এটা হচ্ছে গৌণ লেখকের কাল

লেখক রাজু আলাউদ্দিন ও কবি ব্রাত্য রাইসুর নেওয়া সৈয়দ শামসুল হকের এই সাক্ষাৎকারটি ১৯৯৬ সালে তৎকালীন বাংলাবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় দুই সাক্ষাৎকার গ্রহীতার অনুমতি নিয়ে পুরো সাক্ষাৎকারটি আবার প্রকাশ করা হল।

>>বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Sept 2016, 03:19 PM
Updated : 28 Sept 2016, 08:23 AM

সৈয়দ শামসুল হক: কথা বলতে চাও, নাকি?

ব্রাত্য রাইসু: হ্যাঁ, কথাই তো সব।

হক: তো বলো তুমি কি জিজ্ঞেস করবে? ব্রাত্য-রাজু কে শুরু করবে?

রাজু আলাউদ্দিন: আচ্ছা হক ভাই, এখন আপনি কবিতা কম লিখছেন আগের তুলনায়, এটা কি উপন্যাস বা গদ্যের চাপ বেশি বলে?

হক: কোনো কিছু কম লেখা বেশি লেখা এটা কোনো প্রশ্নই হয় না, রাজু । কারণ আমি তো অনেক কিছুই লিখি; কবিতা লিখি গল্প লিখি, নাটক লিখি, উপন্যাস লিখি।

রাইসু: চিঠি বোধহয় লেখেন না?

হক: চিঠি লেখার অভ্যেস খুব কম আমার। এটা সেইভাবে দেখা যাবে না যে কোনটা কম লিখছি, কোনটা বেশি লিখছি। কারণ তালিকা করে তো আর লেখা যায় না। ওরকম প্ল্যান করেও লেখা যায় না যে সপ্তাহে একটি কবিতা লিখবো, বছরে তিপ্পান্নটি সপ্তাহ তিপ্পান্নটি কবিতা চাইই, একটি নাটক হতেই হবে তা না। এটা অনেক কিছুর উপর নির্ভর করে। কবিতা কম লিখছি, এটা ঠিক না। বরঞ্চ যদি বিরতিহীন কাজের কথা বলো, তা হলে কবিতার কাজটাই চলে বিরতিহীনভাবে। প্রতিদিনই কোনো না কোনো শব্দ বা শব্দগুচ্ছ, কখনও পংক্তি, কখনও একাধিক পংক্তি, কখনও পুরো স্তবক, এটা একেক দিন একক রকম।  প্রায় প্রতিদিনই একটা।

রাইসু: ভাবনা চলে?

হক: আমি যাকে বলি করোটির ভেতরে।

রাইসু: করোটির ভিতরে...হ্যাঁ হ্যাঁ, অপেক্ষা করতে ছিলাম আপনার করোটি’র জন্য।

হক: একেবারে করোটির ভেতরে উড্ডীন থাকে।

রাইসু: আচ্ছা এটা ‘করোটি’ কেন বলেন?

হক: ‘করোটি’ একটা এক্সপ্রেশন হিসেবে ব্যবহার করি, সেটা ঠিক।

রাইসু: চাঁছাছোলা জিনিস।

হক: না, এটা থিংকিং প্রসেস। করোটির যে অর্থটা তোমরা জানো যে করোটি হচ্ছে স্কাল, এটাকে আমি একটা বিশেষ অভিধায় ব্যবহার করি। সেটা হচ্ছে দ্য হোল থিংকিং প্রসেস। ‘চিন্তার ভেতরে আছে’ ‘চেতনার ভিতরে আছে’ এর চেয়ে আমার মনে হয় করোটি ইজ মোর ট্যানজিবল।

রাইসু: মনে হয় যেন মানুষের মৃত্যুর পরও তার করোটিটা থাকে।

হক: এটা তুমি এখন নতুন মাত্রা দিলে। হবে ওই অর্থে ব্যবহার করি। তো যে কথাটি বলছিলাম। যে করোটির ভেতরে উড্ডীন থাকে কবিতার শব্দ, শব্দগুচ্ছ, পংক্তি। আর আমার কবিতা লেখার প্রক্রিয়াটা, এটা কিন্তু একবার বলেওছি, নিশ্চয়ই তোমাদের মনে পড়বে, সেটা হচ্ছে এই ধরনের শব্দ, শব্দগুচ্ছ, পংক্তি এগুলো আমি ঐ টুকরো টুকরো কাগজে হাতের কাছে যখন যেখানে পাই, এই যেমন ধরো এখানে বসে আছি: ন্যাপকিন, ন্যাপকিনের উপরে এই কয়েকদিন আগে এখানে কয়েকটা পংক্তি লিখেছি। রেখে দেই এবং এগুলো জমা হতে থাকে এবং মাঝে মাঝেই আমি এগুলো নিয়ে আবার বসি।

রাইসু: কখন বসেন?

হক: যে কোনো সময়।  আমার কিন্তু লেখার কোনো বিশেষ সময় নেই, কাজের বিশেষ সময় নেই। আমাকে অনেক সময় তোমরা বলো না ‘সার্বক্ষণিক লেখক’-সেই অর্থে আমি সার্বক্ষণিক লেখক। আমার কোনো বিশেষ সময় নেই যে এই সময়টায় বসে লিখছি। যেহেতু আমার কোনো বাঁধাধরা চাকরি নেই, জীবিকার ক্ষেত্রে বাঁধাধরা কোনো একটা সময় আমাকে দিতে হয় না। যদিও জীবিকা উপার্জনের জন্য বিভিন্ন ধরনের কাজ করি, বাঁধাধরা কোনো সময় নেই। কাজেই আমি সর্বক্ষণই লিখতে পারি। যখন যা দরকার হয় এবং সময় হয়। তো ঐ সময় নিয়ে বসি, এবং প্রায়ই এ রকম হয় যে হয়ত ওভার এ উইক অর মান্থ আই হ্যাভ কালেক্টেড এবাউট সিক্সটি পিসেজ...। হয়ত একটা দীর্ঘ অবসরের ভেতরে দেখছি টুকরোগুলো। তার ভেতরে হয়তো চার পাঁচটার ভেতরে একটা ঐক্য পাওয়া যায় এবং সেগুলোকে নিয়েই ভাবতে গিয়ে হয়ত একটা কবিতার প্রথমিক খসড়া দাঁড়িয়ে গেল। আমাকে কবিতা লিখতে হয় অনেক, অনেক পরিশ্রম করে। এটাকে একটা মিস্ত্রীর কাজ হিসেবে দেখি। আমি পুরো লেখাটাকেই সেভাবে দেখি। এভাবে আমার প্রায় কবিতাই লেখা। আবার একেবারে যে তৈরি বেরিয়ে আসেনি তাও নয়। সেটা অনেক সময় এ রকম হয় যে একটা কিছু নিয়ে ভাবনার প্রক্রিয়ায় এতটাই হয়ত নিমজ্জিত আছি যে যখন লিখতে বসি তখন এ রকম হয় যে একটা প্রবল জলরাশি হঠাৎ করে একটা নির্গমের পথ পেয়ে যেন দৌড়ে বেড়িয়ে যাবে; নিজেই খাল কেটে চলে যায়।

সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গে লেখক রাজু আলাউদ্দিন।

রাজু:
আচ্ছা এই পর্বের কবিতাগুলো কোনগুলো আপনার?

হক: সবই তো মনে থাকে না। আমি পেছনের লেখা একেবারেই ভুলে যাই।

রাজু: এটা কি আপনার ‘পরাণের গহীন ভিতর’ বলতে পারেন?

হক: না না ‘পরাণের গহীন ভিতর’ ওয়াজ পিওরলি এন এক্সারসাইজ ইন ইউজিং আওয়ার ডায়লেক্টস। এটা যেমন ধরো ‘বৈশাখে রচিত পংক্তিমালা’। পরিষ্কার মনে আছে এগারো দিন আমি লিখেছিলাম। এগারো দিন লেগেছিল এবং এগারো দিন আমার স্ত্রী কজে বেরিয়ে যেতেন ভোর সাতটায়। আমি সাড়ে সাতটা নাগাদ কাজ করতে বসতাম, উনি আসতেন আড়াইটা নাগাদ। মানে প্রায়ই এ রকম হতো যে আড়াইটা নাগাদ আমি উঠছি। তারপরও বিকেলে আবার কিছু বসছি, মধ্যরাতে বসছি, শেষরাতে বসছি। এই প্রক্রিয়ায় প্রায় এগারো দিন, আমার মনে আছে পুরো এগারোটা দিন আমি ‘বৈশাখে রচিত পংক্তিমালা’ শেষ করেছি। এখন বোধহয় কিছুকম ৮০০ লাইন এর মত আছে, কমবেশি আটশ’ লাইনের মত-প্রথম প্রায় তেরশ’ চৌদ্দশ’ লাইনের মত ছিল। এটা পরে বাদ দিয়েছি।

রাইসু: কেন, বাদ দিলেন কেন?

হক: বাদ দিলাম কারণ লেখার একটা বিশেষ জিনিস হচ্ছে যে তুমি অনবরত  সংকেত সৃষ্টি করছো। এবং সবগুলো সংকেত মিলে একটা চিত্র দাঁড়ায়। এখানেই হচ্ছে লেখার জাদু, যে সংকেত তুমি কতটা দিচ্ছো কি না আবার কম হয়ে গেল কি-না। এটা যে কোনো, যে, কোনো কবিতা, যে কোনো নাটক, যে কোনো উপন্যাস। একেকটা উপন্যাস যখন আমরা পড়ি আমরা পড়তে পড়তে ভুলি, ভুলতে ভুলতে পড়ি। তরপরও  একটা উপন্যাসের পুরোটা আমাদের ভেতরে থেকে যায়। তার মানে কি? তার মানে গিভেন এ পেসেজ, এ চ্যাপ্টার, কাপল অফ পেইজেস। এবং ইউ উইল রিসিভ সারটেইন সিগনাল এবং এই সিগনালটা থেকে যায় এবং এই সিগনালগুলো জড়ো হতে হতে একটা ভাব তৈরি হয়। মানে উপন্যাসটা হচ্ছে সে রকম। না হলে তুমি একটা ৫০০ পৃষ্ঠার উপন্যাসে ৫০০ পৃষ্ঠাই তোমার ডিটেইলে মনে থাকে না। কিছু সংকেত মনে থাকে শুধু সংকেত মনে থাকে সবকিছুর। এমনকি একটা চৌদ্দ লাইনের সনেটেও তাই। ইটা ইজ দ্যা সিগনাল। এই যে তুমি বললে যে কেন বাদ দিলাম এই কেন বাদ দেয়ার প্রসেসটাই হচ্ছে...

রাজু: মানে ঐগুলো সিগনাল কনভে করে না।

হক: হ্যাঁ, সিগনাল কনভে করে না, কিংবা হয়তো দ্বিরুক্তি হয়েছে বেশি।

রাইসু: বাদ আপনি কি কি জিনিসগুলো দেন, আপনার লেখায়?

হক: এটা ঠিক এভাবে বলা যাবে না। একেক লেখাতে একেক রকম। একটা থাকে অতিকথন।

রাইসু: অতিকথন আপনি নরমালি বাদ দেন?

হক: নরমালি নয়, এটা বাদ দিতেই হবে। অতিকথন তো বাদ দিতেই হবে। কিন্তু তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনেক জিনিস আছে বাদ দেবার। এ প্রক্রিয়া বোঝানো যাবে না। সৃষ্টির কিন্তু ন’ ভাগই অন্ধকার। মাতৃগর্ভের মতো ন’ ভাগই অন্ধকার। অতিকথন বাদ দেবার ব্যাপরটা যে কোনো লেখকের প্রথম জীবনে শিখতে হবে।

রাইসু: অতিকথন তো আবার অনেক সময় উপন্যাস কিংবা গল্প তৈরিও করতে পারে।

হক: সে তো একটা ল্যাংড়া লোক দেখতে ভালো লাগলে মনে হবে তোমার যেন নাচছে। না না, অতিকথন ইজ এ ব্যাড এলিমেন্ট। যখন তুমি এটা ব্যবহার করবে তখন সেটা আর অতিকথন থাকবে না।

রাজু: এই প্রসঙ্গে আমার যেটা মনে পড়ে..

হক : না আমি কথাটা শেষ করে নেই। কথাটা শেষ করে নেই। লাফিয়ে উঠো না। একটা প্রশ্ন করেছো উত্তরটা শোনো। কি কি বাদ দেব, আমি বলছি যে অতিকথন একটা জিনিস, বাদ দেবার কথা বলেছি। তারপরও আছে, যেমন ধরো তুমি বিশেষ্য, বিশেষণ এই যে পদগুলো আমরা জানি-বিশেষণ কমাবে।

রাইসু: ও বিশেষণ আপনি কমান?

হক: আমি নয়, যে কোনো লেখককে কমাতে হবে।

রাইসু: আচ্ছা বিশেষণটা কি ক্ষতি করে?

হক: ক্ষতি করে মানে, তুমি তাহলে আর কি বলছো নিজে। বিশেষিত করবে বলেইতো তুমি লিখছো।

রাইসু: লেখাটা পুরোটাই একটা বিশেষণ?

হক: একটা জিনিস ভালো লাগছে বা খারাপ লাগছে, গ্লানি হচ্ছে বা আনন্দ হচ্ছে, উল্লাস হচ্ছে, এ কথাটা তুমি বলবে বলেই তো লিখছো। এখন যদি বিশেষণ দিতে দিতে তুমি লিখে যাও তাহলে দেখবে তোমার বক্তব্য কিছুই থাকছে না, বলার কিছু থাকছে না। যার জন্য কোটি লোক তোমাকে চিঠি লেখে সাহিত্য হয় না, কিন্তু একজন যখন কবি লেখেন খুব সাধারণ ভাবে

তুমি যে তুমি ওগো সেই তব ঋণ

আমি মোর প্রেম দিয়ে শুধি চিরদিন।

অথবা ‘তমসী মম ভূষণ’ তুমি আমার অলংকার।

এই যখন বলো তখন ইউ হ্যাভ সেইড সামথিং হুইচ অ্যাডস টু দ্য ল্যাংগুয়েজ। তারপরে আরও বাদ দেবার আছে। আরও বাদ দেবার আছে। সেটা হচ্ছে যে তুমি কি বলতে চাচ্ছো। হাউ ডু ইউ লুক এট ইট। তোমার যদি একটা স্ট্যান্ডপয়েন্ট না থাকে, তোমার যদি একটা দৃষ্টিভঙ্গি না থাকে, দৃষ্টিকোণ না থাকে তুমি লিখবে কেন? তুমি আমার ভার বৃদ্ধি করবে কেন? ইউ হ্যাভ নো রাইট অ্যাবসুলটলি। তুমি তখনই লিখবে যখন তুমি মনে করবে এই যে আমারা ভাবছি এই ভাবনাটা আমি আগে কখনও কোথাও দেখিনি। ঠিক এইভাবে আমি দেখছি, এই ভাবে আমি চিন্তা করছি, হয়ত আগে থেকে থাকতে পারে সেটা অন্যকথা কিন্তু তোমার নিজের কাছে কনভিনসড্ হতে হবে যে এটা নতুনভাবে দেখছি এবং আগে কখনও দেখিনি। নতুন বলবো না, আগে কোনো লেখায় দেখিনি, কারো লেখায় দেখিনি; তখনই তুমি লিখছো। না হলে ইউ হ্যাভ নো রাইট হোয়াটসোএভার টু লোড মি উইথ ইউর পয়েম অর ইউর শর্ট স্টোরি অর উইথ ইউর প্লে। কারণ কোটি কোটি কোটি কোটি লেখা হচ্ছে। একজন পাঠক, তুমি তার উপর একটা ভার চাপিয়ে দেবে ! এটা তো ঠিক নয়। তারপর আরও কিছু বাদ দেবার আছে। সেটা হচ্ছে যে লেখাটি দরকার কিনা আদৌ। আমারা অনেক সময় একটা ভুল করি, যে আমরা যা কিছুই লিখি, যা কিছুই লিখি মনে হয় যেন ছাপার জন্য পাঠিয়ে দেই। মাস্ট স্টপ এন্ড আস্ক যে এটা আমার ছাপবার দরকার আছে কি-না। আমি লিখতে পারি, আমার আনন্দ আছে আমার লেখায়। কিন্তু লেখাটা যে মুহূর্তে আমি প্রকাশ করি সেটা আবার অন্য পর্যায়। সেজন্যে? দেখবে অনেক লেখক আছে যারা ছ’বছর দশ বছর অপেক্ষা করে; অনেকে আছে সঙ্গে সঙ্গে, অনেকের অনেক লেখা প্রকাশিতই হয় না।

রাইসু: এটা এই কারণে হতে পারে হক ভাই যে কালের অগ্রবর্তী লেখকরা ঐ কালটা আসার জন্য আবার অপেক্ষা করে।

হক: অনেক কারণ । না এতবড় কথা আমি বলবো না। অনেক কারণ, যেমন জীবনানন্দ তার গল্প-উপন্যাস প্রকাশ করতে চান নি।

রাজু: জীবদ্দশায় চাননি?

হক: জীবদ্দশায় ব’লে না। উনি লেখার আনন্দে লিখেছেন। কিন্তু উনি মনে করেছেন যে ছাপব না, রাইট অর রং সেটা অন্য কথা, উই মাস্ট গিভ এ রাইটার দ্যাট মাচ যে তার সিদ্ধান্ত। কারণ লেখাটা এমন একটা কাজ যেটা তুমি না করলে তোমাকে কেই জেল-ফাঁসি দেবে না। জরিমানাও করবে না, হ্যাঁ? এটা তুমি নিজের আনন্দেই করছো।

রাজু: আচ্ছা হক ভাই আপনি একটু আগে যেটা বললেন অতিকথনের ব্যাপারটা, যেটা আপনি বাদ দিতে চান। এ যেমন বোরহেসের একটা ইয়ে ছিল যে..

হক: কার?

রাজু: বোরহেস, হোরহে লুইস বোরহেস। উনি বলছিলেন যে, যে ইয়েটা আমি ৫ মিনিটের আয়তনের মধ্যে বলতে পারি সেটার জন্যে কেন আমি ৫শ’ পৃষ্ঠা খরচ করবো? তার মানে এইখানে উনি অতিকথনগুলো বাদ দেয়ার কথা বলেছেন। যদি এভাবে অতিকথন বাদ দেয়ার কথা মেনে নেয়া হয় হবে তো উপন্যাস ফর্মই থাকে না আর।

হক: তুমিই সমস্যার সৃষ্টি করছো, তুমিই সিদ্ধান্ত দিচ্ছো, এটা তো হতে পারে না।

রাজু: না আপনি বলেন এই বিষয়ে।

হক: না এই বিষয়ে তো বললাম, যে আমি আমার ব্যাপারে..আমার কথা জিজ্ঞাসা করছো। আই এম নট কনসার্নড উইথ বোরহেস অর ইউ অর হিম অর এনিবডি। আমার কথা বলছি। যে আমি অতিকথন বাদ দিতে বলেছি। আমি এটাকে কোনো সূত্র হিসেবে দেখছি না। উই আর টকিং এবাউট উইথ মাই রাইটিং। আমি দেখি, আমার প্রথম বিচার্য অতিকথন ঘটেছে কিনা। এখন ৫ মিনিটে যদি বলা যায় ৫শ’ পাতা কেন খরচ করবো? যেটা ৫ মিনিটে বলা যায় সেটায় ৫শ’ মিনিটে বা ৫শ’ পাতার কথা উঠবে কেন? আমার মনে হয় না বোরহেস এভাবে কথাটা বলেছেন। আই ডোন্ট থিংক সো, আই ডোন্ট থিংক সো। উনি বলতে পারেন না।

রাজু: না, উনি উপন্যাসের পক্ষে ছিলেন না তো।

হক: না না পক্ষে বিপক্ষের কোনো কথা নয়। যেখানে একটা জিনিস ৫ মিনিটে বলার সেখানে ৫শ’ পৃষ্ঠার প্রশ্ন উঠতেই পারে না। সেটা ৫ মিনিটেই। তাই না। যেমন ধরো সনেট; এটা কি এমন যে আমি একটা...

রাইসু: মাহাকাব্য?

হক: হ্যাঁ, মহাকাব্যকে একেবারে চুম্বক করে নিয়ে আসলাম ৫মিনিটে, আমি কেন সনেট লিখবো না? কেন মহাকাব্য লিখবো যদি সনেটে বলা যায়? অফকোর্স তোমার ধারণায় বা যদি সেটা করোটির মধ্যে এসে থাকে তবে সনেট হিসেবেই এসেছে।

রাজু: না উনি মনে করেন যে উপন্যাস হচ্ছে একটি শিথিল শিল্পমাধ্যম।

হক: দেখো, উপন্যাসের পক্ষে-বিপক্ষে প্রচুর কথা আছে। কবিতার পক্ষে-বিপক্ষে আছে। এটা একেকজন লেখকের স্ট্যান্ডপয়েন্ট। এটা এমন কিছু না যে তোমাকে কম্পাসের কাঁটা ধরে তারপরে দ্বীপ সন্ধানে বেরুতে হবে; তা নয়। এটা হচ্ছে তার মত। উনি শিথিল মাধ্যম মনে করেন। আবার অনেকে মনে করেন যে উপন্যাস হচ্ছে মহাকাব্যের সাবসটিটিউট, এই যুগে।

রাইসু: আর এইটার মাঝে একটা গণ্ডগোল থাকে। যে ধইরা নেয়া হয় একটা নির্দিষ্ট কিছু আছে কোথাও, সেইটা বোধ হয় আমি বর্ণনার ভার নিচ্ছি। তা তো না, মানুষ আবিষ্কার করে।

হক
: এটা ঐভাবে দেখা যাবে না। শোনো, লেখা এমন একটা জিনিস দেখো যেমন লিখবো কি লিখবো না এটা লেখকের সিদ্ধান্ত, হ্যাঁ? কেউ তো তাকে বলেনি। না লিখলে বড়জোর দুঃখ করতে পারে, কিন্তু তাকে জেল জরিমানা করবে না, অপরাধও নেবে না। তেমনি আবার কি লিখবে, কিভাবে লিখবে না এটাও কিন্তু সম্পূর্ণ তারই ব্যাপার। ইটস ভেরি ইন্ডিভিজুয়াল স্টেপ।

রাইসু: তাহলে সমালোচকরা কি করবেন?

হক: আমি তো বলেছি তাদের সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাই নেই, সমালোচক সম্পর্কে। আমি তাদের কোনোরকম গণনাতেই আনি না।

রাইসু: বলতেছেন তাদের কোনো অস্তিত্বই নেই?

হক: আমার কাছে নেই। এটা আমার পাঠকের কাছে আছে, এটা যারা আমার ভাষায় কথা বলে, সাহিত্য করে তাদের কাছে আছে। ছাত্রছাত্রীদের কাছে আছে, পাবলিশারের কাছে আছে,বইমেলায় আছে, পত্র-পত্রিকায় যারা আছে তাদের কাছে থাকতে পারে, আমার কাছে কোন অস্তিত্ব নেই। আমি লেখক এবং আমি লিখি এইটুকুই আমার কাজ। আমার লেখা সম্পর্কে কি আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে না হচ্ছে আই এম লিস্ট কনসার্নড এবাউট দ্যাট, কারণ আমি আমার সবচে বড় সমালোচক। একজন লেখককে এটা হতে হয়। আমার এটাই ধারণা। সে যদি নিজেই নিজের সবচে বড় সমালোচক না হয় তা হলে সে বেশিদূর এগুতে পারবে না। আমাদের ভাষাতেও এর প্রমাণ আছে, দেখবে যে আমাদের ভাষায় আমাদের বড় মাপের লেখকেরা প্রকাশ্য মানেই বোঝা যায় যে তারা অনেক বড় সমালোচক, অনেক বড় সমালোচক।

রাইসু: কি রকম?

হক: রবীন্দ্রনাথের কথা ধরো। হু ইজ আন্ডারস্টেনডিং অফ আর্ট, অফ লাইফ,অফ সোসাইটি, অফ ইগো, অফ পলিটিকস। এটা দেখলেই বুঝতে পারবে যে তার ভিতরে কিন্তু সব সময়....

রাইসু: সমালোচক রয়েছে?

হক: হ্যাঁ আছে, এটাতো বোঝা যায়। এমনকি তিনি রাজনীতি নিয়ে প্রবন্ধ লেখেন তখন আমি বুঝতে পারি এই লোকটার এই ধরনের দৃষ্টি আছে। তাঁর নিজের লেখা সম্পর্কেও আছে। তিনি যখন ‘গোরা’ উপন্যাস লিখছেন বা ‘মানসী’ কাব্য লিখছেন তখনো একই বিশ্লেষণ একই এটিচ্যুড কাজ করছে। এটা এমন না যে এটা বন্ধ করে রেখে দিলাম। রেখে দিয়ে তারপর কবিতা লিখছি তা না, একই ফ্যাকান্টি কাজ করে। জীবনানন্দ, সুধীন দত্ত, বুদ্ধদেব বসু কত নাম করবে, এঁরা প্রত্যেকে। কারো হয়তো লিখিত প্রমাণে বোঝা যায় যে এই ধরনের মন এই ধরনের দৃষ্টি, এই ধরনের বিশ্লেষণে তারা অভ্যস্ত বা এটাই তাদের চালিকাশক্তি। কিন্তু এটা না হলে আমার মনে হয় না কোনো কাজ হবে। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক লেখা তো বাদ দাও অন্য কোনো কাজও তো করা যায় না। তুমি যখন একটা সিঁথি করছো তখনো তো তুমি সমালোচনা করো যে না এভাবে ঠিক ভাল লাগছে না। সমালোচনা করছো না? এটা মানুষের করতেই হয়। এই যে বেয়ারা এসে একটুখানি চামচটাকে এমন করবে। হোয়াট ইট ইজ একচুয়ালি, তার কাছে মনে হলো যে এটা এরকম হয়নি তো ঠিক করি।

রাইসু: তা হক ভাই আপনি এত রকমের সমালোচনা মানতে রাজি আছেন, সাহিত্য সমালোচকদের ব্যাপারে আপনার এই অসূয়া কেন?

হক: না সাহিত্য সমালোচকদের ব্যাপারে অসূয়া না। এটা তুমি, ইউ আর পুটিং ওয়ার্ডস ইন মাই মাউথ। আমি বলেছি আমার কাছে ততখানি একজিসটেন্স নাই। আমি মনে করি আমার কাজ হচ্ছে লেখা। আমি কনসার্নড না। আমি বলেছি যে এটায় আমি কনসার্নড না। সমালোচনা হলে ভালো। হচ্ছে। তুমি যদি এমন কিছু বলো যেটা আমার কাছে গ্রহণযোগ্য আমি নিশ্চয়ই নেবো এবং আমি নিয়েছিও কিন্তু। নিয়েছি। কোনো কোনো কথা এমনি মৌখিকভাবে আলোচনায় সমালোচনায় কেউ বলেছে এই যে এই জায়গাটায় আমার ভাল লাগে নাই; চিন্তা করেছি কারণ তোমাকে যদি আমি জানি যে তুমি যে মতামতটা দিচ্ছো তোমার সে যোগ্যতা আছে, যদি আমি তোমার প্রতি আস্থা রাখি তুমি যদি বলো যে হক ভাই এই জায়গাটা আমার ভাল লাগলো না। আমি চিন্তা করবো যে কেন বলল। আমি চেষ্টা করবো তোমার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে লেখাটাকে দেখতে। এন্ড ইন এনি কেস আমার ব্যাপারে যেটা হয় আমি যে কোনো লেখা শেষ করার পরে কিন্তু আই কাম আউট অফ ইট।

রাইসু: মানে এই লেখাগুলোর একটা ভৌগোলিক অবস্থান আছে আপনার মধ্যে। যে ওটা ছেড়ে আসা যায় না।

হক: ভৌগোলিক অবস্থান বলা ঠিক হবে না এটা হচ্ছে, যে নিঃশ্বাসটা তুমি ছেড়ে দিলে সে নিঃশ্বাসটা আর তুমি নিচ্ছো না। পরবর্তী নিঃশ্বাস নিচ্ছো। এক নদীতে দুবার যেমন স্নান করা যায় না সে রকম।

রাইসু: এটা করা যেতে পারে হক ভাই, আমি এটা ভাবছিলাম যে নদী যদি আটকায়া দেই আমরা দুই দিকে।

হক: হ্যাঁ তাহলে তো আর নদী থাকলো না।

রাইসু: পুকুর হয়ে গেল?

হক: ইউ আর গট ইন ইউর ওউন ট্র্যাপ। এটাতো আর নদী থাকলো না।

রাইসু: নদী থাকলো না মানে কি? আমিতো দুইবার স্নান করে ফেললাম এরই মধ্যে।

হক: এটা নিয়ে এতটা কোরো না, কারণ তুমি যদি লজিক পড়ে থাকো তুমি জানো যে প্রত্যেকটা উপমার তুলনার একটা সীমাবদ্ধতা আছে ইউ মাস্ট নট সি ইট টু দি লাস্ট এক্সটেন্ট। উপমায় ধরেই নেয়া হয় যে এটা হচ্ছে আংশিক।

রাইসু: বা ডিসিশনটা আগে নিয়ে তারপর উপমাটা দিতে হয়?

হক: না না না, উপমা কখনই শেষ পর্যন্ত যাবে না। চাঁদের মত মুখ যখন বলবো। এটা আংশিক। উপমা ছাড়া মানুষ কাজ করতে পারে না। এটা আলো হাওয়ার মত সদা সত্য, উপমা কখনও শেষ পর্যন্ত যেতে চায় না। পারে না। এটা আমার কোনো ব্যাখ্যার দরকার করে না। দু’ চার হাজার বছর আগে এটা সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে। এবং কমনসেন্স থাকলে তুমি বুঝতে পারবে যে উপমা ছাড়া হয় না এবং উপমার সীমাবদ্ধতা আছে। ইট গোজ আপ টু এন এক্সটেন্ট। নট অল দ্যা ওয়ে।

রাইসু: বেশিদূর টানা যাবে না?

হক: হ্যাঁ এটা টানা যায় না, উচিত না। উপমার সবসময় সীমাবদ্ধতা আছে। যেমন ধরো একটা লোক বললো যে, ওহ এত কষ্ট লাগলো যে বুকে শেল বিঁধেছে! এবং একটা সাধারণ লোক বলে বুকটা ফেটে গেছে। এটা উপমা নয় কি?

রাইসু: তখন কেউ তো গিয়ে বলে না যে না ফাটে নাই তো।

হক: হ্যাঁ, ঘরটা অন্ধকারে ডুবে গেলো। কিন্তু দেখো তুমি বুঝে গেছো। এইটি হচ্ছে উপমা। এটা আমরা সবাই ব্যবহার করি। এটার সঙ্গে কোনো ক্রিয়েটিভিটির কোনো যোগ নেই। এটা হচ্ছে হিউমেন লিমিটেশন।

রাজু: আচ্ছা হক ভাই আপনার অন্তর্গত উপন্যাসটা প্রথম যখন বের করলেন; সম্ভবত বিচিত্রায় বের হয়েছিল উপন্যাস আকারে। পরে আবার এটাকে আপনি কাব্যরুপ দিয়ে গ্রন্থাকারে বের করলেন।

হক: আমার বইটা পড়েছিলে?

রাজু: হ্যাঁ।

হক: ছাপা আকারে দেখেছিলে?

রাজু: হ্যাঁ।

হক: ভূমিকা পড়েছিলে?

রাজু: ভূমিকাটা আমার এই মুহূর্তে খেয়াল নেই।

হক: এটাতো খেয়াল থাকার কথা। তাহলে তো এই প্রশ্নটা করতে না। তাতে আমি লিখেছিলাম যে দৈনিক পত্রিকা বা সাপ্তাহিক পত্রিকার বিশেষ সংখ্যায় যখন ছাপা হবে তখন কম্পোজিটরদের লিমিটেশন আমি জানি। যার জন্যেও আমি যদি এই কবিতার ফর্মে এভাবে দেই তাহরে ভেঙ্গেচুরে একাকার করে ফেলবে। সে জন্যে আমি টানা ছেপেছি। কিন্তু মূল পাণ্ডুলিপি অনুসারে গ্রন্থাকারে এটাকে ছাপা হযেছে। ওখানে বলাই আছে কারণটাতো তুমি বোঝোই, ঈদ সংখ্যায় কিভাবে বেরোয়।

রাজু: একটা তাড়াহুড়া থাকে?

হক: ওখানে এই যে আমি ধরো একটা একটা শব্দ এই রকম দিচ্ছি। সম্পাদক ভাবতেও পারে কাগজ ক্ষয় হচ্ছে। এ রকম হয় না? এই যে কবিতা বহুদিন আগে এক সম্পাদক আমাকে বলেছিলেন যে, আপনি এ রকম ছোট ছোট লাইন দিলেন একটু টাইনা দিতেন লাইনগুলা, তাইলে একটু জায়গা পাইতাম। কিসের জায়গা? আমার ঐ হাঁপানির আর অর্শ রোগের বিজ্ঞাপনটা ছাপতে পারতাম। এই বহু আগে, তিরিশ-পঁয়ত্রিশ বছর। দীর্ঘদিন লেখার ফলে হয় এই ধরনের অভিজ্ঞতা তোমার হয় প্র্যাকটিকালি, যার জন্যে উই বিকাম কশাস।

রাইসু: আচ্ছা আপনি কতদিন যাবত লিখতেছেন হক ভাই?

হক: হিসাব করো তুমি, তোমার তো জানার কথা?

রাজু: চল্লিশ বছরের মতো। চল্লিশ বছরের উপরে। বেয়াল্লিশ তেতাল্লিশ হবে বোধ হয়?

হক: আমার এমনিতে তো ধরো লেখা অনেক আগে থেকেই কিন্ত আমি লিখবো সেটা হচ্ছে তেপ্পান্ন সালে। ফিফটি থ্রির মে মাসে আমার একটি কবিতা বেরোয়। এইখান থেকে মনে করো শুরু, তাহলে আজকে আমরা ৯৫-এর শেষ মাসের শেষ দিনে কথা বলছি। তাহলে তেতাল্লিশ বছর হলো প্রায়।

রাইসু: তেতাল্লিশ বছরের সাহিত্য সাধনা তো বিশাল ব্যাপার! ছত্রিশ বছরেই তো....

হক: ‘সাধনা’ বোলো না। এইগুলা হচ্ছে আবার তোমাদের বাঙালিদের একটা সবকিছুর সঙ্গে সাধনা। সবকিছুর সঙ্গে মহান। মহান মুক্তিযুদ্ধ, মহান একুশে, সাহিত্য সাধনা, জীবন চর্চা।

রাইসু: ‘তাৎপর্যমণ্ডিত’?

হক: এইসব বাদ দাও। বলো যে হ্যাঁ লিখছি। লিখছি, কাজও করছি, লিখছি।

রাইসু: হ্যাঁ হ্যাঁ এইটাতো হয়। কেননা আমরা তো বলি নাই উনি চল্লিশ বছর যাবত রিকশা চালনা সাধনা করছেন।

হক: আমি সেটাই বলছি। আমার মনে হয় যে এই বিষয়ে কোনো...

রাইসু: তারপরেও আমি হক ভাই মনে করি লেখাটা একটা সাধনাই।

হক: সব কিছুই সাধনা। আমি এইটাকে পারটিকুলার গুরুত্ব দেই না। আমার কিন্তু কোনো সময় এটাকে একটা বিশেষ কাজ হিসেবে....

রাজু: কনসিডার করেন না?

হক: না, ইট ইজ এজ ইম্পর্টেন্ট এজ এনি ওয়ার্ক।

রাইসু: না ইম্পর্ট্যান্ট হইতে পারে, কিন্তু ইম্পর্ট্যান্ট কাজও অনেক কিন্তু গুরুত্বহীনতার সঙ্গে করা যাইতে পারে?

হক: আমি তো গুরুত্বের সাথে করছি। কাজেই যারা গুরুত্বের সঙ্গে করছে তাদের দেখো। যে লোকটা অন্য কাজ করছে, গুরুত্বের সঙ্গে করছে।

রাইসু: সেইটা তার সাধনা। সাধনা শব্দটা আসলে নষ্ট হয়ে গেছে আমার মনে হয় ঔষধালয়গুলির কারণে?

হক: না, না, তা নয়। ‘সাধনা’ এইভাবে ব্যবহার করতে চাই না। তার কারণ হচ্ছে যে, নানা ভাষার আমরা বহু শব্দ না বুঝে….

রাইসু: এইটা কি ভাষার একটা পজেটিভ দিক না হক ভাই যে শব্দ তার ইচ্ছামত অর্থগ্রহণ করতেছে। মানে শব্দ তার সময়ের সঙ্গে অর্থ পাল্টায়ে নিচ্ছে?

হক
: আবার বলো তুমি। আমার মনে হয় তুমি কি বললে তুমি তা নিজেই জানো না। না, না এটা ভাষার কোনো পজেটিভ সাইড নেগেটিভ সাইড কিচ্ছু নয়। সাধনার যে অভিধা, এটা আমাদের দেখায় যে এরকম একটা লোক সারাজীবন এর পিছনে লেগে আছে। এর সঙ্গে ‘ভাব’ ‘ভক্তি’ ‘নিবেদিতপ্রাণ’ নানারকম কনোটেশন আছে। আবার এর মধ্যে সাধুটাধু ব্যাপারও আছে। এমন কিছু সার্বক্ষণিক লেগে থাকারও ব্যাপার নয়। একটা কাজ করতে হবে করছি। আমি বলবো যে আমি তেতাল্লিশ বছর লিখছি।

রাইসু: এর মধ্যে ছাড়তে চাইছেন কখনও লেখা?

হক: না, নট ফর এ সিঙ্গেল ডে, নট ফর এ সিঙ্গেল মোমেন্ট।

রাইসু: লেখা আপনারে যুক্ত রাখছে কিভাবে? মানে কোন জিনিসের কারণে আপনি লেখাতে নিযুক্ত আছেন?

হক: এটাও আমি বলেছি। আমার কলামেই বলেছিলাম যে এটা আমার নিজের সঙ্গে সংলাপ। আমি নিজের সঙ্গে সংলাপ এই জন্যেই বলছি যে, যখন আমি লিখি-এটা যে কোনো লোকেরই হয়, চিন্তাটা অনেক স্পষ্ট হয়। জিনিসটার একটা আকার দিচ্ছি। কাজেই আমি নিজেই নিজের কাছে স্পষ্ট হতে চাই। নিজের কাছে স্পষ্ট হই, এটিই আমার কাছে জরুরি। এবং এইটি আমাকে ধরে রেখেছে আমার লেখার কাজে। আমি এখন পর্যন্ত আর কোনো কাজ পাইনি যেটা আমাকে আমার কাছে স্পষ্ট করতে পারে। আমি আমার কাছে স্পষ্ট হতে চাই। দ্যাট ইজ মাই ফার্স্ট কনসার্ন। প্রতিটি মানুষের ভেতরেই অভিজ্ঞতা আছে। সে অভিজ্ঞতাটাকে একটা আকার দেয়।

রাইসু: আপনি কিন্তু নিজের কাছে স্পষ্ট হচ্ছেন একটা পরিশীলিত ভাষায়। এবং যেই ভাষাটা আপনার অর্জিত ভাষা। আপনার মুখের ভাষা হয়তো এটা না?

রাজু: মানে আপনার তৈরি করা ভাষা তাই নয় কি?

হক: গোড়াতেই তো একটা ভুল করে বসে আছো। প্রতিদিনের ভাষার সঙ্গে সাহিত্যের ভাষাকে মিলিয়ে ফেলেছো। সাহিত্যের ভাষাটা হচ্ছে চিত্রকরের রং এর মতো। যে কম্পোজার তার সেই ধ্বনির মত। সাউন্ডের মতো। কাজেই এটা তোমার প্রতিদিনের ভাষা নয়। এটা অর্জিত এবং কৃত্রিম ভাষাতো বটেই।

রাইসু: আলংকারিক?

হক: না না আলংকারিক নয়, এটা অর্জিত ও কৃত্রিম ভাষা তো বটেই। যে অর্থে চিত্রকরের রং কৃত্রিম, যে অর্থে তোমার সারগাম কৃত্রিম। সাহিত্যের একটা বিচার করতে সবাই ভুল করে। তোমরা নিশ্চয়ই করবে না সেই ভুল। সেটি হচ্ছে যে প্রতিদিনের ভাষা কিন্তু সাহিত্যের ভাষা নয়। যদিও মনে হয় যে এটা প্রতিদিনের ভাষা। গোলমালটা কোথায় জানো? আমরা যে ভাষা দিয়ে প্রতিদিন জীবন যাপন করি, চাওয়ালাকে চা দিতে বলি, রিকশাওয়ালাকে ডাকি লিখতে গিয়ে মনে করি সেই ভাষাটাই ব্যবহার করছি। কিন্তু এটা অ্যাজ পিওর অ্যাজ পেইন্টারস কালার। এভাবে দেখতে হবে। দ্যাখো আলো ছিল পাতা ছিল নাচ ছিল; যখন রবীন্দ্রনাথ লেখেন‘ এই যে পাতায় আলোর নাচন’,কই সেটাতো প্রতিদিনের ভাষা থাকে না। সেই আলো নয়, সেই পাতা নয়, সেই নাচও নয়। ‘এই যে পাতায় আলোর নাচন’ এটা প্রতিদিনের ভাষা নয়। কাজেই এটা কৃত্রিম। এটা সেই অর্থে কৃত্রিম যে অর্থে পেইন্টরের রং কৃত্রিম। যে অর্থে একজন সংগীত স্রষ্টার সারগাম কৃত্রিম।

রাজু: আচ্ছা এ ক্ষেত্রে হক ভাই তা হলে কমলকুমার মজুমদারের কৃতিত্ব বোধহয় বিশাল।

হক: আবার তুমি নাম করছো। আমি তো কারও সম্পর্কে আলোচনা করবো না আজকে বছরের শেষ দিনে।

রাজু: ওনি তো মরে গেছেন।

হক: না জীবিত মৃত না আমি কাউকে ভয় পাই না। নট দ্যাট। আজকে আমার কথা বলো, তোমরা গোড়াতেই বলেছো যে আপনার কথা শুনবো।

রাজু: না আমি যেটা বলতে চাচ্ছিলাম সেটা হলো, আপনি তো বিশাল একটা সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী। তাই না?

হক: এগুলো বড় বড় কথা বলো কেন! ‘সাধনা’ এখন ‘উত্তরাধিকারী’ নিয়ে এলে। আমি কিন্তু এই ধরনের এক্সপ্রেশনগুলো থেকে দূরে থাকতে চাই। এবং দূরে থেকেছি। তুমি দেখ যেমন এই যে ‘ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার’ কথাটা বললে এই কথাটা আমার তেতাল্লিশ বছরের লেখার মধ্যে পাবে না। ‘ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার’ নেই।‘ঐতিহ্য’ আছে ‘উত্তরাধিকার’ আছে। কিন্তু ‘ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার’ নেই। এটা তোমাকে কোনো রকমের ক্ষুণ্ন করার জন্যে বলছি না। আমি মনে করি আমাদের বিশেষ একটা পতনের দিক হচ্ছে

রাইসু: বাঙালির?

হক: হ্যাঁ বাঙালির। বলো বাংলাদেশের বাঙালির। আমরা প্রচুর শব্দ ব্যবহার করি না বুঝে। এই যে ‘মহান একুশে’ ‘মহান মুক্তিযুদ্ধ’ তুমি জিজ্ঞেস করো যে ‘মহান’ কেন বলে? কেন ‘গৌরবময়’ নয়? সে বুঝতে পারবে না, সে মনে করবে বুঝি ঠাট্টা করছো। হ্যাঁ অমর একুশে। অমর একুশের অনেক আমি জানি। কিন্তু তোমরা আমাকে বোঝাও এই যে অমর একুশে কনোটেশনটা কি শুনতে ভালো লাগে বলে সবাই বলে। শুধু একুশে বললে ন্যাংটো মনে হয়। ঐ যে বললাম শ্যামল এ কুলোয় না সুশ্যামল । শীতল-এ কুলোয় না সুশীতল। যে জাতির গদ্য ঠিক নয়, যে জাতি শব্দ ব্যবহার সম্বন্ধে সচেতন নয় জানবে যে সমূহ বিপদ তার এবং আমি এটাকে যে কোনো রাজনৈতিক সংঘর্ষ, রাজনৈতিক সংকটের চেয়ে অনেক বড়মাপের সংকট বলে মনে করি। আমি খুব শংকিত চারদিকের অবস্থা দেখে।

রাইসু: হক ভাই নিকের কাছে নিজে স্পষ্ট হন এবং অপরের কাছে নিজেকে অস্পষ্ট করে তোলেন?

হক: না আমার লেখাটাই হচ্ছে আমার পরিচয়। আমি অস্পষ্ট করতে চাইনা, আমি যেটা আশা করি, আমি যেটা চাই সেটা হচ্ছে যে আমার লেখা পড়ে আমাকে জানো। কারণ ওখানে যেমন আমি নিজের কাছে নিজে স্পষ্ট হতে চেয়েছি, যখন উপস্থিত করছি তখন কি বলতে চেয়েছি কিভাবে বলেছি সেসব তো আছে। তার সঙ্গে তো আমিই আছি পেছনে। কাজেই আমাকে জানবার একবার একমাত্র উপায় হচ্ছে আমার লেখা। যার জন্যে দেখবে যে আমি সাক্ষাৎকারে খুব একটা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি না। কারণ হচ্ছে যা বলবার আছে এটাতো বলবার জন্যেই আজকে ৪৩ বছর হয়ে গেলো। লিখছি। কবিতা, গল্প, নাটক, উপন্যাস, কলাম, গদ্য, সবকিছুই করছি, তার ভেতরেই আছি। যখন আমাকে কেউ জিজ্ঞেস করে যে প্রেম সম্বন্ধে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কি...আরে সে কথাটা বলবার জন্যেই তো এতোগুলো কবিতা লিখলাম, গল্প লিখলাম, কাব্যনাট্য লিখলাম।

রাইসু: তবে প্রেমের ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গির চেয়ে অন্যান্য ভঙ্গিগুলো ভালো।

রাজু: আচ্ছা হক ভাই বিয়ে করার আগে একটু ইয়ে নিবিড় প্রশ্নে যাচ্ছি-সেটা হলো ভাবীর সাথে আপনার সম্পর্ক হওয়ার আগে কখনো কি প্রেমে পড়ছিলেন কিংবা অন্য কোনো মেয়ে আপনার প্রেমে পড়েছিল?

হক: এ বিষয়ে আমি কিছু বলবো না। তার কারণ হচ্ছে যে আমার যে ব্যক্তিগত জীবন সে জীবনটা আমি মনে করি না যে…

রাজু: প্রকাশযোগ্য?

হক: না প্রকাশযোগ্য নয়…. এর কোনো প্রসঙ্গিকতা আছে? এর কোনো প্রসঙ্গিকতা আছে আমাকে বোঝার বা জানার ব্যাপারে, কোনো প্রাসঙ্গিকতা আছে বলে আমি মনে করি না। সেক্ষেত্রে প্রশ্নের উত্তর আমি কখনোই দেইনি। আজও দেবো না, ভবিষ্যতে দেবো কিনা তা বলতে পারি না। ভবিষ্যতে আমার মত পরিবর্তনও ঘটতে পারে। সে স্বাধীনতা প্রত্যেক মানুষের আছে, আমারও আছে। তবে আমি আগে প্রেম করেছি কিনা, ভবিষ্যতে প্রেম করবো কিনা, পরকীয়া প্রেম সম্বন্ধে আমার কি ধারণা, বা স্বকীয়া তথাকথিত প্রেম সম্পর্কে আমার কি দৃষ্টিভঙ্গি- আমি মনে করি যে এটা প্রাসঙ্গিক কোনো বিষয় নয়। যেমন আমার অনেক কিছুই প্রাসঙ্গিক নয়। আর যতটুকু জানাবার সেটা কিন্তু আমার লেখার ভেতরেই আছে। তুমি যদি একটু সতর্ক পাঠক হও, একটু মনোযোগী পাঠক হও, আমার লেখার ভেতরেই পাবে।

রাইসু: আচ্ছা হক ভাই, আপনি কি সরকারি চাকরি করেছেন?

হক: না।

রাইসু: সরকারের ব্যাপারে আপনার এই বীতরাগ?

হক: এটা বীতরাগ নয়তো। তুমি তো ওস্তাদ দেখছি, মানুষের মুখে কথা বসিয়ে দেবার জন্যে। আমি তো বলিনি বীতরাগ। না না, তুমি জিজ্ঞেস করেছো সরকারি চাকরি কেন করিনি। কারণ সরকারি চাকরি করবার মতো চিন্তাই কখনো আমার আসে নাই।

রাইসু: এটা কি রবীন্দ্রনাথের দেখাদেখি?

হক: না না ‘৫৩ সাইে বলেছি যে লেখাপড়া যাই করিনা কেন আমি লেখক হবো। মানুষের তো একটা প্রস্তুতির সময় থাকে। সতেরো, আঠারো থেকে বিশ-চব্বিশ বছর বয়স পর্যন্ত লেখাপড়া করে কোনো না কোনো জীবিকার দিকে সে ধাবিত হয়। আমি ডিসাইড করি যে আমি লেখক হবো, এটা কেন আমি ঠিক বলতে পারবো না। তুমি কি বললে রবীন্দ্রনাথ? রবীন্দ্রনাথ নয়। এটা আমার মনে হয়েছে যে আমি এই কাজটাই করবো। তারপরে দেখলাম যে লিখছি। এইতো লিখছি। আবার চাকরি করতে গেলে বিএ পাসও করতে হয়। বিএ পাসও করিনি। কাজেই আমার আরো সুবিধা হয়েছে।

রাইসু: শিক্ষার দিকে আপনার একটু কমতি আছে দেখা যাচ্ছে।

হক: হ্যাঁ, সেটাতো বটেই।

রাইসু: এটা রবীন্দ্রনাথেরও আছে। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আপনার অনেকগুলো মিল আছে। আপনি ডায়রি লেখেন নাতো বোধহয়?

হক: না।

রাইসু: রবীন্দ্রনাথ পদ্মায় ঘুরতে পছন্দ করতেন আপনি পদ্মায় ঘুরেন না; কিন্তু আপনি গাড়িতে কিন্তু অনেক ঘোরাঘুরি করেন।

রাজু: এখনতো আর নদী নাই, পানি নাই।

হক: রবীন্দ্রনাথও এখন থাকলে গাড়িতেই ঘুরতেন।

রাইসু: রবীন্দ্রনাথ নানা মাধ্যমে কাজ করেছেন, আপনিও তাই করছেন। তারপরে আরো কিছু জিনিসপত্র আছে।

রাজু: আপনি চিঠিপত্রটা লেখেন না, হক ভাই, এটাই বোধহয় একটা অমিল?

রাইসু: হক ভাই ফোন করেন।

হক: হ্যাঁ সেই। রবীন্দ্রনাথ তো যশোরে বিয়ে করেছেন। আমিও যশোরে বিয়ে করেছি। যদি তুমি মিলই টানতে চাও তা হলে এটাই বাদ পড়বে কেন? ওটা কোনো ব্যাপার নয়।

রাজু: আপনি আপনার ‘হৃৎকলমের টানে’ একবার বলছিলেন যে ম্যাজিক রিয়ালিজমের উপাদান আমাদের লোকসাহিত্যে আছে। এটা সম্পর্কে একটু বলেন।

হক: যা বলেছি তার বেশি খুব বলবার নেই। এটা নতুন কোনো বিষয় নয়। ম্যাজিক রিয়ালিজম বলতে যেটা আজকাল বোঝানো হয় ল্যাটিন আমেরিকার উপন্যাসের সূত্রে, বিশেষ করে এই ধরনের বাস্তবকে একেবারে ছেনে ছেনে …..করে উপস্থিত করা। এটা আমাদের কথকতাতেও আছে। এবং আমি তখন ঐ ‘পূর্ববাংলা গীতিকা’ থেকে একটি উদাহরণ দিয়েছিলাম। যে একটি মেয়ে, তার স্বামী বিদেশে গেছে বাণিজ্য করতে, বারো বছর চরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে ফিরে আসার। তুমি আজকে উপন্যাস লিখতে গেলে চিন্তা করবে বারো বছর এখানে দাঁড়িয়ে আছে কি করে? তাকে কেউ ধরছে না, তাকে কেউ চাইছে না। সে খাচ্ছে কি, সে কোথায় ঘুমোচ্ছে। কিন্তু পূর্ববাংলা গীতিকায় তুমি দেখবে, ইউ অ্যকসেপ্ট ইট। এন্ড দিস ইজ ম্যাজিক রিয়ালিজম। ইউ অ্যাকসেপ্ট ইট যে বারো বছর সে তাকিয়ে আছে পথের দিকে। এই যে ব্যাপারটা এটা আমি একটা উদাহরণ দিয়েছি। কিন্তু এরকম পরতে পরতে আছে। এগুলো আমাদের এপিকের ভেতরে আছে, রামায়ণে আছে, মহাভারতে আছে। একটা এপিকে তো ধরো মাস্টার ব্লুপ্রিন্ট থাকে। একটা জাতির কথকতা। সে মাস্টার ব্লুপ্রিন্টের ভেতরেই তুমি এই ধরনের ম্যাজিক রিয়ালিজমে ব্যাপারগুলো পাবে। পাখি মানুষ হয়ে যাচ্ছে, মানুষ পাখি হয়ে যাচ্ছে। এখন তুমি ব্যবহার করোনি আজকের দিনে বা তুমি বিস্মৃত হয়েছো।

রাইসু: বা তত্ত্ব হিসেবে নেই নি?

হক: তত্ত্ব হিসেবে নাওনি সেটার জন্য তো...

রাইসু: অন্যেরা বসে থাকে না?

হক: হ্যাঁ, অন্যেরা বসে থাকে না। এটা অনেক কিছু ব্যাপার আছে। এসব ব্যাপারে একজন প্র্যাকটিসিং রাইটার হিসেবে আমি দূরে থাকি। এই ম্যাজিক রিয়ালিজমই বলো, আর পোস্টমডার্নিজমই বলো, আর এবসার্ড নাটকই বলো আমি একটু দূরে থাকি। কারণ আমার একটা বলবার কথা আছে এবং বলবার একটা কৌশল আমাকে নির্ধারণ করতে হয়।

রাইসু: শৈলী না কৌশল?

হক: আমি কৌশল বলি। কৌশল থেকে শৈলীর তেমন দূরত্ব নেই, তুমি উচ্চারণেই বুঝছ। একটা কৌশল নির্ণয় করতে হয়। কৌশলের ভেতরেই এই ব্যাপারটা আছে যে আমাকে একটা জিনিস তৈরি করতে হবে যেটা সংকেত পাঠাবে। ঐ যে গোড়াতে সিগন্যালের কথা বলেছিলাম। এখন সংকেত পাঠাবার ধরনটা ম্যাজিক রিয়ালিজমের ভেতরে পড়ছে না পোস্টমডার্নিজমের না এবসার্ড নাটকের ভেতরে পড়ছে সেটা হচ্ছে অন্যের ব্যাপার। সেটা আমার ব্যাপার না। এটা এমন নয় যে তুমি একটা আম গাছ করবে বলে আমের বীজ লাগালে। তা নয়। এবং এটারও দরকার আছে, এই সমালোচনারও দরকার আছে। কারণ এইভাবেই কিন্তু তুমি বুঝতে চেষ্টা করো যে কি ধরনের বিবর্তন হয়েছে, বলার দিক থেকে, বিষয়ের দিক থেকে, দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে অনেক রকম আলোচনা আছে। একটা সাহিত্য সমালোচনায় যে রকম -দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সমালোচনা হয়, আঙ্গিক নিয়ে সমালোচনা হয়, তারপর সময়ের সঙ্গে যুক্ত করে দেখা হয়। দ্যাখো না, হয়ত একজন লেখকের আলোচনা শুনবে, তার সম্পর্কে দেখবে যে, তার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির উপরেই ষোলআনা জোর দেয়া হয়েছে। তার আঙ্গিক নিয়ে কোনো কথাই বলা হলো না। আবার আরেকজনের শুধু গদ্যরীতিরই প্রশংসা করা হচ্ছে, কিন্তু সে কি বলতে চেয়েছে কি দৃষ্টিভঙ্গি এটা বলা হচ্ছে না। কাজেই বিভিন্নভাবে লোকে আলোচনা করছে। কিন্তু সবকিছু মিলিয়ে আলোচনা হওয়া দরকার। এবং এই কাজটি গুরুত্বপূর্ণ।

রাইসু: আচ্ছা সব মিলিয়ে বাংলা সাহিত্যের অবস্থাটা কি মনে হয় আপনরা?

হক: এখন খুব খারাপ অবস্থা।

রাইসু: ভাল ছিল?

হক: ভাল ছিল।

রাজু: কোন সময়টা পর্যন্ত?

হক: পুরো রবীন্দ্রনাথের সময়টা ভাল ছিল এবং তোমার আমি বলবো আর্লি সিক্সটিজ পর্যন্ত ভাল ছিল।

রাইসু: মানে আপনাদের সময়টা পর্যন্ত?

হক: আমাদের সময়ের কিছু পর পর্যন্ত ভাল ছিল। কিন্তু এখন যেটা হয়েছে সেটা এই অর্থে খারাপ বলছি যে এখন আর আমি নতুন কোন বাঁকের সন্ধান পাচ্ছি না। এখন এটি মিডিওকারদের সময়।

রাইসু: আপনি কি পড়েন নতুনদের কিছু?

হক: হ্যাঁ হ্যাঁ সবসময়ই পড়ি। না পড়লে আমি কাজ করবো কি করে? আমাকে দেখতে হবে না? আমি চেয়ার বানাই, আমি ফার্নিচারের দোকান ঘুরে বেড়াবো না যে কে কোন ডিজাইনের চেয়ার তৈরি করেছে?

রাইসু: এরকম হইতে পারে যে আপনি একই দোকানে বারবার যাচ্ছেন?

হক: তা হতে পারে, হতে পারে।

রাইসু: নতুন দোকানটাই হয়ত আপনি চিনলেন না?

হক: হ্যাঁ হতে পারে। হতে পারে, এটা অসম্ভব কিছু নয়। এবং সেটা যদি হয়ে থাকে আমার লেখাতেই সেটা প্রমাণ পাবে। যদি আমার লেখাকে তোমার মনে হয় যে গুরুত্বপূর্ণ তা হলে তুমি জানবে যে না আমি নতুন দোকানেও যাচ্ছি। এটা আমার লেখা দেখলেই বোঝা যাবে। কারণ এটার তো একটা রিফ্লেকশন থাকবে। আমাকে জানতে হয় কেন?

রাইসু: দুটোই তো সমস্যা। এক হচ্ছে নতুন দোকানে পুরোনো মাল, আরেকটা হচ্ছে পুরানো দোকানে নতুন মাল।

হক: হতে পারে, সেটা আমার সমস্যা নয়; অপরের সমস্যা।

রাইসু: বাংলা সাহিত্যেরই সমস্যা।

হক: অপরের সমস্যা; কিন্তু আমাকে সেটা জানতে হবে তো। কিন্তু আমি মনে করি, এটা আমি খুব বেশি ব্যাখ্যায় যাবো না। এটা হচ্ছে, ইট ইজ দ্য টাইম অফ দি মিডিওকার্স।

রাজু : মানে গ্রস ইয়েতে?

হক: হ্যাঁ এটা বাংলাদেশেও, পশ্চিমবঙ্গেও। এখন মিডিওকাররাই। এবং তাদেরও গুরুত্ব আছে।

নব্বই দশকের মাঝামাঝিতে সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গে কবি ব্রাত্য রাইসু।

রাইসু
: কিন্তু না, আপনি যখন এ কথা বলবেন তখন এটা কিন্তু একটা লেবেলিং হয়ে যাচ্ছে আবার?

হক : না লেবেলিং নয়, লেবিলিং নয়। দিস ইজ মাই এসেসমেন্ট। এটা আমার মূল্যায়ন। যে এখন মধ্যমানের লেখকেরা লিখছেন। এটা হচ্ছে গৌণ লেখকের কাল।

রাইসু: বড় লেখকরা এখন কম লিখছেন?

হক: না, বড় লেখক নেই-ই এখন।

রাইসু: সেটা কি আপনি নিজেরে ধইরা বলতেছেন?

হক: হ্যাঁ নিজেকে ধরেই বলছি।

রাইসু: নিজেকে আপনি গৌণ বলতেছেন?

হক: না আমি বলছি যে এটা হচ্ছে গৌণ লেখকের কাল। কেন বলছি? আমি অবজার্ভ করেছি বলেই তো।

রাজু: কিন্তু আপনাকে গৌণ মনে হয় না তো। আপনার কাজ এগুলো সব মিলিয়ে...

হক: এটা আমার সমস্যা নয়।

রাইসু: এটা আমাদের সমস্যা। কিন্তু কথা হইলো যে আপনি নিজেরে কেন গৌণ ভাবতেছেন?

হক: আমি ভাবছি না। আমি তো বলিনি আমি গৌণ লেখক, বলেছি এটা গৌণ লেখকের কাল। এবং একজন লেখকের ভেতরে যদি আমাকে ধরো, হ্যাঁ আমিও আছি। কিন্তু হয়তো আমি চেষ্টা করছি। আমি তো বলিনি যে আমি মেনে নিয়েছি।

রাইসু: এই রকম হতে পারে যে গৌণ লেখকের কালের মূখ্য লেখক আপনি, এরকম হতে পারে?

হক: না আমি তো মেনে নিয়েছি সেটা বলিনি। কথাটা শোনো, পরিষ্কারভাবে শোনো। গৌণ লেখকের কাল, আমাকে ধরেই বলছি। কিন্তু আমি গৌণ লেখক নিজেকে বলছি না। হয়তো মে বি আই এম ট্রায়িং টু কাম আউট। সেটা তোমার নিজের পড়ার ওপর ডিপেন্ড করবে আমার লেখা। যে এটা গৌণ লেখকের কাল। আবার একই সঙ্গে একটি কথাও বলেছি যেটা পাশ কাটিয়ে গেলে। যে এটারও গুরুত্ব আছে। এবং এলিয়টের সমালোচনা যদি পড়ি, এলিয়ট বলেন, যে প্রধান লেখকেরা একটি বাঁক ফিরিয়ে দেন। কিন্তু সে বাঁকটি ফেরাবার পরে ধারাকে এগিয়ে নেয়া এটা গৌণ কাজ। এবং সেটাও কিন্তু সমান জরুরি। এটা কোনো অংশে কম জরুরি নয়। এবং আমি মনে করি এখন সেই কাজটাই হচ্ছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে নানা রকম অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে যে আমরা গেছি, আমাদের সমাজ, সংসার, দেশ, রাষ্ট্র, রাজনীতি, মূল্যবোধ সমস্ত কিছু। গল্প উপন্যাস নাটক কবিতার ফর্ম সবকিছুতে একটা ভঙ্গি আমরা আবিষ্কার করে ফেলেছি। এবং এই ধারাটাই সবাই আমরা এগিয়ে নিয়েছি। সেটা গৌণ লেখকের কাজ। কিন্তু হয়তো কেউ না কেউ এর ভেতর থেকে একটা বাঁক ফেরাতে পারবে। কিন্তু আমি খুব ডিসাপয়েনটেড। এটা আসা উচিত ছিল। বিশেষ করে এই বাংলাদেশে, এই বাংলাদেশে আসা উচিত ছিল, আমার এই বাংলাদেশ। আমার এই বাংলাদেশের কথা এই জন্যে বলছি যে, আমার এই বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা, জীবনের অভিজ্ঞতা, কালের অভিজ্ঞতা অনেক বেশি। অনেক বিস্তৃত। আমাদের এই বাংলাদেশ; এখনেই আসা উচিত ছিল। এখানেই আসা উচিত ছিল। আজকে দেখো না কত রকম, অনেক। এই কিছু দিন ধরে আমি সব জায়গায় দেখেছি এই যে তারামন বিবি বেরোলেন। কিন্তু দ্যাখো মুক্তিযুদ্ধের এতো গল্প উপন্যাস লেখা হয়েছে। কিন্তু কোথাও তুমি নারীচরিত্র পেয়েছো। নারীকে দেখেছো ধর্ষিতা, না হলে পালাচ্ছে।

রাজু: আপনার উপন্যাসেও তো তাই ছিল হক ভাই?

হক: না না না অসম্ভব কথা। গো ব্যাক এন্ড রিড মাই বুকস। আমি যখন বলছি ইট মাস্ট দ্যাট আই এম ভেরি মাচ অ্যাওয়ার অফ দিজ। কোথাও তুমি পাওনি। গৌণ লেখকদের কথা বলছি। এসব হচ্ছে মিডিওকারদের লেখা। একটা জিনিস হওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে যে দশ লক্ষ নারী ধর্ষিতা; কাজেই নারী মানেই ধর্ষিতা। কিন্তু আজকে যখন তারামন বিবি এসেছেন, ইভেন টুডে, কোনো গল্পে তুমি মুক্তিযোদ্ধা নারী খুঁজে পাওনা। আমি একটা কমন উদাহরণ দিলাম। এটা এস্কেপ করে গেছে। তারপরে যেমন ধরো এই যে বাংলাদেশের বাঙালি মুসলমানের যে আধুনিকতার সঙ্গে যুক্ত হবার প্রসেস, এটা কোনো গল্প উপন্যাসে পাওনি।

রাইসু: এইটা কি রশীদ করীম একটু চেষ্টা করছেন?

হক: কিছু এদিক ওদিকে চেষ্টাতো অনেকেই করেছেন, কিন্তু খালি জিনিসটা বুঝলেও তো হবে না। এটা আবার প্রকাশের একটা দিক আছে, শিল্পের দিক আছে।

রাইসু: আপনি কি রশীদ করীমের সমালোচনা করলেন?

হক: না না। শুধু বুঝলেই হবে না। রশীদ করীম এটা করতে পারেননি। পারলেতো আমি বলতাম না। উনি পারেননি।

রাইসু: বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে আধুনিকতার যে প্রবেশ, অনুপ্রবেশ সেইটা তুলে ধরেন নি?

হক: এই ক্ষেত্রটাই তুলে ধরেননি। অথচ এটা একটা মেজর এক্সপিরিয়েন্স, এই বাংলাদেশের জন্যে। বাংলাদেশে আমাদের একা মেজর এক্সপিরিয়েন্স। যা আমাদের জীবদ্দশায় যে আমরা যখন লিখতে শুরু করি। আমাদের লেখার জন্য আমি এটা অনুভব করেছি পরতে পরতে। যে এই যে আমার পাঠক, এই যে মানুষ একে আধুনিকতার সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। সমসাময়িকতার সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। কবিতার ক্ষেত্রে কায়কোবাদ, গোলাম মোস্তফার খপ্পরে পড়ে আছে কবিতা, উপন্যাসের ক্ষেত্রে নজিবর রহমানের কাছে পড়ে আছে। নাটকের ক্ষেত্রে ইব্রাহিম খাঁর কাছে পড়ে আছে। মনে করো তেপ্পান্নো সালে, আজকে তেহাত্তর সালে দেখো আমার লেখায় তুমি অস্তিত্ববাদ খুঁজে পাচ্ছো। আমার লেখায় তোমরা এটা আবিষ্কার করছো। উত্তরাধুনিকতা, ম্যাজিক রিয়ালিজম নানান রকমের কথা বলছো। ভাবতে পারো এই অবস্থাটা, যে কুড়ি বছরে বোধহয় এই কাজটা আমাকে করতে হয়েছে। এবং আমাকে। হ্যাঁ, আমাকে। হ্যাঁ আমাকেই করতে হয়েছে। আরো অনেকে করেছেন। কিন্তু আমি বলছি আমার দায়িত্ব যে আমাকেই করতে হয়েছে, উপন্যাস কবিতা নাটককে এক্সেপ্টেবল করতে হয়েছে। আজকে যখন বলো আপনার এই গল্প বিশ্বমানের গল্প, তুমি একবার চিন্তা করে দ্যাখো এই যে নজিবর রহমানের ‘আনোয়ারা’ থেকে মাত্র কুড়ি বছরের ভেতরে তোমাকে বলতে হচ্ছে। ইউ মে বি রাইট অর রং। আজকে আমার প্রসঙ্গে, তুমি আমাকে নিন্দা করবার জন্যে যদি ষাট-এর কথা বলো, তুমি এটা ভাবতে পারো যে একজন বাঙালি মুসলমান লেখকের প্রসঙ্গে জাঁ পল সার্ত্রের নাম উচ্চারণ করছো। এটা কুড়ি বছরে আমাকে করতে হয়েছে। আই টেক ফুল ক্রেডিট এন্ড রেসপনসিবিলিটিজ। তাই বলে আমি একা নই। দেয়ার আর আদার্স। কিন্তু আমি আমার কথা বলছি বলে আমার কথা বললাম। এবং এটা আমাকে দেবে। তারপর তোমরা একটা জিনিস ভুলে যাও যে পঞ্চাশের দশকে, বাংলা ভাষার উপরে যে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ষড়যন্ত্র চলেছে, বাংলা ভাষাকে নষ্ট করে দেবার জন্য সরকারিভাবে পাকিস্তানিরা নানারকম কৌশল ষড়যন্ত্র করেছে, সেখানে আমার লেখা যত খারাপই হোক আমি যদি অ্যাকসেপ্টেবল স্ট্যান্ডার্ড বেঙ্গলিতে লিখে থাকি দ্যাট ইজ মাই ফাইট। আজকে তুমি যখন লিখছো তখন তুমি জানবে যে-মাটিতে তুমি দাঁড়িয়েছো সে মাটি, পলিমাটির ওপরে আমার রক্ত। ‘৫০-এর দশকে, দেয়ার ইজ এ গ্রেট কনট্রিবিউশন অফ দি রাইটার্স অফ ফিফটিজ। এটা কিন্তু কখনই আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত হবে না। এইভাবে দেখতে হবে। ইফ ইউ ওয়ান্ট টু লুক এট দি রাইটিংস অফ ফিফটিজ তা হলে এভাবে দেখবে। যেমন ধরো আমি এখনো লিখে যাচ্ছি। সেটা অন্য প্রসঙ্গ অন্য গুরুত্ব। অন্য সময়ের ব্যাপারে আসে। কিন্তু আদি কাজটাকে আমাদেরই ধরতে হয়েছে। ভাষাটাকে তাতে পাওয়া। সমসাময়িকের সঙ্গে যুক্ত করা, সেটাকে রক্ষা করা। আধুনিকতার সঙ্গে এই দেশের মানুষকে পরিচয় করিয়ে দেয়া। এবং এটা শুধু সাহিত্য নয়, শিল্পের ক্ষেত্রেও লাগে।

রাজু: আপনার ঐ আব্দুল খালেক এটা গ্রন্থাকারে কবে নাগাদ বেরোবার সম্ভাবনা?

হক: আরো কিছু গল্প হোক। এটাতো তোমার খুবই সমসাময়িক কোনো না কোনো ঘটনা সম্পর্কে একটা গল্পের আকারে আমার কিছু পর্যবেক্ষণ বলা যায়। তো হোক আরও কিছু, জমুক না।

রাইসু: আচ্ছা হক ভাই, বেইলি রোডের যে নাটকগুলো হচ্ছে এগুলো বেসিক্যালি মধ্যবিত্তের এক ধরনের ইয়ের চর্চা কিনা মানে সময়ের চর্চা, আপনি কি বলেন?

হক: না, সেই সমালোচনা করলে কবিতা সম্বন্ধেও তাই করবে, পেইন্টিং সম্বন্ধেও তাই করবে। এভাবে বলা যায় না। এভাবে বলা যাবে না। মধ্যবিত্তের বিলাস চর্চা যদি বলো তবে অনেক কিছুই মধ্যবিত্তের বিলাসের ভেতরে আবার ঢুকে যাবে। অনেক কিছুই চলে যাবে, যেটা ডেঞ্জারার্স।

রাইসু: শিল্পচর্চার মধ্যেই মনে হয় এই ব্যাপারটা, এই সমস্যাটা আছে। এটাকে কোনো সমস্যা মনে করেন না আপনি?

হক: আমি মনে করি না। কারণ হচ্ছে যখন তুমি কবিতা লিখছো তখন তোমাকে কতগুলো জিনিসতো ধরেই নিতে হচ্ছে। কবিতা যদি ছাপা হয় লোকটা পড়তে জানে। পড়তে জানার পর কবিতা সম্পর্কে তার আগ্রহ আছে। কবিতা সম্পর্কে তার ধারণা আছে। অনেকগুলো জিনিস ধরে নিচ্ছো না? বেইলি রোডে যখন নাটক হচ্ছে তখনো এ রকম কতগুলো জিনিস ধরে নিচ্ছো। কারা আসছেন কিভাবে আসছেন। তবে এটা ঠিক বেইলি রোড দিয়ে বিচার করা যাবে না। কারণ আমরা এখনো নাটকের যে কতগুলো বাস্তব দিক আছে, মঞ্চ বলো, তারপরে সংগঠন বলো এগুলোর ব্যাপারে খুব বেশি দূর অগ্রসর হতে পারিনি আমরা। এটা হলে তখন বলা যেত। এখন তুমি এই যে বলছো শেক্সপিয়র তো রাজার দরবারে নাটক করেছেন তাই বলে যদি তুমি বলে যে অভিজাত শ্রেণীর চর্চা, তাতো নয়। কাজেই এভাবে একেবারেই সামনাসামনি মিলিয়ে একটা কিছু বলা যাবে না।

রাইসু: তা হলে আর্থ-সামাজিক অবস্থাটা বিচার না করাই ভালো?

হক: না আর্থ-সামাজিকের কথা তো বলছি না। এটা হচ্ছে যে নাটকের ব্যাপারে কথা হচ্ছে। একটা নাটক করার জন্যে একটা জায়গা দরকার। সে জায়গাটা বেইলি রোড থেকে আবিষ্কার করা গেছে। ধরো ২৫ বছর ধরে হচ্ছে। কিন্তু এটাও ঠিক যে বাইরে বেরোবার জন্য এই লোকেরাই চেষ্টা করছে। আরো ১০টা মঞ্চ হোক, এরা বাইরে গিয়েই নাটক করবে। আজকে এদের নয়, সমস্ত বাংলাদেশে এমনকি গ্রামেও আজকে নাটক হচ্ছে। কাজেই শুধু একটা জায়গায় সীমিত হয়ে আছে আমি এভাবে দেখি না।

রাজু: এখন মানে কি ধরনের বইটই পড়েন আপনি লেখালেখির বাইরে?

হক: পড়াশোনায় তো আমার চিরকালের কতগুলো প্রিয় বিষয় আছে। যেমন, ইতিহাস একটা।

রাজু: ইতিহাস মানে কি বাংলার ইতহাস?

সৈয়দ শামসুল হক

হক
: বাংলার ইতিহাস ঠিক নয়। ভারতবর্ষের ইতিহাস। যদিও আমি অন্যান্য দেশের ইতিহাস সম্বন্ধে সমান উৎসাহী তবে এটা বিশেষভাবে আমি বোঝার চেষ্টা করি। তার ভিতরে বিশেষভাবে আমি গত দ’শ বছরের-দু’শ আড়াইশ’ বছরের বৃটিশ ঔপনিবেশিক কালের ইতিহাস। এটা আমার একটা প্রিয় সাবজেক্ট। তারপরে এই যেমন ধরো কবিতা এটা আমার। এটা লেখার প্রয়োজন বলে নয় এটা আমার যেমন পাঠক হিসেবে নিজের কাছেই নিজের অভিজ্ঞতাকে আরও স্পষ্ট করবার জন্যে কতগুলো জিনিস করি। ভাষাতত্ত্ব আমার একটি প্রিয় বিষয়। পড়াশোনার বিষয়। আর খুব বেশি বলতে পারছি না, যেমন ধরো গল্প উপন্যাস বা আমাদের ভাষাতে কবিতা যেগুলো লেখা হয়েছে এগুলোতে লেখালেখির ব্যাপারে আবার বিশেষভাবে কাজ করে যে আমি কোথায় দাঁড়িয়ে কাজ করছি। কি লেখা হচ্ছে না হচ্ছে এবং কাজের জন্যেই আমি করছি। আমি এ বিষয়গুলো বললাম। এটা একবারেই একজন পাঠক হিসেবে। যে কোনো বিষয় পড়তে ভালবাসি, আগ্রহী।

রাইসু: আচ্ছা হক ভাই, এখন তো আপনার ষাট বছর হলো, তাই না? এখন সাহিত্য করার ক্ষেত্রে আপনি কি ভঙ্গিটা নিচ্ছেন?

হক: ৬০ বছর হয়েছে বলে যে আমাকে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে তা না। আমি এইভাবে দেখিই না। আমার জন্মদিনকে এভাবে দেখিই না। আমি এখনো মনে হয় যে ২৭/২৮ বছর এরকম একটা সময় যে ধরনের মনোভাব আমার ছিলো যে ধরনের সজীবতা ছিলো এখনো আমি মনে করি যে আমার ভেতরে সেটাই কাজ করে। কাজেই ৬০ বছর হয়েছে বলে যে আমি একটা থমকে দাঁড়িয়ে নতুনভাবে ভাবছি এটা এ রকম নয়।

রাইসু: আর ৬০ বছর তেমন বয়সও না?

হক: আমি এটাকে এইভাবে দেখিই না। ষাট হয়েছে এটা তো ধরো সময়ের হিসেব গুনে বললে ৬০ হয়েছে।

রাইসু: এখন বোধহয় হক ভাই হাতে আর লেখেন না।কম্পিউটার ব্যবহার করেন?

হক: হ্যাঁ, টাইপরাইটারে লিখতাম ধরো নিয়মিতভাবে ১৯৭২ থেকে। তারপরে এসে ১৯৮৮-তে ওয়ার্ড প্রসেসিং মানে কম্পিউটার যাই বলো, সুইচের মাধ্যমে।

রাইসু: স্বস্তি পাচ্ছেন?

হক: না এটা একটা কলমের মতো। যেমন এক সময় নিব চুবিয়ে লিখতাম। বলপেনে লিখেছি। লেখার একটা যন্ত্র।

রাজু: মানে এই কম্পিউটারে আপনি কি কি সুবিধা পাচ্ছেন? আগের তুলনায়।

হক: না সুবিধা অসুবিধার দিকে যেও না।

রাজু: অসুবিধা হলে তো আপনি যেতেনও না।তাই না?

হক: না।

রাজু: সুবিধার কিছু আছে?

হক: সুবিধার কিছু নেই। লেখাগুলো কপি করতে পারছো। বার বার পড়তে পারছো। সংরক্ষণ করতে পারছো। এডিটিং-এর সুবিধা। প্রত্যেকটা লিখনযন্ত্রেরই একটা না একটা এডভান্টেজ থাকেই। এডিটিংয়ের সুবিধা আছে, তারপরে সংরক্ষণের সুবিধা আছে। মাল্টি কপি করার সুবিধা আছে।

রাইসু: সবচে বড় সুবিধা ছাপানোর সুবিধা আছে। মানে আবার তো কম্পোজ করতে হচ্ছে না।

হক: এ সুবিধাগুলো তো আছে। আমি খুব স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। অনেকে আমাকে প্রশ্ন করেন যে কলমে লিখে কি আপনি যথেষ্ট স্বচ্ছন্দে ছিলেন না। এবং সেটা কোনো ব্যাপার নয়। মানুষ লিখনযন্ত্রের উন্নততর রুপে সবসময় নিজেকে...।

রাইসু: আর হক ভাইতো লেখেন হৃৎকলমে? কি বলেন হক ভাই?

হক: হ্যাঁ। কলমতো হৃৎকলমই বটে। এটাও একটা শব্দ বোধহয়, না? অনেকে হৃদকমল বলে? এতে বোঝা যায় যে মানুষ কতটা অভ্যস্ত হয়ে যায় একটি শব্দে। এই হৃদকমল শুনতে শুনতে অনেকেই আমাকে বলে আপনার হৃদকমল পড়লাম।

রাইসু: অর্থ একই। একই অর্থ শেষ পর্যন্ত।

হক: আমার কাছে বেশ মজা লাগে যে মানুষ চোখে দেখেও কিভাবে অভ্যেসের কাছে পরাজিত হয়।

রাইসু: আমার মনে হয় মানুষ ছঁবি আকারে নেয় শব্দগুলোকে। চাইনিজদের মতো?

হক: সে তো বটেই, আমাদের পড়াওতো তাই। আমরা তো প্রতিটি অক্ষরকে বানান করে পড়ি না। একেকটা শব্দের ইমেজ আমাদের মাথার ভেতরে থাকে এবং সেই ইমেজটা আমরা দেখলেই বুঝি যে এটা হচ্ছে এই শব্দ।