‘অসম বিশ্বে মানসিক স্বাস্থ্য’

মো. আমির হোসেন
Published : 9 Oct 2021, 10:42 PM
Updated : 9 Oct 2021, 10:42 PM

'মানসিক স্বাস্থ্য' শব্দযুগলে পরিষ্কারভাবে 'স্বাস্থ্য' শব্দটি উল্লেখ রয়েছে। অর্থাৎ মানসিক বিষয়টি স্বাস্থ্যের একটি বড় অংশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা স্বাস্থ্যের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছে, "ব্যক্তির শারীরিক, মনঃস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক স্বাস্থ্যের ভালো অবস্থানকেই 'ভালো স্বাস্থ্য' বলে। অথচ  মানসিক স্বাস্থ্যের যত্নটি  আমাদের দেশে এখনও উপেক্ষিত। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের  ২০১৮-১৯ এর জরিপে দেখা যায়, দেশের ১৭ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ মানসিক রোগে ভুগছেন, যাদের মধ্যে ৭ শতাংশ বিষণ্ণতায় আক্রান্ত। এদের মধ্যে পুরুষ  ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ এবং নারী ১৭ শতাংশ। দুঃখজনক বিষয় হলো এদের মধ্যে ৯২ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ কোন ধরনের মানসিক রোগের চিকিৎসা নেন না।  বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, "মানসিক স্বাস্থ্য হলো ব্যক্তির মনের এমন এক ভালো থাকার অনুভূতির অবস্থা যেখানে ব্যক্তি তার নিজের ভেতরের দক্ষতাগুলোকে কার্যকর করে তুলতে পারে। জীবনের স্বাভাবিক মানসিক চাপগুলো মোকাবেলা করতে পারে, উৎপাদনশীল ও কার্যকরভাবে কাজ করতে পারে এবং তার নিজ সমাজে সে অবদান রাখতে পারে"। 

কিন্তু আমরা স্বাস্থ্য বলতে শুধু শারীরিক বিষয়কেই বুঝি। এই সংজ্ঞা থেকেই বোঝা যায়, মানসিক স্বাস্থ্য আসলে কতটা গুরুত্বপূর্ণ। দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশের ৭৫ শতাংশ থেকে ৯৫ শতাংশ মানুষের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা রয়েছে। দুঃখজনক বিষয় হলো তাদের কোন মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবা নেই। এমন বাস্তবতায় 'অসম বিশ্বে মানসিক স্বাস্থ্য'- প্রতিপাদ্য নিয়ে এ বছর পালিত হচ্ছে বিশ্ব 'মানসিক স্বাস্থ্য দিবস'।  কোভিড-১৯ মহামারী মানুষের 'মানসিক স্বাস্থ্যে'র ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে। বিশেষ করে সম্মুখসারির যোদ্ধা চিকিৎসক, নার্স, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, আইনজীবীসহ সাধারণ মানুষ কোভিডের কাছে হার মেনেছে এবং অনেকই মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় আক্রান্ত হয়েছে। মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর কোভিড মহামারীর প্রভাব নিয়ে একটি গবেষণায় দেখা গেছে ৬৪ শতাংশ মানুষ বিষণ্ণতায়, ৮৭ শতাংশ মানুষ আতঙ্কজনিত ও ৬১ শতাংশ চাপে ভুগছেন (সূত্র: আনালস অব গ্লোবাল  হেল্থ- ২০২০)।  দুঃখজনক হলেও এটি সত্যি যে মহামারী চলার মধ্যেই কোভিড নিয়ে এবং সংক্রমিত ব্যক্তির সৃষ্ট মানসিক সমস্যা নিয়ে অনেক সামাজিক অপবাদ ও বৈষম্যের ঘটনা ঘটেছে। 

মনে রাখা প্রয়োজন, যারা মানসিক অসুস্থতা অনুভব করেন, তাদের প্রতি সামাজিক অপবাদ এবং বৈষম্য আক্রান্ত ব্যক্তির  শিক্ষাগত সুযোগ, পেশাগত  সম্ভাবনা, তাদের পরিবার এবং প্রিয়জনকেও প্রভাবিত করে। মানসিক রোগকে এখনো সাধারণ রোগের মতো দেখার মানসিকতা গড়ে ওঠেনি। মানসিক রোগ ও রোগীকে নিয়ে সামাজিক অপবাদ ও বৈষম্যের অনেক নির্দয় উদাহরণ আমরা অহরহ দেখতে পাই। যার কারণে মানুষ এটি নিয়ে কথা বলতে চায় না, রোগটিকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করে। ফলে আক্রান্ত ব্যক্তি ও তার পরিবারের এক সময় ভয়াবহ পরিণাম  ভোগ করতে হয়। আত্মহত্যার একটি বড় কারণও অপবাদ। অথচ মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক না থাকলে আমরা পরিবার ও পেশাগত জীবনে ভালোভাবে খাপ খাওয়াতে পারব না। এই বৈষম্য মোকাবেলা করা প্রয়োজন, কারণ এটিকে চলতে দেওয়া উচিত নয়। এসব বৈষম্য দূর করার জন্য সকল মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবীদের একযোগে কাজ করার ব্যাপক সুযোগ রয়েছে এবং যা সময়ের দাবি। এই প্রসঙ্গে জাতিসংঘের মহাসচিবের  আহ্বান, "আসুন আমরা সবাই একটি স্বাস্থ্যকর কর্মী বাহিনীর অংশ হই, কারণ আমরা সবার জন্য একটি উন্নত বিশ্ব গড়ার কাজ করছি।"

জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) ২০৩০ এ অভিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা ৩ এর ৩ দশমিক ৪ ধারায়  প্রতিরোধ ও চিকিৎসার মাধ্যমে ২০৩০ সালের মধ্যে অসংক্রামক রোগের কারণে অকাল মৃত্যু এক তৃতীয়াংশ হ্রাস করা এবং মানসিক স্বাস্থ্য ও কল্যাণ নিশ্চিত  করতে সহায়তা দেওয়ার বিষয়টি গুরুত্বের সাথে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। একটি সুন্দর ও স্বাস্থ্যবান জাতি হয়ে উঠতে গেলে শুধু অর্থনৈতিক সক্ষমতার সঙ্গে সুস্থ মানসিকতার সমাজ প্রয়োজন। আর এ কারণে মানসিক রোগকে অন্য রোগের মতই দেখতে হবে। সবার জন্য মানসিক রোগের মানসম্মত  চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে । 

মানসিক স্বাস্থ্য সেবায় উন্নয়ন ও  বৈষম্য হ্রাসে মানসিক রোগ নিয়ে সমাজে সর্বস্তরে কথা বলা ও আলোচনা হওয়াটা জরুরী। এছাড়া মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়টি কমিউনিটিভিত্তিক স্বাস্থ্য সেবার আওতায় নিয়ে আসতে হবে। স্কুলের পাঠ্য বইয়ে মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব সম্পর্কে তুলে ধরে অভিভাবকদের সন্তান প্রতিপালন ও সুস্থ মানসিক বিকাশ নিয়ে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। স্থানীয়ভাবে সকল স্তরের মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করার পাশাপাশি 'সামাজিক অপবাদ' এর বিরুদ্ধে সামাজিকভাবেই আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। আর এসব কিছু করতে হলে মানসিক স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ এবং বরাদ্দও বাড়াতে হবে। 

গবেষণায় প্রমাণিত যে মানসিক স্বাস্থ্য সেবাগ্রহিতাদের মানসম্মত চিকিৎসায় ঘাটতি রয়েছে। তাই পেশাজীবীদের মানসম্মত চিকিৎসা দিতে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ পেশাজীবী গড়ে তোলার ব্যবস্থা ,করতে হবে।  আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব- নিজের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নবান হওয়া, মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সামাজিক অপবাদ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। এই বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করা এবং প্রয়োজনে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সহায়তা নেওয়া।