চিত্রনাট্য: জীবনানন্দ দাশের ‘আমার এ ছোটো মেয়ে’

fauzia_khan
Published : 21 May 2008, 11:46 AM
Updated : 21 May 2008, 11:46 AM


জীবনানন্দ দাশ (১৭/২/১৮৯৯–২২/১০/১৯৫৪)

ভূমিকা
জীবনানন্দ দাশের কবিতার সাথে আমার পরিচয় যখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। ১৯৯৩ সাল। বাংলা বিভাগে তৃতীয় সম্মানের পাঠ্যসূচীতে তিরিশের পাঁচ কবির কবিতার একটি অপশন্যাল কোর্স ছিল। কোর্সটি পড়াতেন প্রয়াত শিক্ষক ড. হুমায়ূন আজাদ। অপশন্যাল হলেও কোর্সটি নিয়েছিলাম। কারণ হুমায়ুন আজাদ পড়াতেন। তিনি নম্বর কম দিতেন বলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই কোর্সের ব্যাপারে তেমন আগ্রহ ছিল না। আমরা বিশ/পঁচিশ জন হবো যারা ওই কোর্সটি নিয়েছিলাম। হুমায়ুন আজাদের অনেক কিছু আমরা অপছন্দ করলেও তাঁর পাঠদান পদ্ধতির খুব ভক্ত ছিলাম আমরা। তিনি যে নিপুণ দক্ষতার সাথে আমাদের ভাষাবিজ্ঞান পড়িয়েছেন — ঠিক একই দক্ষতায় তিরিশের কবিদের কবিতার কোর্সটি পড়িয়ে এই কবিদের সম্পর্কে আমাদের মধ্যে নিবিড় এক আগ্রহও তৈরি করেছিলেন। তাঁর শিক্ষকতার গুণেই বলা চলে জীবনানন্দীয় ভুবনের সাথে আমার অন্তরঙ্গ পরিচয় ঘটেছিল।

১৯৯৫ সাল। মাস্টার্স শেষ বর্ষের কোর্স ফাইন্যাল পরীক্ষা চলছে। এক মাস অন্তর একটি পরীক্ষা হতো। দুই মাসে দুটি কোর্সের পরীক্ষা দেবার পর ভারত সরকারের বৃত্তি পেয়ে সবকিছু ছেড়েছুঁড়ে পুনায় চলে যাই চলচ্চিত্র পড়তে। দর্শক হিসেবে ফিল্ম দেখতাম অনেকদিন ধরেই — কিন্তু ফিল্ম পড়ার কোনো প্রস্তুতিই তখন ছিল না আমার। সুতরাং পুনায় প্রথম তিন মাস খুব কষ্টে কেটেছে। নিজেকে ফিল্ম পড়ার উপযোগী করে তোলার জন্য প্রতিদিন প্রাণান্ত চেষ্টা করতে হয়েছে। এই প্রাণপাত চেষ্টার সময় বাংলা সাহিত্য পড়ার অভিজ্ঞতা ভীষণভাবেই সহায়ক হয়েছিল। সাহিত্য এবং চলচ্চিত্র। দুই ভিন্ন মাধ্যম। তবুও সাহিত্য পাঠের অভিজ্ঞতাই চলচ্চিত্রকে বুঝতে আমার হাতে একটি উজ্জ্বল আলোর বর্তিকা তুলে দিয়েছিল। পাঠক, ইতোমধ্যেই নিশ্চয় ভাবতে শুরু করেছেন যে, ধান ভানতে গিয়ে শিবের গীত গাইতে শুরু করেছি। ফিরে যাই 'আমার এ ছোটো মেয়ে'-র চিত্রনাট্য লেখার প্রসঙ্গে।

পুনায় আমাদের প্রথম বর্ষের কোর্সটি ছিল সমন্বিত কোর্স। সবাইকে সবকিছু পড়তে হতো। যে সম্পাদনা পড়তে গেছে কিংবা সিনেমাটোগ্রাফি বা সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং অথবা চিত্রনাট্য রচনা ও পরিচালনা — তাকে প্রথম বর্ষে আসলে সবকিছুই পড়তে হতো। তত্ত্ব তো বটেই — তবে পাঠক্রমে প্র্যাকটিক্যাল দিকটারই প্রাধান্য ছিল বেশি। প্রথম বর্ষের কোর্স সমাপনী হিসেবে সব শিক্ষার্থীকেই ১৬ মি.মি. ফরম্যাটে পাঁচ মিনিটের একটি কাহিনীচিত্র বানাতে হতো। প্রথম বর্ষের কোর্স সমাপনী ওই চলচ্চিত্রের জন্য জীবনানন্দ দাশের এই কবিতা 'আমার এ ছোট-মেয়ে' নির্বাচন করেছিলাম। দুঃখের বিষয় যে তখন আসলে কাজটি করতে পারিনি। কারণ এটি চিত্রায়নের জন্য ডিজলভ, সুপার ইমপোজ এবং ফেইড ইন-ফেইড আউটের মতো স্পেশাল ইফেক্ট-এর ব্যবহার জরুরি ছিল। কিন্তু পুনায় প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা এই স্পেশাল ইফেক্টগুলো ব্যবহারের সুযোগ পেত না। এটা আজ থেকে তের বছর আগের ঘটনা বলছি। তখনো ফিল্ম ফরম্যাটের সনাতন রীতিতে পুনায় পড়ানো হতো — ডিজিট্যাল টেকনোলজির ব্যবহার পাঠক্রমে শুরু হয়নি। কেবল কাট টু কাট রীতিতে ছবি বানাবার সুযোগ পেত প্রথমবর্ষের শিক্ষার্থীরা। তাই ১৯৯৫ সালে 'আমার এ ছোট-মেয়ে'-র চলচ্চিত্রায়ণ করতে পারিনি।

২০০৬ সালে আমার স্বামী মোসাদ্দেক মিল্লাত ভিডিও প্রযোজনার সংস্থা রে ভিশনের গোড়াপত্তন করেন এবং ভিডিও প্রযোজনার জন্য কিছু যন্ত্রপাতি কেনেন। এই যন্ত্রপাতির ভরসায় আমি পূর্ণকালীন চাকরি ছেড়ে দিই এবং নিজের মতোন করে কিছু ছবি বানাবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করি। 'আমার এ ছোটো মেয়ে' আবার আমার মাথায় ঘুরতে শুরু করে। একদিন আধাবেলা কম্পিউটারে বসে এর চিত্রনাট্যটি লিখে ফেলি। রে ভিশনের ক্যামেরা আছে, আছে সম্পাদনার যন্ত্র। এগুলো ছাড়াও ছবি বানাতে আরো কিছু নগদ টাকা লাগে। কোথায় পাব সেই টাকা? নুন আনতে পান্তা ফুরোবার উপক্রম হয় হয় যার তার শিল্পক্ষুধা মেটাবার জন্য ভাত কেনার টাকা থেকে বিপদের দিনে কাজে লাগাবার উদ্দেশ্যে জমিয়ে রাখা টাকা খরচ করা কঠিন। যদিবা সেই কঠিন দুঃসাহস করেও বসি তবে তারপরে আসলে কী? ছবি তো কেবল নির্মাণ করলেই হয় না — সেই ছবি দর্শকের কাছেও পৌঁছানো চাই। ছবি দর্শকের কাছে পোঁছাবার জন্যও নগদ কড়ি ফেলতে হয়। বাংলাদেশে আমার মতোন অভাজন চলচ্ত্রিকারের এই ধরনের মুক্ত চলচ্চিত্রের পিছনে টাকা লগ্নি করার কোনো আয়োজন নেই। আর জীবন ও জগতের নানান ঘূর্ণাবর্তেও আবর্তে আমার সঞ্চয়েও ভাটার টান পড়েছে। আমি তাই 'আমার এ ছোটো মেয়ে'-র চিত্রনাট্যটি এখোনো পর্যন্ত চলচ্চিত্রায়িত করিনি। তবে সেই স্বপ্ন এখনো আমার আছে।

২.
কচিৎ-কদাচিত দু'একটি জায়গায় সম্পাদনা বিষয়ে ক্লাশ নেবার ডাক পাই আমি। সেখানে তরুণ চলচ্চিত্রপ্রেমীদের কারোর কারোর সাথে আলাপচারিতার সুযোগ হয়। সেই সব আলাপচারিতায় তাদের অনেকেই তাদের নানান রকম কাহিনী চলচ্চিত্রায়ণের স্বপ্নের কথা শোনায় আমাকে। তারা বলে, ভাবনাটি কিংবা কাহিনীটি কীভাবে চিত্রনাট্য আকারে লিখবে সেটি তারা বুঝে উঠতে পারে না। মূলত আমার সেইসব সুহৃদদের সামান্য হলেও কাজে লাগতে পারে ভেবে 'আমার এ ছোট-মেয়ে' প্রকাশিত হলো। এটি প্রকাশিত হলো বটে — এটি চিত্রায়ণের কোনো অনুমতি আমি কাউকে দিচ্ছি না। এ-বছর শেষ নাগাদ 'আমার এ ছোট-মেয়ে' চিত্রায়ণের বাসনা রাখি। আশা করি আমার এই বাসনা পূরণে আপনাদের সমর্থন পাবো।

ফৌজিয়া খান
পুরানা পল্টন, ঢাকা ১৯/৫/২০০৮

কবিতা: আমার এ ছোটো মেয়ে/জীবনানন্দ দাশ

আমার এ ছোটো মেয়ে — সব শেষ মেয়ে এই
শুয়ে আছে বিছানার পাশে —
শুয়ে থাকে — উঠে বসে — পাখির মতন কথা কয়
হামাগুড়ি দিয়ে ফেরে
মাঠে মাঠে আকাশে আকাশে।….

ভুলে যাই ওর কথা — আমার প্রথম মেয়ে সেই
মেঘ দিয়ে ভেসে আসে যেন
বলে এসে: 'বাবা, তুমি ভালো আছ? ভালো আছ? — ভালোবাসো?'
হাতখানা ধরি তার: ধোঁয়া শুধু কাপড়ের মতো শাদা মুখখানা কেন!

'ব্যথা পাও? কবে আমি মরে গেছি — আজও মনে কর?'
দুই হাত চুপে চুপে নাড়ে তাই
আমার চোখের 'পরে, আমার মুখের 'পরে মৃত মেয়ে;
আমিও তাহার মুখে দু'হাত বুলাই;
তবু তার মুখ নাই — চোখ চুল নাই।

তবু তারে চাই আমি — তারে শুধু — পৃথিবীতে আর কিছু নয়
রক্ত মাংস চোখ চুল — আমার সে মেয়ে
আমার প্রথম মেয়ে — সেই পাখি — শাদা পাখি — তারে আমি চাই;
সে যেন বুঝিল সব — নতুন জীবন তাই পেয়ে
হঠাৎ দাঁড়াল কাছে সেই মৃত মেয়ে।

বলিল সে: 'আমারে চেয়েছ, তাই ছোটো বোনটিরে —
তোমার সে ছোটো-ছোটো মেয়েটিরে এসেছি ঘাসের নিচে রেখে
সেখানে ছিলাম আমি অন্ধকারে এত দিন
ঘুমাতেছিলাম আমি' — ভয় পেয়ে থেমে গেল মেয়ে,
বলিলাম: 'আবার ঘুমাও গিয়ে —
ছোটো বোনটিরে তুমি দিয়ে যাও ডেকে।'

ব্যথা পেল সেই প্রাণ — খানিক দাঁড়াল চুপে — তারপর ধোঁয়া
সব তার ধোঁয়া হয়ে খসে গেল ধীরে ধীরে তাই,
শাদা চাদরের মতো বাতাসেরে জড়ায় সে একবার
কখন উঠেছে ডেকে দাঁড়কাক —
চেয়ে দেখি ছোটো মেয়ে হামাগুড়ি দিয়ে খেলে — আর কেউ নাই।

—————————————————————–
চিত্রনাট্য: আমার এ ছোটো মেয়ে
—————————————————————–

রাত। একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের শোবার ঘর। বিছানার উপর তিনজন মানুষ শুয়ে আছে। একজন নারী, একজন পুরুষ। নারী-পুরুষ পরস্পর পরস্পরের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে আছে।

মধ্যখানে একটি শিশু এক-দেড় বছরের একটি বাচ্চা মেয়ে। দূর থেকে মনে হচ্ছে সকলেই ঘুমাচ্ছে। জানালায় পাতলা সাদা পর্দা। হালকা বাতাসে মিহি উড়ছে। দূরে কোথাও কুকুর ডাকার শব্দ শোনা যায়। রাতপোকাদের মৃদু গুঞ্জন।

ক্যামেরা ধীরে ট্র্যাক করে খাটের একপাশে আসে — যে পাশে পুরুষটি শুয়ে। ক্যামেরা আরো ট্র্যাক ইন করলে দেখা যায় যে ভদ্রলোক ঘুমাচ্ছেন না; প্রায় চল্লিশ বছর বয়সী মানুষটি কাত হয়ে শুয়ে চোখ চেয়ে তাকিয়ে আছেন একদিকে। তার ওপাশে ঘুমন্ত স্ত্রীর গভীর শ্বাস-প্রশ্বাসের মিহি শব্দ পাওয়া যায়। দূরে কুকুর ডাকার শব্দ শোনা যয়। লোকটি পাশ ফিরে চিৎ হয়ে শোয়। অল্প পরেই সন্তানের দিকে পাশ ফেরে। মেয়ে বাবার দিকে কাত হয়ে শুয়ে — ঘুমুচ্ছে। বাবা নরম হাতে মেয়ের শরীরে হাত বুলায়। বুলাতেই থাকে। ক্যামেরা স্লো ট্র্যাক ইন-এ বাবার মুখে ধরে। মেয়ের শরীর আলতো হাতে বুলাতে বুলাতে পলকহীনভাবে আনমনা চেয়ে থাকে ক্যামেরার দিকে — ধীরে — অতি ধীরে বাবার চোখে জুম ইন হতে থাকে। কাট টু/ ডিজলভ টু –

একটি ছোটো বাচ্চা মেয়ে — বয়স এক দেড় হবে; হাসে দৌঁড়ায়, হামাগুড়ি দিয়ে বেড়ায়। কলকলিয়ে কথা বলে — কাঁদে। সবুজ ঘাসে ঢাকা মাঠে ছুটে বেড়ায়, সাদা ফ্রক পরা এটি মেয়ে। কাট টু/ ডিজলভ টু –

আকাশে সাদা মেঘ — মেঘের ওড়াওড়ি। ডিজলভ টু — সাদা ধোঁয়া — কুণ্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া উড়ছে। ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে ভেসে ওঠে ৪/৫ বছরের একটি মেয়ের মুখ — ক্রমশ ধোঁয়া মিলিয়ে যায়। মেয়েটি সবুজ মাঠের ভেতর দিয়ে ধীর পায়ে হেঁটে আসে — ক্যামেরার খুব কাছে এসে লেন্সের দিকে চোখ রেখে বলে — 'বাবা, তুমি ভাল আছো? ভাল আছো? — ভালবাস?' বাবা হাত বাড়িয়ে মেয়ের হাত ধরে — ধোঁয়ায় মিলিয়ে যায় মেয়ের মুখ। ক্রমে ধোঁয়াও মিলিয়ে যায় — ভেসে ওঠে — পানির ঢেউ ধির স্থির। সবুজ ঘাস ডুবে আছে তাতে। সেই ডুবন্ত ঘাসের মধ্যে ক্রমশ ভেসে ওঠে আবার মেয়ের মুখ। বলে, 'ব্যথা পাও? কবে আমি মরে গেছি — আজও মনে কর?' মেয়ের মুখ ডিজলভ টু –

মেয়ে বাবার মুখের উপর হাত বুলোয়, বাবাও মেয়ের চুল নেড়ে দেখে, মুখের উপর হাত বুলায়। হাত বুলাতেই থাকে মেয়ের পুরো শরীর জুড়ে, দৃশ্যটি ধীরে মিলিয়ে যায়। মিলিয়ে যায় সবুজ ঘাসও। ক্রমে ভেসে ওঠে প্রান্তর জুড়ে সবুজ মাঠ। মাঠে দৌঁড়ে বেড়াচ্ছে সাদা ফ্রক পরা ৪/৫ বছর বয়সী একটি বাচ্চা মেয়ে — দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে সে ক্যামেরার দিকে আসে। ক্যামেরার খুব কাছে এসে বলে, 'আমারে চেয়েছ তাই ছোটো বোনটিরে — তোমার সে ছোটো মেয়েটিকে রেখে এসেছি ঘাসের নিচে/সেখানে ছিলাম আমি অন্ধকারে এতদিন/ ঘুমাতেছিলাম আমি!' এই অডিও-র উপর ওভারল্যাপ বা সুপার ইমপোজ হবে পরের দৃশ্যটি —

একটি কবরস্থানের দৃশ্য — বাচ্চাদের সারিবদ্ধ কবর — কবরের উপর দিয়ে ক্যামেরা স্লো ট্র্যাক হবে।

কবরস্থানের দৃশ্য মিলিয়ে যায় ধীরে — ধীরে ফুটে ওঠে সাদা ধোঁয়ার মধ্যে মেয়েটির মুখ — বাবার কণ্ঠে শোনা যায়: 'আবার ঘুমাও গিয়ে — ছোটো বোনটিরে তুমি দিয়ে যাও ডেকে।' শুনে মেয়েটির মুখ বেদনার্ত হয় — চোখ ছাপিয়ে পানি পড়তে থাকে — ক্রমে সাদা ধোয়ার মধ্যে মেয়েটির বিষণ্ন মুখ মিলিয়ে যায়। পর্দায় শুধু সাদা ধোঁয়া। কাট টু/ ডিজলভস টু — আকাশে কালো/সাদা মেঘ। ডিজলভস টু — কবরস্থানের সবুজ সারিবদ্ধ কবর। ডিজলভস টু —
টপ অ্যাঙ্গেল থেকে ঢাকা শহরের লং শট। প্রায়ান্ধকার সকাল, সূর্য উঠি উঠি। পাখিদের মৃদু গুঞ্জন। কাট টু –

ঘরের ভেতর। প্রথম দৃশ্যে দেখা সেই ঘর। ভোরের মিহি আলোয় দেখা যায় ঘুম থেকে আড়মোড়া ভেঙে ছোটো মেয়ে বিছানায় উঠে বসে — হামাগুঁড়ি দিয়ে খেলে। পাশে শুয়ে বাবা আনমনা চেয়ে দেখে। খাটের ওপাশে বাচ্চার মা মুখ পেছন ফিরে শুয়ে আছে। আপন মনে খেলছে ছোটো মেয়েটি। জানলার সাদা পর্দা গলে ভোরের মিহি আলো ঘরের ভেতর খেলা করে। বাবা আনমনে চেয়ে দেখে ছোটো মেয়েটিকে। খেলতে খেলতে মেয়েটি বাবার বুকের উপর উঠে আসে। দূরে কোথাও পাখির মৃদু গুঞ্জন। ক্যামেরা স্লো মুভমেন্টে ট্র্যাক ব্যাক করলে পরে পুরো ঘর দেখা যায়। ক্রমশ ঘরের আলো আরো উজ্জ্বল হয়। মেয়েটি বাবার বুকের উপর খেলছে।

ফেড আউট।

দৃশ্য বিভাজনসহ চিত্রনাট্য:

ক্রম

দৃশ্য  

   শব্দ
১.

লং শট
রাত                                                   
একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের শোবার ঘর। বিছানার উপর তিনজন মানুষ শুয়ে আছে। একজন নারী, একজন পুরুষ। নারী-পুরুষ পরস্পর পরস্পরের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে আছে।
মধ্যখানে একটি শিশু — এক-দেড় বছরের একটি বাচ্চা মেয়ে। দূর থেকে মনে হচ্ছে সকলেই ঘুমাচ্ছে। জানালায় পাতলা সাদা পর্দা। হালকা বাতাসে মিহি উড়ছে। পর্দার ফাঁক গলে রাতের ফিকে আলো ঘরে খেলা করে বেড়ায়।

দূরে কোথাও কুকুর ডাকার শব্দ শোনা যায়। রাতপোকাদের মৃদু গুঞ্জন। রাত প্রহরীদের হুইসেল শোনা যায় মাঝে মধ্যে।

২.

ক্যামেরা স্লো ট্র্যাক করে খাটের একপাশে আসে — যে পাশে পুরুষটি শুয়ে। ক্যামেরা আরো ট্র্যাক ইন করে মিড শট কম্পোজ করে।
দেখা যায়, ভদ্রলোক ঘুমাচ্ছেন না; প্রায় চল্লিশ বছর বয়সী মানুষটি কাত হয়ে শুয়ে চোখ চেয়ে তাকিয়ে আছেন একদিকে। তার ওপাশে ঘুমন্ত স্ত্রীর পেছনটা দেখা যায়। কাত হয়ে শুয়ে আছেন। কাট টু

ঘুমন্ত স্ত্রীর গভীর শ্বাস-প্রশ্বাসের মিহি শব্দ পাওয়া যায়। দূরে কুকুর ডাকার শব্দ শোনা যায়। সঙ্গীত ধীর লয়ে ফেড ইন করে।

৩.

পায়ের দিক থেকে নেয়া মিড লং শট
লোকটি পাশ ফিরে চিৎ হয়ে শোয়। অল্প পরেই সন্তানের দিকে পাশ ফেরে। মেয়ে বাবার দিকে কাত হয়ে শুয়ে — ঘুমুচ্ছে। বাবা নরম হাতে মেয়ের শরীরে হাত বুলায়। বুলাতেই থাকে। কাট টু      

ঘুমন্ত স্ত্রীর গভীর শ্বাস-প্রশ্বাসের মিহি শব্দ। দূরে কুকুর ডাকছে। রাত প্রহরীদের হুইসেল শোনা যায় মাঝে মধ্যে।
ধীর লয়ে সঙ্গীত বাজছে।

৪.

বাবার পয়েন্ট অব ভিউ থেকে মিড ক্লোজ শট
মেয়ের ঘুমন্ত মুখ — বাবার দিকে কাত হয়ে শুয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমুচ্ছে

আগের দৃশ্যের মতোই

৫.

পায়ের দিক থেকে মিড লং শট
বাবা নরম হাতে মেয়ের শরীরে হাত বুলায়। বুলাতেই থাকে।
ক্যামেরা স্লো মুভমেন্টে ট্র্যাক ইন করে — বাবার মুখ।
মেয়ের শরীর আলতো হাতে বুলাতে বুলাতে পলকহীনভাবে আনমনা চেয়ে থাকে ক্যামেরার দিকে —  ধীরে — অতি ধীরে বাবার চোখে জুম হতে থাকে। কাট টু/ ডিজলভস টু –

আগের দৃশ্যের মতোই

৬.

কাট টু/ ডিজলভস টু — বিভিন্ন কম্পোজিশনে শ্যুট করা পরপর কয়েকটি দৃশ্য, যেমন:
একটি ছোট বাচ্চা মেয়ে — বয়স এক দেড় হবে; হাসে দৌঁড়ায়, হামাগুড়ি দিয়ে বেড়ায়। কলকলিয়ে কথা বলে — কাঁদে। সবুজ ঘাসে ঢাকা মাঠে ছুটে বেড়ায়, সাদা ফ্রক পরা মেয়েটি। ডিজলভস টু –

সঙ্গীত বাজছে। বাচ্চা মেয়ের হাসি, ঘাসের উপর পায়ের শব্দ, দূরে পাখির ডাক, বাচ্চার অন্যান্য শব্দ।
ধীর লয়ে সঙ্গীত বাজছে।

৭.

লং শট
নীল আকাশে সাদা মেঘ —  মেঘের ওড়াওড়ি।

ডিজলভস টু

ধীর লয়ে সঙ্গীত বাজছে।
৮.

লং শট
সাদা ধোঁয়া —  কুণ্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া উড়ছে।

ধীর লয়ে সঙ্গীত বাজছে।
৯.

ক্লোজ শট
ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে ভেসে ওঠে ৪/৫ বছরের একটি মেয়ের মুখ –

ধীর লয়ে সঙ্গীত বাজছে।
১০.

লং শট-ক্লোজ শট
মেয়েটি সবুজ মাঠের ভেতর দিয়ে ধীর পায়ে হেঁটে আসে — ক্যামেরার খুব কাছে এসে লেন্সের দিকে চোখ রেখে বলে —  'বাবা, তুমি ভাল আছো? ভাল আছো? — ভালবাস?'  হালকা সাদা ধোঁয়া উড়ছে।
ডিজলভস টু –

ধীর লয়ে সঙ্গীত বাজছে।
১১.    

লং শট-ক্লোজ শট
বাবা ব্যাক টু ক্যামেরা
বাবা হাত বাড়িয়ে মেয়ের হাত ধরে —  চুল নাড়ে — গালে হাত বুলায়।
ক্যামেরা স্লো ট্যাক ইন করে মেয়ের মুখ ধরে।
বাবা মেয়ের গাল ছুঁয়ে আদর করছে।
হালকা ধোঁয়া উড়ছে।
ডিজলভস টু –

ধীর লয়ে সঙ্গীত বাজছে।
১২.    

ধোঁয়ায় মিলিয়ে যায় মেয়ের মুখ। ক্রমে ধোঁয়াও মিলিয়ে যায় —  ভেসে ওঠে — পানির ঢেউ ধীর স্থির। সবুজ ঘাস ডুবে আছে তাতে।
ডিজলভস টু –

ধীর লয়ে সঙ্গীত বাজছে।
১৩.

সেই ডুবন্ত ঘাসের মধ্যে ক্রমশ ভেসে ওঠে আবার মেয়ের মুখ — ক্লোজ আপ। বলে, 'ব্যথা পাও? কবে আমি মরে গেছি —  আজও মনে কর?' মেয়ের মুখ, ঘাস মিলিয়ে যায়
ডিজলভস টু –

ধীর লয়ে সঙ্গীত বাজছে।
১৪.    

লং শট
পানির মধ্যে ডুবে থাকা সবুজ ঘাসে ছাওয়া কবরস্থানের দৃশ্য —
বাচ্চাদের সারিবদ্ধ কবর। ক্যামেরা স্লো প্যান/ট্র্যাক করে কবরের উপর দিয়ে।
ডিজলভস টু –

ধীর লয়ে সঙ্গীত বাজছে।
১৫.   

লং শট
সাদা ধোঁয়ার/ আকাশের সাদা মেঘ সুপার ইমপোজ

ধীর লয়ে সঙ্গীত বাজছে।
১৬.   

মিড ক্লোজ শট
মেয়েটির মুখ, ক্যামেরার দিকে চেয়ে আছে, হাসি হাসি মুখ —  বাবার কণ্ঠে শোনা যায়: 'আবার ঘুমাও গিয়ে —  ছোট বোনটিরে তুমি দিয়ে যাও ডেকে।' শুনে মেয়েটির মুখ বেদনার্ত হয় —  চোখ ছাপিয়ে পানি পড়তে থাকে — ক্রমে সাদা ধোয়ার মধ্যে মেয়েটির বিষণ্ন মুখ মিলিয়ে যায়। বাবার কণ্ঠে শোনা যায়: 'আবার ঘুমাও গিয়ে —  ছোট বোনটিরে তুমি দিয়ে যাও ডেকে।'

ধীর লয়ে সঙ্গীত বাজছে।
১৭.    

লং শট টু ক্লোজ শট
পর্দায় শুধু সাদা ধোঁয়া। ডিজলভস টু –

ধীর লয়ে সঙ্গীত বাজছে।
১৮.   

লং শট
আকাশে কালো/ সাদা মেঘ।
ডিজলভস টু –

ধীর লয়ে সঙ্গীত বাজছে।
১৯.   

লং শট
কবরস্থানের সবুজ সারিবদ্ধ কবর।
ডিজলভস টু –

ধীর লয়ে সঙ্গীত বাজছে।
ফেড্‌স্‌ আউট
২০.

টপ অ্যাঙ্গেল থেকে লং শটে ঢাকা শহরের প্রায়ান্ধকার সকাল, সূর্য উঠি উঠি।
কাট টু –

পাখিদের মৃদু গুঞ্জন।
২১.

লং শট
ঘরের ভেতর। প্রথম দৃশ্যে দেখা সেই ঘর। ভোরের মিহি আলোয় দেখা যায় ঘুম থেকে আড়মোড়া ভেঙে ছোট মেয়ে বিছানায় উঠে বসে —  হামাগুঁড়ি দিয়ে খেলে। পাশে শুয়ে বাবা আনমনা চেয়ে দেখে। খাটের ওপাশে বাচ্চার মা মুখ পেছন ফিরে শুয়ে আছে। জানলার সাদা পর্দা গলে ভোরের মিহি আলো ঘরের ভেতর খেলা করে। কাট টু –

দূরে কোথাও পাখির মৃদু গুঞ্জন। বাচ্চার কণ্ঠ।
২২.

মিড শট
আপন মনে খেলছে ছোট মেয়েটি। বাবা আনমনে চেয়ে দেখে ছোট মেয়েটিকে। খেলতে খেলতে মেয়েটি বাবার বুকের উপর উঠে আসে। ক্যামেরা স্লো মুভমেন্টে ট্র্যাক ব্যাক করলে পুরো ঘর দেখা যায়। ক্রমশ ঘরের আলো আরো উজ্জ্বল হয়। মেয়েটি বাবার বুকের উপর খেলছে।
ফেড আউট।    

দূরে কোথাও পাখির মৃদু গুঞ্জন। বাচ্চার কণ্ঠ।