ব্র্যাডম্যানের বাড়ি, ব্র্যাডম্যানের মাঠ, ব্র্যাডম্যানের স্মৃতির রাজ্যে

সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের শৈশব-কৈশোরের স্মৃতি বিজড়িত বাউরালে ব্র্যাডম্যানময় একটি দিন কাটানোর গল্প।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 Oct 2022, 06:08 PM
Updated : 31 Oct 2022, 06:08 PM

বাড়িটার ছবি এতবার দেখেছি, একটু দূর থেকে দেখেই চোখ একদম আটকে গেল। তারপরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য নামফলকে চোখ রাখলাম। সাদা রঙের কাঠের সীমানা প্রাচীরে ছোট্ট একটি নামফলকে সবুজ-সাদায় লেখা- ৫২ শেফার্ড স্ট্রিট।

‘২২১বি বেকার স্ট্রিট’ বললেই যেমন সবাই বুঝে যান শার্লক হোমসের ঠিকানা, ততটা বিখ্যাত অবশ্যই নয় ৫২ শেফার্ড স্ট্রিট। তবে ক্রিকেটের একনিষ্ঠ অনুসারী মাত্রই জানা থাকার কথা, এটি কার বাড়ি। নামফলকে লেখা আছে, 'ডন ব্র্যাডম্যান লিভড ইন দিস হাউস ফ্রম ১৯১১ টু ১৯২৪।' 

সিডনি থেকে প্রায় ১৩০ কিলোমিটার দূরে ছোট্ট, ছিমছাম এক শহর বাউরালের এই বাড়িতেই কেটেছে ব্র্যাডম্যানের শিশুকাল-শৈশব-কৈশোরের প্রায় ১৩ বছর। 

ইন্টারনেটে দেখা শত বছর পুরোনো সাদা-কালো ছবির সঙ্গে চোখের সামনে বাস্তব বাড়িটির মিল খুঁজছিলাম। কোনোভাবেই আলাদা করতে পারলাম না। হুবহু সেই একই ডিজাইন, গড়ন, কাঠামো। সবকিছু যেন এখনও অবিকৃত! 

বাড়ির সামনের ছবির পর ছবি তোলার পালা চলছিল। আমার সঙ্গী সিডনি প্রবাসী শিহাব রহমান। হঠাৎ এক প্রবীণ ব্যক্তির আগমন। আমাদের দিকে সৌজন্যমূলক একটু মাথা নাড়িয়ে পকেট থেকে চাবি বের করে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলেন তিনি। একটু পর হুট করে বেরিয়ে জানতে চাইলেন কোত্থেকে এসেছি। বাংলাদেশ থেকে গিয়েছি শোনার পরই বললেন, “ডনের সেই পানির ট্যাংক দেখতে চান?” 

মেঘ না চাইতেই বৃ্ষ্টি তো একেই বলে! অভাবনীয় উপহারের প্রস্তাবে ভাষা হারিয়ে ফেললাম। কোনোরকমে মাথা নাড়িয়ে বোঝালাম, ‘অবশ্যই…।” মুখে এক চিলতে হাসি নিয়ে তিনি বললেন, “অনেকেই এই বাড়ি দেখতে আসে। খুব বেশি জনকে ভেতরে নিই না। আপনাদের কেন জানি পছন্দ হয়েছে আমার… এতদূর থেকে এসেছেন…।” 

আর কী কী যেন বলছিলেন। তখন আসলে তার কথা শোনার অবস্থা ছিল না। সম্মোহিতের মতো তাকে অনুসরণ করে বাড়ির পেছনের দিকে গেলাম। এই কি সেই ট্যাংক… এটিই সেটি? ওই যে ট্যাংকের নিচে ইটের সেই পাটাতন, শত বছর আগেও কী এমনই ছিল…!!! 

একটি পানির ট্যাংক ঘিরে কেন এতটা রোমাঞ্চ, এটা আসলে যারা জানেন না, তাদের বোঝানো সম্ভব নয়। যারা ক্রিকেট বা ব্র্যাডম্যানের ভক্ত-অনুসারী কিংবা কিছুটা খোঁজখবর রাখেন, তারাই কেবল অনুভব করতে পারবেন। ছেলেবেলায় তার নিজস্ব ধরনের একক ক্রিকেটের অনুসঙ্গ ছিল এই পানির ট্যাংক। 

বাউরালে তখন আশেপাশে সমবয়সী বাচ্চা ছিল না তেমন কেউ। বালক ব্র্যাডম্যান বের করে ফেলল নিজের পদ্ধতি। বাড়ির পেছন দিকে দরজার সামনে স্টান্স নিত সে। এরপর পানির ট্যাংকের পাটাতনে গলফ বল ছুড়ে সরু এক স্টাম্প দিয়ে ব্যাটিং করে যেত ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে। সাধারণ ক্রিকেট স্টাম্পের তুলনায় বেশ সরু স্টাম্প সেটি।

নাহ, ভবিষ্যতে ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন থেকে নয়, স্রেফ মনের আনন্দেই চলত সেই খেলা। খাওয়ার জন্য কিংবা কোনো প্রয়োজনে বাবা-মা যখন ডাকাডাকি করতেন, নিজের জগতে ডুবে থাকা বালকটি তখন বিরক্ত হতো বেশ। 

বলা হয়, সরু স্টাম্প দিয়ে এভাবে ব্যাটিং করাতেই ব্যাটের সঠিক জায়গায় বল হিট করার দক্ষতা গড়ে উঠেছিল তার। চোখ, মাথা আর হাতের সমন্বয়ের যে স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়া এবং কেতাবি টেকনিক না থাকার পরও তিনি যে সেরাদের সেরা হয়েছিলেন, সেটাও নাকি তখনই পোক্ত হয়েছিল। অন্য সবার চেয়ে ব্র্যাডম্যান যে পুরো স্বতন্ত্র, সেটির শুরুও নাকি ওই সময়টাতেই। 

ট্যাংকের পাটাতন থেকে গলফ বল ফিরে আসত বিদ্যুৎ গতিতে। স্টাম্প দিয়ে সেই বল খেলতেন বলে তার রিফ্লেক্স হয়েছিল অবিশ্বাস্য। পেছনে বিশাল দরজার পুরোটাই স্টাম্প। বল পেছনে গেলেই তা বোল্ড। তাই কোনো বলই মিস করতে চাইতেন না। কোন শটে বলে কতটা ভালোভাবে হিট করতে পারতেন, সেই অনুযায়ী নিজেকে রানও দিতেন। নিখুঁত টাইমিং হলে চার, আরেকটু কম জোরে লাগলে তিন... এভাবে চলত।

কখনও কখনও নিজস্ব এই উইকেটেই তিনি খেলতেন টেস্ট ম্যাচ। চার্লি ম্যাকার্টনি, জনি টেইলর, জ্যাক হবস, ফ্র্যাঙ্ক উলির মতো ক্রিকেটারদের নাম লিখে রাখতেন পরিত্যক্ত কাগজে। তাদের হয়ে ব্যাট করতেন নিজেই। দুই ঘণ্টা ধরে চলত প্রতি ম্যাচ, প্রতি ইনিংস আধ ঘণ্টা করে। বাঁহাতি কোনো ব্যাটসম্যানের ক্ষেত্রে তিনিও হয়ে যেতেন বাঁহাতি। সবকিছুই ওই পানির ট্যাংক ঘিরে। 

প্রথাগত ক্রিকেট প্রশিক্ষণ তিনি কখনোই পাননি। নিজেকে গড়ে তুলেছেন নিজের মতো করে। সেই অধ্যাবসায়ের সঙ্গী এই ট্যাংক। 

ব্র্যাডম্যান এমনই একজন, তার সৌজন্যে একটি পানির ট্যাংক পর্যন্ত রূপকথা হয়ে আছে এত বছর ধরে। 

ওই ট্যাংক ছুঁয়ে দেখা, সরু স্টাম্প হাতে নিয়ে দেখতে দেখতেই ওই ভদ্রলোক বললেন, “আপনাদের আমি ব্র্যাডম্যানের শোবার ঘরও দেখাব। আবারও বলছি, সবাইকে এই সুযোগ দেই না… আপনাদের আমার ভালো লেগেছে…।” 

এবার মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি শুধু নয়, রীতিমতো ভালোলাগা ও বিস্ময়ের তীব্র বর্ষণ!

এতক্ষণে ভদ্রলোক তার নাম জানালেন। অ্যান্ড্রু লিমিং। শতাব্দীপ্রাচীন এই বাড়ির সত্ত্বাধিকারী তিনি গত ২০ বছর ধরে। যে বাড়িতে ব্র্যাডম্যান কাটিয়েছেন তার জীবনের মূল্যবান প্রায় ১৩ বছর। 

বছর বিশেক আগে বাড়িটির ছিল ভগ্নদশা। লিমিংয়ের হাতে পড়ার পর আবার তা ফিরে পেয়েছে আপন সৌন্দর্য। ক্রিকেটপ্রেমী মানুষটি বাড়ি সংস্কার করেছেন, পানির সেই ট্যাংক ফিরিয়ে এনেছেন এবং ব্র্যাডম্যান পরিবারের স্মৃতি ধরে রাখার ব্যবস্থা নিয়েছেন। 

ডন ব্র্যাডম্যানের জন্ম সিডনি থেকে প্রায় সাড়ে চারশ কিলোমিটার দূরে কুটামুন্ড্রা নামের ছোট এক শহরে। বাবা জর্জ ব্র্যাডম্যান, মা এমিলি। দুই ভাই, তিন বোনের মধ্যে ডন সবচেয়ে ছোট। তার আড়াই বছর বয়সে পুরো পরিবার বাউরালে চলে আসে এমিলির পরিবার ও স্বজনদের কাছাকাছি থাকার জন্য, আর কৃষিকাজের চেষ্টা করার জন্য।

৫২ শেফার্ড স্ট্রিটের বাড়িটি গড়া হয় ১৮৯০ সালে। ব্র্যাডম্যান পরিবার এই বাড়িতে থাকতে শুরু করে ১৯১১ সাল থেকে। তার ক্রিকেটের হাতেখড়ি এই বাড়ি থেকে। এই বাড়ি, বাউরালের নানা পথ আর মাঠে খেলেই অমরত্বের পথে তার হাঁটা শুরু। 

ব্র্যাডম্যানকে নিয়ে নতুন করে বলার আছে সামান্যই। তবু যারা নতুন ক্রিকেট অনুসারী, তাদের জন্য ছোট্ট করে কিছু বলা যায়। সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে তিনি অবিসংবাদিত। তার ৯৯.৯৪ টেস্ট ব্যাটিং গড়কে মনে করা হয় বিশ্বের যে কোনো খেলায় উৎকর্ষ ও শ্রেষ্ঠত্বের সর্বোচ্চ উদাহরণ। আরও অসংখ্য অবিশ্বাস্য রেকর্ড, কীর্তি ও অর্জন তার সঙ্গী।

ব্র্যাডম্যান নামেই এত রোমাঞ্চ, ব্র্যাডম্যান মানেই এত কৌতূহল, তার শোবার ঘরে যেতে পারা মানে তাকে নিবিড়ভাবে অনুভব করতে পারার অমূল্য সুযোগ। 

পরের কয়েক মুহূর্ত যেন ঘোরের মধ্যে ছিলাম। লিমিং নিয়ে গেলেন ব্র্যাডম্যানের শোবার ঘরে। ছোট্ট একটি কক্ষে দুটি সিঙ্গেল বিছানা। ব্র্যাডম্যানের কক্ষসঙ্গী তার চার বছরের বড় ভাই ভিক্টর। 

বাঁ দিকের খাটে ঘুমাতেন ব্র্যাডম্যান। সেটি ছুঁয়ে দেখার, সেখানে একটু বসে থাকার অনুমতি দিলেন লিমিং নিজ থেকেই। খুব ভালো করেই তিনি জানেন, এই কক্ষে এলে একজন ক্রিকেটপ্রেমীর চাওয়াগুলি কী! 

খাটের সঙ্গে হেলান দিয়ে রাখা পুরনো এক জোড়া প্যাড, ক্রিকেট বল, অনেক পুরনো একটি ব্যাট ও টেনিস র‌্যাকেট। ১৪-১৫ বছর বয়সে একবার ক্রিকেট ছেড়ে টেনিসকেই ভবিষ্যতের পাথেয় করে নিয়েছিলেন। দুই বছর ছিলেন সেই চেষ্টায়। পরে আবার ক্রিকেটের পথেই ফেরেন। ফিরতেই হতো!

দুই খাটের মাঝে ছোট্ট টেবিলে রাখা আছে ব্র্যাডম্যানের বালক বয়সের একটি ছবি। পাশে একটি ক্রিকেটের বই। 

সব মিলিয়ে অন্য এক ভুবনে চলে গিয়েছিলাম যেন। লিমিংয়ের কথায় সম্বিত ফিরল, “আপনাদের একটা অডিও শোনাচ্ছি আমি, মিনিট তিনেকের…।” তিনি বাটন চাপতেই দেয়ালের কোনো আড়াল থেকে ভেসে এলো কণ্ঠ, যেখানে বলা হয়েছে এই বাড়ি আর এই ঘরের নানা গল্প। স্বয়ং ব্র্যাডম্যানের কণ্ঠও শোনা গেল। মজা করে তিনি শোনালেন, কতটা গড়পড়তা মানের ছাত্র ছিলেন তিনি। 

“এই ঘরের দেয়ালের রং থেকে শুরু করে কোনো কিছুই বদলাইনি আমি। এই বিছানা, টেবিল, সজ্জা, সবকিছু একদম অবিকৃত রাখার চেষ্টা করেছি”- লিমিং যখন বলছিলেন, একটা গর্ব আর প্রশান্তির ছাপ ফুটে উঠল তার কণ্ঠে। 

পাশেই একটি কক্ষে কাঠের একটি একটি বাক্স, যেখানে রাখা আছে করাত, হাতুড়িসহ অনেক কিছু। ব্র্যাডম্যানের কাঠমিস্ত্রী বাবার জীবিকার সব হাতিয়ার! সবকিছুই শত বছরের পুরনো। এই বাক্সের সঙ্গেও দাঁড় করিয়ে রাখা আছে জোড়াতালি দেওয়া একটি ব্যাট। সেদিকে কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকাতেই লিমিং বললেন, “এই ব্যাট পেয়েছিলাম ডনের শোবার ঘরে বিছানার নিচে। নিশ্চিত নই, এটা তারই ব্যাট কিনা…।” 

ব্র্যাডম্যানের স্মৃতির স্মারক হয়ে আছে বাড়িটির অন্যান্য ঘরও। সেই পিয়ানো দেখা গেল, যেটায় তিনি গান শেখার চেষ্টা করতেন বড় বোনের সঙ্গে। একটি টাইপ রাইটার। অজস্র পুরনো বই-খাতা। বেশ কিছু সাদা-কালো ছবি। অনেক পুরনো আসবাবপত্র। অনেক কিছু। 

কিছু চোখে দেখা। কিছু ছুঁয়ে দেখা। আর কিছু, মনের দেখা! 

আড়াই বছর থেকে ১৬ বছর বয়স পর্যন্ত এই বাড়িতে কাটিয়েছেন ব্র্যাডম্যান। এই বাড়িময় ছুটে বেড়ানো, শৈশবের দুরন্তপনা, ক্রিকেটার হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার শ্রম… সেসব তো হৃদয়ের চোখেই দেখতে হয়! 

১৯২৪ সালে এই বাড়ি ছেড়ে পাশেই ২০ গ্লিব স্ট্রিটের বাড়িতে চলে যায় ব্র্যাডম্যান পরিবার। বছর চারেক পর ব্র্যাডম্যান পাড়ি জমান সিডনিতে। তবে ব্র্যাডম্যানের বাড়ি বলতে বাউরালের শেফার্ড স্ট্রিটের বাড়িই বোঝায়। 

১৯৩১ সালে একবার এই বাড়িতে ঘুরে যান ব্র্যাডম্যান, তখন তিনি মহাতারকা। ১৯৮৮ সালেও আরেকবার তিনি আসেন বাউরালে। তবে সেবার আসেননি স্মৃতিময় বাড়িটায়। 

“আশা করি, আপনাদের ভালো লেগেছে…”, বিদায় জানিয়ে বললেন লিমিং। তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে পথ ধরলাম। বোঝাতে পারলাম না, স্রেফ ভালো লাগা নয়, ব্র্যাডম্যানকে ছোঁয়ার শিহরণে কতটা উষ্ণ হয়ে আছে হৃদয়! 

ব্র্যাডম্যান ওভাল    

সেন্ট্রাল সিডনি রেল স্টেশন থেকে বাউরাল পর্যন্ত ট্রেন ভ্রমণও দারুণ অভিজ্ঞতা। শুরুর কিছুটা সময় পর থেকে দুই পাশে সবুজের সমুদ্র। নিউ সাউথ ওয়েলসের কান্ট্রি সাইডের অপরূপ দৃশ্য মুগ্ধতার দোলা দেয় মনে। প্রায় ১৩০ কিলোমিটার পথ কীভাবে পেরিয়ে গেল, টেরই পাওয়া গেল না! 

পথের সেই ভালোলাগার রেশ রয়ে যায় বাউরাল রেল স্টেশনে নেমেও। ছোট্ট, ছিমছাম স্টেশন, দুহাত বাড়িয়ে আলিঙ্গন করে নেয় যেন মফস্বল শহরের নিখাদ আন্তরিকতা ও শান্তির পরশ নিয়ে। 

এই স্টেশন থেকেই ১২-১৫ মিনিটের হাঁটাপথ ব্র্যাডম্যান ওভাল। 

স্টেশন থেকে গুগল ম্যাপ ধরে এগিয়ে যেতে যেতে প্রতিটি পদক্ষেপে রোমাঞ্চের দোলা বাড়ছিল একটু একটু করে। এরপর যখন চোখের সামনে ফুটে উঠল সেই কাঙ্ক্ষিত ঠিকানা, অদ্ভুত এক শিহরণ খেলে গেল গোটা শরীরে। মুহূর্তের জন্য থমকে গেল পা দুটো। গাছপালায় ঘেরা সবুজ এক আঙিনা। এক পাশে ছোট একটি প্যাভিলিয়ন। সামনে অল্প কয়েকটি আসন নিয়ে গ্যালারির দুটি অংশ। মাঝখান দিয়ে মাঠে নেমে যাওয়ার সিঁড়ি। 

এই সেই মাঠ, যেখান থেকে বাউরালের এক স্বশিক্ষিত ক্রিকেট বালক যাত্রা শুরু করেছিলেন অবিসংবাদিত শ্রেষ্ঠত্বের পথে। এই আঙিনা থেকেই ছুটতে শুরু করেছিলেন ব্র্যাডম্যান নামক এক বিস্ময়, যে ভ্রমণ একসময় তাকে পৌঁছে দিয়েছে অমরত্বের ঠিকানায়। শত বছর পরও যে অধ্যায়কে ঘিরে কত মিথ, কত অবিশ্বাস, কত কত গল্প আর রোমাঞ্চের চূড়ান্ত! 

মাঠের এক পাশে দাঁড়িয়ে চঞ্চল চোখ দুটি অস্থিরতায় ঘুরতে থাকে চারপাশে। আর মন ডুবে যায় ইতিহাসের অলিন্দে। শত বছর আগে কেমন ছিল এই মাঠের চেহারা? এতটা সবুজ কি ছিল? এই গাছগুলোর বয়স কত! ওই যে ঘাস কাটার মেশিন ছুটছে মাঠের সবুজ চিড়ে, এটা তো তখন থাকার প্রশ্নই আসে না। ঝকঝকে ওই স্কোরবোর্ড ও এমন আধুনিক প্র্যাকটিস ফ্যাসিলিটিও সেই সময় ছিল না নিশ্চিত। 

প্যাভিলিয়নটা কেমন ছিল তখন? এই সিঁড়ি দিয়েই কি মাঠে নামতেন ব্র্যাডম্যান নাকি তখন ছিল ভিন্ন কিছু...! মনের ছুটোছুটি চলতে থাকে ইতিহাসের নানা অলিগলিতে। 

১৮৮৩ সালে গঠন করা হয় বাউরাল ক্রিকেট ক্লাব। এই মাঠে খেলা শুরু ১৮৯৩ সাল থেকে। 

ব্র্যাডম্যানের টেস্ট ক্যারিয়ারের মতোই তার জীবনের চমকপ্রদ সব ঘটনার স্বাক্ষী এই মাঠ। বড়দের সঙ্গে খেলার নেশা তার ছোট থেকেই। ৮ বছর বয়সেই বাউরাল প্রাইমারি স্কুলে আলাদা একটি পরিচিতি গড়েছিলেন ক্রিকেটের কারণে। স্কুলে অবশ্য রাগবিও খেলতেন তিনি। শৈশবে টেনিসে বেশি ভালো ছিলেন নাকি ক্রিকেটে, সেটা এখনও বড় আলোচনার খোরাক। স্কুলের বয়সভিত্তিক দৌড়ের বেশ কয়েকটি ক্যাটাগরিতে ছিলেন চ্যাম্পিয়ন। 

তবে ভাগ্য তো বাঁধা তার ক্রিকেটে। জীবনের প্রথম বড় ম্যাচটি খেলেন ১১ বছর বয়সে। তখনও তিনি প্রাইমারি স্কুলে, প্রতিপক্ষ দলের বেশির ভাগই ছিল হাই স্কুলের। এই মাঠেই সেই ম্যাচে ব্র্যাডম্যান ব্যাটিংয়ে নামলেন প্রতিপক্ষের এক বোলারের হ্যাটট্রিকের মুখে। দুর্দান্ত ডেলিভারিতে কোনোরকমে আউট হওয়া থেকে বেঁচে গেলেন প্রথম বলে। কিন্তু দিনশেষে অপরাজিত রইলেন ৫৫ রানে। 

মাঠের নাম তখন গ্লিব ওভাল। ১৯৪৭ সালে মাঠের নাম বদলে হয়ে যায়, ‘ব্র্যাডম্যান ওভাল।’ যে মাঠে খেলে কিংবদন্তি হওয়ার পথে যাত্রা, সেই মাঠই পরে গর্বিত তার সন্তানের নাম ধারণ করতে পেরে। 

পরের মৌসুমে ব্র্যাডম্যান দেখা পান তার প্রথম সেঞ্চুরির। বাউরাল ইন্টারমেডিয়েট স্কুলের হয়ে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মিটাগংয়ের বিপক্ষে দলের ১৫৬ রানে তার একার রানই ১১৫।

সেই সময় একের পর এক ম্যাচে বোলারদের পিটিয়ে ছাতু বানাতে থাকেন। ব্র্যাডম্যান একাদশে থাকলে বাউরাল স্কুলের সঙ্গে খেলবে না বলে সাফ জানিয়ে দেয় কয়েকটি স্কুল। এমনকি প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী মিটাগং স্কুল আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠিতে জানায়, ব্র্যাডম্যানকে মাঠে নামালে তারা ম্যাচ ছেড়ে দেবে আগেই! 

১২ বছর বয়সে শহরের মূল দল বাউরাল টাউন ক্রিকেট টিমের স্কোরারের দায়িত্ব পান ব্র্যাডম্যান। পুরনো একটি ট্রাক চালিয়ে শহরের বাইরের ম্যাচগুলোতে নিয়ে যেতেন তার বাবা, পেছনে একটি কাঠের বাক্সে বসে থাকতেন ব্র্যাডম্যান। 

একদিন মোস ভ্যালের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ এক ম্যাচে দলের একাদশ সাজানোই দায়। একজন আসেননি মাঠে! ছোট্ট ব্র্যাডম্যানকে নামিয়ে দেওয়া হলো উপায় না পেয়ে। দলের অষ্টম উইকেট পতনের পর বড়দের প্যাড পরে কোনোরকমে হাঁটতে হাঁটতে মাঠে নামলেন কিশোর ব্র্যাডম্যান। শেষ পর্যন্ত অপরাজিত রইলেন ৩৭ রানে! 

পরের সপ্তাহে সেই বড়দের ম্যাচেই তাকে নামিয়ে দেওয়া হলো ওপেনিংয়ে। এবারও তাকে আউট করতে পারলেন না কেউ। অপরাজিত ২৯। 

মুগ্ধ হয়ে তাকে একটি ব্যাট উপহার দিলেন দলের সিনিয়র ক্রিকেটার ডন কাপিট। ব্র্যাডম্যানের জীবনের প্রথম সত্যিকারের ক্রিকেট ব্যাট! এর আগে তিনি খেলতেন গাম গাছের কাঠ থেকে কোনোরকমে বানানো ব্যাট দিয়ে। ছোট্ট ছেলের খেলার উপযোগী করতে যে ব্যাটের নিচের দিকে ৭ সেন্টিমিটার চেঁছে দেন কাঠমিস্ত্রী বাবা। 

বয়স ১৩ হওয়ার আগে ব্র্যাডম্যানকে দারুণ এক উপহার দেন বাবা, সিডনিতে অ্যাশেজের টেস্ট ম্যাচ উপভোগ করা! বাউরাল স্টেশন থেকে ট্রেন ধরে বাবা-ছেলে সেন্ট্রাল স্টেশনে নেমে ট্রামে করে চলে যান সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে। নতুন শার্ট, টাই, কেতাদুরস্ত পোশাক গায়ে আর নতুন বলের মতো চকচকে জুতো পায়ে বাবার সঙ্গে প্যাডিংটন প্রান্তে বসেন ব্র্যাডম্যান। চার্লস ম্যাকার্টনির ১৭০ রানের অসাধারণ ইনিংস তার হৃদয়ে গেঁথে যায় আজীবনের জন্য, যে ইনিংসের কথা তিনি পরে বলেন বহুবার। 

সেবার শুধু খেলাই দেখেননি, পুরো মাঠ ঘুরে দেখেন বাবা-ছেলে, মাঠের আবহের স্বাদ নেন। এক পর্যায়ে বাবার কাছে কিশোর ব্র্যাডম্যানের অমর প্রতিজ্ঞা, “এই মাঠে না খেলা পর্যন্ত আমি শান্তি পাব না।”  

১৭ বছর বয়স হতে হতে বাউরাল দলের নিয়মিত সদস্য তো বটেই, ক্লাবের সচিবও হয়ে যান ব্র্যাডম্যান। বাউরালের এই মাঠে তার অসাধারণ সব পারফরম্যান্স নিয়মিত জায়গা পেতে থাকে সিডনির খবরের কাগজে। একটি ম্যাচের পারফরম্যান্স তো বিখ্যাত। বাউরালের সঙ্গে উইঙ্গেলোর ম্যাচ স্রেফ খেলা নয়, ছিল একরকম যুদ্ধ। 

১৯২৫ সালে উইঙ্গেলোর এক উঠতি লেগ স্পিনার দারুণ আলোড়ন ফেলে দিয়েছিলেন। তার সঙ্গে ব্র্যাডম্যানের লড়াই নিয়ে ম্যাচের আগে উত্তেজনা ছিল তুঙ্গে। ফলাফল? সেই লেগ স্পিনারসহ সব বোলারকে তুলাধুনা করে প্রথম দিনেই ২৩৪ রানে অপরাজিত ব্র্যাডম্যান। 

সেই লেগ স্পিনারও পরে কিংবদন্তি হয়ে ওঠেন। নাম নিশ্চয়ই শুনে থাকবেন, বিল ও’রাইলি। আগ্রাসী মানসিকতার জন্য যিনি ক্রিকেটে পরিচিত ‘টাইগার’ নামে। ২৭ টেস্টে ১৪৪ উইকেট নেওয়া বোলারকে মনে করা হয় সর্বকালের সেরা লেগ স্পিনারদের একজন।

বাউরালের হয়ে দুর্দান্ত সব ইনিংসের খবর জেনেই ১৮ বছর বয়সী ব্র্যাডম্যানকে সিডনিতে ডাকা হয় ট্রায়ালের জন্য। পরে গ্রেড ক্রিকেট, প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট হয়ে তার টেস্ট দলে প্রবেশ এবং সর্বকালের সেরা হওয়ার পথে এগিয়ে চলা। 

একটা সময় নিউ সাউথ ওয়েলস ছেড়ে তিনি চলে যান সাউথ অস্ট্রেলিয়ায়। থিতু হন অ্যাডিলেইডে। জীবনের বড় অংশ কাটান সেখানেই। তার অসংখ্য স্মৃতিচিহ্ন আছে সেখানেও। কিন্তু তারপরও সবসময় তার পরিচিতি ছিল এবং আছে ‘দা বয় ফ্রম বাউরাল’ কিংবা 'ওয়ান্ডার বয় ফ্রম বাউরাল' নামে। 

ব্র্যাডম্যান মিউজিয়াম 

ব্র্যাডম্যান ওভালে ব্র্যাডম্যান মিউজিয়ামের মাঝখানে ব্র্যাডম্যানের নান্দনিক এক ভাস্কর্য। যেন মাত্রই দুর্দান্ত কোনো ইনিংস খেলে একহাতে উঁচিয়ে ধরেছেন ক্যাচ। মুখে স্মিত হাসি। ব্র্যাডম্যানের সবচেয়ে ‘আইকনিক’ ছবিগুলোর একটি এখানে স্থায়ী হয়ে আছে ব্রোঞ্জের দৃষ্টিনন্দন শিল্পকর্মে।

ভাস্কর্যের নাম, ‘দা ফাইনাল স্যালুট।’ 

পাশেই বিখ্যাত ব্র্যাডম্যান মিউজিয়াম। ব্র্যাডম্যানের জীবনের নানা স্মারক ধরে রাখা, তার স্মৃতি জীবন্ত রাখা, ব্র্যাডম্যানকে ধারণ করার এই উদ্যোগের যাত্রা শুরু হয় ১৯৮৯ সালে। দ্রুতই এটি হয়ে ওঠে নিউ সাউথ ওয়েলসের জনপ্রিয় এক পর্যটক গন্তব্য। 

তবে সেরাদের সেরা হয়েও যিনি নিজের খ্যাতি ও জনপ্রিয়তাকে বড় করে দেখেননি, নিজের নাম ও অর্জনের বড়াই করেননি, নিজেকে কখনোই ক্রিকেট খেলাটির চেয়ে বড় করে দেখেননি, মিউজিয়ামও কী শুধু তার নামে থাকতে পারে! 

এই মিউজিয়াম পরে পরিসর বাড়িয়ে রূপ নেয় ‘ব্র্যাডম্যান মিউজিয়াম অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট হল অব ফেম।’ আগের ব্র্যাডম্যান জাদুঘরের সব রত্ন এখানে ঠাঁই পায় তো বটেই, সঙ্গে যোগ হয় বিশ্ব ক্রিকেটের আরও অনেক স্মারক। 

স্বয়ংক্রিয় দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকলেই আপনি ঢুকে যাবেন ক্রিকেটময় এক জগতে। রিসিপশনে তাকালেই চোখে পড়বে লেখা, ‘ওয়েলকাম টু দা মিউজিয়াম।’ সামনে তাকালেই চোখে পড়বে বড় বড় অক্ষরে লেখা, “লিভিং সেন্টার অব ক্রিকেট।”

কী নেই সেখানে! 

বিশ্ব ক্রিকেটের দারুণ সব ছবি চোখে পড়বে দেয়ালে সাঁটানো। মাঝখানে একটি ট্রফি কেসে সযত্নে রাখা আছে অস্ট্রেলিয়ার ২০০৭ ও ২০১৫ ওয়ানডে বিশ্বকাপ জয়ের ট্রফি। বিশ্বসেরার দুই ট্রফির মাঝখানে বিশ্বসেরা আম্পায়ারের ট্রফি, ২০০৭ সালে যে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ারই সাইমন টফেল। 

এই ট্রফিকেসের বড় আকর্ষণ অবশ্য অন্য তিনটি ট্রফি। একটি ১৮৮১ সালের, আরেকটি ১৮৯৩ সালের। এই দুই ট্রফির মাঝে রাখা আছে একটি চায়ের কেটলি। এটিও আসলে একটি ট্রফি! সেই যুগে ট্রফি হিসেবে চায়ের কেটলি বা চায়ের সেট দেওয়ার রীতি ছিল। ১৮৮০ সালে এই কেটলি দেওয়া হয়েছিল অ্যালেক ব্যানারম্যানকে। ইতিহাসের প্রথম টেস্টের সেঞ্চুরিয়ান চার্লস ব্যানারম্যানের বড় ভাই অ্যালেক ব্যানারম্যান অস্ট্রেলিয়ার হয়ে খেলেছিলেন ২৮টি টেস্ট। 

এই ট্রফি কেসের পেছনেই একটি শো কেসে রাখা আছে মহেন্দ্র সিং ধোনির টেস্ট জার্সি, বিরেন্দর শেবাগ ও বিরাট কোহলির ওয়ানডে জার্সি, অজিঙ্কা রাহানের হেলমেট, পার্থিব প্যাটেলের কিপিং গ্লাভস, শিখর ধাওয়ানের ব্যাটিং গ্লাভস। সবকটিতেই নেওয়া আছে তাদের অটোগ্রাফ। সাজিয়ে রাখা আছে এমন আরও অনেক স্মারক। 

এই কক্ষের বাঁ পাশ দিয়ে মূল জাদুঘরের প্রবেশ দুয়ার। শুরুতেই আছে ক্রিকেটের মৌলিক শিক্ষার আয়োজন। ডিজিটাল স্ক্রিনে স্পর্শ করলেই ক্রিকেটের নানা শট কিংবা নানা ডেলিভারির ভার্চুয়াল চিত্র। এরপর ক্রমেই আপনি ঢুকে যাবেন ক্রিকেটের এক স্বর্গরাজ্যে। যেখানে আছে ইতিহাস, আছে ঐতিহ্য, আছে অর্জন-সম্মান-স্বীকৃতির প্রমাণ, আছে শ্রদ্ধা-ভালোবাসা-সমীহের নজির। অতীতকে এখানে ধরে রাখা হয়েছে চিরস্থায়ী বর্তমানে। 

‘অরিজিনস অব দা গেম’ সেকশনে খেলাটির আদি ইতিহাস যেমন জানা যাবে, তেমনি দেখা যাবে নানা ছবি, ১৭৫০ সালের বিচিত্র আকৃতির ব্যাটসহ দেখা যাবে দেড়শ-দুইশ বছর পুরনো ব্যাট-বলসহ নানা স্মারক। 

টেস্ট ক্রিকেটের শুরু থেকে এগিয়ে চলার বিভিন্ন ধাপ নিয়ে আছে আলাদা সেকশন। যথারীতি নানা সময়ের ব্যাট, প্যাড, জার্সি, ট্রফি, ক্যাপসহ স্মারকের শেষ নেই। 

একটু পরপরই রাখা আছে ভিডিও স্ক্রিন, যেখানে ক্রিকেটের ইতিহাসের প্রতিবেদন যেমন আছে, তেমনি আছে ক্রিকেটের নানা যুগের ক্রিকেটারদের নানা কথা, সাক্ষাৎকার ও অনেক কিছু। 

বিখ্যাত (কিংবা কুখ্যাত) বডিলাইন সিরিজের তথ্যচিত্র দেখার জন্য আছে আলাদা একটি কক্ষ। যেখানে আলো-আঁধারিতে বসে দেখা যায় পুরো ফিল্ম। চাইলে পড়তেও পারেন সেই সিরিজের ইতিহাস কিংবা দেখতে পারেন স্মারক। 

১৯৪৮ সালে ইংল্যান্ড সফরে অস্ট্রেলিয়ার সেই ‘ইনভিন্সিবল’ দলকে সম্মান জানানো হয়েছে আলাদা করে। সেই সিরিজের ছবি, দলের সবার পরিসংখ্যান খোদাই করা আছে দেয়ালে। ফ্রেমবন্দি আছে সেই সিরিজের একটি ব্যাট, যেখানে অটোগ্রাফ নেওয়া আছে অস্ট্রেলিয়ার ১৭ জনের দলের ১৫ জনেরই। কেবল ওপেনার আর্থার মরিস ও কিপার ডন ট্যালনের স্বাক্ষর নেই সেই ব্যাটে। সফরে অস্ট্রেলিয়ার ৩৪ ম্যাচের ৯টিতে অনুপস্থিত ছিলেন এই দুজন। ব্যাটে অটোগ্রাফ সেই সময়েই নেওয়া। 

একটি কক্ষে রূপ দেওয়া হয়েছে সত্যিকারের ড্রেসিং রুমে। একজন ব্যাটসম্যানের প্রতিকৃতি আছে সেখানে, মনে হবে যেন সত্যিই কোনো ব্যাটসম্যান বসে আছেন। ড্রেসিং রুমের মতোই দেয়ালে ঝুলছে পোশাক, আশেপাশে ছড়ানো-ছিটানো ক্রিকেট সরঞ্জাম। আছে প্রাচীন আমলের টেলিফোন। সেখানে বাটনের পাশে লেখা আছে ক্রিকেটারদের নাম। রিসিভার কানে নিয়ে রিচি বেনোর বাটনে চাপ দিলে শোনা যাবে তার কণ্ঠ, আর্থার মরিসের বাটনে চাপ দিলে তার কণ্ঠ। এরকম বাটন আছে বেশ কয়েকজনের নামে।

ও হ্যাঁ, কিংবদন্তি ধারাভাষ্যকার ও অস্ট্রেলিয়ার সাবেক অধিনায়ক রিচি বোনোকে নিয়ে আলাদা একটি সেকশনও আছে। 

জাদুঘরেরর সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ নিঃসন্দেহে ‘ব্র্যাডম্যান গ্যালারি।’ আগের ব্র্যাডম্যান মিউজিয়ামের সব স্মারক রাখা হয়েছে এখানে। সমৃদ্ধ এই সংগ্রহশালায় কী নেই! ব্র্যাডম্যানের জীবনের প্রথম ব্যাট থেকে শুরু করে তার বেশ কয়েকটি ব্যাট, বেশি কয়েকটি ব্যাগি গ্রিন ক্যাপ, হ্যাট, ব্লেজার, কিছু ম্যাচের বল, ট্রাউজার, ট্রফি, অসংখ্য ছবি… আর যে কত কী! 

পাতলা, ফিনফিনে ব্যাটগুলো দেখলে বিস্ময় জাগে, বাচ্চাদের খেলনা ব্যাটের মতো এসব ব্যাট দিয়ে খেলেই সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান হয়েছেন তিনি! সেই সব যুগের সব ব্যাটসম্যানের বাস্তবতাই অবশ্য এটি। 

এক পাশের দেয়ালজুড়ে আছে ব্র্যাডম্যানের জীবনের নানা ছবি। মাঠের ভেতরের, বাইরের। ক্রিকেটারদের সঙ্গে, পরিবার-পরিজনের সঙ্গে, নিজের-একান্তের। এই অংশেই ভিডিও স্ক্রিনে শচিন টেন্ডুলকার শোনাচ্ছেন ব্র্যাডম্যানের সঙ্গে তার দেখা হওয়ার গল্প। 

কক্ষের দেয়ালজুড়ে ফুটে উঠেছে ব্র্যাডম্যানের বিখ্যাত সব স্কোর। একটি অংশে বিশেষ একটি লেখা আছে, “হোয়াই ওয়াজ হি সো গুড?” লেখার বিষয়বস্তু নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন। 

খেলাটির ইতিহাসের নানা বাকে বিপ্লবী পরিবর্তন মোড় এনেছেন যারা, তাদেরও সম্মান জানানো হয়েছে একটি অংশে। ব্র্যাডম্যান যাকে খুব একটা পছন্দ করেননি, ক্রিকেট সম্প্রচারের ইতিহাস বদলে দেওয়া সেই ক্যারি পেকার থেকে শুরু করে আরও অনেক পরিবর্তনের নায়কদের ঠাঁই হয়েছে সেখানে। 

বিশ্বের সব টেস্ট খেলুড়ে দলের নানা স্মারক সেখানে আছে। বড় একটি হলরুমে শেন ওয়ার্ন থেকে শুরু করে অস্ট্রেলিয়ার অনেক ক্রিকেটারের ব্যাগি গ্রিন, ওয়ানডে ক্যাপ, অনেকের জার্সি এবং আরও অনেক স্মারক যে আছে! 

‘গ্রেটস অব দা গেম’ সেকশনে একটি সরু পথের দেয়ালে সাঁটানো আছে ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা কিছু ক্রিকেটারের বিশাল প্রতিমূর্তি। শুরুটা অবশ্যই ব্র্যাডম্যানকে দিয়ে। তার পাশেই ক্রিকেটের অমর বুড়ো ডব্লিউ জি গ্রেস, ভিক্টর ট্রাম্পার, জ্যাক হবস, ওয়ালি হ্যামন্ড, ফ্রাঙ্ক ওরেল, জর্জ হেডলি, গ্রায়েম পোলক, গ্যারি সোবার্স, সুনিল গাভাস্কার, ভিভিয়ান রিচার্ডস, অ্যাডাম গিলক্রিস্ট, শচিন টেন্ডুলকার, শেন ওয়ার্ন, মুত্তিয়া মুরালিধরন, ইমরান খান, রিচার্ড হ্যাডলি, ডেনিস লিলি, বিল ও’রাইলি, সিডনি বার্নসের প্রতিকৃতি আঁকা হয়েছে সেখানে। সবকটিই মুগ্ধতা জাগানিয়া। 

জাদুঘর শেষ হয়েছে আইসিসির হল অব ফেম-এ জায়গা পাওয়া ক্রিকেটারদের তালিকা দিয়ে। 

সব মিলিয়ে এখানে আছে ক্রিকেট পিপাসু মনের খোরাক মেটানোর সব আয়োজন। ২-৩ ঘণ্টাও আছে এই জাদুঘর দেখার জন্য যথেষ্ট নয়। 

ব্র্যাডম্যানের জনপ্রিয়তা, তার বিশালত্বের কিছুটা নমুনা মেলে এখানকার সু্ভ্যেনির শপে গেলে। ব্র্যাডম্যানের নামে কত কী যে বিক্রি হচ্ছে এখানে! ক্রিকেটে নানা স্মারক থেকে শুরু করে ব্র্যাডম্যানের নামে সানস্ক্রিন, হ্যান্ড স্যানিটাইজারসহ বিচিত্র সব জিনিস বিক্রি হচ্ছে ব্র্যাডম্যানের নামে। আছে ক্রিকেট সম্পর্কিত অনেক বইও। 

শেষ কী এখানেই! ব্র্যাডম্যান মিউজিয়াম, ব্র্যাডম্যান ওভাল, ৫২ শেফার্ড স্ট্রিটের বাড়ি, ২০ গ্লিব স্ট্রিটের বাড়ি, তার স্কুল ও চারপাশের এলাকা মিলে গড়া পথটুকুর নাম দেওয়া হয়েছে ‘ব্র্যাডম্যান ওয়াক।’ চারপাশ দেখে, আলসে ভঙ্গিতে হেঁটে, ওই আবহে ডুব দিয়ে ৪০-৪৫ মিনিটের পথ। ব্র্যাডম্যানে বুঁদ থেকে সেই সময়টুকু কখন পেরিয়ে যাবে!

মর্ত্যে ৯২ বছরের জীবন কাটিয়ে ব্র্যাডম্যান অসীমে পাড়ি জমিয়েছেন ২০০১ সালে। কিন্তু এই বাউরালের পথে পথে তিনি জীবন্ত প্রবলভাবে।

সব মিলিয়ে আসলে গোটা একটা দিনও যথেষ্ট নয় সবটুকুর স্বাদ নিতে। ট্রেন ধরার তাড়ায় ফিরতে হলো একটা সময়। মনে ভেতরে তখন নানা অনুভূতির দোলাচল। অসাধারণ সময় কাটানোর সুখস্মৃতি। আরেকটু থাকতে না পারার অতৃপ্তি। সবকিছুর ওপরে, ব্র্যাডমান নামক মহীরূহের বিশালত্ব নতুন করে অনুভব করা, আগে থেকে জানা সবকিছুকেও নতুন করে অনুভব করার বিস্ময়।