সাহিত্যে নোবেল পেলেন প্যাত্রিক মোদিয়ানো

সাহিত্যে এ বছর নোবেল পেলেন ফরাসি ঔপন্যাসিক প্যাত্রিক মোদিয়ানো, যার গল্পেরা গড়ে উঠেছে মানব মনের স্মৃতি-বিস্মৃতির খেলা, আত্মপরিচয়ের সঙ্কট আর প্যারিসে নাৎসি দখলদারিত্বের ইতিহাসকে কেন্দ্র করে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 Oct 2014, 11:22 AM
Updated : 9 Oct 2014, 02:46 PM

সুইডিশ অ্যাকাডেমি বৃহস্পতিবার সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী ১১১তম লেখক হিসাবে তার নাম ঘোষণা করে।

৬৯ বছর বয়সী মোদিয়ানো একাদশ ফরাসি সাহিত্যিক, যিনি এই পুরস্কার পেলেন। 

স্টকহোমে এক সংবাদ সম্মেলনে অ্যাকাডেমির সেক্রেটারি পিটার ইংলান্দ বলেন, প্যাত্রিক মোদিয়ানোকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হলো তার শৈল্পিক স্মৃতিগ্রন্থনার জন্য, যার মধ্য দিয়ে তিনি মনে করিয়ে দেন মানব ভাগ্যের দুর্বোধ্যতার কথা, উন্মোচন করেন আগ্রাসনের বিশ্বে জীবনের স্বরূপ।

১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার মাত্র দুই মাসের মাথায় প্যারিসের পশ্চিমে এক শহরতলীতে জন্ম নেন মোদিয়ানো। তার ইহুদি বংশোদ্ভূত ইতালীয় বাবার সঙ্গে বেলজীয় অভিনেত্রী মায়ের যখন দেখা হয়, প্যারিস তখন হিটলারের নাৎসি বাহিনীর দখলে।    

সেইসব দিনের প্যারিস বার বার ফিরে এসেছে মোদিয়ানোর লেখায়। নাৎসি আগ্রাসন আর ইহুদিদের আত্মপরিচয়ের সঙ্কট তৈরি করে দিয়েছে তার অধিকাংশ উপন্যাসের পটভূমি। 

১৯৬৮ সালে প্রকাশিত তার ‘লা প্লাস দো লিতোয়াইল’ বইটি জার্মানিতে হলোকাস্ট পরবর্তী একটি গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস হিসাবে বিবেচনা করা হয়। 

প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে মোদিয়ানো ভর্তি হন প্যারিসের লুসি অঁরি-৪ সেকেন্ডারি স্কুলে, যেখানে তিনি শিক্ষক হিসাবে পান লেখক রেমো কুইনোকে।

বলা হয়, কুইনোর উৎসাহ আর পরিচর্যাই লেখক মোদিয়ানোর ভিত্তি গড়ে দেয়। তিনিই প্রকাশনা সংস্থা গ্যালিমার সঙ্গে মোদিয়ানোর যোগাযোগ ঘটিয়ে দেন।

ফ্রান্সের পাঠকদের কাছে প্যাত্রিক মোদিয়ানো একটি পরিচিত নাম। তার বেশ কিছু বই ইংরেজিতেও অনূদিত হয়েছে। তারপরও অন্য ভাষার পাঠকরা তার লেখার সঙ্গে পরিচিত নন খুব একটা।

আলোর শহর প্যারিসও এই নিভৃতচারী সাহিত্যিকের ওপর খুব বেশি আলো ফেলতে পারেনি। সংবাদপত্রগুলো খুব কমই তার সাক্ষাৎকার ছাপতে পেরেছে।

এমনকি সুইডিশ অ্যাকাডেমিও আনুষ্ঠানিক ঘোষণার আগে রেওয়াজ অনুযায়ী তাকে টেলিফোনে নোবেলপ্রাপ্তির খবর জানাতে পারেনি।

কেবল উপন্যাস নয়, মোদিয়ানোর হাত দিয়ে শিশু সাহিত্য, এমনকি চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যও বেরিয়েছে। তবে তার সবচেয়ে পরিচিত কাজ সম্ভবত ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত ‘রুই দে বুটিক অবসকিউর’ (ইংরেজি অনুবাদের নাম মিসিং পারসন), যে উপন্যাসের জন্য তিনি সম্মানজনক ‘প্রি গুনকুয়া’ পুরস্কার জিতে নেন।

এ উপন্যাসের কাহিনী গড়ে উঠেছে এমন এক গোয়েন্দাকে ঘিরে, যিনি ঘটনাচক্রে স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছেন এবং জীবনের শেষ ‘কেইস’ হিসাবে নিজের পরিচয় উদঘাটনের তদন্তে নেমেছেন। এই অন্বেষণে ইতিহাসের পাতায় তিনি অনুসরণ করে চলেছেন নিজেরই ফেলে আসা পদচিহ্ন।    

সুইডিশ অ্যাকাডেমির সেক্রেটারি পিটার ইংলান্দ বলেন, “আকারে ছোট, ১৩০ থেকে ১৫০ পৃষ্ঠার এক একটি বই। অধিকাংশ কাহিনীতেই ফিরে ফিরে এসেছে স্মৃতি, স্মৃতিলোপ, আত্মপরিচয়ের সঙ্কট আর নিজের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা।”

মোদিয়ানোর বহু উপন্যাসের কাহিনী গড়ে উঠেছে তার শৈশবের প্যারিসে। তারই জীবনের টুকরো টুকরো অংশ নিয়ে গল্পের পরিণতির দিকে এগিয়েছে এক একটি চরিত্র।

কখনো কখনো তিনি উপন্যাসের মাল-মসলা সংগ্রহ করেছেন মানুষের সাক্ষাৎকার থেকে, পত্রিকার নিবন্ধ থেকে, কখনো কখনো নিজের ডায়েরিতে লেখা নোট থেকে, বছরের পর বছর ধরে যা তিনি লিখে চলেছেন।

কখনো আবার মোদিয়ানোর একটি উপন্যাসের গল্প থেকেই জন্ম নিয়েছে আরেকটি উপন্যাস, এক কাহিনীর চরিত্র অন্য কোনো উপন্যাসে হাজির হয়েছে ভিন্ন কোনো প্রেক্ষাপটে।  

১৯৭০ সালে দোমিনিক জাহফুসকে বিয়ে করেন মোদিয়ানো। ১৯৭৪ ও ১৯৭৮ সালে জন্ম নেয় তাদের দুই মেয়ে জিনা ও মারি। 

মোদিয়ানোর লেখা ৩০টির বেশি উপন্যাসের মধ্যে ইংরেজিতে অনূদিত কয়েকটির নাম রিং রোডস, ভিলা ত্রিস্তে, আ ট্রেস অব ম্যালিস ও হানিমুন। 

চলতি বছর প্রকাশিত হয়েছে তার সর্বশেষ বই ‘পুর কু তু নে তো পেহদু পা দঁ লে ক্যাৎচি’ বাংলায় যার তর্জমা দাঁড়ায় ‘যাতে তুমি নিজেকে নিজের পাড়ায় হারিয়ে না ফেল’।

আগামী ১০ ডিসেম্বর স্টকহোমে আনুষ্ঠানিকভাবে মোদিয়ানোর হাতে পুরস্কার বাবদ তুলে দেয়া হবে ৮০ লাখ ক্রোনার।

গত বছর সাহিত্যে নোবেল পান ছোটগল্পকার এলিস মুনরো, প্রাঞ্জল গদ্যে মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা ফুটিয়ে তোলায় মুনশিয়ানার জন্য যাকে ‘কানাডার চেকভ’ বলা হয়।

[প্রতিবেদনটি তৈরি করতে বিবিসি ও গার্ডিয়ানের লেখা এবং সুইডিশ অ্যাকাডেমির বিবৃতির সহায়তা নেওয়া হয়েছে।]