কিডনি বিকল চার দিন, নিউ ইয়র্কে ডায়ালাইসিস পাননি জামাল

কিশোর বয়সে বাংলাদেশে বাবা-মা হারানো জামাল উদ্দিন  লোয়ার ম্যানহাটনের হাই স্কুল ও কলেজে পড়াশুনা শেষে এইচআইভি/এইডস আক্রান্তদের সাহায্যে আত্মনিয়োগ করার আগে একটি ফিতার কারখানায় কাজ করেন।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 May 2020, 08:36 AM
Updated : 2 May 2020, 08:37 AM

তার ৬৮ বছরের জীবনে তিনি নিজেকে উত্তরজীবী হিসেবে প্রমাণ করেছেন। কিন্তু শহরে নতুন করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর ব্রুকলিনের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে তার জীবনযুদ্ধের সমাপ্তি হয়।

ভেন্টিলেটর সংকটের মধ্যের শ্বাস নেওয়ার জন্য সহায়ক যন্ত্রের অভাব তার ক্ষেত্রে হয়নি। কিন্তু কোভিড -১৯ রোগীর ঢেউয়ের মধ্যে পর্যাপ্ত পরিমাণ মেশিন না থাকায় ডায়ালাইসিস না পেয়ে কিডনি বিকল হয়ে তার মৃত্যু হয় বলে তার পরিবার বলছে।

মধ্য এপ্রিলে জামাল উদ্দিনের মৃত্যুর আগে ডায়ালাইসিস না পাওয়ায় তার স্ত্রী জেসমিন উদ্দিন ও ছেলে শেহরান উদ্দিন ক্রমশ  উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন এবং শেষ চার দিন তারা মরিয়া হয়ে ওঠেন। কিন্তু ডায়ালাইসিস মেলেনি।

জামাল উদ্দিনের শ্যালক অর্থোপেডিক সার্জন ডা. রাসেল রানা বলেন, পরীক্ষায় কিডনির বাজে অবস্থা ধরা পড়ার পর তিনি ও তার বোন হাসপাতালে বার বার ফোন করে ডায়ালাইসিসের ধরনা দিয়েছিলেন।

“এমন পরিস্থিতি যে হতে পারে তা একজন চিকিত্সক হিসাবে আমার কল্পনাতেও আসেনি।”

প্রাদুর্ভাবের বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে জামাল উদ্দিনের চিকিৎসাস্থল ব্রুকলিনের এনওয়াইইউ ল্যাঙ্গোনসহ নিউ ইয়র্ক সিটির হাসপাতালগুলোতে কিডনি জটিলতা নিয়ে আসা কোভিড-১৯ রোগীর সংখ্যা হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় ডায়ালাইসিসের সংকট তৈরি যায়। অপ্রত্যাশিত রোগীর ভিড় মোকাবিলায় ওষুধ, স্বাস্থ্যকর্মী ও মেশিন নেই বলে নেফ্রোলজিস্টরা (কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞ) সতর্ক করেছিলেন।

কোভিড-১৯ নিয়ে গুরুতর অবস্থায় জামাল চিকিৎসাধীন সময়ে ‘কন্টিনিউয়াস রেনাল রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি’ হিসাবে পরিচিত বিশেষায়িত ডায়ালাইসিসের যে সরবরাহ সংকট ছিল হাসপাতালের নিজস্ব রেকর্ডে তার ইঙ্গিত মিলেছে বলে নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

গত ১৪ এপ্রিল তার ফাইলে লেখা নোট বলছে, ‘বর্তমান জায়গায় রোগীর জন্য এটা (ডায়ালাইসিস) পাওয়া যায়নি’, যদিও তখন কিডনি অকার্যকারিতার গুরুত্বপূর্ণ সূচক পটাশিয়ামের স্তর জামালের শরীরের উচ্চ মাত্রায় পৌঁছেছে।

ওই হাসপাতালের চিফ মেডিকেল অফিসার ডা. জোসেফ ওয়িস্টাক বলেন, তিনি স্থিতিশীল ছিলেন কিনা, তার জন্য জরুরি জরুরি হস্তক্ষেপ দরকার কিনা সেগুলো প্রতিদিনই দেখা হত। কিন্তু কোনোদিনই তিনি ভাল ছিলেন না।

“অত্যন্ত অসুস্থ রোগীর যত্ন নেওয়ার ক্ষেত্রে আমরা আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি।”

মৃতের পরিবারের অনুমতি নিয়ে হাসপাতালের কাছ থেকে ১,৪০৩ পৃষ্ঠার ডিজিটালাইজড মেডিকেল রেকর্ডের অনুলিপি সংগ্রহ করেছে নিউ ইয়র্ক টাইমস।

পটাসিয়াশের বিপদজনক মাত্রার মধ্যেই ওই দিন সন্ধ্যায় হৃদযন্ত্র ক্রিয়া বন্ধ হয়, কিন্তু ডাক্তারদের চেষ্টায় তা সচল হয়। নেফ্রোলজি বিভাগের প্রধান জামালের বিশেষায়িত ডায়ালাইসিসের পরমর্শ দেন, যার পরিবারের সদস্যরা ফোনে কয়েকদিন ধরে বলছিলেন। যাই হোক, ডায়ালাইসিস হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যে শুরু হতো যদি জামাল আর কিছুক্ষণ বেঁচে থাকতেন।  

ক্ষতিগ্রস্ত কিডনি নিয়ে আক্রান্ত কোভিড-১৯ রোগীদের জন্য পর্যাপ্ত উন্নত ডায়ালাইসিস মেশিন ছাড়াই নিউইয়র্ক সিটির অন্যান্য হাসপাতালের আইসিইউতে রোগীদের চিকিত্সা দেওয়া হচ্ছে।

নাম প্রকাশ না করে সিটি হাসপাতালের এক চিকিত্সক বলেন, “এসব মানুষ যদি তাদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পেত, তাহলে তাদের মধ্যে কেউ কেউ আরও কিছুকাল বেঁচে থাকতেন।”

জরুরি ডায়ালাইসিসের অপ্রত্যাশিত চাহিদা তৈরি হওয়ায় রাজ্য স্বাস্থ্য কমিশনার ডা. হাওয়ার্ড জাকারের আবেদনে ৫০টি উন্নত ডায়ালাইসিসি মেশিন দিয়েছে কেন্দ্র।

কিডনি চিকিত্সা না পেয়ে করোনাভাইরাসে কত রোগী মারা গেছেন তা বলা কঠিন। কারণ বেশিরভাগ মারাত্মক অসুস্থ রোগীই একাধিক অঙ্গের অকার্যকারিতার সঙ্গে লড়ছেন। এমনকি পর্যাপ্ত ডায়ালাইসিস দেওয়ার পরও দেখা গেছে পরে অনেকের ফুসফুস,হৃদপিণ্ড বা অন্য অঙ্গগুলি অকার্যকর হয়েছে।

ওয়িস্টাক বলেন, “আমরা এই রোগের ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত যা দেখেছি তা হল- অনেকের তাৎক্ষণিকভাবে অবস্থার উননতির হলেও আমাদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে শেষ পর্যন্ত তারা ভেঙে পড়েছেন।”

জামালকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য যা যা করা হয়েছে তার সবই রয়েছে হাসপাতালের রেকর্ডটিতে; ডজন ডজন চিকিৎসক, নার্স ও প্রযুক্তিবিদ; ভেন্টিলেটর; প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের হাইড্রোক্সাইক্লোরোকুইনসহ সব ওষুধের কথাও রয়েছে।

শুরুর দিকে জামাল নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে ডায়ালাইসিসসহ বিশেষায়িত চিকিত্সা পেয়েছিলেন। কিন্তু তার সঙ্কট যখন তীব্র তখন এনওয়াইইউ ল্যাঙ্গোনসহ নিউইয়র্ক সিটি হাসপাতালগুলিতে মেশিনের সংকট দেখা দেয়।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পেরিটোনাল ডায়ালাইসিস নামে একটি বিশেষ পদ্ধতি প্রয়োগ করে যা রোগীদের ক্ষেত্রে অনেক সময় কার্যকর হলেও অস্থিতিশীল রোগীদের ক্ষেত্রে সবসময় উপযোগী হয় না। সেটাও অবস্থার মারাত্মক অবনতি হওয়ার আগে জামালকে দেওয়া হয়নি।

তার স্ত্রী জেসমিন উদ্দিন বলেন, “আমি কেবল এটিই চাই, যাতে মানুষ পরিস্থিতি সম্পর্কে জেনে প্রস্তুত থাকতে পারে।”

কোভিড-১৯ এর ভবিষ্যত হট স্পটগুলিতে ডায়ালাইসিস মেশিনের যোগানের প্রয়োজনের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমি চাই, আর কেউ যেন এমন পরিস্থিতির মধ্যে না পড়েন।”

কিডনির সাধারণ প্রয়োজনীয় ভূমিকা ডায়ালাইসিস পালন করে; অন্যান্য কাজের মধ্যে রক্তে বিষাক্ত উপাদান ও শরীরে জমা বাড়তি পানি অপসারণ করে। দেশজুড়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ২০ থেকে ৪০ রোগীর রোগী কিডনিতে অকার্যকর হয়েছিল, যাদের জরুরি ডায়ালাইসিসের প্রয়োজন ছিল কিডনি বিশেষজ্ঞদের অনুমান।

সংকট চলাকালীন নিউ ইয়র্ক সিটির কয়েকটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিসের চাহিদা তিনগুণ বেড়েছে।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে জেসমিন বলেন, “তারা বলেছিলেন যে তার সংখ্য সবকিছু ভাল। তার চেয়ে খারাপ অন্য অনেক রোগী টিকে আছে। তাদের ডায়ালাইসিস দিতে হবে।”