টেম্পেস্ট থেকে হ্যারি পটার: জাদু থেকে জাদুতে

সেই রেনেসাঁসের যুগ থেকে কেমন করে লোক জীবনের জাদু বিশ্বাস সঞ্চরিত হয়েছে সাহিত্যের পাতায়, লেখকেরা যুগে যুগে কোন তাড়নায় সৃষ্টি করেছেন জাদু বাস্তবতা, তার সুলুক সন্ধানে ঢাকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্মেলনে বসেছেন সাহিত্য বিশারদরা।

চৌধুরী রুবাইয়াৎ আহমেদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 May 2016, 11:00 AM
Updated : 28 May 2016, 02:41 AM

‘ম্যাজিক অ্যান্ড লিটারেচার’ শীর্ষক এই আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করেছে ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস (ইউল্যাব)। শুক্রবার সকাল থেকে চলতে থাকা সমান্তরাল সেশনগুলোতে নানাভাবে উল্টে পাল্টে দেখা হচ্ছে জাদুর সঙ্গে সাহিত্য আর যাপিত জীবনের যোগাযোগ।       

কালজয়ী সব সাহিত্যকর্ম থেকে আলোচকরা এ সম্মেলনে হাজির করছেন পাঠকের মানসপটে স্থায়ী আসন করে নেওয়া সব জাদুময় চরিত্রদের। শতাধিক শিক্ষার্থী, শ্রোতা, দর্শক, সংবাদকর্মীকে জাদুর জগতে নিয়ে যেতে আক্ষরিক অর্থেই জাদু দেখালেন কেউ কেউ।

“মানুষের জীবন জাদুময়। দৈনন্দিন জীবনযাপনে প্রতিনিয়তই সচেতন কিংবা অবচেতনে একে বহন করি আমরা। এই যে রাশিফল দেখে মনের মধ্যে এক ধরনের শুভ কিংবা সতর্কতাবোধ নিয়ে আমরা অনেকেই ঘুরে বেড়াই, সে তো জাদুই, নাকি?”

সম্মেলনের সূচনা বক্তব্যে এভাবেই জাদু আর সাহিত্যের আত্মীয়তা খোঁজার সূচনা করেন ইউল্যাবের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সামসাদ মর্তুজা। উদ্বোধনী বক্তব্য দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপচার্য অধ্যাপক ইমরান রহমান।

ভারতের রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সুবীর কুমার ধর তার মূল প্রবন্ধে শ্রোতাদের নিয়ে যান সেই ষোড়শ শতকে, পুনর্জাগরণের কালে।  তার প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল ‘দি আর্ট অব ইলিউশন ইন রেনেসাঁস ইংল্যান্ড: আ পারফরমেটিভ রিক্রিয়েশন’।

পাথর উধাও করে দেওয়ার গল্পে শুরু করে বেকন, মার্লো, শেকসপিয়র, চসার, বেন জনসন হয়ে নিৎশে এবং হাল আমলের জে কে রাউলিং পর্যন্ত এসে ঠেকে তার বিশ্লেষণ।

ইতিহাসের পাঠ ঘেঁটে সুবীর বলেন, মধ্যযুগেও ইংল্যান্ডে প্রাতিষ্ঠানকিভাবে ম্যাজিক বা জাদু শিক্ষার প্রচলন ছিল। এর সঙ্গে যুক্ত ছিল অর্থনৈতিক কারণও। পেশাদার ম্যাজিশিয়ানরা যেমন জাদু দেখিয়ে অর্থ উপার্জন করতেন, তেমনি ব্যবহৃত হয়েছে মানুষকে ঠকানোর কৌশল হিসেবেও। সেই ষোড়শ শতকেও ইংল্যান্ড-স্কটল্যান্ডের রাস্তায় জাদু দেখানো হতো। মানুষ অবাক হয়ে সেই জাদু দেখত, আর সুযোগ মতো তাদের পকেট কাটত জাদুকরের চ্যালারা।

সেসব দিনেই জাদু সংক্রমিত হয়েছিল ইংরেজি সাহিত্যে। ক্রিস্টোফার মার্লো তার ‘ড. ফস্টাস’ নাটকে নরকের অধিপতি লুসিফারের কাছে আত্মা বিক্রি করে দেওয়া মহাজ্ঞানী ফস্টাস মেফিসটোফেলিসের মাধ্যমে নানা ধরনের জাদু দৃশ্য ব্যবহার করেন। উড়ে যাওয়া, অদৃশ্য হয়ে যাওয়া কিংবা কোনোকিছু উধাও করে দেওয়ার দৃশ্য সেখানে দেখা যায়।

শেকসপিয়রের ‘ম্যাকবেথ’ কিংবা ‘দ্য টেম্পেস্ট’ এবং ‘হেনরি দ্য ফোর’ নাটকে জাদু দৃশ্যের অবতারণার কথাও মনে করিয়ে দেন সুবীর ধর। ম্যাকবেথের ডাকিনীরা, ব্ল্যাক মিরর, চলমান বন তার ভাষায় ‘জাদুরই নামান্তর’।

“ম্যাকবেথে সৃজনশীলভাবে জাদুর ব্যবহার হয়েছে। স্কটল্যান্ডের সামাজিক বিশ্বাসের পাশাপাশি নাটকীয় কৌশল হিসেবে জাদু ব্যবহৃত হয়েছে,” বলেন সুবীর।

 

“দ্য টেম্পেস্টে দেখা যায়, নির্বাসিত রাজা প্রসপেরো জাদুবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে হাওয়াপরী এরিয়েল এবং ক্যালিবানকে নিয়ন্ত্রণ করছেন। প্রসপেরোর সেই ম্যাজিক বা মায়াবিদ্যা শুভ অর্থে ব্যবহৃত হয়। প্রসপেরোর ম্যাজিক আর্ট। সেটা জ্ঞানের ফলে অর্জিত। অর্থাৎ, জাদুবিদ্যা বা ম্যাজিক বলতে অনেকের ভেতরেই যেমন অশুভ কোনোকিছুর আভাস সৃষ্টি করে তেমনটা নাও হতে পারে যদি প্রয়োগ শুভঅর্থে হয়।”

সুবীর বলেন, মার্লো মনে করতেন ধর্ম মূল্যবোধ সৃষ্টি করে। অর্থাৎ, এক ধরনের নীতিবোধের শিক্ষা দেয়। ফস্টাস, মেফেসটোফিলিসকে যে আহ্বান জানান, সেটা ‘একইসঙ্গে ধর্মীয় ভাবধারার এবং অবশ্যই ও জাদু বিশ্বাসের অন্তর্গত’।

“রেনেসাঁসের শিক্ষা হচ্ছে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং বাহিরকেও নিয়ন্ত্রণ করা নিজের শুভ ইচ্ছার দ্বারা,” বলেন তিনি।

সাহিত্যের এই অধ্যাপকের মতে, ‘ফ্যান্টাসি ওয়ার্ল্ড’ আসলে বাস্তব পৃথিবীর খুব কাছাকাছি।

“আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে ফ্যান্টাসির মিশেল যদি আরোপিত হয়, তবে তা ননসেন্সে পর্যবসিত হয়। জেকে রাউলিং এই বিষয়টি জানেন। এ কারণেই দক্ষতার সঙ্গে হ্যারি পটার সিরিজে ফ্যান্টাসি ও জাদুর অসামান্য মিশ্রণ ঘটাতে সক্ষম হয়েছেন।”

সুবীর বলেন, সাহিত্যিক ও জাদুকর দুজনেই আসলে জাদু সৃষ্টি করেন। দুজনের মাধ্যম ভিন্ন হলেও লক্ষ্য অভিন্ন।

প্রবন্ধ উপস্থাপন শেষে তিনি নিজেই জাদু প্রদর্শন করেন। এক সময় জাদু দেখাতেন, বলেন সেই অভিজ্ঞতার কথাও।

এরপর ‘ম্যাজিক অ্যান্ড কালচার’ সেশনে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ফকরুল আলম।

এ পর্বে ইউল্যাবের সেন্টার ফর ল্যাংগুয়েজ স্টাডিজের পরিচালক এটিএম সাজেদুল হক একটি মাল্টিমিডিয়া উপস্থাপনা দেখান, যার উপজীব্য ছিল রবার্ট জর্ডানের ‘হুইল অব টাইম’ বইয়ে জাদুচক্রের উপস্থাপনা।

ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির ইংরেজির শিক্ষক নাজুয়া ইদরিস ‘দ্য ফেইরি অ্যাবিলিটি টেলস: রি-কনসেপচুয়ালাইজিং ডিস/অ্যাবিলিটি থ্রো ম্যাজিক’ এবং নর্থ সাউথ ইউনির্ভার্সিটির ইংরেজির শিক্ষক নাজিয়া মনজুর ‘ফুকোস হেটেরোটোপিয়া অ্যান্ড হ্যারিপটারস ফ্যান্টম’ শিরোনামে দুটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এরপর।

ইউল্যাবের এই জাদুময় দিনে কক্ষে কক্ষে চলে জাদু আলোচনা। ‘ম্যাজিক অ্যান্ড পপুলার কালচার’, ‘ম্যাজিক রিয়েলিজম’, ‘ম্যাজিক অ্যান্ড কমোডিটি’, ‘ম্যাজিক অ্যান্ড মেমরি’, ‘ম্যাজিক অ্যান্ড রেজিস্টেন্স’, ‘ম্যাজিক অ্যান্ড রিয়েলিটি’, ‘ম্যাজিক অ্যান্ড নেচার’, ‘ম্যাজিক অ্যান্ড শেকসপিয়র/ দ্য রেনেসাঁস’, ‘ম্যাজিক অ্যান্ড ন্যারেটোলজি/টেক্সচুয়ালিটি’ শিরোনামে একের পর একে সমান্তরাল সেশনে ঘুরে ঘুরে পাঠক-শ্রোতারা নেন জাদুর পাঠ।

বিকালের শেষ পর্ব ‘বাংলা সাহিত্যে জাদু’ শীর্ষক প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন কবি মোহাম্মদ রফিক, কবি শামীম রেজা ও কবি রাজু আলাউদ্দিন। সঞ্চালনায় ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানের গ্র্যান্ড ভ্যালি স্টেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষক আজফার হোসেন।

কেবল সাহিত্য বা জাদুর আলোচনা নয়, ইউল্যাবের লবিতে চলছে শিল্পী লায়লা শারমীনের ভিডিও আর্ট ইন্সটেলেশন ‘সোনার কাঠি, রূপার কাঠির রাজকন্যা’।

শনিবার একই ভেন্যুতে ক্যারিবিয়া, লাতিন আমেরিকা আর মেক্সিকোর সাহিত্যে জাদু বাস্তবতার আলোচনায় শুরু হবে দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠানমালা।

দুই দিনের এই আন্তর্জাতিক সম্মেলনে গণমাধ্যম সহযোগী হিসেবে রয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।