ট্রাম্প এখন ক্ষমতায় নেই, নানা প্রতিকূলতায়ও তিনি অবিচল। আর হ্যারিস ট্রাম্প নন কিংবা বাইডেনও নন- দু’জনই তাদের কিছু বৈশিষ্ট্যের কারণে ভোটারদের সমর্থন পাচ্ছেন।
Published : 04 Nov 2024, 08:09 PM
যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের আর মাত্র একদিন বাকি। জনমত জরিপগুলোর ফলে দুই প্রার্থীর মধ্যে ব্যবধান কম থাকায় ধারণা করা যায়, ডনাল্ড ট্রাম্প বা কমলা হ্যারিস যিনিই জিতুন না কেন খুব অল্প ভোটের হেরফের হবে। দুইজনের মধ্যে যে কোনও একজন দুই বা তিন পয়েন্ট এগিয়ে থাকতে পারেন।
ঠিক কী কী কারণে হ্যারিস বা ট্রাম্প জিততে পারেন তার ১০টি কারণ তুলে ধরেছেন বিশ্লেষকরা।
১৩০ বছরের মধ্যে প্রথম একজন পরাজিত প্রেসিডেন্ট পুনঃনির্বাচিত হতে পারেন এমন ইতিহাস সৃষ্টির সম্ভাবনা দিয়ে শুরু করে তারা বলছেন:
ট্রাম্প জিততে পারেন কারণ...
১. তিনি ক্ষমতায় নেই
এবারের ভোটের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু অর্থনীতি। যেখানে দেখানো হচ্ছে, বেকারত্ব কম এবং স্টক মার্কেট ফুলে ফেঁপে উঠছে, সেখানে বেশিরভাগ আমেরিকান বলেছেন, তারা প্রতিদিন উচ্চ মূল্যের সাথে লড়াই করছেন।
করোনাভাইরাস মহামারী পরবর্তী সময়ে ১৯৭০-এর দশকের পর থেকে মুদ্রাস্ফীতি এমন উচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে যে এবারের নির্বাচনী প্রচারণায় এটাই ছিল ট্রাম্পের প্রধান ‘ট্রাম্প কার্ড’। মুদ্রাস্ফীতিই ট্রাম্পকে জিজ্ঞাসা করার সুযোগ দিয়েছে, "আপনি কি চার বছর আগের চেয়ে এখন ভাল আছেন?"
২০২৪ সালে, বিশ্বজুড়ে ভোটাররা বেশ কয়েকবার ক্ষমতায় থাকা দলকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। বিশেষ করে কোভিড-পরবর্তী জীবনযাত্রা ব্যয়ের কারণে। মার্কিন ভোটাররাও পরিবর্তনের জন্য মুখিয়ে আছে বলে মনে হচ্ছে। মাত্র এক-চতুর্থাংশ আমেরিকান বলেছেন, তারা দেশটি যে দিকে যাচ্ছে তাতে সন্তুষ্ট।
কমলা হ্যারিস তথাকথিত পরিবর্তনের প্রার্থী হওয়ার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসাবে অজনপ্রিয় জো বাইডেনের কাছ থেকে নিজেকে দূরে রাখতে তিনি লড়াই করছেন।
২. দুঃসংবাদেও তার অবিচল ভাবমূর্তি:
২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি ইউএস ক্যাপিটলে দাঙ্গা, একের পর এক অভিযোগ এবং ফৌজদারি অপরাধে নজিরবিহীনভাবে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পরও ট্রাম্পের সমর্থন সারা বছর ৪০% বা তারও বেশি স্থিতিশীল থেকেছে।
ডেমোক্র্যাটরা এবং 'নেভার-ট্রাম্প' রক্ষণশীল আন্দোলনকারীরা বলছেন, তিনি হোয়াইট হাউজের জন্য অযোগ্য। আর বেশিরভাগ রিপাবলিকানই ট্রাম্পের সঙ্গে একমত যে, তিনি রাজনৈতিক উইচ-হান্ট এর শিকার।
দুই পক্ষেরই এই ধারণা এত বদ্ধমূল যে, ট্রাম্পের এখন দরকার সিদ্ধান্তহীন ভোটারদের সেই অংশের যথেষ্ট সমর্থন জেতা- যাদের তার সম্পর্কে এমন কোনও বদ্ধমূল ধারণা বা দৃষ্টিভঙ্গি নেই।
৩. অবৈধ অভিবাসন নিয়ে তার সতর্কবার্তার অনুরণন
অর্থনৈতিক অবস্থার বাইরেও আবেগের টান আছে এমন কোনও বিষয় থেকেই প্রায় ক্ষেত্রে নির্বাচনের ফল নির্ধারণ করে দেয় ভোটাররা। ডেমোক্র্যাটদের প্রত্যাশা, এ বিষয়টি হয়ত গর্ভপাত হবে। যে ইস্যু নিয়ে তারা প্রচার চালিয়েছে। আর টাম্প বাজি ধরে বলছেন, এটি অভিবাসন।
বাইডেনের শাসনামলে সীমান্তে বিনা বিচারে হত্যার সংখ্যা রেকর্ড স্তরে পৌঁছেছে। সীমান্ত থেকে দূরের রাজ্যগুলোতে অভিবাসনের সংখ্যাও প্রভাব ফেলেছে। এর প্রেক্ষাপটে নির্বাচনি জরিপগুলোতে দেখা যাচ্ছে, ভোটাররা অভিবাসনের বিষয়ে ট্রাম্পের উপর বেশি আস্থা রেখেছে। ল্যাটিনোদের মধ্যেও ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা আগেরবারের চেয়ে অনেক বেড়েছে।
৪. কৃষ্ণাঙ্গ ও হিসপ্যানিস পুরুষদের সমর্থন:
শেষ সময়ের পরিচালিত জরিপগুলোতে হিসপ্যানিক পুরুষ এবং কৃষ্ণাঙ্গ ভোটারদের মধ্যে সমর্থন বেশি পেতে দেখা যাচ্ছে রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ডনাল্ড ট্রাম্পকে।
যে হিসপ্যানিকদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই ডেমোক্র্যাটরা সমর্থন বেশি সমর্থন পেয়ে এসেছে, তাদের সেই সমর্থন বিশেষত: পুরুষদের মধ্যে বলতে গেলে এবার ৫ নভেম্বরের নির্বাচনের আগে দিয়ে প্রায় উবেই গেছে।
রয়টার্স/ইপসোস পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে, এই হিসপ্যানিক পুরুষদের সমর্থনে আগের তুলনায় এগিয়ে গেছেন ট্রাম্প।
নিউ জার্সির হিসপ্যানিক এক ভোটার বলেছেন, তিনি ব্যবসায়ী হিসাবে ট্রাম্পের পেশাকে শ্রদ্ধা করেন এবং তাকেই ভোট দেবেন বলে স্থির করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রে হিসপ্যানিক ভোটারের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। ১৯৭০ এর দশক থেকেই হিসপ্যানিক ভোটাররা বেশির ভাগ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটদেরকে অনেক বেশি সমর্থন দিয়ে এসেছে। অথচ এবছরের নির্বাচনে তাদেরই উল্লেখযোগ্য সমর্থন পেয়েছেন রিপাবলিকান প্রার্থী ট্রাম্প।
৫. অস্থিতিশীল বিশ্বে ট্রাম্পকে শক্তিশালী মানুষ হিসেবে দেখা হয়
ট্রাম্পের সমালোচকদের কথায়, তিনি কর্তৃত্ববাদী নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে আমেরিকার জোটকে দুর্বল করছেন।
সাবেক এই প্রেসিডেন্ট অবশ্য তার অপ্রত্যাশিতভাবে কিছু করার বৈশিষ্ট্যকে একটি শক্তি হিসেবে দেখছেন। ট্রাম্প এও উল্লেখ করেছেন যে, তিনি হোয়াইট হাউজে থাকাকালে কোনও বড় যুদ্ধ শুরু হয়নি।
যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেইন ও ইসরায়েলে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার পাঠানোয় অনেক আমেরিকান ক্ষুব্ধ এবং বাইডেনের অধীনে আমেরিকা দুর্বল বলে মনে করেন।
বেশিরভাগ ভোটার, বিশেষ করে পুরুষরা হ্যারিসের চেয়ে ট্রাম্পকেই শক্তিশালী নেতা হিসেবে দেখে।
হ্যারিস জিততে পারেন কারণ
১. তিনি ট্রাম্প নন
ট্রাম্পের সুবিধা থাকা সত্ত্বেও তিনি গভীর মেরুকরণকারী ব্যক্তিত্ব হিসাবে রয়ে গেছেন।
২০২০ সালে তিনি রিপাবলিকান প্রার্থীর পক্ষে রেকর্ড সংখ্যক ভোট জিতেছিলেন। কিন্তু পরাজিত হয়েছিলেন কারণ আরও ৭০ লাখ আমেরিকান বাইডেনকে সমর্থন করেছিলেন।
এবার হ্যারিস ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছেন। তিনি তাকে 'ফ্যাসিবাদী' এবং গণতন্ত্রের জন্য হুমকি বলে অভিহিত করেছেন। ট্রাম্পের নাটকীয় কীর্তিকলাপ এবং সংঘাতের পথ থেকে সরে তিনি ভিন্ন পথে চলার অঙ্গীকার করেছেন।
জুলাইয়ে রয়টার্স/ইপসোসের এক জরিপে দেখা গেছে, প্রতি পাঁচজন মার্কিনির মধ্যে চারজন মনে করেন দেশ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। কমলা হ্যারিস আশা করছেন, ভোটাররা, বিশেষ করে মধ্যপন্থি রিপাবলিকান ও স্বতন্ত্ররা তাকে স্থিতিশীলতা ফেরাতে সম্ভাবনাময় একজন প্রার্থী হিসেবে দেখবে।
২. তিনি বাইডেনও নন
বাইডেন দৌড় থেকে ছিটকে পড়ার পর ডেমোক্র্যাটরা প্রায় নিশ্চিত পরাজয়ের মুখোমুখি হয়েছিল। ট্রাম্পকে পরাজিত করার আকাঙ্ক্ষায় একাট্টা হয়ে দলটি দ্রুত হ্যারিসকে নিয়ে সমাবেশ করেছিল।
বাইডেনের অজনপ্রিয় নীতির ধারাই হ্যারিস অনুসরণ করবেন বলে রিপাবলিকানরা তাকে ভোটারদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করলেও, হ্যারিস তা খন্ডন করেছেন।
এর আগে বাইডেনের বয়স নিয়ে বিতর্ক ছিল, যেটা হ্যারিসের বয়স নিয়ে নেই। এখন নির্বাচনি দৌড় উল্টে গেছে। এ দৌড়ে এখন ট্রাম্পই সবচেয়ে বয়স্ক ব্যক্তি।
৩. তিনি নারী অধিকারের চ্যাম্পিয়ন
যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট রো ভি ওয়েড এবং গর্ভপাতের সাংবিধানিক অধিকার বাতিল করার পর এটিই প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন।
গর্ভপাতের অধিকার রক্ষা নিয়ে উদ্বিগ্ন ভোটাররা অপ্রতিরোধ্যভাবে হ্যারিসকে সমর্থন করেছেন। অতীতের নির্বাচনগুলিতে দেখা গেছে- বিশেষত ২০২২ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচন - গর্ভপাত একটি অন্যতম প্রধান ইস্যু এবং নির্বাচনের ফলে প্রভাব ফেলতে পারে।
এবার দোদুল্যমান রাজ্য অ্যারিজোনাসহ ১০টি রাজ্যে ভোটারদের কাছে জানতে চাওয়া হবে গর্ভপাতের বিষয়টি কীভাবে পরিচালনা করা উচিত। এর ফলে ভোটার উপস্থিতি কমলা হ্যারিসের পক্ষে যেতে পারে।
প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হওয়ার ইতিহাস গড়ার পথে যাওয়ার হ্যারিসের সম্ভাবনার কারণে নারী ভোটারদের মধ্যে তিনি শক্তিশালী সমর্থন পেতে পারেন।
৪. তার ভোটার উপস্থিতি বেশি হওয়ার সম্ভাবনা
কমলা হ্যারিসকে বেশি ভোট দেবেন, তরুণ কলেজে পড়ুয়ারা ও বয়স্ক ব্যক্তিরা।
নিউইয়র্ক টাইমস/সিয়েনার জরিপে দেখা গেছে, ২০২০ সালে যারা নিবন্ধিত ছিলেন কিন্তু ভোট দেননি তাদের মধ্যে ট্রাম্প বিশাল ব্যবধানে এগিয়ে আছেন।
এবার তারা হাজির হবেন কি না, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
৫. তিনি নির্বাচনের জন্য বিপুল অর্থ সংগ্রহ ও ব্যয় করেছেন
এটা কোনো গোপন বিষয় নয় যে, আমেরিকার নির্বাচন ব্যয়বহুল এবং ২০২৪ সালের নির্বাচন এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ব্যয়বহুল হওয়ার পথে রয়েছে। এবার খরচ করার ক্ষেত্রে হ্যারিস শীর্ষে।
ফিনান্সিয়াল টাইমসের সাম্প্রতিক বিশ্লেষণ অনুসারে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে পুরো সময়কালে ট্রাম্প যতটা তহবিল সংগ্রহ করতে পেরেছেন হ্যারিস জুলাইয়ে প্রার্থী হওয়ার পর থেকে তার চেয়ে অনেক বেশি তহবিল সংগ্রহ করতে পেরেছেন। একইভাবে নির্বাচনি প্রচার এবং বিজ্ঞাপনে ট্রাম্পের চেয়ে দ্বিগুণ খরচও করেছেন হ্যারিস।
তার এই খরচই কাজে আসতে পারে দোদুল্যমান রাজ্যগুলোতে হা্ড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে ভোট দলে টানতে। বিজ্ঞাপনের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে সেখানে হ্যারিসের পক্ষে ভোট দিতে পারে ভোটাররা।