বিদ্যুৎখাত: পরিস্থিতির দায় কার?

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 22 July 2022, 02:36 PM
Updated : 22 July 2022, 02:36 PM

একটা পুরনো কৌতুক দিয়ে শুরু করা যাক।

এক আড্ডায় ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, রাজনীতিবিদের মধ্যে পেশার শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে কথা হচ্ছে। কোন পেশা সবার আগে পৃথিবীতে এসেছে− এই নিয়ে তুমুল তর্ক।

ডাক্তার বললেন, অবশ্যই ডাক্তারি পেশা। প্রথম মানুষ এলো পৃথিবীতে, তাদের সন্তান জন্ম নিলো, শুরু হয়ে গেল ডাক্তারি।

ইঞ্জিনিয়ার বললেন, না, না। তারও আগে মহাবিশ্ব ছিল লন্ডভন্ড। সৃষ্টিকর্তা সেসবকে সুশৃঙ্খল করলেন। সেটা অবশ্যই একটা ইঞ্জিনিয়ারিং কাজ। কাজেই প্রকৌশলবিদ্যাই পৃথিবীর আদিতম বিদ্যা।

রাজনীতিবিদ কোনো কথা না বলে মিটিমিটি হাসছেন।

বাকি দুজন বললেন, কী ব্যাপার, আপনি কোনো কথা না বলে হাসছেন কেন?

রাজনীতিবিদ বললেন, মানলাম, ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যা মহাবিশ্বকে সুশৃঙ্খল করেছে, কিন্তু মহাবিশ্বটাকে লন্ডভন্ড করলটা কে?

গল্পটা মনে পড়ল বিদ্যুৎখাতের বর্তমান সংকট দেখে। ‘বিদ্যুতের প্রাচুর্য’ রাতারাতি কমে গিয়ে সংকট শুরু হয়েছে। সরকারিভাবেই দেশে ঘোষণা দিয়ে নিয়ম করে লোডশেডিং করা হচ্ছে। প্রশ্ন হলো, বিদ্যুতের এমন সংকট সৃষ্টি হলো কেন?

একথা ঠিক যে আওয়ামী লীগ সরকার দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন অনেকগুণ বাড়িয়েছে। ২০১১ সাল থেকে গেল বছর পর্যন্ত ঢাকা শহর থেকে লোডশেডিং শব্দটি প্রায় হারিয়েই গিয়েছিল। সেই অবস্থা থেকে এখন আবার দেশে লোডশেডিংয়ের অন্ধকারে ছেয়ে গেল কেন? হ্যাঁ, এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির দায় আছে, কিন্তু এর বাইরে কি আর কারোর কোনো দায় নেই?

প্রথমেই বিদ্যুৎ নিয়ে বিএনপি নেতাদের সাম্প্রতিক কিছু বক্তব্য নিয়ে কিছু বলাটা জরুরি হয়ে দেখা দিয়েছে। বিএনপি নেতারা এখন বিদ্যুৎ পরিস্থিতি নিয়ে সরকারের সমালোচনায় সরব হয়েছেন।

অথচ তাদের শাসনামলে দেশের বিদ্যুৎ খাতকে লন্ডভন্ড করে দেওয়া হয়েছিল। তখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং হতো। টানা ১২-১৪ ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিংয়ের নজির আছে। ১৯৯৫ সালে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন হতো মাত্র ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট। চারদিকে তখন ছিল বিদ্যুতের জন্য হাহাকার। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর বিদ্যুৎখাতের উন্নয়নে বেশ কিছু প্রকল্প গ্রহণ করে। আইন করে বেসরকারি খাতকে উন্মুক্ত এবং দেশে প্রথমবারের মতো বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই ১ হাজার ৬০০ থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন ৪ হাজার ৩০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়।

এরপর ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াতের জোট ক্ষমতাসীন হয়ে আওয়ামী সরকার গৃহীত প্রকল্পগুলো স্থগিত বা বাতিল করে দেয়। নতুন করে শুরু হয় বিদ্যুৎ সংকট। পরের বছরগুলোতে তারা হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেও বিদ্যুৎ সমস্যার কোনো সমাধান করতে পারেনি। বিদ্যুৎ সমস্যার কারণে তখন দেশের মানুষের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠে। বিদ্যুৎ চাওয়ার কারণেই ২০০৬ সালের জানুয়ারিতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে ২০ জন গ্রামবাসীকে হত্যা করা হয়। ঢাকার কেরানীগঞ্জসহ দেশের বহু জায়গায় বিদ্যুতের দাবিতে বিক্ষোভরত জনতার উপর পুলিশ গুলি করে।

এরপর ২০০৭ সালে সেনানিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। এই সরকার প্রায় দুই বছর ক্ষমতায় থাকলেও বিদ্যুৎ খাতে নতুন কিছুই করেনি বা করতে পারেনি। এরপর ২০০৯ সালে আবার আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে নতুন করে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর কাজ শুরু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের এপ্রিলে রেকর্ড সর্বোচ্চ ১৪ হাজার ১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে।

কিন্তু এত প্রাচুর্যের মধ্যে আকস্মিকই বিদ্যুৎ খাতে সংকট দেখা দিয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার কারণে বিদ্যুতের ব্যবহার কমাতে নানা রকম ফরমান জারি করা হচ্ছে। নিয়ম করে লোডশেডিং দেওয়া হচ্ছে। রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী সৃষ্ট জ্বালানি সংকটের ফল হিসেবে এমনটি হয়েছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে। সরকারের এই যুক্তির বিরোধিতা করার কারণ নেই। তবে বাংলাদেশে এত দ্রুত কেন এমন সংকট সৃষ্টি হলো, তার পেছনের অন্যান্য কারণগুলোও খুঁজে বের করা দরকার।

বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই ভয়াবহ বিদ্যুৎ সংকট মোকাবিলার কথা বলে যখন একের পর এক 'কুইক রেন্টাল' বিদ্যুৎকেন্দ্র বসাতে থাকে; তখন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অনেকেই এর তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। তাদের যুক্তি ছিল, বেশিরভাগই উচ্চমূল্যের ডিজেল বা ফার্নেস অয়েলভিত্তিক হওয়ায় এগুলোর উৎপাদন খরচ দেশের গড় বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচের তুলনায় অনেক বেশি। তাছাড়া বিনা টেন্ডারে এসব কেন্দ্র দেওয়া হয়েছিল ক্ষমতাসীন দলের নেতা বা ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের। বিশেষজ্ঞদের ওই সমালোচনা যে অমূলক ছিল না- দিন যত গেছে, ক্রমেই তা স্পষ্ট হয়েছে।

তারপরও সাধারণ মানুষ সরকারি উদ্যোগকে মেনে নিয়েছিল এ কারণে যে, তাদের বিদ্যুৎ ও জ্বালানির কারণে অশেষ ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে না। আর অপেক্ষাকৃত সাশ্রয়ী জ্বালানিভিত্তিক বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র তথা 'বেইজলোড প্ল্যান্ট' নির্মাণ রাতারাতি সম্ভবও ছিল না। সরকারও তখন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল- বেইজলোড প্ল্যান্টগুলো নির্মিত ও সচল হলেই ধাপে ধাপে কুইক রেন্টাল কেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দেওয়া হবে। কিন্তু ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি গ্যাস ও কয়লাভিত্তিক বেইজলোড প্লান্ট অপারেশনে আসায় বর্তমানে চাহিদার চেয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা অনেক বেশি হওয়া সত্ত্বেও সরকার রহস্যজনক কারণে দফায় দফায় কুইক রেন্টাল কেন্দ্রগুলোর চুক্তির মেয়াদ বাড়িয়েই চলেছে।

মাত্র গত মার্চে সাড়ে ৫০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার পাঁচটি কুইক রেন্টাল কেন্দ্রের আয়ু দ্বিতীয় দফায় দুই বছরের জন্য বাড়ানো হয়েছে। আরও চারটি কেন্দ্রের মেয়াদ দুই বছরের জন্য বাড়ানো হচ্ছে বলে গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। ২০১০ সালে চালু এসব কেন্দ্রের মেয়াদ এর আগেও একাধিকবার বাড়ানো হয়েছিল।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড বা পিডিবি এসব কেন্দ্রের মেয়াদ বারবার বাড়াচ্ছে খুবই খোঁড়া কিছু যুক্তি দেখিয়ে। সংস্থাটি বলছে, সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে, এ জন্য নাকি এসব কেন্দ্র টিকিয়ে রাখতে হবে। অথচ ৬৬০ মেগাওয়াটের তুলনামূলক স্বল্পমূল্যের পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র বসে আছে।

বেশ কয়েকটি গ্যাস ও কয়লাভিত্তিক বেইজলোড প্লান্ট অপারেশনে আসায় বর্তমানে চাহিদার চেয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা অনেক বেশি হওয়া সত্ত্বেও সরকার রহস্যজনক কারণে দফায় দফায় কুইক রেন্টাল কেন্দ্রগুলোর চুক্তির মেয়াদ বাড়িয়েই চলেছে।

তাছাড়া আরও প্রায় ৩ হাজার মেগাওয়াট এ ডিসেম্বরেই জাতীয় গ্রিডে আসার কথা। পিডিবি যে 'নো ইলেকট্রিসিটি নো পেমেন্ট' ভিত্তিতে কুইক রেন্টালগুলোর আয়ু বাড়াতে চাচ্ছে, তাতেও রয়েছে শুভঙ্করের ফাঁকি। এর আগে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে কুইক রেন্টালগুলোকে ৭০ হাজার কোটি টাকা পরিশোধের তুমুল সমালোচনা হওয়ায় পিডিবি বলছে, এখানে সেই ক্যাপাসিটি চার্জ নেই। বাস্তবে স্থির পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ চার্জ নামে একটা খাত যুক্ত করা হয়েছে, যার বাবদ সরকারকে গড়ে ৩ টাকা দিতে হবে, যেখানে ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল ২ টাকা। তা ছাড়া 'পরিবর্তনশীল মেরামত ও পরিচালন ব্যয়' আগে ছিল দশমিক ৫ পয়সা; এখন হয়েছে ২৫ পয়সা! ফলে কুইক রেন্টালের পেছনে সরকারের খরচ আগের তুলনায় বরং বাড়বে।

গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, শীতকালে যখন বিদ্যুতের চাহিদা কমে আসে, তখন নানা ভোঁতা যুক্তি দেখিয়ে খুবই সস্তায় বিদ্যুৎ সরবরাহকারী সরকারি কেন্দ্রগুলো বসিয়ে রেখে উচ্চমূল্যের কুইক রেন্টালগুলো চালু রাখা হয়েছে। ২০১০ সালে যখন সচেতন মহলের বিরোধিতাকে উপেক্ষা করে এ কুইক রেন্টালগুলোকে আইনি ঝামেলা থেকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য দ্রুত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ (বিশেষ প্রভিশন) আইনটি প্রণীত হয়, তখনই ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মালিকদের আত্মিক সম্পর্কের বিষয়টি বোঝা গিয়েছিল।

তবে সরকারকে এটা বুঝতে হবে, পয়সার অভাবে আজ যখন জ্বালানি কিনতে না পারার কারণে দেশবাসীকে এক থেকে দুই ঘণ্টা লোডশেডিং মেনে নিতে বলা হচ্ছে, ঠিক তখনই অপ্রয়োজনীয় কুইক রেন্টালের মালিকদের জনগণের পকেট কেটে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। এটা বন্ধ করার কোনো উদ্যোগ নেই।

দেশে গ্যাস সম্পদ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎস থাকলেও কমিশনভোগী এবং কিছু গোষ্ঠীকে লাভবান করতে গত এক দশকে জ্বালানি খাতকে আমদানিনির্ভর করা হয়েছে। প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা, জনগণের করের টাকা ভর্তুকির নামে অপচয় করেও সংকট এড়ানো যাচ্ছে না। গ্যাস উত্তোলনে মনোযোগ না দিয়ে সরকার দেশের জ্বালানির জন্য আমদানির ওপরই নির্ভরশীল থেকেছে।

দেশিয় উৎস থেকে গ্যাসের সরবরাহ ২০১৮ সালেও ছিল ২ হাজার ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট। বর্তমানে কমে এসে ২ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট ঠেকেছে। দেশীয় উৎস থেকে গ্যাস কমার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে এলএনজির আমদানি। চাহিদা মেটাতে লং টার্ম এলএনজির পাশাপাশি বাংলাদেশ স্পট মার্কেট থেকেও আমদানি করে। বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় স্পট মার্কেট থেকে এলএনজির আমদানি বন্ধ রেখেছে পেট্রোবাংলা। তার প্রভাব পড়েছে বিদ্যুৎ খাতে। বাংলাদেশে বিদ্যুতের ৫১ শতাংশ আসে গ্যাসচালিত বিদ্যুৎ থেকে। আমদানিনির্ভর গ্যাস খাত হওয়া সত্ত্বেও কেন সরকার দেশীয় উৎস থেকে গ্যাস অনুসন্ধান করছে না? জবাবে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমরা যদি ১০০ মিলিয়ন ডলার গ্যাস অনুসন্ধানে খরচ করার পর দেখি গ্যাস নেই, তাহলে এই ক্ষতির দায়ভার কে নেবে?’

কিন্তু বিশেষজ্ঞরা ভিন্ন কথা বলছেন। তাদের মতে, সরকারের অদূরদর্শিতার কারণে বছর বছর যে পরিমাণ টাকা গচ্চা দিচ্ছে, তা দিয়ে আরও ব্যাপক আকারে গ্যাস অনুসন্ধান করা যেত। গত দশ বছরে ষাট হাজার কোটি টাকারও বেশি গচ্চা দিতে হয়েছে ভাসমান বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সঙ্গে অসম চুক্তির কারণে। এই কেন্দ্রগুলো কোনো বিদ্যুৎ সরবরাহ না করেও সরকারের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে এবং এখনও নিচ্ছে। এ ছাড়া রয়েছে চুরি, অপচয় ্র ব্যাপক দুর্নীতি। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা গেলে গ্যাস অনুসন্ধানের টাকার কোনো অভাব হতো না।

উৎপাদিত বিদ্যুতও পুরোপুরি ব্যবহার করা যাচ্ছে না সঞ্চালনের ব্যবস্থার অভাবে। সঞ্চালন অবকাঠামো তৈরির ব্যপারটি আটকে আছে দীর্ঘদিন ধরে। বেশি সঞ্চালন ব্যবস্থা উন্নত না করে কেন এত বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হলো, সে প্রশ্নেরও কোনো জবাব মিলছে না। আসলে জ্বালানি খাত যে নীতির ভিত্তিতে পরিচালিত হচ্ছে তা অদূরদর্শী, অসম এবং সামঞ্জস্যহীন। তার ফলেই এমন লন্ডভন্ড পরিস্থিতি।

প্রশ্ন হলো বিদ্যুৎ খাতে এমন ‘লন্ডভন্ড’ পরিস্থিতির দায় কার?