'নিয়াজির আত্মসমর্পণ বিলম্বিত হয় যুক্তরাষ্ট্রের কারণে'

একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় প্রয়োজনে ভারতীয় অবস্থানে হামলা চালানোর জন্য মার্কিন নৌবহরকে নির্দেশ দেওয়ার পাশাপাশি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের বিষয়টিও অন্তত ১৯ ঘণ্টা ঝুলিয়ে রেখেছিল যুক্তরাষ্ট্র সরকার।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 Nov 2011, 02:31 AM
Updated : 5 Dec 2014, 02:27 PM

সম্প্রতি প্রকাশিত ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি গোপন নথির ভিত্তিতে টাইমস অব ইন্ডিয়া এ খবর দিয়েছে।

টাইমস অব ইন্ডিয়ার অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৭১ সালে ভারতের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ছিল ধারণার চেয়েও অনেক বেশি আক্রমণাত্মক।

"এই নথিতে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের তখনকার প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন সে সময় তিন ব্যাটালিয়ন মেরিন সেনাকে ভারতীয় উপমহাদেশে পাঠানোর জন্য তৈরি রেখেছিলেন। বঙ্গোপসাগরের দিকে পাঠানো মার্কিন রণতরী ইউএসএস এন্টারপ্রাইজকেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল- যাতে তারা প্রয়োজনে ভারতীয় সামরিক অবস্থানে হামলা চালাতে পারে।"

তবে এই পরিস্থিতির মধ্যেও ভারতের তখনকার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী 'বাংলাদেশকে মুক্ত করার' সাহসী পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যান বলে উল্লেখ করা হয়েছে টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ শুরু করার পর এ ভূখণ্ডের লাখ লাখ মানুষকে আশ্রয় দিয়েছিলো ভারত। সমর ও কূটনৈতিক সহায়তা দিয়েছিলো বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারকে।

বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের স্বীকৃতি আদায়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা। যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা সত্ত্বেও এ প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে অনেক দেশও সফর করেন তিনি। যুদ্ধপরবর্তী বাংলাদেশ গড়ার কাজেও ইন্দিরার সহযোগিতা পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলের কমান্ডার লেফট্যানেন্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজি ঢাকায় আত্মসমর্পণ করেন। এর মধ্য দিয়েই নয় মাস যুদ্ধের পর বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়। কিন্তু ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে ৬ পৃষ্ঠার সেই নথির বরাত দিয়ে টাইমস অব ইন্ডিয়া বলছে, নিয়াজির আত্মসমর্পণের বিষয়টিও প্রায় এক দিন ঝুলিয়ে রেখেছিল যুক্তরাষ্ট্র।

প্রতিবেদনে বলা হয়, নিয়াজি তার আত্মসমর্পণের আগ্রহের কথা ঢাকায় তখনকার মার্কিন কনস্যুলার জেনারেলকে জানান একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর। কনস্যুলার জেনারেল তা জানান ওয়াশিংটনকে। কিন্তু ওয়াশিংটন থেকে ভারতে এই বার্তা পৌঁছাতে ১৯ ঘণ্টা দেরি হয়।

টাইমস অব ইন্ডিয়া লিখেছে, "যুক্তরাষ্ট্র সরকার ভারতে সামরিক হামলার একটি সম্ভবনাও মেপে দেখছিল। এ কারণেই তাদের (বার্তা পাঠাতে) এতোটা সময় লাগে বলে ভারতীয় কূটনীতিকদের ধারণা।"

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছিল, তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে আটকে পড়া মার্কিন নাগরিকদের উদ্ধার করতে বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর পাঠাচ্ছে তারা। কিন্তু নথির তথ্যে দেখা যায়, এই নৌবহর থেকে 'প্রয়োজনে' ভারতে হামলার পরিকল্পনাও ছিল প্রেসিডেন্ট নিক্সনের।

"আমাদের দূতাবাসের ধারণা, ভারতকে 'আগ্রাসী রাষ্ট্র' আখ্যা দিয়ে বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর পাঠানোর সিদ্ধান্তটি নিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট নিক্সন নিজেই।...ইউএসএস এন্টারপ্রাইজে থাকা জঙ্গিবিমানগুলোকে প্রয়োজনে ভারতীয় সেনাবাহিনীর স্থাপনায় হামলা চালানের নির্দেশনাও দিয়ে রাখা হয়েছিল বলে আঁচ করতে পেরেছে দূতাবাস।"

একাত্তরের সেই সময়টায় ভারত ও পাকিস্তানকে কোনো ধরনের সামরিক সহায়তা দেওয়ার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা থাকলে যুক্তরাষ্ট্র গোপনে ইসলামাবাদকে ঠিকই অস্ত্র যুগিয়ে গেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নথিতে।

এতে বলা হয়- ভারত এই যুদ্ধে যোগ দেওয়ার আগে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রবাহী তিনটি পাকিস্তানি জাহাজ আটক করার পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু সেক্ষেত্রে গোলোযোগ ও ক্ষয়ক্ষতি আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় সেই পরিকল্পনা বাদ দেয় ভারত সরকার।

টাইমস অব ইন্ডিয়া লিখেছে, "জাহাজ আটক করতে চাইলে ভারতের সামনে দুটি পথ খোলা ছিল- করাচি পৌঁছানোর আগেই সেগুলো দখল করা, অথবা বঙ্গোপসাগরে জাহাজগুলোর পথ অবরোধ করা। কিন্তু দুটো ক্ষেত্রেই বলপ্রয়োগ করতে হতো, যা পরিগণিত হতো সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা হিসেবে।"