এই শিল্পকলা রূপকধর্মী ও আখ্যানভিত্তিক। মূলত অ্যাবসার্ড বা যুক্তিপরম্পরারহিত উদ্ভট ও পরাবাস্তব আবহে রূপায়িত হয় রনির রূপকাশ্রয়ী আখ্যানের অবারিত দুনিয়া। বর্তমানকে তিনি তামাশার নাটকে হাজির করেন। রনির আখ্যানধর্মী শিল্পভাষায় এক পৌরাণিক বিষাদেরও উপস্থিতি আছে। পুরাণ ও বর্তমানের বিক্রিয়া সময়ের পদার্থবিদ্যক মাত্রাকে নাকচ করে। তার শিল্পভাষায় কাল নেই, কালাতীত সংক্রান্ত বিকল্পের প্রস্তাব আছে। রনির আখ্যানে অভিজ্ঞতালব্ধ এই পৃথিবীও নেই। স্থান বিষয়ক প্রচলিত ভাবনাগুলোর বিরোধিতার মধ্যদিয়ে তিনি অন্য কোন গ্রহের অবভাস সৃষ্টি করেন। কালবিনষ্ট এক কল্পজগতের মানুষ ও বিচিত্র জীবজন্তুর মিশ্র অবয়বে সৃষ্ট প্রেতাত্মাগণ রনি আহম্মেদের কৌতুকধর্মী বিয়োগান্তক (ট্রাজিকমিক) আখ্যানের কুশীলব।
এই শিল্পী সম্প্রতি ‘কসমিক টার্টল ভিজিটিং গ্রিন আর্থ’ নামে এক অতিকায় কচ্ছপ-ভাস্কর্য সৃষ্টি করেছেন। এটি এবাদুর রহমানের কিউরেশনে ইতালির ভেনিসে ‘ওপেন ১৫’ শিরোনামা একটি আন্তর্জাতিক ভাস্কর্য ও স্থাপনাশিল্পের (ইনস্টলেশন) প্রদর্শনীতে (১-৩০ সেপ্টেম্বর ২০১২) অংশ নেয়। এখন, এই শিল্পকর্মটি বাংলাদেশের কক্সবাজারের সৈকতবর্তী হিমছরির মারমেইড রিসোর্ট সেন্টারে ম্যুরাল রূপে স্থাপন করা হয়েছে। পৃথিবীতে ব্যাপক হারে কচ্ছপের ডিম বিনাশ ও কচ্ছপ নিধনের বিরুদ্ধে সংবেদনা জাগানোর লক্ষ্যে তিনি এই মহাকাব্যিক ভাস্কর্যটি উৎসর্গ করেছেন। ৫৭ ফুট দৈর্ঘ্যরে ৩৬ ফুট প্রস্থের ও ১৮ ফুট উচ্চতার এই ভাস্কর্য একটি গম্বুজ-ঘরের মতন যা বাহ্যত কচ্ছপেরই দৃশ্যকল্প। এর চারদিকে ৮টি জানালা ও ২টি দরজা আছে যার মাধ্যমে অনায়াসে দর্শনার্থী এর ভেতরে ঢুকে পৃথিবীর বিচিত্র কচ্ছপ-পুরাণ দর্শন করতে পারবেন। আয়না ও কাচের টুকরা, স্টিল, সমুদ্রতট থেকে পাওয়া বিবিধ উপকরণ যেমন ছেড়াঁ জুতা, লাইটার, মাছের হাড় প্রভৃতি ইন্টারটেক্সচুয়াল উপাদানের সমন্বয়ে রনি তার ভাস্কর্যকে, বহুস্তরায়িত তথ্যময়তার দোহাই দিয়ে এক আজব কিন্তু উপভোগ্য কল্পদুনিয়ায় রূপান্তর করেছেন।
দৃশ্যের মারফতে কথনের ভঙ্গিমা রনির কাজকে দিয়েছে স্বকীয় মাত্রা। কচ্ছপ সংক্রান্ত পৃথিবীর নানা সংস্কৃতির রূপকথা ও পৌরাণিক আখ্যায়িকার সমবেত উপস্থিতির সাথে শিল্পীর ব্যক্তিগত পুরাণ থেকে জন্ম নেয়া অপরাপর কল্পকচ্ছপগাথার স্বতঃস্ফূর্ত বিক্রিয়া পরিশেষে এক তুরীয়ধর্মা স্পেসের অবতারণা করে। এভাবে বহুতল দৃশ্যজ আখ্যান বুননের মাধ্যমে রনি সমগ্র মনুষ্যজাতির এক অভিন্ন সাংস্কৃতিক ডিএনএ (DNA)-এর তত্ত্বতালাশ করেন। এই কচ্ছপ-ভাস্কর্য আমাদেরকে এক যৌথ অচৈতন্যের ভাষার মুখোমুখি করে । সভ্যতার অধিপতিশীল চেতনা-প্রবাহের দমনে তটস্থ মানুষের নিকট এ হলো মানুষেরই এক হারানো ভাষা। গভীর মনোজাগতিক ইস্যুগুলো নিয়ে শিল্পসৃষ্টিতে পারদর্শী রনি সভ্যতার অবদমনে হারিয়ে যাওয়া এই প্রত্মমনের অচেনা ভাষাতেই কথা বলেন। মহাজাগতিক কচ্ছপের ম্যুরালে সুইস মনস্তত্ত্ববিদ কার্ল গুস্তাভ ইয়ুং কথিত এই প্রত্নমন আদতে, বিশেষ মানুষের কৌমমনের অচেতন স্তরে নিহিত সামান্য অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার।
রনি কথিত এই মহাজাগতিক কচ্ছপ প্রকৃতপক্ষে এক ব্যক্তিগত পৌরাণিক কচ্ছপ। রনীয় কচ্ছপের এই পৌরাণিক বাঙ্মময়তা স্বভাবত মানুষের সমষ্টিগত প্রাগৈতিহাসিক সত্তার আরশীনগর। এই আদিজৈবিক যৌথ সত্তার সাথে বিবিধ প্রাণ ও প্রকৃতির বিক্রিয়ার কারণে রনীয় কচ্ছপের মহাকাব্যিক ভাস্কর্য যেমনি এক মহাজাগতিক স্মৃতির রূপক, তেমনি নিত্য অভিনয়শীল এই রঙ্গিলা পৃথিবীর বাস্তবপ্রবাহের আসন্ন জনজল্পনার ছলাকলাও বটে।