জ্বালানি সংকট: জার্মানি ধুঁকছে, ইতালি নিরাপদে

গত ৮ বছরে জার্মানি রুশ গ্যাসের ওপর ক্রমেই বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে, ইতালি খুঁজেছে অন্য উৎস।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 Sept 2022, 01:59 PM
Updated : 30 Sept 2022, 01:59 PM

ইউক্রেইনে চলতি বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার অভিযান শুরুর পরের কয়েক সপ্তাহ ইতালির বৃহৎ জ্বালানি কোম্পানি এনি’র প্রধান নির্বাহী ক্লদিও দেসকালজিকে গ্যাসের জন্য আফ্রিকার দেশগুলোতে হন্যে হয়ে ঘুরতে দেখা গেছে।

ফেব্রুয়ারিতে আলজেরিয়া, অ্যাঙ্গোলা, মার্চে মিশর আর কঙ্গো প্রজাতন্ত্রে এসব সফরে তার সঙ্গে রোমের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও ছিলেন বলে গ্যাস কোম্পানি ও সরকারের বিভিন্ন বিবৃতির বরাতে জানা গেছে।

এভাবেই রাষ্ট্রপরিচালিত এনি এবং ইতালি তাদের শীর্ষ সরবরাহকারী রাশিয়ার কাছ থেকে যে গ্যাস পেত তার বদলে অন্য জায়গা থেকে বাড়তি গ্যাস আনতে আফ্রিকার ওই দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ককে কাজে লাগাতে সক্ষম হয়েছিল বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।

চটপট সিদ্ধান্ত নিয়ে তারা যেভাবে অন্য উৎসের দ্বারস্থ হয়েছে, ইউক্রেইনে পুতিনের যুদ্ধের কারণে ঝাঁকুনি খাওয়া ইউরোপের অনেক দেশই এখন পর্যন্ত সেরকম পদক্ষেপ নিতে পারেনি।

যেমন জার্মানি, ইউরোপের অর্থনৈতিক পরাশক্তি এবং বিচক্ষণধর্মী পরিকল্পনার জন্য যার খ্যাতি আছে। কিন্তু এই দেশটিই রাশিয়ার যুদ্ধ পরবর্তী জ্বালানি সংকটে কেমন তব্দা খেয়ে বসে আছে। দেশটি এখন মন্দার দ্বারপ্রান্তে, শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো প্রস্তুতি নিচ্ছে গ্যাস, বিদ্যুৎ রেশনিং করার।

পরিস্থিতি মোকাবেলায় জার্মানিকে এরই মধ্যে বড় একটি গ্যাস সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে জাতীয়করণও করতে হয়েছে। 

অন্যদিকে ইতালি। কিছুদিন পরপরই যার অর্থনৈতিক সংকটের কথা শোনা যায়। তারাই বরং এই জ্বালানি সংকটের কালে তুলনামূলক অনেক ভালো অবস্থানে আছে।

সংকটকালে গ্যাস রেশনিং করা লাগবে না বলে আত্মবিশ্বাসী তারা, দেশটির সরকার সম্প্রতি জ্বালানি নিরাপত্তায় ইতালি ‘ইউরোপের সেরা’ বলে নিজেদের ঢোল নিজেরা পিটিয়েছেও।

রাশিয়ার গ্যাস সরবরাহের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল মহাদেশ ইউরোপে এখন দুই দেশের চিত্র দুই রকম। 

বলা হচ্ছে, রাশিয়ার থেকে গ্যাস না মিললে শীতকালে সবচেয়ে বেশি সংকটে যে দেশগুলো পড়বে তার মধ্যে থাকবে জার্মানি, হাঙ্গেরি ও অস্ট্রিয়া। কম বিপদে পড়বে এমন দেশগুলোর মধ্যে থাকবে ফ্রান্স, সুইডেন, যুক্তরাজ্য, ইতালি।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান উড ম্যাকেঞ্জির তেল ও গ্যাস বিশেষজ্ঞ মার্টিন মারফি বলেছেন, রাশিয়া যদিও দীর্ঘদিন ধরে ইতালির সবচেয়ে বড় গ্যাস সরবরাহকারী, তবুও অন্যান্য সরবরাহকারী এবং আফ্রিকার দেশগুলোর সঙ্গে লম্বা সময়ের যোগাযোগ রোমকে এমন জায়গায় রেখেছে যে রাশিয়ার গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলেও তারা অন্য অনেকের চেয়ে ভালো থাকবে।

আসন্ন ভয়াবহ জ্বালানি সংকট নিয়ে ইউরোপের দেশগুলো যেভাবে মাথা কুটে মরছে, তা ১৯৭০ এর দশকের জ্বালানি সংকটের চিত্রই ফিরিয়ে আনছে। সেবার পশ্চিমা দেশগুলো মধ্যপ্রাচ্যের তেলের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীলতা নিয়ে পুনর্বিবেচনায় নামে, যার ফলশ্রুতিতে ভেনিজুয়েলা ও মেক্সিকোর মতো বিকল্প সরবরাহকারীর খোঁজ বাড়তে থাকে।

ইতালি গত বছর রাশিয়ার কাছ থেকে ২ হাজার ৯০০ কোটি কিউবিক মিটার গ্যাস নেয়, যা ছিল তাদের আমদানি করা গ্যাসের ৪০ শতাংশ। চলতি শীত থেকে তারা অন্য দেশের যে গ্যাস নেওয়ার পরিকল্পনা করছে, তাতে রাশিয়ার ওপর গ্যাসের নির্ভরতা ধীরে ধীরে অনেকখানিই কমিয়ে আনতে পারবে তারা।

অন্য দেশ থেকে যে গ্যাস নেওয়ার পরিকল্পনা করছে তারা, তার বেশিরভাগই যাবে আলজেরিয়া থেকে।

উত্তর আফ্রিকার এ দেশটি গত ২১ সেপ্টেম্বর বলেছে, তারা চলতি বছরই ইতালিতে মোট সরবরাহের পরিমাণ ২০ শতাংশের মতো বাড়িয়ে ২ হাজার ৫২০ কোটি কিউবিক মিটারে নিয়ে যাবে।

এর মধ্য দিয়ে তারা ইতালির সবচেয়ে বড় গ্যাস সরবরাহকারীতে পরিণত হবে।

২০২৩ সালের বসন্তকাল থেকে মিশর, কাতার, কঙ্গো, নাইজেরিয়া আর অ্যাঙ্গোলা থেকে ইতালিতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) সরবরাহও বাড়বে, যা রাশিয়ার গ্যাসের ওপর নির্ভরশীলতা আরও কমিয়ে আনবে, বলেছে এনি।  

অন্যদিকে জার্মানি গত বছর রাশিয়ার কাছ থেকে ৫ হাজার ৮০০ কোটি কিউবিক মিটার গ্যাস আমদানি করেছে, যা তাদের মোট চাহিদার ৫৮ শতাংশ। চলতি বছরের জুনে নর্ড স্ট্রিম ১ পাইপলাইন দিয়ে তাদেরকে গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে দেওয়ার পর অগাস্টে তা পুরোপুরি বন্ধই করে দিয়েছে রাশিয়া।

অন্য দেশ থেকে পর্যাপ্ত গ্যাস পেতে দীর্ঘমেয়াদী চুক্তি করতে না পারা এবং বিভিন্ন দেশে জ্বালানি উত্তোলনে জড়িত নিজেদের এমন বড় তেল-গ্যাস কোম্পানি না থাকায় শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে বার্লিনকে স্পট মার্কেট থেকে নগদ জ্বালানি সংগ্রহে নামতে হয়েছে।

কখনো কখনো তাদেরকে গত বছরের একই সময়ে থাকা দামের আটগুণ বেশি দিয়েও জ্বালানি নিতে হয়েছে। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উত্তর আফ্রিকার সঙ্গে ইতালির ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ কিংবা নর্থ সি-র কারণে যুক্তরাজ্য ও নরওয়ে যে ধরনের সুবিধাজনক অবস্থানে পৌঁছে যেতে পারল, জার্মানির পক্ষে তা সম্ভব নয়।

এর বাইরে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও তাদের হিসাবে গণ্ডগোল হয়েছে। যেমন রাশিয়ার ক্রাইমিয়া দখল পরবর্তী সময়েও তারা সম্ভবত পরিস্থিতি যে কয়েক বছরের মধ্যে আরও জটিল পর্যায়ে চলে যাবে, সে অনুমান করতে পারেনি।  

২০০৬ সালেও ইতালিকেই রাশিয়ার গ্যাসের জন্য জোরে ছুটতে দেখা যাচ্ছিল, আর গত ৮ বছরে চিত্রটা অন্যরকম হয়ে গেছে। জার্মানি রুশ গ্যাসের ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে, ইতালি খুঁজেছে অন্য উৎস।

লিবিয়া, নাইজেরিয়া, কঙ্গোয় নানান প্রকল্প দেখভাল করা অনুসন্ধান ও উৎপাদন বিশেষজ্ঞ দেসকালজি জ্বালানি জায়ান্ট এনির দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই ইতালি এ নতুন পথে যাত্রা শুরু করে।

দেসকালজি সেই কাজেই মনোযোগ দেন, যা তিনি সবচেয়ে বেশি জানতেন। সেটি হলো- আফ্রিকায় জ্বালানি অনুসন্ধান।

বড় সাফল্য মেলে ২০১৫ সালেই, এনি ভূমধ্যসাগরের সবচেয়ে বড় গ্যাস ক্ষেত্র জোহর আবিষ্কার করে বসে। দেসকালজি যত দ্রুত সম্ভব প্রকল্প বাস্তবায়নে জোর দিলে মাত্র আড়াই বছরের মধ্যে এনি উৎপাদন শুরু করে দেয়।

কোম্পানিটি ২০১৯ সালে আলজেরিয়ার কাছ থেকে ২০২৭ সাল পর্যন্ত গ্যাস আমদানির চুক্তিও করে ফেলে।

এ ধরনের পদক্ষেপই ইতালিকে এখন বিপদমুক্ত রাখছে। অন্যদিকে জার্মানির হাতে এখন দৃশ্যমান বিকল্পের খুবই অভাব।

জ্বালানি সংকটে কম ক্ষতিগ্রস্ত হলে ইতালির অর্থনীতি অন্যদের তুলনায় ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে উঠবে। আর জার্মানি যদি শিগগিরই সংকট থেকে উত্তরণের পথ না করতে পারে, তাহলে তাদের এতদিনের অর্থনৈতিক অর্জন মুখ থুবড়ে পড়বে।

এসব বিষয়ে রয়টার্স কথা বলতে চাইলে ইতালির সরকার রাজি হয়নি।

জার্মানির অর্থমন্ত্রী বলেছেন, তারা যত দ্রুত সম্ভব রাশিয়ার গ্যাস আমদানি থেকে বের হতে এবং অন্য উৎস থেকে গ্যাস পাওয়া নিশ্চিত করতে চান।

এর প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) ৫টি ভাসমান টার্মিনাল ইজারা নেওয়ার মতো কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

জার্মানির এখন কোনো এলএনজি টার্মিনাল নেই। অন্যদিকে ইতালির ৩টি টার্মিনাল এখনই সচল, সম্প্রতি তারা আরও দুটি টার্মিনালও কিনেছে।