সুনামগঞ্জের হকের ইফতারির ‘সুনাম’

“মালিক পক্ষের কড়া নির্দেশ আছে, মান খারাপ করা যাবে না।”

সুনামগঞ্জ প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 March 2024, 03:55 PM
Updated : 12 March 2024, 03:55 PM

স্পেশাল বাখরখানি, জিলাপি, পেঁয়াজু, ছোলা, বেগুনি, আলুচপ ও ডিমচপসহ বাহারি পদের খাবার থরে থরে সাজানো ‘সুনামগঞ্জ হক হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের’ বাইরে অংশে।

এখানেই শেষ নয়। রয়েছে লাল শাক, কলমি শাক, পুই শাকের বড়া, নিমকি, খাজা, চিকেন আখনি পোলাও, চিকেন টিক্কা, চিকেন সাসলিক, চিকেন রোল, চিকেন কাকলেট, চিকেন চপ, চিকেন ফ্রাই, চিকেন পাকোড়া, জালি কাবাব, শামি কাবাবসহ অন্তত ২৬ পদ।

কুড়ি বছর ধরে ব্যবসা করে আসা সুনামগঞ্জ হক হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের এ এলাহী আয়োজন ইফতারের জন্য। ‘গুণগত’ মানের খাবারের জন্য ‘প্রসিদ্ধ’ এ দোকানে ভিড় দেখা গেল উচপে পড়া।

সুনামগঞ্জ শহরের ‘নাভি পয়েন্ট’ হিসেবে খ্যাত ট্রাফিক পয়েন্ট সংলগ্ন স্থানে এ খাবারের দোকানের অবস্থান। ‘সুস্বাস্থ্য খাবারে আতিথেয়তায় পরশ’-স্লোগানে নিজস্ব ভবনে ২০০৪ সাল থেকে ব্যবসা করছে তারা। শুধু ব্যবসা নয়, মানবিক দুর্যোগে অসহায় মানুষদের ‘বিনামূল্যে’ খাবার সরবরাহ করার খ্যাতিও রয়েছে তাদের।

রোজার প্রথমদিনে ২৬ ধরনের খাবারের লিফলেট প্রচার করেও রোজাদারদের দৃষ্টি আকর্ষণ চলছিল রেস্টুরেন্টের বাইরে। সেখানে ভিড় ঠেলে একটু ভেতরে ঢুকতেই দেখা মিলল রেস্টুরেন্টের বাবুর্চি শেখ আশরাফের সঙ্গে। তিনি সুনামগঞ্জে যখন এসেছিলেন, তখন যুবক। তার বাড়ি হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার রামপুর গ্রামে।

রেস্টুরেন্টর উদ্বোধনের দিন থেকেই তিনিই টানা ২০ বছর ধরে প্রধান বাবুর্চির দায়িত্ব পালন করছেন। এই দীর্ঘ সময়ে আরও কয়েকজন সহকারী বাবুর্চিও বেরিয়েছে তার হাত ধরে। তারা তাকে এখন সহযোগিতা করে।

আশরাফ বলেন, “সুনামগঞ্জ শহরের যে কয়টা রেস্টুরেন্ট ভালো মানের খাবার তৈরি করে, তাদের মধ্যে প্রথমেই হক রেস্টুরেন্ট সবার চেয়ে এগিয়ে। কর্তৃপক্ষ জেলা শহরে ভালো মানের রেস্টুরেন্টের অভাব বোধ করেই এটির যাত্রা শুরু করেছিল। তাই খাবারের মান বজায় রাখার কঠোর নির্দেশনা আছে সবসময়।

“খাবারের মান কর্তৃপক্ষ কখনও আপস করে না। মালিক পক্ষের কড়া নির্দেশ আছে, মান খারাপ করা যাবে না। যে কারণে এই দোকানের সুনাম ধরে রাখতে বাবুর্চিসহ সব কর্মীরা এই নির্দেশনা মেনে চলেন।“

রমজান মাসে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়টি মাথায় রেখে খাবারের গুণাগুণ বজায় রাখতে বিশেষ সতর্কতা জারি করেছে বলে জানালেন বাবুর্চি। পাশাপাশি দোকানের প্রবেশপথে সাঁটিয়ে দেওয়া হয়েছে ইফতার সামগ্রীর মূল্য তালিকা; যাতে রোজাদাররা পছন্দের আইটেম কিনতে পারেন।

হক রেস্টুরেন্টে খাবারের জন্য যেভাবে মানুষ অপেক্ষায় থাকে, ঠিক একইভাবে ইফতারের জন্যও দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ইফতার নিতে দেখা গেছে প্রথম রোজার দিনে। তাদের মধ্যে অনেকে মেয়ের বাড়ি পাঠাবেন বলে ইফতার কিনতে এসেছেন। অনেকে পরিবারের লোকজনের জন্য নিয়ে যাচ্ছেন প্যাকেট বন্দি করে। কেউ কেউ আবার নিচ্ছেন অল্প-স্বল্প।

আলাদা আলাদা আইটেম বাদেও রয়েছে ‘স্পেশাল ইফতারি প্যাকেজ’। তাতে রাখা হয়েছে- খেজুর, শরবত, আপেল, জিলাপি, পেঁয়াজু, বেগুনি, ছোলা, আখনি চিকেন, চিকেন পাকোড়া ও মিনারেল ওয়াটার; মূল্য রাখা হচ্ছে ২০০ টাকা।

প্রথম রোজার হক থেকে ইফতার কিনছিলেন ব্যাংক কর্মকর্তা জামি; তিনি অর্ডার করছিলেন লাইনে দাঁড়িয়েই। কিছুক্ষণ বাদে হাতে গ্লাবস, পড়নে গাউন পরিহিত রেস্টুরেন্টের কর্মীকে সে খাবার প্যাকেটে ভরতে দেখা গেল।

হকের ইফতারি কেন? জানতে চাইলে জামি বলেন, “এ রেস্টুরেন্ট খাবারের জন্য যেমন প্রসিদ্ধ, তেমনি ইফতার আইটেমের জন্যও। তারা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখে। এ কারণে রোজায় ইফতার হিসেবে তাদের খাবারই আমার ভালো লাগে।”

হকের ইফতারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ এনজিও কর্মী কামাল আহমেদ বলেন, “সুনামগঞ্জ শহরে হকের খাবারের বেশ নাম রয়েছে। রেগুলার আইটেমের পাশাপাশি তাদের ইফতারি আইটেমও ভালো এবং স্বাস্থ্যসম্মত। খাবারও বেশ মজাদার। এ কারণে এবার রমজানের প্রথম দিন থেকেই তাদের ইফতার নিচ্ছি।

“তাছাড়া তাদের পরিবেশন ও পার্সেল ব্যবস্থাও বেশ ভালো লেগেছে।”

হকের এত সুনাম কেন? জানতে চাইলে স্বত্তাধিকারী জিয়াউল হক সজল দৃষ্টিতে একবার চোখ বোলান তার প্রতিষ্ঠানে। তারপর বলেন, “আমাদের অন্য ব্যবসাও আছে। এক সময় দেখলাম, শহরে ভালো মানের খাবারের দোকান নেই। বাইরের মানুষ আসলে রুচিসম্মত কিছু খেতে পারেন না।

“তাই শুভাকাঙ্খীরা একটি উন্নত রেস্টুরেন্ট করার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। আমরাও ক্রেতাদের ভালো মানের খাবার সরবরাহ করতে রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় নামি।”

এখন যতদিন যাচ্ছে, ততই মানুষের মধ্যে আস্থার জায়গা তৈরি করেছে জানিয়ে আবেগ ভরা কণ্ঠে তিনি বলেন, “আমরা এই সুনাম ধরে রাখতে চাই।”