রনি আহম্মেদের মহাজাগতিক কচ্ছপের সবুজ পৃথিবী পরিদর্শন

পূর্ববর্তী প্রতীকবাদী রাজনৈতিক শিল্পধারা ও সমকালীন বিমূর্তবাদী শিল্পচর্চার উভয় ঘরানা থেকে সরে এসে শিল্পী রনি আহম্মেদ একটি স্বকীয় শিল্পভাষা নির্মাণ করেন। বাস্তবতার অনুকরণপ্রবণতা ও অভিজ্ঞতাবাদী পদ্ধতিকে নাকচ করে গঠিত হয়েছে রনির শিল্পভাষা। নানাপ্রকার প্রতিচিত্রন বা সিমুলেশনের উপায়ে বাস্তবকে ব্যাখ্যার সূত্রে, তিনি নির্মাণ করেন আপন শিল্পভাষা।

>>বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 March 2013, 04:17 AM
Updated : 17 March 2013, 04:17 AM
 

এই শিল্পকলা রূপকধর্মী ও আখ্যানভিত্তিক। মূলত অ্যাবসার্ড বা যুক্তিপরম্পরারহিত উদ্ভট ও পরাবাস্তব আবহে রূপায়িত হয় রনির রূপকাশ্রয়ী আখ্যানের অবারিত দুনিয়া। বর্তমানকে তিনি তামাশার নাটকে হাজির করেন। রনির আখ্যানধর্মী শিল্পভাষায় এক পৌরাণিক বিষাদেরও উপস্থিতি আছে। পুরাণ ও বর্তমানের বিক্রিয়া সময়ের পদার্থবিদ্যক মাত্রাকে নাকচ করে। তার শিল্পভাষায় কাল নেই, কালাতীত সংক্রান্ত বিকল্পের প্রস্তাব আছে। রনির আখ্যানে অভিজ্ঞতালব্ধ এই পৃথিবীও নেই। স্থান বিষয়ক প্রচলিত ভাবনাগুলোর বিরোধিতার মধ্যদিয়ে তিনি অন্য কোন গ্রহের অবভাস সৃষ্টি করেন। কালবিনষ্ট এক কল্পজগতের মানুষ ও বিচিত্র জীবজন্তুর মিশ্র অবয়বে সৃষ্ট প্রেতাত্মাগণ রনি আহম্মেদের কৌতুকধর্মী বিয়োগান্তক (ট্রাজিকমিক) আখ্যানের কুশীলব।

এই শিল্পী সম্প্রতি ‘কসমিক টার্টল ভিজিটিং গ্রিন আর্থ’ নামে এক অতিকায় কচ্ছপ-ভাস্কর্য সৃষ্টি করেছেন। এটি এবাদুর রহমানের কিউরেশনে ইতালির ভেনিসে ‘ওপেন ১৫’ শিরোনামা একটি আন্তর্জাতিক ভাস্কর্য ও স্থাপনাশিল্পের (ইনস্টলেশন) প্রদর্শনীতে (১-৩০ সেপ্টেম্বর ২০১২) অংশ নেয়। এখন, এই শিল্পকর্মটি বাংলাদেশের কক্সবাজারের সৈকতবর্তী হিমছরির মারমেইড রিসোর্ট সেন্টারে ম্যুরাল রূপে স্থাপন করা হয়েছে। পৃথিবীতে ব্যাপক হারে কচ্ছপের ডিম বিনাশ ও কচ্ছপ নিধনের বিরুদ্ধে সংবেদনা জাগানোর লক্ষ্যে তিনি এই মহাকাব্যিক ভাস্কর্যটি উৎসর্গ করেছেন। ৫৭ ফুট দৈর্ঘ্যরে ৩৬ ফুট প্রস্থের ও ১৮ ফুট উচ্চতার এই ভাস্কর্য একটি গম্বুজ-ঘরের মতন যা বাহ্যত কচ্ছপেরই দৃশ্যকল্প। এর চারদিকে ৮টি জানালা ও ২টি দরজা আছে যার মাধ্যমে অনায়াসে দর্শনার্থী এর ভেতরে ঢুকে পৃথিবীর বিচিত্র কচ্ছপ-পুরাণ দর্শন করতে পারবেন। আয়না ও কাচের টুকরা, স্টিল, সমুদ্রতট থেকে পাওয়া বিবিধ উপকরণ যেমন ছেড়াঁ জুতা, লাইটার, মাছের হাড় প্রভৃতি ইন্টারটেক্সচুয়াল উপাদানের সমন্বয়ে রনি তার ভাস্কর্যকে, বহুস্তরায়িত তথ্যময়তার দোহাই দিয়ে এক আজব কিন্তু উপভোগ্য কল্পদুনিয়ায় রূপান্তর করেছেন।

মহাজাগতিক কচ্ছপের এই সবুজ ধরিত্রী ভ্রমণের প্রস্তাবনার সূত্রে রনি আমাদেরকে চাক্ষুস করান তার একান্ত নিজস্ব এক রূপকল্প। এই শিল্পীর ভাবনা হলো, শিল্প স্বয়ং কোনো রূপকল্প নয়। বরং রূপকল্পকে রূপায়িত করার প্রবাহী প্রক্রিয়াটাই হলো শিল্প। রনির মহাজাগতিক কচ্ছপ-কর্ম একটি প্রাগৈতিহাসিক-সাংস্কৃতিক বিশ্বজনীনতার সম্ভাবনাকে প্রমূর্ত করে। মানবের এই অদিসাংস্কৃতিক বিশ্বজনীনতার আখ্যানবাদী রনীয় প্রকল্পটির বাস্তবায়ন কিন্তু বর্তমান সভ্যতার পুঁজিকেন্দ্রিক অনুশাসনে ঘটে না। রনি এখানে উল্টোরথে আরোহন করেন। শিল্পী এক্ষেত্রে সভ্যতার যুক্তিবাদী ব্যাকরণ নাকচ করে মানুষের আদিজৈবিক সত্তার প্রস্তাবনার সূত্রে এক প্রাকৃতিক ইতিহাস বয়ানে মগ্ন হয়েছেন। এ কারণেই কচ্ছপাকৃতির গম্বুজ-ঘরের ভেতরতলে উত্তর আমেরিকা থেকে শুরু করে চৈনিক কল্পগাথার এক বিস্তৃত ভ্রমণের রূপরেখা হাজির করেন শিল্পী। ধরিত্রী ও প্রকৃতি, এমনকি ব্রহ্মাণ্ডের সাথে মানুষের প্রাগৈতিহাসিক সম্পর্কসূত্রটি পুনরায় উদ্ভাবিত হয় এই শিল্পকর্মে। এই কচ্ছপকীর্তির সূত্রে বলা যায়, রনি প্রবৃত্তিতাড়িত শিল্পী নন, বরং মানুষের প্রত্নমনের ভাষাসন্ধানী।

দৃশ্যের মারফতে কথনের ভঙ্গিমা রনির কাজকে দিয়েছে স্বকীয় মাত্রা। কচ্ছপ সংক্রান্ত পৃথিবীর নানা সংস্কৃতির রূপকথা ও পৌরাণিক আখ্যায়িকার সমবেত উপস্থিতির সাথে শিল্পীর ব্যক্তিগত পুরাণ থেকে জন্ম নেয়া অপরাপর কল্পকচ্ছপগাথার স্বতঃস্ফূর্ত বিক্রিয়া পরিশেষে এক তুরীয়ধর্মা স্পেসের অবতারণা করে। এভাবে বহুতল দৃশ্যজ আখ্যান বুননের মাধ্যমে রনি সমগ্র মনুষ্যজাতির এক অভিন্ন সাংস্কৃতিক ডিএনএ (DNA)-এর তত্ত্বতালাশ করেন। এই কচ্ছপ-ভাস্কর্য আমাদেরকে এক যৌথ অচৈতন্যের ভাষার মুখোমুখি করে । সভ্যতার অধিপতিশীল চেতনা-প্রবাহের দমনে তটস্থ মানুষের নিকট এ হলো মানুষেরই এক হারানো ভাষা। গভীর মনোজাগতিক ইস্যুগুলো নিয়ে শিল্পসৃষ্টিতে পারদর্শী রনি সভ্যতার অবদমনে হারিয়ে যাওয়া এই প্রত্মমনের অচেনা ভাষাতেই কথা বলেন। মহাজাগতিক কচ্ছপের ম্যুরালে সুইস মনস্তত্ত্ববিদ কার্ল গুস্তাভ ইয়ুং কথিত এই প্রত্নমন আদতে, বিশেষ মানুষের কৌমমনের অচেতন স্তরে নিহিত সামান্য অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার।

শিল্পসৃষ্টির জন্য করণ-কৌশলগত দক্ষতার কাছে শরণার্থী হতে ইচ্ছুক নন রনি। আপাতত অধরা যে প্রত্নভাষা তাকে ধরতেই রনির ব্যাকুলতা। দক্ষতার স্পর্শ শিল্পে যে জাঢ্য ও স্থিতি আনে, রনির কাজে সেটা সুলভ নয়, বরং বিরল।
বিষয়বোধের প্রতাপ থেকে নিজের সহজাত প্রকাশভঙ্গিটি খুঁজে নিয়ে এর প্রয়োগে লিপ্ত হন এই শিল্পী। দুটি আড়াআড়ি রেখার একটি ছেদন্দিুতে অদ্বৈত দ্বৈত রূপে রনির আধার ও আধেয় উল্লাস করে। সেজন্য কেবল দক্ষতার আশ্রয়কে নাকচ করে তিনি এক শিশুসুলভ ক্রীড়া-কৌতুক-তামাশা-উৎকল্পনা ও আমোদ-প্রমোদে মত্ত হন। ডেমিয়েন হার্স্ট যেমন বলেন, শিল্প হলো শিশুতোষ ও শিশুসুলভ (Art is childish and childlike)। রনির চিত্রল আখ্যায়িকার ভাষা তেমনি ‘শিশুতোষ’ ও ‘শিশুসুলভ’। তার স্বতন্ত্র বাগবিধি মানুষের আত্মাকে প্রতিফলিত করতে সক্ষম। এ কারণে রনির কাজকে জীবিতদের শিল্পকলা বলা যায়। ব্রাংকুসি’র স্বতঃস্ফূর্ত তর্ক থেকেও শুনতে পাই, ঠিক যখন থেকে আমরা আর শিশু নই, ঠিক তখন থেকেই আমাদের মৃত্যু হয় (when we are no longer children we are already dead)। জ্ঞান, আবেগ ও শ্রেয়োনীতি (logos, pathos, ethos)–এই তিনটি বর্গ দিয়ে মানুষের অস্তিত্ব বিশ্লেষণের পশ্চিমা সক্রেটিক পন্থা অস্বীকার করেন রনি আহম্মেদ। মানুষের প্রবহমান জীবন উদযাপনের লক্ষ্যে, রনি তার এই কাজে, পূর্বসূত্র ও সূত্রহীনতার মাধ্যমে আমাদের এই একমাত্র পৃথিবীকে রূপান্তর করেন দ্বিতীয় দুনিয়ায়। কচ্ছপ-আখ্যানের বর্ণিল আয়তনে দ্বিতীয় দুনিয়ায় রূপান্তরের রনীয় প্রক্রিয়াটি একান্তই পৌরাণিক। রনির পৌরাণিকতা, কেবলি পুরাণের দোহাই থেকে জন্মায় না। শিল্পীর কল্পনার খেলাচ্ছল আধার থেকে আসা ব্যক্তিগত পুরাণও এতে দ্রবীভূত হয়। পুরাণের পাটাতনে জন্মানো শিল্পের ভাষাকেন্দ্রিক ডিসকোর্স গঠনের প্রক্রিয়ায়, ভাস্কর্যটির মাধ্যম ও অর্থ নির্ণয়ের লক্ষে বিবিধ পাঠ্য-উপাদানের পরস্পর সম্পর্কিত একটি অভিন্ন পরিসর (ইন্টারটেক্সচুয়াল দশা) হাজির করেন শিল্পী। শিল্পীর ইচ্ছাকৃত এই সঙ্কর দশা আবার প্রসব করে বহুত্ববোধকতা, নিদেনপক্ষে দ্ব্যর্থবোধকতা। শিল্পার্থ কুক্ষিগত করে রাখার আধুনিকতাবাদী কর্তৃপক্ষের অবস্থানে ধ্বস সৃষ্টি করে এখানে শিল্পী দুই হাতে তুড়ি বাজান। শিল্পার্থের মালিকানা নিতে দর্শককে শিল্পী নিজের কাজের সাথে অভিনয় বা পারফর্ম করতেও প্ররোচিত করেন। শিল্পস্রষ্টা/অথর হিসেবে রনি নিজের মৃত্যু উদযাপন করেন। আদতে দর্শকের শিল্পী হয়ে ওঠার জন্মান্তর চাক্ষুষের জন্যই রনির এই স্বয়ংক্রিয় মৃত্যু। কচ্ছপের ভাস্কর্যে চড়ে শিল্পী রনি স্থানকালপাত্রের যুক্তিশাস্ত্রীয় মাত্রা ও সীমাগুলো এভাবেই ঘন্টা বাজিয়ে লঙ্ঘন করেন।

রনি কথিত এই মহাজাগতিক কচ্ছপ প্রকৃতপক্ষে এক ব্যক্তিগত পৌরাণিক কচ্ছপ। রনীয় কচ্ছপের এই পৌরাণিক বাঙ্মময়তা স্বভাবত মানুষের সমষ্টিগত প্রাগৈতিহাসিক সত্তার আরশীনগর। এই আদিজৈবিক যৌথ সত্তার সাথে বিবিধ প্রাণ ও প্রকৃতির বিক্রিয়ার কারণে রনীয় কচ্ছপের মহাকাব্যিক ভাস্কর্য যেমনি এক মহাজাগতিক স্মৃতির রূপক, তেমনি নিত্য অভিনয়শীল এই রঙ্গিলা পৃথিবীর বাস্তবপ্রবাহের আসন্ন জনজল্পনার ছলাকলাও বটে।