাকিবের বাবা নূরুল আলম রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “হত্যাকারীদের দ্রুত ফাঁসি হলে রাকিবের আত্মা শান্তি পাবে। আর যেন কোনো রাকিবের জীবন এভাবে ঝরে না যায়। শাস্তি দেখে আর কেউ যেন এ ধরনের অপরাধ ঘটানোর সাহস না পায়।”
তবে বিউটি বেগম খালাস পাওয়ায় চিৎকার করে অসন্তোষ প্রকাশ করতে দেখা যায় রাকিবের মা লাকি বেগমকে।
এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী কাজী আবু শাহিন বলেন, “খুবই স্বল্প সময়ের মধ্যে চাঞ্চল্যকর এ মামলার রায় ঘোষণা হওয়ায় ইতিহাস তৈরি হয়েছে। আসামিদের উপযুক্ত শাস্তি হয়েছে।
অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী তৌহিদুর রহমান চৌধুরী তুষার এ রায়কে ‘আবেগতাড়িত’ বলেছেন। তিনি বলেছেন, সর্বোচ্চ সাজা দেওয়ার মত উপাদান এ মামলায় ছিল না।
‘ন্যায় বিচারের জন্য’ উচ্চ আদালতে যাওয়ার কথাও বলেছেন আসামি পক্ষের আইনজীবী।
বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার খুলনা ইউনিটের সমন্বয়কারী অ্যাডভোকেট মোমিনুল ইসলাম বলেন, “চাঞ্চল্যকর এ মামলার বিচার মাত্র ১০ কার্যদিবসে শেষ হয়েছে। এত স্বল্প সময়ে মামলার রায় ঘোষণা বাংলাদেশের ইতিহাসে নেই। এ রায়ের কারণে মানুষের আদালতের প্রতি শ্রদ্ধা বাড়বে।”