তিন কোটি টাকায় পৌনে ২ কিলোমিটার রাস্তা, তাও কাজ নিম্নমানের

এলজিইডি কর্মকর্তারা কাজের অনিয়ম স্বীকার করে নিয়ে কাজ বন্ধ রাখতে বলার পরও কাজ চলছে বলে জানিয়েছেন রবার্টপাড়ার বাসিন্দারা।

উসিথোয়াই মারমাবান্দরবান প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 March 2024, 06:27 AM
Updated : 16 March 2024, 06:27 AM

নির্মাণাধীন সড়কটির কাজে বালুর বদলে দেওয়া হচ্ছে পাহাড় কাটা মাটি। নির্মাণে প্রথম শ্রেণির ইট ও সেই ইটের খোয়া ব্যবহার করার কথা থাকলেও রাস্তায় দেখা গেল বাতিল ইটের খোয়া। রাস্তার পাশে পড়ে আছে ঝিরি-ঝরনার ভাঙা পাথরের স্তূপ, নির্মাণে যার ব্যবহার নিষিদ্ধ।

বান্দরবানের থানচি উপজেলায় নির্মাণাধীন এই সড়কে প্রকল্পের বিস্তারিত জানিয়ে কোনো সাইনবোর্ডও রাখা হয়নি। যদিও নিয়ম অনুযায়ী নির্মাণ এলাকায় প্রকল্পের নাম, ঠিকাদারের নাম, প্রাক্কলিত ব্যয়, চুক্তির মূল্য, কাজের শুরু ও মেয়াদ লিখে সাইনবোর্ড টাঙানোর কথা ।

তবে ‘অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ পল্লী অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প-৩’ এর অধীনে এম এম ট্রেডার্স নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া কার্যাদেশের নথি থেকে জানা যায়, সড়কটির নাম থানচি-রবার্টপাড়া-মায়ারাংপাড়া-হানারাংপাড়া রাস্তা।

২০২৩ সালের ১১ এপ্রিল স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের বান্দরবান কার্যালয় থেকে দেওয়া কার্যাদেশে বলা হয়েছে, এই সড়কের কার্পেটিংয়ের দৈর্ঘ্য হবে ১ দশমিক ৭৭ কিলোমিটার। নির্মাণের প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে দুই কোটি ৯৭ লাখ ৩১ হাজার টাকা আর চুক্তির মূল্য তিন কোটি ১২ লাখ এক হাজার টাকা।

কাজের মেয়াদ ২০২৩ সালের ১৮ এপ্রিল থেকে ২০২৪ সালের ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত। অর্থাৎ মেয়াদ শেষ হতে আর এক মাস বাকি ।

কাজ শুরুর আগে প্রকল্পস্থলে মজুদ নির্মাণসামগ্রীর ল্যাবটেস্ট করার কথা বলা হয়েছে কার্যাদেশে। টেস্ট রিপোর্ট সংযুক্ত ছাড়া কোনো বিল বিবেচনাযোগ্য হবে না বলে জানিয়ে রাখা হয়েছে। কাজ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত (শ্রমিক, পথচারী ও যানবাহন ইত্যাদি নিরাপত্তাসহ) সকল প্রকার নিরাপত্তার বিষয়টিও নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে।

কিন্তু সম্প্রতি থানচি সদরের মিশন পাড়া এলাকা থেকে তিন পাড়া এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, রাস্তাটি নির্মাণে এসব মৌলিক নিয়মের কোনোটাই মানা হয়নি।

এমনকি রবার্টপাড়ার ছয়টি বসতঘরও মাটির স্তূপে প্রায় অর্ধেকটা ঢাকা পড়েছে।

মঙ্গলবার সকালে কথা হয় সেখানকার বাসিন্দা শোভন ত্রিপুরার সঙ্গে।

তিনি বলেন, মাটিতে ঘরের বেড়া প্রায় ঢেকে যাওয়ায় বর্ষার সময় বৃষ্টিতে মাটি ঘরে ঢুকে পড়তে পারে।

“রাস্তা নির্মাণকারীদের এ নিয়ে অভিযোগ দেওয়ার পর, ঘরের পাশে রড ছাড়া সেইফটি দেয়াল তৈরি করে দেবে বলেছে। ইতোমধ্যে সেজন্য মাটিও খুঁড়েছে তারা। কিন্তু রড ছাড়া দেয়াল তৈরি করে দিলে আরও বড় ঝুঁকি হবে। যেকোনো সময় দেয়াল ধসে ঘর মাটিচাপা পড়তে পারে।”

পাড়ার আরেক বাসিন্দা বলেন, “রাস্তায় কোথাও কোথাও ঝিরির পাথর ভেঙে ব্যবহার করা হয়েছে। পাড়ার কয়েকজন এগুলো নিয়ে আপত্তিও জানিয়েছিল। কিন্তু লাভ হয়নি।”

পাড়াটির বাসিন্দা বেনেডিক্ট ত্রিপুরা বলেন, “রবার্টপাড়ায় ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের ৩৪টি পরিবার রয়েছে। পাড়ার ভেতর দিয়ে কোনো দিন রাস্তা হবে ভেবে পরিকল্পিতভাবে তো ঘর তৈরি করা হয়নি।

“তাই রাস্তা হতে হবে, ঘরও টিকে থাকতে হবে- এভাবে সামঞ্জস্য রেখে কাজ করার কথা বলেছিলাম। তারপর পাড়ার ভেতর রাস্তা একটু ছোটও করা যেতে পারে বলেছিলাম। কিন্তু কিছু না শুনে তারা এবড়ো-থেবড়োভাবে কাজ করে যাচ্ছে।”

“আপত্তি দেওয়ার পর দুইজন ইঞ্জিনিয়ারও এসে দেখে গেছে। এরপর আর কী করার আছে আমরা জানি না,” বলেন স্কুল শিক্ষক বেনেডিক্ট।

সড়কে নিম্নমানের কাজের বিষয়টি থানচি উপজেলা এলজিইডির প্রকৌশলী এমদাদুল হককে অবহিত করা হলে তিনি বলেন, “ওয়ার্ক অ্যাসিস্ট্যান্ট (কার্য সহকারী) তিন জন থাকার কথা থাকলেও তারা কোনো একটা সরকারি পরীক্ষা দিতে ঢাকায় গিয়েছিলেন। আমি নিজেও অফিসের কাজে চট্টগ্রাম ও রাঙামাটিতে গিয়েছিলাম। সে সুযোগে তারা হয়ত নিম্নমানের মালামাল দিয়ে কাজ করেছে।”

তবে সাংবাদিকদের মোবাইলে থাকা সড়কের ছবি দেখে তিনি বলেন, “মানসম্মত কাজ একেবারেই করেনি। খুবই নিম্নমানের কাজ হয়েছে।”

পরে তিনি ঠিকাদারকে ফোন করে কাজ বন্ধ রাখতে ও প্রাক্কলন হিসাবে অনুযায়ী না করলে কাজ করতে পারবেন না বলে জানান। এছাড়া নিজেই রাস্তা পরিদর্শনে যাবেন বলেও জানান এই প্রকোশলী।

তবে মঙ্গলবার কাজ বন্ধ হয়নি বলে রবার্ট পাড়ার বাসিন্দারা জানান। শ্রমিকরাও জানিয়েছেন ঠিকাদারের কাছ থেকে কাজ বন্ধের কোনো নির্দেশনা তা পাননি।

এ বিষয়ে জানতে বুধবার দুপুরে এলজিইডির বান্দরবান জেলা কার্যালয়ে নির্বাহী প্রকৌশলী মুহাম্মদ জিয়াউল হক ইসলাম মজুমদারের সঙ্গে দেখা করতে গেলে তাকে অফিসে পাওয়া যায়নি।

মোবাইলে ফোন করলে তিনি অফিসের জ্যেষ্ঠ সহকারী প্রকৌশলী জামাল উদ্দিনের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।

তিনি বলেন, “কাজ তো ভালোই চলেছে। তবে শুরুতে কাজটি নিয়ে অনেক ঝামেলা ছিল।”

ঝামেলার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, “কাজটি পেয়েছিল এম/এস এমএম ট্রেডার্স (মং এ মারমা) লাইসেন্সের নামে ঠিকাদার আতাউর রহমান রিপন। তিনি কাজটি করতে অপারগতা প্রকাশ করায় আনিসুর রহমান সুজনকে দেওয়া হয়। সুজন তার ভাই মেহেদী হাসানকে কাজটি দেখভালের দায়িত্ব দেন।

সুজনকে কাজ দেওয়ার কারণ ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, “থানচিতে সুজনের নিজস্ব ইটভাটা রয়েছে। ফলে সহজলভ্য ইট, কংক্রিট, এস্কেভেটর ও পরিবহন ট্রাক ইত্যাদি যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র থাকায় সুজনের পক্ষে কাজটি করা সম্ভব।

“তবে কাজের মানের বিষয়ে বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া হবে না।”

তখন রাস্তাটিতে নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার ও নির্মাণাধীন রাস্তার ছবি দেখার সঙ্গে সঙ্গে জামাল উদ্দিন থানচি উপজেলা এলজিইডি প্রকৌশলী ও ঠিকাদারকে ফোন করে কাজ বন্ধ রাখতে নির্দেশ দেন।

তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “যেকোনো উন্নয়ন প্রকল্পে সবসময় কোয়ালিটিকে প্রাধান্য দিয়ে থাকি। পরিদর্শন করে রিপোর্ট করতে বলা হয়েছে। এরপর অফিস থেকে নতুন করে কোনো নির্দেশনা না পাওয়া পর্যন্ত তিনি কাজ করতে পারবেন না।”

এছাড়া জেলার এলজিইডির পক্ষ থেকেও শিগগিরই নির্মাণাধীন রাস্তাটি পরিদর্শন করার কথা জানান তিনি।

এ বিষয়ে ওয়ার্ক অর্ডার পাওয়া এমএম ট্রেডার্সের মালিক মং এ মারমার সঙ্গে যোগাযোগ হলে তিনি বলেন, “লাইসেন্স আমার হলেও কাজটি করেন ঠিকাদার আনিসুর রাহমান সুজন।”

সুজনের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দিয়ে ফোন কেটে দেন তিনি।

পরে ঠিকাদার আনিসুর রহমান সুজনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে উত্তেজিত সুরে বলেন, “কাজ যারই হোক, শ্রমিকরা ভুল করতে পারে। সংশোধন করা যাবে। কী সমস্যা হয়েছে বলেন।”

এ সময় কাজের মান ও অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “শ্রমিকদের ছোটোখাট ভুল নিয়ে এত কথাবার্তা কেন বলতে হবে?”

বলে ফোন কেটে দেন তিনি।

সুজনের ভাই মেহেদী হাসানকে ফোন করা হলে কোনো প্রশ্নের জবাব দেননি তিনি।

পরে দেখা করে তিনি বলেন, “ভুল হয়েছে। কাজের সময় উপস্থিত থাকতে পারিনি। শ্রমিকরা ভুল করে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করে থাকতে পারে বলে আমার ধারণা।”

এ বিষয়ে থানচি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মামুনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বৃহস্পতিবার দুপুরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমরা খবর নিয়ে দেখছি, যদি কোনো অনিয়ম পাওয়া যায় তাহলে কাজ বন্ধ করে দেওয়া হবে। যারা এই কাজটা করেছে তাদের বিরুদ্ধেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

পরে সড়কটির নির্মাণকাজ বন্ধ রাখা হয়েছে বলে শনিবার সকালে জানিয়েছেন থানচি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা।