আধুনিক সমাজতন্ত্রের দিকে হাঁটতে চায় চীনা কমিউনিস্ট পার্টি

Published : 1 July 2021, 04:40 PM
Updated : 1 July 2021, 04:40 PM

১৯২১ সালের পয়লা জুলাই চীনে যখন কমিউনিস্ট পার্টি অব চায়না (সিপিসি) জন্ম নেয় তখন হয়তো প্রতিষ্ঠাকালীন সংগঠকদের কল্পনাতেও আজকের সাফল্যর ছবি ছিল না। কিন্তু অনেক সংগ্রাম, আত্মত্যাগ, গৌরব ও সাফল্যের পথ ধরে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি ১০০ বছর পূর্ণ করেছে। সিপিসির এই শতবর্ষ উদযাপন সমগ্র চীন দেশে পালিত হচ্ছে সাড়ম্বর, বর্ণাঢ্য আয়োজনের ভিতর দিয়ে। শতবর্ষ পূর্তির দিন সকালেই বেইজিংয়ের বিখ্যাত থিয়েন আনমেন চত্বরে চীনের প্রেসিডেন্ট এবং সিপিসির কেন্দ্রীয় কমিটির জেনারেল সেক্রেটারি শি জিনপিং বিশাল জনসমাবেশে এক বক্তব্যে এই শতকে চীনকে একটি আধুনিক সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যের কথা ঘোষণা করেন। 

অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে অন্যতম ক্ষমতাধর দেশ চীন মহাকাশেও জয়যাত্রা চালাচ্ছে। অতি সম্প্রতি মহাকাশ স্টেশনে মনুষ্যবাহিত নভোযান পাঠানো, মঙ্গল গ্রহ ও চাঁদে নভোযান পাঠানোর মধ্য দিয়ে চীন বিশ্বকে দেখিয়েছে প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানে তাদেরকে অস্বীকার করার চেষ্টা বাতুলতা মাত্র। আর অর্থনৈতিকভাবে চীনের সাফল্য তো বলার অপেক্ষাই রাখে না। এমনকি বৈশ্বিক মহামারীর মধ্যেও ঘুরে দাঁড়িয়েছে চীনের অর্থনীতি। এ সাফল্য অবশ্যই সিপিসির এবং বর্তমান নেতৃত্বের। 

পয়লা জুলাইয়ের বক্তৃতায় শি জিনপিং বলেছেন, সিপিসি বিগত ১০০ বছর ধরে চীনের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে একটি মূল লক্ষ্য অর্জনে নেতৃত্ব দিয়েছে- সেটি হলো চীনা জাতির পুনরুত্থান। সার্বিকভাবে সমৃদ্ধ সমাজ বিনির্মাণ করেছে চীন। প্রেসিডেন্ট শি ঘোষণা করেন যে, প্রথম শতবর্ষে চীন সব দিক থেকে মোটামুটি সমৃদ্ধ সমাজ গঠনের লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হয়েছে। 

একথা ঠিক যে, চীনা জনগণকে সত্যিই ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছে সিপিসি। বিশ্বের অন্যতম বিশালাকার চীনদেশের ৫৬টি জাতির মানুষকে একতাবদ্ধ করা বড় সহজ কাজ নয়। 

১৯৪৯ সালে কমিউনিস্ট বিপ্লবের মাধ্যমে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের (পিপলস রিপাবলিক অব চায়না) জন্ম হয়। বিশালকার এবং পাঁচ হাজার বছরের প্রাচীন সভ্যতার দেশটি ঊনবিংশ শতকে হয়ে পড়েছিল ঔপনিবেশিক শোষণ, সাম্রাজ্যবাদীদের টার্গেট এবং অভ্যন্তরীণ ধনিক শ্রেণির নিপীড়নে ক্ষতবিক্ষত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কষাঘাতে চীনের জনগণের দারিদ্র্য ও কষ্টভোগ উঠেছিল চরমে। ১৯৪৯ সালে চীনের মহান নেতা মাও সে তুংয়ের নেতৃত্বে কমিউনিস্ট বিপ্লবে তাই শ্রমজীবী ও সাধারণ জনগণ অংশ নিয়েছিল স্বাভাবিকভাবেই। 

চীনা জনগণের চরম দারিদ্র্য দূর করে সিপিসি তাদের আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়। সিপিসির সাফল্যের মূল চাবিকাঠি কী ছিল? আমরা শি জিন পিংয়ের ভাষণেই সেই উত্তর পাই। তিনি তার ভাষণে গত শতকে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির চারটি বড় সাফল্যের কথা তুলে ধরেন:

এক. পার্টি চীনের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে, অদম্য মনোভাব নিয়ে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছে এবং এর মধ্য দিয়ে একটি নয়া-গণতান্ত্রিক বিপ্লবে বড় সাফল্য অর্জন করেছে।

দুই. পার্টি চীনের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে আত্মনির্ভরতার চেতনায় একটি শক্তিশালী চীন প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দিয়েছে এবং সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ও বিনির্মাণে বড় সাফল্য অর্জন করেছে। 

তিন. পার্টি চীনের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে চিন্তার মুক্তি ও সামনে এগিয়ে যেতে নেতৃত্ব দিয়েছে এবং সংস্কার, উন্মুক্তকরণ ও সমাজতান্ত্রিক আধুনিকায়নে গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য পেয়েছে। 

চার. পার্টি চীনের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে আত্মবিশ্বাস, আত্মনির্ভরতা ও উদ্ভাবনী মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছে। একটি মহান লক্ষ্য, একটি মহান সংগ্রাম ও একটি মহান স্বপ্নের দিকে ধাবিত করেছে এবং এর মধ্য দিয়ে নতুন যুগে চীনা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন সমাজতন্ত্র অর্জনে সাফল্য লাভ করেছে।

সিপিসি প্রতিষ্ঠার চেতনাই ছিল এ যাত্রাপথে শক্তির উৎস। প্রেসিডেন্ট শি বলেন, "সিপিসি প্রতিষ্ঠার মহান চেতনাই পার্টির শক্তির উৎস।"

একথা সত্যি যে পার্টির কমরেডদের আত্মত্যাগ, কঠোর শ্রম, নিষ্ঠা এবং কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের প্রতি আস্থাই ছিল সিপিসির সাফল্যের মূল রহস্য। তারা সমাজতন্ত্রের আদর্শে সত্যিই বিশ্বাস করেছেন মনপ্রাণ দিয়ে। চীনে কমিউনিজমের পথিকৃৎদের পার্টি প্রতিষ্ঠার চেতনা নিম্নোক্ত নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত: সত্য ও আদর্শকে সমুন্নত রাখা, প্রতিষ্ঠার প্রকৃত লক্ষ্যে বিশ্বস্ত থাকা, আত্মত্যাগে ভীত না হয়ে নির্ভয়ে লড়াই চালিয়ে যাওয়া এবং পার্টি ও জনগণের প্রতি বিশ্বস্ত থাকা। 

চীনের সমাজতন্ত্র হলো চীনা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সমাজতন্ত্র। সেখানে ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক উদ্যোগ রয়েছে বটে কিন্তু সামাজিক নিরাপত্তা ও জনকল্যাণে রাষ্ট্রের নিরঙ্কুশ ক্ষমতাও রয়েছে। চীনে প্রতিটি নাগরিকের স্বাধীনতা রয়েছে ব্যক্তিগত ব্যবসায়িক উদ্যোগের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটানোর তেমনি পাশাপাশি প্রতিটি নাগরিকের জন্য সামাজিক নিরাপত্তাও রয়েছে, যা সমাজতন্ত্রের মূল চেতনা। চীন সফলভাবে তার প্রতিটি নাগরিককে দারিদ্র্যসীমার উপরে তুলতে সক্ষম হয়েছে গত বছর। 

শি জিনপিং পার্টির সদস্যদের মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠালগ্নের মূল উদ্দেশ্য ছিল জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করা। সেটি ভুলে গেলে চলবে না। আর দলকে সব সময় জনগণের সঙ্গে সংযুক্ত থাকতে হবে। তিনি বলেন, "সিপিসির প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্যের প্রতি অবিচল থাকতে হবে এবং জনগণের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বন্ধন অটুট রাখতে হবে।"

চীনের মহান কমিউনিস্ট বিপ্লবের নেতা এবং চীনা কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন চেয়ারম্যান মাও সে তুং চীনের জনগণের কল্যাণে ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। তিনি সবসময় সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। জনসাধারণের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের ব্যক্তিগত সুখ দুঃখের খোঁজ খবর নিতেন। এ বৈশিষ্ট্যটি বর্তমান চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এরও রয়েছে বলে দেশটির অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন। তিনিও প্রায়ই চীনের প্রত্যন্ত এলাকাগুলো ঘুরে দেখেন। একেবারে সাধারণ মানুষের সাধারণ সুখ-দুঃখের কথা শোনেন। 

সমাজতান্ত্রিক চীনের সঙ্গে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের বন্ধুত্ব রয়েছে। বর্তমানের চীনা নেতৃত্ব বাংলাদেশের বিভিন্ন উন্নয়নে সহায়তা দিচ্ছেন। কোভিড মহামারীর সময়ও চীন বাংলাদেশের পাশে থাকার প্রত্যয় জানিয়েছে। 

সিপিসির শতবর্ষে তাই বন্ধুপ্রতীম এই দেশকে শুভ কামনা জানাই। সেই সঙ্গে সিপিসির সাফল্যের সূত্র পর্যবেক্ষণ করে আমরাও হয়তো নিজের দেশকে কিভাবে উন্নত করতে হয় সেই শিক্ষাটি নিতে পারি। সবচেয়ে বড় কথা হলো যে যে অবস্থানেই থাকি না কেন, দেশের ও জনমানুষের কল্যাণের কথা সবচেয়ে আগে চিন্তা করা এবং সে অনুযায়ী কাজ করা।