আওয়ামী লীগের ‘জনবান্ধব’ বাজেট মেননের কাছে ‘অস্পষ্ট’; বিএনপির চোখে ‘লুটপাটের’

৭ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের ফর্দ দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। এই বাজেটে ঘাটতি থাকবে ২ লাখ ৫৭ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকার বেশি, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 June 2023, 04:03 PM
Updated : 1 June 2023, 04:03 PM

নতুন অর্থবছরের বাজেট নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রথাগত প্রতিক্রিয়ায়ই এসেছে।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ প্রস্তাবিত বাজেটকে ‘জনবান্ধব’ বলেছে। তার বিপরীত প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি বলেছে, এটা ‘লুটপাটের’ বাজেট।

এদিকে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের চোখে ‘অস্পষ্ট’ ঠেকছে তাদের জোট শরিক দলের সরকারের দেওয়া এই বাজেট।

বাম দলগুলো বলছে, আইএমএফকে ‘খুশি’ রাখতে গিয়ে দেওয়া বাজেটে জনআকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়নি।

আওয়ামী লীগ সরকারের এই মেয়াদের সর্বশেষ বাজেট বৃহস্পতিবার সংসদে উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।

বৈশ্বিক সংকট এবং অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের জন্য ৭ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের ফর্দ দিয়েছেন তিনি। এই বাজেটে আয় ও ব্যয়ের হিসাবে সামগ্রিক ঘাটতি থাকবে ২ লাখ ৫৭ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকার বেশি, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।

আওয়ামী লীগ

বাজেট অধিবেশন থেকে বেরিয়েই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিকদের বলেন, “এই বাজেট সংকটে ঘুরে দাঁড়ানোর বাজেট।

“বাজেট এমনভাবে করা হয়েছে যে মানুষের কষ্টটা লাঘব হবে। দ্রব্যমুল্য মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকবে। বাজেটকে জনবান্ধব এই কারণে বলেছি, সাধারণ মানুষের কথা মাথায় রেখে এই বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে।”

দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, “বিশ্ব অর্থনীতি যখন মন্দা, সে মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার সময় উপযোগী বাজেট দিয়েছে।

“প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে আমরা যে স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, এই বাজেটের মাধ্যমে সেই স্মার্ট বাংলাদেশ, স্মার্ট নগরায়ন এবং স্মার্ট জনগণ গড়ে উঠতে সাহায্য করবে।”

বাজেটের গুরু্ত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরে নানক বলেন, “বিশেষ করে পিছিয়ে পড়া নিম্নবিত্ত মানুষ যাতে সমানতালে এগিয়ে যেতে পারে, সেদিকে লক্ষ্য রেখে বাজেট ঘোষণা হয়েছে। একই সঙ্গে ব্যবসায়ীরা যেন উপকৃত হন, সে দিকেও লক্ষ্য রাখা হয়েছে। এতে করে বেকারত্ব কমবে, উদ্যোক্তা বাড়বে।”

প্রস্তাবিত বাজেটকে স্বাগত জানিয়ে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনগুলো রাস্তায় মিছিলও নামিয়েছে।

বিএনপি

বাজেটের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানাতে ঢাকার বনানীতে নিজের বাসায় সাংবাদিকদের সামনে আসেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী।

তিনি বলেন, “বাজেট হচ্ছে রাজনীতির চিন্তার প্রতিফলন। আজকে যেখানে অবৈধ দখলদার সরকার বসে আছে, তাদের তো সাধারণ মানুষের চিন্তার প্রতিফলন ঘটবে না।

“বাজেট তো বড় বড় অঙ্ক দিচ্ছে, আর মানুষকে বড় বড় অবকাঠামোর কথা বলছে। বড় বড় অবকাঠামো মধ্যে বড় বড় চুরি, বড় বড় ডাকাতি ছাড়া কিছু দেখছি না। সেজন্য তো দেশে ডলার সংকট দেখা দিয়েছে, সেজন্য আজকে ব্যাংকে টাকা নেই, সেজন্য তো বাংলাদেশের পুঁজিবাজার বেহাল।”

আওয়ামী লীগ সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে ধ্বংস করে দিয়েছে বলে মন্তব্য করেন সাবেক এই মন্ত্রী।

“একটা দলীয় চিন্তার ভিত্তিতে পৃষ্ঠপোষকতার লুটপাটের অর্থনীতির মডেল তৈরি করে এটা (বাজেট) করা হয়েছে। তারা ঋণ নিচ্ছে। বৈদেশিক ঋণ যেটা ৮/১০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ছিল, সেটা আজকে এক লক্ষ কোটি টাকায় চলে গেছে। এই ঋণ নিয়ে তারা ঘি খাচ্ছে। এই ঘিয়ের টাকা দেশের জনগনকে পরিশোধ করতে হবে।”

প্রস্তাবিত বাজেট বাস্তবায়নযোগ্য মনে করেন কি না- প্রশ্নে আমীর খসরু বলেন, “এই বাজেট সরকার দিচ্ছে, না আইএমএফ দিচ্ছে, সেটাও তো দেখার বিষয়। মূলত আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী তাদেরকে বাজেট দিতে হবে।”

বনানীতে নিজের বাসায় সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের উপস্থিতি দেখে ক্ষুব্ধ হন সংসদ ছেড়ে আসা বিএনপির নেতা আমীর খসরু।

তিনি বলেন, ‘“এখানে গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা বাসায় ঢুকে … তাদের কাজটা কী? তার মানে কি আমরা বাজেটের কোনো প্রতিক্রিয়াও দিতে পারব না। তাদের উপস্থিতি দেখে এটাই প্রমাণ হয় যে, বাজেট প্রতিক্রিয়া দিতে সাবধান হতে হবে কিংবা প্রতিক্রিয়া দেওয়ার সুযোগও নাই।”

তিনি অনাহুত ব্যক্তিদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলেন।

জাতীয় পার্টি

প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের সংসদ অধিবেশন থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, “এই বাজেট বাস্তবসম্মত মনে করছি না। এই বাজেটে জনবান্ধব বা কল্যাণমুখী কিছু দেখছি না। নিম্নবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও গরিব মানুষ যাতে বেঁচে থাকতে পারে, তা এই বাজেটে নেই। এই বাজেট জনবান্ধব বলা যাচ্ছে না, এটা জনবান্ধবহীন বাজেট।

“মানুষের জীবন যাত্রা কঠিন হয়ে আছে, এমন বাস্তবতায় যে রাজস্ব আদায়ের টার্গেট করা হয়েছে, তা হয়তো আদায় হবে না। ডাইরেক্ট ট্যাক্সের পাশাপাশি সকল কিছুতেই ইনডাইরেক্ট ট্যাক্স দেওয়া হয়েছে। এতে সাধারণ ও মধ্যবিত্তের কষ্ট বাড়বে।”

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নে বিরোধীদলীয় উপনেতা কাদের বলেন, “আইএমএফফের কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার কারণে যে শর্ত দেওয়া হচ্ছে, তাতে জিনিসপত্রের দাম আরও বাড়বে। আমার মনে হয়, এই বাজেটে দ্রব্যমূল্য কমবে না বরং বাড়বে।”

ওয়ার্কার্স পার্টি

আওয়ামী লীগের জোট শরিক দলটির সভাপতি রাশেদ খান মেনন সাংবাদিকদের বলেন, “অর্থমন্ত্রী তার উন্নয়নের কথামালা দিয়ে এই বাজেটে বাস্তবতাটাকে কিছুটা অস্পষ্ট করে দিয়েছেন।

“বর্তমানে যে চ্যালেঞ্জগুলো আছে, যেমন মূল্যস্ফীতি, সেটা কীভাবে নিয়ন্ত্রণ হবে, এর স্পষ্ট কিছু এই বাজেটে আসছে বলে আমার মনে হয়নি।”

সাবেক মন্ত্রী মেনন আরও বলেন, “বাজেটে চ্যালঞ্জেগুলো কীভাবে মোকাবেলা হবে, এটাও অস্পষ্ট রয়ে গেল বলে আমার মনে হচ্ছে। বিশেষ করে আইএমএফের স্থিতিশীলতা বজায় রাখার যে বিষয়গুলো রয়েছে, সেগুলো আমার কাছে স্পষ্ট বলে মনে হয়নি।”

জাসদ: আওয়ামী লীগের জোট শরিক দলটির সভাপতি হাসানুল হক ইনু সাংবাদিকদের বলেন, “এই বাজেট উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার বাজেট।

“বৈশ্বিক সংকট এবং রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধের প্রভাবের ভেতরে দেশের উন্নয়নের ধারাকে অব্যহত রাখার প্রচেষ্টার এই বাজেট। এই বাজেটে দরিদ্র জনগোষ্ঠির সামাজিক নিরাপত্তার খাত, নারী শিশুর শিক্ষা স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে এবং দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করার এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টার কথা বলা হয়েছে।”

ইনু আরও বলেন, “আমি মনে করি, বাজেটে কোন খাতে কী বরাদ্দ আছে, সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হচ্ছে নিত্যপণ্যের দাম ঠিক রেখে চলার ব্যবস্থা করা এবং বিদ্যুত ও গ্যাস সরবরাহ রাখা, এই তিন বিষয়ের চশমা দিয়ে বাজেটের সাফল্য নির্ধারণ করতে হবে।”

সিপিবি

কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মোহাম্মদ শাহ আলম ও সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স এক বিবৃতিতে বলেন, এই বাজেট ধনীদের ‘স্বার্থ রক্ষার’ বাজেট।

“নিম্ন প্রবৃদ্ধি, সর্বোচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, সর্বনিম্ন বৈদেশিক মুদ্রার কর্তৃত্বপরায়ণতা, বৈদেশিক চাপের মুখে প্রদত্ত বাজেটে সাধারণ মানুষের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়নি। বাজেটে দুর্নীতি ও বৈষম্য মুক্তির নির্দেশনা নেই বরং জনগণের কাধে নানাভাবে করের বোঝা চাপবে-যা সাধারণ মানুষের জীবনকে আরও বিপর্যস্ত করে তুলবে।”

প্রস্তাবিত বাজেট প্রত্যাখ্যান করে বিবৃতিতে বলা হয়, “নয়া উদারনীতিবাদী অর্থনৈতিক দর্শনের ভিত্তিতে প্রণীত এই বাজেট বড় লোকের স্বার্থই রক্ষা করবে।”

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি

দলটির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক নতুন বাজেটে সাধারণ মানুষের জন্য কোনো ‘সুখবর’ দেখছেন না।

“আইএমএফকে খুশি রেখেই বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে। দুঃসময়ে সমতাধর্মী যে বাজেট দরকার ছিল, প্রস্তা্বিত বাজেটে তা অনুপস্থিত। বাজেটে আশার পরিবর্তে হতাশা বাড়িয়ে তোলা হয়েছে।”

সাইফুল বলেন, “ঋণ করে ঘি খাওয়ার মাশুল দিতে যেয়ে বাজেটের টাকার এক বড় অংশ বেরিয়ে যাবে ঋণ ও ঋণের সুদ পরিশোধ করতে। আমরা মনে করি, এই বাজেট দারিদ্র্য ও নিঃস্বকরণ প্রক্রিয়াকে পরোক্ষভাবে আরও জোরদার করবে।”

গণসংহতি আন্দোলন

দলটির প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি ও নির্বাহী সমন্বয়কারী আবুল হাসান রুবেল যৌথ বিবৃতিতে বলেন, “ঘোষিত বাজেটে অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় কোনো দিশা নেই, দিক-নির্দেশনা নেই।

“এই বাজেট আসলে সরকারের তথাকথিত উন্নয়নের নামে লুন্ঠনের ধারাবাহিকতা। দেশের বিপুল অধিকাংশ জনগণের জীবনের সংকট মেটাতে ব্যর্থ সরকারের এবং অবৈধ সরকারের ঔদ্ধত্ম্যের প্রকাশ এই বাজেট।”

বাসদ

দলের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশিদ ফিরোজ এক বিবৃতিতে বলেন, “বড় বাজেটের নামে ভ্যাট-ট্যাক্সের বোঝা জনগণের উপর চাপানো হয়েছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের উপযোগী দক্ষতার ঘাটতি যত উদ্বেগ তৈরি করেছে, সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাজেটের বরাদ্দ তেমন দৃশ্যমান নয়।

“সামগ্রিকভাবে এই বাজেট পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক শোষণমূলক ব্যবস্থার ভিত্তিকে আরও সম্প্রসারিত করবে, দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে আরও প্রান্তসীমায় ঠেলে দেবে, বৈষম্য বৃদ্ধি করবে।”