সিরিয়ায় বিমানঘাঁটিতে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা

সিরিয়ায় বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে থাকা একটি শহরে ‘রাসায়নিক হামলার’ জবাবে  সরকারি বাহিনীর সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 April 2017, 03:00 AM
Updated : 8 April 2017, 03:15 AM

একে একটি সার্বভৌম দেশের ওপর আগ্রাসন আখ্যায়িত করে রাশিয়া বলছে, এর পরিণতি ‘খুবই গুরুতর’ হতে পারে। 

সিরিয়ার আকাশে জঙ্গি বিমানের সংঘর্ষ এড়াতে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনীর মধ্যে যে যোগাযোগ ছিল তা বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে মস্কো।  ২০১১ সালে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরুর চার বছর পর প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ অনুগত বাহিনীর সমর্থনে নামে রুশ সেনাবাহিনী।

অপরদিকে সিরিয়ায় জঙ্গি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিমান হামলা চালিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন বাহিনী। এই প্রথম তাদের হামলার শিকার হল আসাদ অনুগতরা। 

পেন্টাগনের বরাত দিয়ে বিবিসি জানিয়েছে, ভূমধ্যসাগরে মার্কিন নৌবাহিনীর ডেস্ট্রয়ার থেকে সিরিয়ার একটি বিমানঘাঁটিতে ৫০টিরও বেশি টমাহক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস জানিয়েছে, হামলায় হোমসের কাছের ওই বিমানঘাঁটি সম্পূর্ণ ধ্বংস এবং এক কর্মকর্তাসহ অন্তত চার সিরিয়ান সৈন্য নিহত হয়েছে।

তবে হোমসের গভর্নর তালাল বারাজি জানিয়েছেন, সেখানে নিহতের সংখ্যা ৫, আহত হয়েছেন আরও চারজন। হতাহতদের মধ্যে বিমানঘাঁটির নিকটবর্তী একটি গ্রামের কয়েকজনও আছে বলে জানিয়েছেন তিনি।  

যে দুই জাহাজ থেকে ওই হামলা চালানো হয়েছে সেগুলোর নাম ইউএসএস পোর্টার ও ইউএসএস রোস বলে জানিয়েছে মার্কিন বেশ কয়েকটি গণমাধ্যম।

 

হামলার ঘোষণা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, সিরিয়ার ওই শায়রাত বিমানঘাঁটি থেকেই মঙ্গলবার রাসায়নিক হামলা চালানো হয়েছিল এবং তিনিই ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার নির্দেশ দিয়েছেন।  

চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠক শেষে ফ্লোরিডার অবকাশযাপন কেন্দ্র মার আ লগোতে দেওয়া বিবৃতিতে তিনি সিরিয়ায় যুদ্ধ শেষ করতে বিশ্বের সব ‘সভ্য দেশের’ সহযোগিতাও চেয়েছেন।

মঙ্গলবার সকালে সিরিয়ার বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত ইদলিব প্রদেশের খান শেইখৌনে চালানো ওই রাসায়নিক গ্যাস হামলায় অন্তত ৭২ জন নিহত হন, এদের মধ্যে বহু শিশু রয়েছে।

এরপর বুধবার জর্ডানের বাদশা আব্দুল্লাহর সঙ্গে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প বলেন, বেসামরিকদের ওপর বিষাক্ত গ্যাস হামলা চালিয়ে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ সীমা অতিক্রম করেছেন।

এরপর বাংলাদেশ সময় শুক্রবার সকাল পৌনে ৭টার দিকে মোট ৫৯টি ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়া হয় বলে বিবিসি জানিয়েছে। যদিও হামলার তথ্য আগেই বিমানঘাঁটিতে থাকা রাশিয়ান সেনাসদস্যদের জানানো হয়েছিল।

পেন্টাগনের মুখপাত্র ক্যাপ্টেন জেফ ডেভিস এক বিবৃতিতে জানান, হামলার আগে তারা ওই বিমানঘাঁটিতে থাকা রাশিয়ান সেনাদের সরে যেতে বলেছে।

ডোনাল্ড ট্রাম্প ও বাশার আল আসাদ

নিরাপত্তা বাহিনীর এক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে বিবিসির বিদেশনীতি বিষয়ক সংবাদদাতা পল ম্যাকলরিও জানান, ঘাঁটিতে থাকা রাশিয়ান বাহিনীকে হামলার কথা আগেই জানিয়েছিল মার্কিন সেনাবাহিনী।

পরে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন ফরাসী সৈন্যদেরও আগেই হামলার খবর জানিয়ে দেয়া হয়েছিল বলে জানিয়েছেন। 

হামলার খবর স্বীকার করেছে সিরিয়ার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনও। এক সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে তারা জানায়, “বেশ কয়েকটি ক্ষেপণাস্ত্রের মাধ্যমে মার্কিন বাহিনী সিরিয়ার সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে আগ্রাসী হামলা করেছে।” 

হামলার পর এক বিবৃতিতে হোমসের গভর্নর বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের এই ক্ষেপণাস্ত্র হামলা সশস্ত্র সন্ত্রাসী ও ইসলামিক স্টেটের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সাহায্য করবে।  

সিরিয়ার সরকারি টেলিভিশনকে টেলিফোনে তালাল বারাজি বলেন, “সিরিয়ার নেতৃত্ব এবং নীতি বদলাবে না। এই ধরনের হামলা এবারই প্রথম নয়, আমার বিশ্বাস এটি শেষও নয়।”

“সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী এবং দায়েশ সিরিয়ার আরব আর্মি ও রাশিয়ান সেনাবাহিনীর ওপর হামলা চালাতে ব্যর্থ হয়েছে, এখন যুক্তরাষ্ট্রের হামলা সিরিয়ায় তাদের সন্ত্রাসী উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখবে; এবং দীর্ঘমেয়াদে ইসরায়েলের লক্ষ্য অর্জনে সাহায্য করবে।” 

হামলার আগেই বেশিরভাগ বিমান থেকে সিরিয়ান সৈন্যদের সরিয়ে নেওয়া হয় বলেও জানান তিনি।

 

দায়িত্ব নেওয়ার পর এটিই কোনো দেশে হামলা চালানোর প্রথম নির্দেশ ট্রাম্পের। নির্বাচনে জয়ী হওয়ার আগে অবশ্য সিরিয়ায় হামলার তীব্র বিরোধী ছিলেন ট্রাম্প।

২০১৩ সালে এক টুইটে তিনি সিরিয়ায় হামলা চালানোয় সরকারের সমালোচনা করেছিলেন। বলেছিলেন, নির্বাচিত হলে তিনি সিরিয়ায় সামরিক হামলা বন্ধে সম্ভব সব কিছু করবেন।

রয়টার্স বলছে, সিরিয়ায় মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র হামলার কিছু সময় পরই জ্বালানি তেলের মূল্য প্রায় এক দশমিক ছয় শতাংশ বেড়ে যায়। বেড়ে যায় স্বর্ণ এবং যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বণ্ডের শেয়ারমূল্যও। তবে দাম পড়ে যায় ডলারের।

ডেমোক্রেট ও রিপাবলিকান বেশিরভাগ সিনেটর এ হামলাকে স্বাগত জানিয়েছেন; তাদের কয়েকজন হামলার বিষয়ে কংগ্রেসে ভোট ডাকতে স্পিকার পল রায়ানকে অনুরোধও করেছেন।

বিমান হামলাকে স্বাগত জানিয়েছে ইসরায়েল। দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এক বিবৃতিতে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের হামলা রাসায়নিক ব্যবহারের বিরুদ্ধে শক্ত বার্তা।

হামলায় পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছে অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, সৌদি আরব ও যুক্তরাজ্য। তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে রাশিয়া ও ইরান।

ক্রেমলিন এই হামলাকে ‘আন্তর্জাতিক আইনের চরম লঙ্ঘন’ হিসেবে অ্যাখ্যা দিয়েছে।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের এই হামলা অবৈধ; এটি রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

তার মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ রুশ প্রেসিডেন্টকে উদ্ধৃত করে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের হামলা সার্বভৌম একটি দেশের উপর আগ্রাসন, যা পরিচালিত হয়েছে ‘মনগড়া অভিযোগের’ ভিত্তিতে। এই হামলা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক জোটের ধারণাকেই নাড়িয়ে দেবে।

পরে বিষয়টি নিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকেও উত্তাপ ছড়ায় পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে।

শুক্রবারের এই বৈঠকে জাতিসংঘে রাশিয়ার উপ রাষ্ট্রদূত ভ্লাদিমির সাফ্রোনকভ বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের এই অবৈধ পদক্ষেপের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি আমরা। এর পরিণতি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতার জন্য খুবই গুরুতর হতে পারে।”

জবাবে জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত নিক্কি হ্যালি বলেন, প্রয়োজন হলে পরবর্তী ব্যবস্থা নিতে প্রস্তুত ছিলেন তারা।

“আরও কিছু করার জন্য আমরা প্রস্তুত। তবে আশা করি, তার দরকার হবে না।”

রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহৃত হলে যুক্তরাষ্ট্র নীরব থাকবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।