রেকর্ডটি নিজের করে নিতে হলে অতিমানবীয় কিছুই করে দেখাতে হবে ম্যানচেস্টার সিটি স্ট্রাইকারকে।
Published : 04 Feb 2023, 12:34 AM
ফুটবলে যে কয়টি রেকর্ড ভাঙা ‘অসম্ভব’ মনে করা হয়, এর একটি ইংল্যান্ডের শীর্ষে লিগে এক মৌসুমে সর্বোচ্চ গোল। যেখানে পঞ্চাশই ছুঁতে পারেননি কেউ সেখানে ৬০ গোল তো অচিন্তনীয় ব্যাপার। তবে কেউ কেউ ভাবছেন, প্রায় শতাব্দী ধরে টিকে থাকা রেকর্ডও হয়তো ভাঙা সম্ভব! আর সেটি করতে পারেন আর্লিং হলান্ড। কিন্তু প্রিমিয়ার লিগে স্বপ্নের মতো শুরু করা ম্যানচেস্টার সিটির তারকা স্ট্রাইকার কি সত্যিই ছুঁতে পারবেন উইলিয়াম রালফ ডিনের অবিশ্বাস্য কীর্তি?
তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ প্রিমিয়ার লিগে হলান্ড কেমন করবেন, তা নিয়ে অনেকেরই ছিল সংশয়। সিটিতে যোগ দেওয়ার পর থেকে এই শঙ্কা অমূলক প্রমাণ করতে বেশি সময় নেননি তিনি। একের পর এক গোল করে যেভাবে ছুটছেন, তাতে মৌসুম শেষে অনেক রেকর্ডের পাশেই হয়তো থাকবে তার নাম। প্রাক-প্রিমিয়ার লিগ যুগে ডিনের করা ৬০ গোলের রেকর্ড কি হবে এর একটি?
‘ফেনোমেনন’, ‘অতিমানবীয়’, ‘গোলমেশিন’ - এমন অনেক বিশেষণেই তুলে ধরা হচ্ছে হলান্ডকে। সেটি সিটিতে যোগ দেওয়ার পর থেকে তার দুর্দান্ত ফর্ম ও রেকর্ড ভাঙার কারণেই।
সিটিতে নিজের সামর্থ্যের জানান দিতে খুব বেশি সময় নেননি হলান্ড। ইংল্যান্ডের শীর্ষ লিগে নিজের প্রথম আট ম্যাচে টানা দুটি হ্যাটট্রিকসহ করেন ১৪ গোল। লিগে এখন পর্যন্ত ১৯ ম্যাচে ২৫ বার জালের দেখা পেয়েছেন নরওয়ের এই স্ট্রাইকার।
যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছেন, তাতে প্রিমিয়ার লিগের ইতিহাসে এক মৌসুমে সর্বোচ্চ ৩৪ গোলের রেকর্ড (যৌথভাবে অ্যান্ডি কোল ও অ্যালান শিয়েরার) নিজের করে নেওয়া খুব কঠিন হওয়ার কথা নয় হলান্ডের জন্য।
তবে প্রাক-প্রিমিয়ার লিগ রেকর্ডের কী হবে? ১৯২৭-২৮ মৌসুমে এভারটনকে লিগ জেতানোয় সবচেয়ে বড় অবদান রাখার পথে ডিন করেছিলেন ৬০ গোল। সেবার ৪২ ম্যাচের তিনটিতে তিনি খেলেননি।
সেই কীর্তি গড়ার অনেক বছর পর নিজের রেকর্ড সম্পর্কে ডিন বলেছিলেন, “লোকেরা আমাকে জিজ্ঞেস করে যে ৬০ গোলের রেকর্ডটি কখনও ভাঙবে কী-না। আমার মনে হয় এটি ভাঙবে। কিন্তু শুধুমাত্র একজন মানুষই তা করতে পারবে। সেই ব্যাক্তি যে অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে। আমার মনে হয়, সে-ই হবে একমাত্র ব্যক্তি।”
১৯২৫-২৬ মৌসুমে ইংল্যান্ডের শীর্ষ লিগে ব্ল্যাকবার্ন রোভার্সের হয়ে ৪৩ গোল করে রেকর্ড গড়েন টেড হার্পার। কিন্তু মাত্র দুই বছরের মধ্যে তা নিজের করে নেন ডিন।
১৯৩০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে প্রেস্টন নর্থ এন্ডের হয়ে খেলার সময়ে তার বিপক্ষে খেলেছিলেন সাবেক লিভারপুল কোচ বিল শ্যাঙ্কলি। তার চোখে, ডিন অতুলনীয়।
“ডিক্সি (ডিন) ছিলেন সর্বকালের সেরা সেন্টার ফরোয়ার্ড। তার গোল করার রেকর্ড এই পৃথিবীর সবচেয়ে চমকপ্রদ ব্যাপার। বিটোভেন, শেক্সপিয়ার, রেমব্রান্টের মতো সর্বশ্রেষ্ঠদের সঙ্গে এক কাতারেই থাকবে তার নাম।”
প্রশ্নটা তাহলে চলেই আসে যে, ডিন আসলে কতটা ভালো ছিলেন? ভিন্ন ভিন্ন যুগ ধরে তুলনা করা কঠিন। তবে তাকে তার সমসাময়িক খেলোয়াড়দের সঙ্গে তুলনা করলে একটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে। ১৯২৭-২৮ মৌসুমের আগের ও পরের তিন বছরের দিকে তাকালে দেখা যায়, ইংল্যান্ডের প্রথম বিভাগে সেরা গোলস্কোরাররা গড়ে ৪০টি করে গোল করেছিলেন।
ডিন তাদের চেয়ে পঞ্চাশ শতাংশ বেশি গোল করেছিলেন। তার রেকর্ডের সবচেয়ে কাছাকাছি এসেছিলেন টম ওয়ার্নিং। ১৯৩০-৩১ মৌসুমে অ্যাস্টন ভিলার হয়ে তিনি জালের দেখা পেয়েছিলেন ৪৯ বার।
এরপর থেকে ইংল্যান্ডের শীর্ষ লিগে এক মৌসুমে ৪০ গোল করাই দুঃসাধ্য। ৬০ বছরেরও বেশি সময় আগে সবশেষ খেলোয়াড় হিসেবে ৪০ বা তার চেয়ে বেশি গোল করেছিলেন জিমি গ্রিভস।
ডিনের রেকর্ড গড়া মৌসুমের সঙ্গে হলান্ডের চলতি মৌসুমের তুলনা করলে কিছু মিল পাওয়া যাবে। দুজনই নিজেদের প্রথম ম্যাচে গোল করেছিলেন, উভয়ই নিজ নিজ অষ্টম ম্যাচে ১২তম গোলের দেখা পেয়েছিলেন। হলান্ড তার অষ্টম লিগ ম্যাচে ম্যানচেস্টার ডার্বিতে হ্যাটট্রিক করেন, তার দল জেতে ৬-৩ গোলে। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে নিজের নবম লিগ ম্যাচে দলের ৫-২ গোলে জয়ের ম্যাচে সবগুলো গোলই ডিন করেছিলেন।
শুরুটা একই গতিতে হলেও এই মুহূর্তে অবশ্য কিছুটা পিছিয়ে পড়েছেন হলান্ড, অন্তত ডিনের তুলনায়। ১৯ ম্যাচ পর সিটি স্ট্রাইকারের নামের পাশে রয়েছে ২৫ গোল, সমান ম্যাচে ডিন করেছিলেন ৩০টি।
যে তিনটি ম্যাচ মিস করেছিলেন, সেগুলোতে খেললে ডিনের গোল কত হতো, এই প্রশ্নের জবাব কখনও জানা সম্ভব হবে না। ইংল্যান্ড দলে ডাক পাওয়ার কারণে তার মিস করা ম্যাচের একটি ছিল ওয়েস্ট হ্যাম ইউনাইটেডের বিপক্ষে। ওই ম্যাচে প্রতিপক্ষকে উড়িয়ে তার দল জিতেছিল ৭-০ গোলে। ওই ম্যাচে খেললে কয়টি গোল করতে পারতেন ডিন?
১৯২৮ সালের মার্চে আগের গোল রেকর্ড ভেঙে দেওয়ার পর তিন ম্যাচে জালের দেখা পাননি ডিন। এরপর শেষের আট ম্যাচে ১৭ গোল করে ৬০ গোলের মাইলফলক স্পর্শ করেন তিনি, যার মধ্যে রয়েছে আর্সেনালের বিপক্ষে মৌসুমের শেষ ম্যাচে হ্যাটট্রিক। এর মাধ্যমে তিনি জর্জ ক্যামসেলের ফুটবল লিগে করা এক মৌসুমে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড ভেঙে দেন। দ্বিতীয় বিভাগে ৫৯টি গোল করেছিলেন ক্যামসেল।
ডিনের রেকর্ডটি এমনই উচ্চতার, যার নাগাল হয়তো নাও পেতে পারেন হলান্ড। তবে প্রিমিয়ার লিগের রেকর্ড রয়েছে তার নাগালের মধ্যেই। ১৯৯৪ সালে নিউক্যাসল ইউনাইটেডের হয়ে ৪০ ম্যাচে ৩৪টি গোল করেন কোল। এক মৌসুম পর তাকে স্পর্শ করেন শিয়েরার, তিনি ম্যাচ খেলেন দুটি বেশি।
৩৮ ম্যাচের প্রিমিয়ার লিগের সবচেয়ে বেশি গোলের রেকর্ডটি এখন আছে লিভারপুল ফরোয়ার্ড মোহামেদ সালাহর (৩২) দখলে।
শিয়েরার লিগে ৩০ বা তার বেশি গোল করেছেন তিনবার। এই তালিকায় নেই মাইকেল ওয়েন, রবি ফাউলার, দিদিয়ের দ্রগবা ও সের্হিও আগুয়েরোর মতো প্রিমিয়ার লিগের গ্রেটরা।
এখন যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছেন, তা ধরে রাখলে প্রিমিয়ার লিগে গোলের রেকর্ড ভাঙতে হলান্ডের প্রয়োজন হবে ২৭ ম্যাচ। সেই হিসেবে আগামী ১৮ মার্চ ওয়েস্ট হ্যাম ইউনাইটেডের বিপক্ষে ম্যাচে রেকর্ড নিজের করে নিতে পারেন ২২ বছর বয়সী এই ফুটবলার।
ডিনের ৬০ গোলের রেকর্ড নাগালের বাইরে থেকে গেলেও ১৯৬১ সালের গ্রিভসের পর প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে ৪০টি গোল করতে পারেন হলান্ড।
১৯২৭-২৮ মৌসুমে ম্যাচপ্রতি গড়ে গোল হয়েছিল ৩.৮টি। সেই তুলনায় ২০২২-২৩ মৌসুমে ম্যাচপ্রতি গোল গড় ২.৮। ডিন যদি এই মৌসুমে প্রিমিয়ার লিগে খেলতেন, তাহলে মৌসুম শেষে তার গোল হতো ৪৪টি; যা হলান্ড যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছেন সেই হিসেবে মৌসুম শেষে তার চেয়ে কিছুটা কম হতো ডিনের। তবে ৬০ গোলের সীমানা হলান্ডের ধরাছোঁয়ার বাইরে বলেই মনে হচ্ছে।
লিগে দ্বিতীয় স্থানে থাকা সিটির পরবর্তী ম্যাচ আগামী রোববার, টটেনহ্যাম হটস্পারের বিপক্ষে। এই ম্যাচে হলান্ড যদি আরেকটি হ্যাটট্রিক করতে পারেন, তাহলে হয়তো ৬০ গোলের অবিশ্বাস্য রেকর্ডের দিকে পাখির চোখ করতেও পারেন সময়ের সেরা প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের একজন এই ফুটবলার।
হলান্ড কি পারবেন নতুন ইতিহাস গড়তে, যা তাকে নিয়ে যেতে পারে অমরত্বের পথে? গোল করাটা যেমন সহজ বানিয়ে ফেলেছেন, তাতে সেটি হয়ে গেলে খুব একটা বিস্ময়ের নাও হতে পারে।