বোরহানউদ্দিন রণক্ষেত্র, নিহত ৪, নেমেছে বিজিবি

ভোলার বোরহানউদ্দিনে এক হিন্দু তরুণের ফেইসবুক আইডি ‘হ্যাক করে অবমাননাকর’ বক্তব্য ছড়ানোর পর ‘মুসলিম তাওহিদী জনতা’র ব্যানারে সমাবেশ থেকে পুলিশের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়েছে কয়েকশ মানুষ।

ভোলা প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Oct 2019, 09:09 AM
Updated : 20 Oct 2019, 03:40 PM

রোববার বেলা পৌনে ১১টা থেকে বোরহানউদ্দিন উপজেলা সদরে দফায় দফায় সংঘর্ষে এক মাদ্রাসাছাত্রসহ আন্তত চারজন নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন ১০ পুলিশ সদস্যসহ শতাধিক।

ভোলার পুলিশ সুপার সরকার মোহাম্মদ কায়সার জানিয়েছেন, এই সংঘর্ষের মধ্যে পুলিশের দিকে গুলিও ছোড়া হয়েছে। তাতে একজন পুলিশ সদস্য গুরুতর আহত হয়েছেন।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বোরহানউদ্দিনে জরুরি ভিত্তিতে ৪ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে বলে জেলা প্রশাসক মাসুদ আলম সিদ্দিক জানিয়েছেন।

বোরহানউদ্দিন ঈদগাহ মাঠে ওই সমবেশ ডাকা হয়েছিল বিপ্লব চন্দ্র শুভ নামের এক যুবকের বিচারের দাবিতে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি ফেইসবুক মেসেঞ্জারে নবী ও ইসলাম নিয়ে অবমাননাকর বক্তব্য দিয়েছেন।   

অথচ ওই যুবক শুক্রবারই ফেইসবুক আইডি ‘হ্যাকড’ হওয়ার কথা জানিয়ে জিডি করতে গিয়েছিলেন বোরহানউদ্দিন থানায়। তদন্তে নেমে দুইজনকে আটক করার পর পুলিশ তার কথার সত্যতাও পেয়েছিল।

সে অনুযায়ী শনিবারই স্থানীয় আলেমদের সঙ্গে কথা বলে রোববারের বিক্ষোভ সমাবেশের কর্মসূচি প্রত্যাহার করতে অনুরোধ করেছিল স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন।

আলেমরা তখন সম্মতি দিলেও রোববার সকালে ঠিকই সমাবেশ শুরু করা হয় এবং সেখান থেকে হঠাৎ করেই পুলিশের ওপর আক্রমণ চালানো হয় বলে বোরহানউদ্দিন থানার ওসি এনামুল হক জানান।

তিনি বলেন, “বোরহানউদ্দিন ঈদগাহ মসজিদের ইমাম মাওলানা জালাল উদ্দিন এবং বাজার মসজিদের ইমাম মাওলানা মিজানকে বিক্ষোভ সমাবেশ না করতে অনুরোধ জানানো হয়েছিল। তারপরও শুরু করায় সাধারণ মানুষ আসার আগেই সেটা বন্ধ ঘোষণা করতে বলা হয়েছিল।

“আমাদের অনুরোধে দুই ইমাম সকাল ১০টার দিকেই উপস্থিত লোকজনকে নিয়ে মোনাজাতের মাধ্যমে বিক্ষোভ মিছিলের সমাপ্তি ঘোষণা করেন। কিন্তু ততক্ষণে বোরহানউদ্দিনের বিভিন্ন গ্রাম থেকে হাজার হাজার লোক এসে ঈদগাহে জড়ো হয়েছে।

“এক পর্যায়ে তারা দুই ইমামের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং সেখানে থাকা পুলিশের ওপর চড়াও হয়। পুলিশ তখন আত্মরক্ষার জন্য মসজিদের ইমামের কক্ষে আশ্রয় নেয়।”

ওসি বলেন, উত্তেজিত জনতা পুলিশকে লক্ষ করে বৃষ্টির মত ঢিল ছুড়ছিল। এক পর্যায়ে পুলিশ আত্মরক্ষার জন্য শটগানের ফাঁকা গুলি ছোড়ে। কিন্তু তাতে তারা আরও উত্তেজিত হয়ে পুলিশের ওপর আক্রমণ চালায়।

সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত দফায় দফায় পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ হয় এবং হতাহতের ঘটনা ঘটে।

নিহতরা হলেন বোরহানউদ্দিন উপজেলার মাদ্রাসা ছাত্র মাহবুব পাটোয়ারি, উপজেলার কাচিয়া ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের কলেজছাত্র শাহিন, বোরহানউদ্দিন পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের মাহফুজ পাটোয়ারি এবং মনপুরা হাজিরহাট এলাকার মিজান।

বোরহানউদ্দিন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসক মো. শাহীন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন, গুলিতে নিহত শাহীন ও মাহবুবের মৃতদেহ তার হাসপাতালে নেওয়া হয়।

আর বাকি দুজনকে মৃত অবস্থায় ভোলা সদর হাসপাতালে নেওয়া হয় বলে জেলার সিভিল সার্জন রথীন্দ্রনাথ রায় জানান।

আহতদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও ভোলা সদর হাসপাতাল ছাড়াও কয়েকজনকে বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।

আর গুলিবিদ্ধ এক পুলিশ সদস্যকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে জানিয়ে ভোলার পুলিশ সুপার সরকার মোহাম্মদ কায়সার বলেন, সমাবেশকারীদের ছোড়া গুলি ওই পুলিশ সদস্যের বুকে লাগে। 

“আমরা হ্যাকের সাথে যারা জড়িত তাদেরকে আটক করেছি। আমরা এ নিয়ে গত রাতে স্থানীয় আলেমদের সাথে কথা বলেছি। তারা বলছে আজকের প্রোগ্রাম হবে না। কিন্তু সকাল থেকে আমাদের কাছে খবর আসে সেখানে মাইকিং হচ্ছে এবং স্টেজ বানানো হচ্ছে।

“সেখানে গিয়ে আমরা উপস্থিত মুসল্লিদের সাথে কথা বলেছি। এবং আমি নিজে সেখানে বক্তব্য দিয়েছি। তারা সবাই আমার বক্তব্য শুনেছে। যখন আমি স্টেজ থেকে নেমে আসি তখন একদল উত্তেজিত জনতা আমাদের ওপর হামলা চালায়।”

পুলিশ সুপার জানান, তারা যখন ইমামের কক্ষে আশ্রয় নিয়েছিলেন, হামলাকারীরা ওই ঘরের জানালা ভেঙে ফেলে।ওই পরিস্থিতিতে পুলিশ শটগানের গুলি ছুড়তে বাধ্য হয়। 

বোরহানউদ্দিনের উপজেলা চেয়ারম্যান আবুল কালাম বলেন, “সমাবেশ শুরু হওয়ার কথা ছিল বেলা ১১টায়। কিন্তু আয়োজকরা সাড়ে ১০টার মধ্যে সমাবেশ শেষ করে দিলে অংশ নিতে আসা জনতা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।

“আমি বেলা পৌনে ১১টার দিকে পৌঁছে দেখি, তখনও বড় বড় মিছিল নিয়ে অনেকে সমাবেশে অংশ নিতে আসছিল। সমাবেশে উপস্থিত লোকজন পুলিশের দিকে ঢিল ছুড়ছিল।”

ওসি এনামুল হক জানান, সংঘর্ষের পর পুরো জেলায় উত্তেজনা চলছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বোরহানউদ্দিনে বাড়তি পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।

সংঘর্ষে হতাহতের খবর পাওয়ার পর হেলিকপ্টারে করে বিজিবি সদস্যদের ভোলায় পাঠানো হয়েছে বলে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ সদরদপ্তরের জনসংযোগ কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম জানান।

বিপ্লব চন্দ্র শুভ নামের ওই যুবকের বিচার দাবিতে শনিবার সকালেও বোরহানউদ্দিনের কুঞ্জেরহাট বাজারে মানববন্ধন এবং থানার সামনে বিক্ষোভ হয় ‘মুসলিম তাওহিদী জনতা’র ব্যানারে।

তার আগেই শুক্রবার রাতে বোরহানউদ্দিন থানায় যান ওই যুবক। তিনি বলেন, তার ফেইসবুক আইডি হ্যাকারের কবলে পড়েছে।

স্থানীয়দের বরাত দিয়ে পুলিশ জানায়, শুক্রবার বিকাল থেকে ফেইসবুকে শুভর মেসেঞ্জারের একটি ‘স্ক্রিনশট’ ছড়ানোর শুরু হয়, যেখানে ইসলাম ধর্ম ও নবীকে নিয়ে কটূক্তি ছিল। ওই ‘স্ক্রিনশট’ ব্যবহার করেই রোববারের সমাবেশে সবাইকে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়।

এই পরিস্থিতিতে বিষয়টি তদন্তের জন্য ওই তরুণকে থানা হেফাজতে রেখে দেওয়া হয়। পরে স্থানীয় আরও দুইজনকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করে।

তদন্তে নেমে পুলিশ শুভর আইডি থেকে মেসেঞ্জারে আরও কিছু কথপোকথন পায়, যেখানে একজন লিখেছেন, তিনি আইডিটি হ্যাক করেছেন এবং সেটা ফেরত চাইলে শুভকে ৫০০ টাকা দিতে হবে। যোগাযোগের জন্য একটি ফোন নম্বরও দেওয়া হয়েছে সেখানে। 

ফেইসবুকে ধর্ম অবমাননা করার গুজব ছড়িয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর হামলার ঘটনা আগেও ঘটেছে।

২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে কক্সবাজার জেলার রামু উপজেলায় হামলা চালিয়ে লুটপাটসহ ১২টি বৌদ্ধ মন্দির ও ৩০টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে একদল লোক।

২০১৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে রসরাজ নামে এক মৎস্যজীবীর বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ এনে লোকজনকে খেপিয়ে তুলে ঘরবাড়ি ও মন্দিরে হামলা চালানো হয়।