পুতিনের জন্মদিনে কিমের শুভেচ্ছা, নিবিড় হচ্ছে সম্পর্ক

বহির্বিশ্বে উত্তর কোরিয়া এবং রাশিয়ার বিচ্ছন্নতার প্রেক্ষাপটে পুতিনের জন্য কিমের এই শুভেচ্ছা সম্পর্ক আরও নিবিড় হওয়ারই সর্বশেষ লক্ষণ।

রয়টার্স
Published : 7 Oct 2022, 12:24 PM
Updated : 7 Oct 2022, 12:24 PM

৭০ বছরে পা রাখছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তার এই জন্মবার্ষিকীতে শুভেচ্ছাবার্তা পাঠিয়েছেন উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-উন।

শুক্রবার পাঠানো এ বার্তায় ‘যুক্তরাষ্ট্রের চ্যালেঞ্জ এবং হুমকি’ চূর্ণবিচূর্ণ করে দেওয়ার জন্য পুতিনের প্রশংসা করেছেন তিনি।

কিমের চিঠিতে বলা হয়েছে, “যুক্তরাষ্ট্র এবং এর নৌশক্তির চ্যালেঞ্জ ও হুমকির মুখে রাশিয়া নির্ভরযোগ্যভাবে নিজ রাষ্ট্রের মর্যাদাসহ মৌলিক স্বার্থ রক্ষা করে চলেছে। আপনার (পুতিন) দৃঢ় ইচ্ছা এবং উল্লেখযোগ্য নেতৃত্ব ছাড়া এমন বাস্তবতা অকল্পনীয় ছিল।”

উত্তর কোরিয়া-রাশিয়া সহযোগিতা আগের যে কোনও সময়ের চেয়ে এখন বেশি জোরদার হয়েছে উল্লেখ করে কিম বলেন, পুতিনের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরও এগিয়ে নেওয়ায় বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে বলেই তিনি আশা করেন।

বহির্বিশ্বে উত্তর কোরিয়া এবং রাশিয়া- দু’দেশের বিচ্ছন্নতার প্রেক্ষপটে পুতিনের জন্য কিমের এই বার্তা সম্পর্ক আরও নিবিড় হওয়ারই সর্বসাম্প্রতিক লক্ষণ।

ইউক্রেইনে আগ্রাসনের জেরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রাশিয়ার বিচ্ছিন্নতা বাড়লেও উত্তর কোরিয়ায় দেশটির মূল্য বাড়তেই দেখা যাচ্ছে।

রাশিয়ার সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার সম্পর্ক সবসময় সোভিয়েত আমলের মতো উষ্ণ না হলেও, এখন মস্কোর বন্ধুদেশের প্রয়োজনের এই সময়টিতে উত্তর কোরিয়া স্পষ্টতই তাদের কাছ থেকে সুবিধা পাচ্ছে।

গত ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেইনে আগ্রাসন শুরুর পর থেকে রাশিয়া এবং উত্তর কোরিয়ার মধ্যে সম্পর্ক দ্রুতই ঘনিষ্ঠ হচ্ছে। গত বুধবার জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের এক জরুরি বৈঠকে উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষাকে সমর্থন করেছে রাশিয়া।

উত্তর কোরিয়া ও রাশিয়ার সম্পর্কের সূচনা এবং দু’দেশ যেভাবে ঘনিষ্ঠ হচ্ছে:

রাজনৈতিক সমর্থন:

কমিউনিস্ট উত্তর কোরিয়া গঠিত হয়েছিল স্নায়ুযুদ্ধের গোড়ার দিনগুলোতে সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন নিয়ে। ১৯৫০-১৯৫৩ সালের কোরিয়ান যুদ্ধেও চীন এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের ব্যাপক সাহায্য-সহযোগিতা নিয়েই উত্তর কোরিয়া লড়েছিল দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রসহ এর জাতিসংঘ মিত্রদের সঙ্গে।

দশকের পর দশক ধরে উত্তর কোরিয়া প্রচণ্ডভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল। ১৯৯০ এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর উত্তর কোরিয়া প্রাণঘাতী দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে।

উত্তর কোরিয়ার নেতারা চীন এবং রাশিয়ার মধ্যে একটি ভারসাম্য বজায় রেখে চলতে ইচ্ছুক ছিলেন। তবে নেতা কিম জং-উনের সঙ্গে এই দুই দেশের সম্পর্ক প্রথম প্রথম তুলনামূলক শীতলই ছিল। কারণ, দুই দেশই যুক্তরাষ্ট্রের পথে হেঁটে উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক পরীক্ষার ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পদক্ষেপ নিয়েছিল।

কিন্তু ২০১৭ সালে উত্তর কোরিয়ার সর্বশেষ পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষার সময় নেতা কিম সম্পর্ক মেরামতের উদ্যোগ নেন। ২০১৯ সালে কিম এবং পুতিনের মধ্যে রাশিয়ার ভ্লাদিভস্তক শহরে প্রথমবারের মতো বৈঠক হয়।

তখন থেকেই উত্তর কোরিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে রাশিয়া। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আরোপের চেষ্টায় জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে প্রকাশ্যে ভেটোও দিয়েছে তারা।

ইউক্রেইন যুদ্ধে সমর্থন:

রাশিয়া যেমন উত্তর কোরিয়াকে সমর্থন দিয়ে এসেছে, তেমনি উত্তর কোরিয়াও ইউক্রেইনে রুশ আগ্রাসন শুরুর পর মস্কোকে প্রকাশ্যেই সমর্থন দিয়েছে।

ইউক্রেইনের বিচ্ছিন্নতাবাদী এলাকাগুলোর স্বাধীনতাকেও উত্তর কোরিয়া স্বীকৃতি দিয়েছে, এমনকী এ সপ্তাহে ইউক্রেইনের চার অঞ্চলকে রাশিয়ার নিজেদের সঙ্গে যুক্ত করে নেওয়ার ঘোষণাকেও উত্তর কোরিয়া সমর্থন দিয়েছে।

“ইউক্রেইনে রাশিয়ার ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ নতুন এক ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা বয়ে এনেছে, যেখানে ক্রেমলিন এবং উত্তর কোরিয়া উত্তরোত্তর ঘনিষ্ঠ হতে পারে,” বলেই অভিমত ভ্লাদিভোস্তকের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আরতিওম লুঙ্কিনের।

যুক্তরাষ্ট্র বলছে, রাশিয়া উত্তর কোরিয়ার দিকে এগিয়েছে বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ এবং অস্ত্র কেনার জন্য, যাতে যুদ্ধের কারণে খালি হওয়া অস্ত্রগুদাম তারা আবার ভরে নিতে পারে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের এমন দাবি অস্বীকার করেছে রাশিয়া এবং উত্তর কোরিয়া উভয়ই।

অর্থনৈতিক বন্ধন:

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উত্তর কোরিয়ার বেশিরভাগ বাণিজ্য চীনের মধ্য দিয়ে হলেও রাশিয়াও বাণিজ্য খাতে দেশটির গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। বিশেষ করে তেল সরবরাহের ক্ষেত্রে।

উত্তর কোরিয়ার ওপর জারি থাকা জাতিসংঘ নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গ করার কথা রাশিয়া অস্বীকার করে আসলেও এই নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে রাশিয়ার ট্যাংকারে করে উত্তর কোরিয়ায় তেল রপ্তানির অভিযোগ আছে। তাছাড়া, নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও রাশিয়ায় উত্তর কোরিয়ার শ্রমিক থাকার কথা জানিয়েছেন নিষেধাজ্ঞা পর্যবেক্ষকরা।

 কোভিড মহামারীর সময়ে উত্তর কোরিয়া তাদের সীমান্তে কড়া লকডাউনের পদক্ষেপ নেওয়ার কারণে রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য এবং অন্যান্য যোগাযোগ প্রায় পুরোই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

তবে সীমান্তে আরোপিত কিছু কঠোর নিষেধাজ্ঞা উত্তর কোরিয়া এখন শিগগিরই তুলে নেবে এবং তা করার যৌক্তিক কারণও আছে বলে জানিয়েছেন ভ্লাদিভোস্তকের ফার ইস্টার্ন ফেডারেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লুঙ্কিন। ট্রেনে বাণিজ্য শিগগিরই চালু করা হতে পারে- স্থানীয় সরকারের এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনের উল্লেখ করে লুঙ্কিন একথা বলেন।

রাশিয়ার কর্মকর্তারা জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও প্রকাশ্যেই উত্তর কোরিয়ার ২০ হাজার থেকে ৫০ হাজার শ্রমিক নিয়োগের রাজনৈতিক ব্যবস্থা করার জন্য কাজ করা নিয়ে আলোচনা করেছেন।

তাছাড়া, ইউক্রেইনের বিচ্ছিন্নতাবাদী অঞ্চলগুলোকে যুদ্ধবিধ্বস্ত অবস্থা থেকে পুনর্গঠন করতে উত্তর কোরিয়ার শ্রমিক নেওয়া নিয়েও রাশিয়ার কর্মকর্তা ও নেতারা আলোচনা করেছেন।