চীনের নতুন ভাইরাস নিয়ে ডব্লিউএইচও’র সতর্কতা

চীনে ছড়িয়ে পড়া নতুন ভাইরাসের বিস্তার নিয়ে শঙ্কা বাড়ছে। ভাইরাসটি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে সতর্ক করে দিয়ে এ ব্যাপারে প্রস্তুত থাকতে বলেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)।

এস এম নাদিম মাহমুদ, জাপান থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Jan 2020, 11:24 AM
Updated : 17 Jan 2020, 11:24 AM

চীনের হুবেই প্রদেশের উহানে ছড়িয়ে পড়া নিউমোনিয়া-সদৃশ এ ভাইরাসটি নতুন এক ধরনের করোনাভাইরাস।প্রচলিত নিউমোনিয়া রোগের জন্য স্ট্রেপটোকক্কাস নিউমোনি নামের একটি ব্যাকটেরিয়াকে দায়ী করা হলেও সম্প্রতি দেখা দিয়েছে নতুন এই ভাইরাস, যেটি পরিচিতি পেয়েছে ‘উহান ভাইরাস’ বা ‘উহান নিউমোনিয়া’ নামে।

গত বছর ডিসেম্বরের শুরুতে উহানের একটি সামুদ্রিক খাবারের বাজার থেকে ছড়িয়ে পড়া এ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছেই। চীনে ইতোমধ্যে অর্ধশতাধিক মানুষ নতুন ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়েছে। যার মধ্যে ডিসেম্বরে একজন আর বৃহস্পতিবার আরো একজন মারা যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

চীনের পর বৃহস্পতিবার জাপানে কানজাওয়া প্রদেশের এক ব্যক্তির দেহে এ ভাইরাসের উপস্থিতি নিশ্চিত করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। যিনি গত ৩ জানুয়ারি চীনের উহান থেকে জ্বর নিয়ে জাপানে ফিরেছেন।

চিকিৎসকরা ওই ব্যক্তির রক্তের নমুনায় নিউমোনিয়া-সদৃশ এ নতুন ভাইরাস শনাক্তও করেছেন। এর আগে থাইল্যাণ্ডে সূবর্ণভূমি বিমানবন্দরে আরো কয়েকজন এ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যা বলছে:

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা নতুন ভাইরাসটি করোনাভাইরাস (সিওভি) পরিবারের বলে নিশ্চিত করেছে। গত ১৩ জানুয়ারি প্রকাশিত এক নির্দেশনা ও বিবৃতিতে সংস্থাটি বলেছে, সম্প্রতি থাইল্যান্ডের এক ব্যক্তির দেহে অজানা এ করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিশ্চিত হওয়ার পর তারা (ডব্লিউএইচও) থাইল্যান্ড ও চীনের সঙ্গে কাজ শুরু করছে।

ঐ ব্যক্তি চীনের উহান থেকে ফেরার পর থাই কর্মকর্তারা তাকে ৮ জানুয়ারি শনাক্ত করেছিলেন। ভাইরাসটি অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে যেতে পারে বলে সংস্থাটি সচেতন থেকে সক্রিয়ভাবে কাজ করে যাওয়া এবং রোগ সংকমণ মোকাবেলায় প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানিয়েছে।

বৃহস্পতিবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পশ্চিমাঞ্চলের প্যাসিফিক আঞ্চলিক কর্মকর্তা তাকেশি কাসাই জাপানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন এনএইচকে’কে বলেন, জাপানে যে নতুন ধাঁচের করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে, তা দেখে মনে হচ্ছে তা দ্রুত সারাদেশে ছড়িয়ে যেতে পারে।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ৩৭ টি দেশে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নেতৃত্ব দেওয়া এ শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা আরো বলেন, এক মানুষ থেকে আর এক মানুষের কাছে কিভাবে এ ভাইরাস ছড়িয়ে যাচ্ছে তা এখনো জানা যায়নি। চীনের চান্দ্র নববর্ষ উদযাপনের সময় ভ্রমণকারীদের কাছে এ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাও প্রকাশ করেন।

নতুন এ ভাইরাসটি কী?

করোনাভাইরাস (সিওভি) ভাইরাস হল একটি বৃহৎ পরিবার যে ভাইরাস সংক্রমণে ঠাণ্ডা, কাশি বা জ্বরের ভাইরাস যেমন রয়েছে ঠিক তেমনি মিডল ইস্ট রেসপিরেটরি সি (এমআরএস-সিওভি) এবং তীব্র শ্বসনতন্ত্র সিন্ড্রোম (এসএআরএস-সিওভি) এর মতো আরও মারাত্মক রোগের ভাইরাসও এই পরিবারের অন্তর্গত। সাধারণত, অচেনা নতুন কোন ভাইরাসের বৈশিষ্ট্য এ গ্রুপের সঙ্গে মিলে গেলে প্রাথমিকভাবে করোনাভাইরাসে নামকরণ করা হয়।

চীনের উহান শহরে রহস্যময় এ ভাইরাস পাওয়ার কারণে, প্রাথমিকভাবে এর নামকরণ করা হয়েছিল ‘উহান ভাইরাস’। তবে চলতি সপ্তাহে ভাইরাসটির জীবনরহস্য (জিনোম সিকুয়েন্স) উম্মোচনের পর এর ডিএনএ করোনভাইরাসের পরিবারের সঙ্গে সাদৃশ্য পাওয়া যায়। যা পরবর্তীতে থাইল্যাণ্ড (২০১৯-সিওভি) নামকরণ করে।

রোগের লক্ষণ:

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, এ ভাইরাসগুলো জুনোটিক, যা মূলত প্রাণীদেহ থেকে মানবদেহে সঞ্চারিত হয়। আর এ ভাইরাসের সংক্রমণে জ্বর, সর্দি-কাশি, শ্বাসকষ্ট হতে পারে যা থেকে নিউমোনিয়ার মত গুরুতর রোগে মৃত্যুর কারণ হতে পারে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একজন কর্মকর্তা মঙ্গলবার জেনেভায় অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, এক মানব দেহ থেকে অপর এক মানব দেহের মধ্যে সংক্রামণ ছড়িয়ে পড়ার কোন ঘটনা জানা না গেলেও সীমিত হারে এ ধরনের সংক্রমণের সম্ভাবনা রয়েছে, বিশেষ করে পরিবারের লোকজনের মধ্যে।

গবেষকরা যা বলছেন,

ভাইরাসটি নিয়ে ইতোমধ্যে গবেষণা শুরু করেছেন বিশ্বের বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী। সিঙ্গাপুর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজিস্ট লিন্ফা ওয়াং বিজ্ঞান সাময়িকী নেচার’কে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে বলেছেন, এটি সাধারণত জুনোটিক ভাইরাস, যা প্রাণীর দেহ থেকে মানবদেহে সহজে চলে আসে। সচরাচর শীতের মাসগুলোতে এ ভাইরাস সংক্রমণশীল হয়ে ওঠে।

২০০২-০৩ সালে এসএআরএস বা সার্স ভাইরাসে চীনে অনেক মানুষ মারা গিয়েছিল বলে তিনি স্মরণ করেন।

সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবর্তন বিজ্ঞানী এডওয়ার্ড হোমস বিজ্ঞান সাময়িকী ‘সায়েন্স’ কে বলেন, প্রাথমিকভাবে সাংহাইয়ের ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়ের ঝাং ইওং-ঝেনের নেতৃত্বে একদল গবেষক ভাইরাসের পাঁচ ধরনের ডিএনএ সিকুয়েন্স পেয়েছে। যা ইতোমধ্যে ডেটাবেইজে শেয়ার করা হয়েছে। যদি এটি মহামারি আকারে রূপ নেয়, তাহলে এ সিকুয়েন্স নতুন গবেষণার খোরাক যোগাবে।

চীনের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রের পরিচালক এবং চীন সরকার এ ভাইরাস মূল্যায়ন কমিটির প্রধান জু জিয়ানগু বলেছেন, প্রথম দিকে রোগীদের শরীরে যে লক্ষণগুলো পাওয়া গিয়েছিল তার মধ্যে ছিল শ্বাসকষ্ট এবং জ্বর যা থেকে আমরা নিউমোনিয়া বলে ধারণা করছি। তবে তিনি আশা করেন, আগামী সপ্তাহে এটি ছড়িয়ে না পড়লে হয়ত এ ভাইরাসের সংক্রমণ কমবে।