যে তিন কারণে ক্রিপ্টোকারেন্সি নিয়ে ‘ভয়ে আছে’ আইএমএফ

ক্রিপ্টোকারেন্সি প্রযুক্তির ঊর্ধ্বমুখী ‘গতি’ নিয়ে গভীর শঙ্কায় ভুগছে ‘ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড (আইএমএফ)”। ক্রিপ্টোকারেন্সি প্রযুক্তির অগ্রগতি এবং এর বাজার এতো দ্রুত  বিস্তার লাভ করছে যে এর সঙ্গে তাল মেলাতে পারছেন না আইনপ্রণেতা ও নীতিনির্ধারকরা।

প্রযুক্তি ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 Dec 2021, 10:59 AM
Updated : 26 Dec 2021, 10:59 AM

ডিজিটাল মুদ্রা খাতের সংশ্লিষ্টদের অভিজ্ঞতার অভাব, গ্রাহক ঝুঁকি আর সন্ত্রাসী ও উগ্রপন্থী কর্মকাণ্ডে এই প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে শঙ্কিত আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থাটি।

সিএনবিসি’র প্রতিবেদন বলছে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে দুই লাখ কোটি ছাড়িয়েছে ক্রিপ্টো সম্পদের বাজার মূল্য, যা আগের বছরের তুলনায় ১০ গুণ বেশি। আর এই তথ্য উঠে এসেছে আইএমএফের প্রতিবেদন থেকেই।

এই প্রসঙ্গে অক্টোবর মাসেই আইএমএফ-এর সহকারী বিভাগ প্রধান ইভান পাপ্পাজিওর্জিও সিএনবিসি-কে বলেছেন, “ক্রিপ্টোকারেন্সি বাজার নজর কাড়ার মতো বেড়েছে… পুরো প্রক্রিয়াটি উল্লেখযোগ্য স্থিতিশীলতা দেখাচ্ছে কিন্তু বেশ কিছু কৌতুহল উদ্দীপক স্ট্রেস টেস্টও হয়েছে।”

ক্রিপ্টোকারেন্সি বা ডিজিটাল মুদ্রা খাতের যে বিষয়গুলো নিয়ে আইএমএফ সবচেয়ে বেশি শঙ্কিত তার মধ্যে প্রথমেই আছে এই খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। সাম্প্রতিক সময়ে যারা ক্রিপ্টোকারেন্সির মাঠে নেমেছেন তাদের “ব্যবস্থাপনা, নিয়ন্ত্রণ এবং ঝুঁকি মোকাবেলার” ক্ষেত্রে যথেষ্ট অভিজ্ঞতার অভাব রয়েছে বলে মন্তব্য করেছে আইএমএফ।

এমন পরিস্থিতিতে ভোক্তারাই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছেন বলে মনে করছে সংস্থাটি। এই খাতে যথেষ্ট “নজরদারির” অভাব রয়েছে এবং ভেতরের খুঁটিনাটি প্রকাশ করা হচ্ছে না বলে মন্তব্য আইএমএফের। এ ছাড়াও ‘ক্রিপ্টো সম্পদ” থেকে “ডেটা গ্যাপ” তৈরি হচ্ছে এবং এই প্রযুক্তি অর্থপাচার এবং সন্ত্রাসী ও উগ্রপন্থীগোষ্ঠীগুলোর জন্য লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে বলে আশঙ্কা আইএমএফের।

এই খাতে বিনিয়োগ আরও নিরাপদ করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের আহ্বান জানিয়েছে বিভিন্ন আর্থিক ও পর্যবেক্ষক সংস্থা। তারপরও ক্রিপ্টোকারেন্সি প্রশ্নে বাজার সংশ্লিষ্টদের মধ্যে বিভক্তি স্পষ্ট। কেউ এই প্রযুক্তিকে দেখছেন বর্তমান আর্থিক ব্যবস্থার উত্তরসূরী হিসেবে, কেউবা একে বিবেচনা করছেন বৈশ্বিক ও জাতীয় অর্থনীতির জন্য মারাত্মক ঝুঁকি হিসেবে।

পরিস্থিতি আরও জটিল করছেন সামাজিক মাধ্যম ‘ইনফ্লুয়েন্সাররা’

বর্তমান পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে করে তুলছে ক্রিপ্টো খাতের সঙ্গে সামাজিক মাধ্যমের ইনফ্লুয়েন্সারদের সংশ্লিষ্টতা। এই বিষয়ে সতর্ক থাকতে বলেছে যুক্তরাজ্যের আর্থিক লেনদেন বিষয়ক নিয়ন্ত্রক সংস্থা ‘ফাইন্যান্সিয়াল কনডাক্ট অথোরিটি (এফসিএ)’।

“প্রতারকরা সামজিক মাধ্যমের ইনফ্লুয়েন্সারদের আর্থিক সুবিধা দিয়ে জ্বল্পনা-কল্পনার ভিত্তিতে নতুন টোকেনের দাম বাড়িয়ে আবার বেচে দিয়ে মুনাফা লুটে নিচ্ছে নিয়মিত ভাবে। কিছু ইনফ্লুয়েন্সার এমন ক্রিপ্টো কয়েন নিয়ে প্রচারণা চালিয়েছেন যে পরে দেখা যায় যে তার অস্তিত্বই নেই।”-- সেপ্টেম্বর মাসেই এই বক্তব্য দিয়েছিলেন এফসিএ প্রধান চার্লস র‌্যান্ডাল।

এই প্রযুক্তিটি এতোটাই নতুন যে, “পুরো একটা আর্থিক বছরে এই খাতে কী হবে সেটাও দেখিনি আমরা। কখন বা কোথায় গিয়ে যে এই গল্প শেষ হবে তা-ও জানি না আমরা। কিন্তু– নতুন অনেক কিছুর সঙ্গেই যা হয়, শেষটা হয়তো ভালো হবে না।” –যোগ করেন তিনি।

ইনস্টাগ্রামে কিম কারদাশিয়ানের ফলোয়ার সংখ্যা ২০ কোটির বেশি। বছরের শুরুতেই ‘ইথেরিয়ামম্যাক্স’ নামের এক ক্রিপ্টোমুদ্রার বিজ্ঞাপনী প্রচারণা চালিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু শুরুতেই ওই নয়া ক্রিপ্টো কয়েনের নির্মাতাদের নিয়ে তথ্যের অভাবের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন সমালোচকরা। উত্তরে কারদাশিয়ান নিজের পোস্টে ক্যাপশন জুড়ে দেন “এটি কোনো আর্থিক পরামর্শ নয় বরং বন্ধুরা আমাকে ইথেরিয়াম ম্যাক্স টোকেন নিয়ে যা বলেছে সেটাই শেয়ার করছি আমি।” নিজের পোস্টের সঙ্গে #অ্যাড (#ad) জুড়ে দেন তিনি। অর্থ সুবিধার বিনিময়ে কোনো কিছুর বিজ্ঞাপনী প্রচারণা চালালে সেটি জানান দেওয়ার জন্য ওই হ্যাশট্যাগটি জুড়ে দিতে হয় সামাজিক মাধ্যমের কনটেন্ট প্রকাশকদের।

ক্রিপ্টোকারেন্সি নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিজ্ঞাপনী প্রচারণায় অংশ নিয়েছেন সামাজিক মাধ্যমের আরও ইনফ্লুয়েন্সার।

“জাকজমকপূর্ণ জীবনচিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করছে এমন পোস্টের পাশেই ক্রিপ্টোকারেন্সির বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে। আমার মনে হয় তরুণ বয়সীদের জন্য এই সংশ্লিষ্টতা বিপজ্জনক এবং ক্ষতিকারক।”-- অক্টোবরেই সিএনবিসি’র কাছে এই মন্তব্য করেন ব্যক্তিগত আর্থিক ব্যবস্থাপক মায়রন জবসন।

সমাধান কী তবে প্রমিতকরণ?

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ক্রিপ্টোকারেন্সি নিয়ে বিজ্ঞাপনী প্রচারণার উপর নজর রাখা এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ঝুঁকি সম্পর্কে ভোক্তাদের পরিষ্কার তথ্য দেওয়া উচিত নীতিনির্ধারকদের। এক দিনের ব্যবধানে আকাশ-পাতাল পরিবর্তন আসছে এই ডিজিটাল মুদ্রার বাজারে।

এই খাতে তরুণদের আগ্রহ নিয়েও বিপাকে পরেছেন নীতিনির্ধারকরা। সিএনবিসি জানিয়েছে, এখন ঋণ নিয়ে বা ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে ক্রিপ্টোকারেন্সি খাতে জীবনের প্রথম বিনিয়োগ করছেন পশ্চিমা তরুণদের মধ্যে অনেকেই।

জুন মাসে এফসিএ থেকে প্রকাশিত তথ্য বলছে, কেবল যুক্তরাজ্যেই ক্রিপ্টোকারেন্সির মালিক হয়ে বসে আছেন অন্তত ২৩ লাখ মানুষ। এর মধ্যে ১৪ শতাংশ ডিজিটাল মুদ্রা কিনেছেন ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে এবং ১২ শতাংশের ধারণা কোনো জটিলতার সৃষ্টি হলে এফসিএ রক্ষা করবে তাদের। কিন্তু সংস্থাটি বলছে, এমন ভোক্তাদের কোনো রকমের সুরক্ষা দেবে না তারা।

জুলাই মাসে ১৮ থেকে ২৯ বছর বয়সী এক হাজার অংশগ্রহণকারীর উপর পরিচালিত এক জরিপ বলছে, ডোজকয়েনে বিনিয়োগ করতে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করেছেন অংশগ্রহণকারীদের ২৭ শতাংশ। ‘স্টুডেন্ট লোন’ নিয়ে বিনিয়োগ করেছেন ১৭ শতাংশ এবং ভিন্ন খাত থেকে নানাভাবে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করেছেন ১২ শতাংশ।

এই পরিস্থিতি বিনিয়োগকারীদের উভয় সঙ্কটে ফেলতে পারে; যে মুদ্রায় বিনিয়োগ করেছেন, তার মূল্যহ্রাসের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন বিনিয়োগকারী, অন্যদিকে মাথায় নেমে আসতে পারে ঋণের বোঝা।

সার্বিক পরিস্থিতি যখন এমন ঘোলাটে, আইএমএফ তখন বলছে, এই খাতের জন্য আন্তর্জাতিক বাজারে প্রযোজ্য কিছু সাধারণ নীতিমালা প্রতিষ্ঠা করতে কাজ করা উচিত বাজার নিয়ন্ত্রকদের। এই খাতটি এমন যে, এখানে ডেটার প্রমিতকরণ এবং সীমানা পেরিয়ে নজর রাখার সক্ষমতা অর্জনের চেষ্টা অতি গুরুত্বপূর্ণ।

আইএমএফ বলছে, “সময় এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং কাজগুলো হতে হবে সিদ্ধান্তমূলক, দ্রুতগতির এবং বৈশ্বিকভাবে সমন্বিত যেন সবাই লাভবান হওয়ার পাশাপাশি দুর্বলতাগুলো মোকাবেলা করা যায়।”