বায়ুমান ব্যবস্থাপনায় গবেষণার প্রয়োজনীয়তা

মো. মাসুদ রানা
Published : 5 June 2020, 07:56 AM
Updated : 5 June 2020, 07:56 AM

বায়ুদূষণ ব্যবস্থাপনা কিছু জটিল কাজের সম্মিলনে প্রস্তুতকৃত একটি চক্রাকার ও চলমান প্রক্রিয়া যা কোনো এলাকার বায়ুর মানকে নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে থাকতে সহায়তা করে। যদি বায়ুমান উক্ত সীমা অতিক্রম করে তবে উক্ত প্রক্রিয়া বায়ুমানকে কমাতে কার্যকর হয় আর যদি বায়ুমান সীমার মধ্যেই বিদ্যমান থাকে তবে উক্ত প্রক্রিয়া বায়ুমানকে সীমার মধ্যে রাখতেই ভূমিকা পালন করে। বায়ুমানের এই নির্দিষ্ট সীমা নির্ধারণ করাটিই বায়ুমান ব্যবস্থাপনার প্রথম ধাপ এবং এই কাজে যথেষ্ট গবেষণার প্রয়োজন। একটি বায়ুদূষকের সর্বোচ্চ কোন মাত্রার ডোজ কোনো একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য প্রাণী ও পরিবেশের জন্য নিরাপদ সেটিই হতে পারে উক্ত সময় ব্যবধানে উক্ত দূষকের মানসীমা। যেমন, বাতাসে অতি সূক্ষ্ণ বস্তুকণা (পিএম.)'র জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক নির্ধারিত সীমা ২৪ ঘণ্টার গড়ে ২৫ মাইক্রোগ্রাম প্রতি ঘনমিটার বাতাসে এবং বাৎসরিক গড়ে ১০ মাইক্রোগ্রাম প্রতি ঘনমিটার বাতাসে। এমন সীমা নির্ধারণ করতে হয়েছে বহুদিনের ডোজ-রেসপন্স সম্পর্ক গবেষণার মাধ্যমে। তদুপরি, এই সীমা বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নিজেই গ্যারান্টি প্রদান করে না – সংস্থাটির মতে, হয়তোবা এই সীমার নিচের মাত্রাতেও মানব স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্থ হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্ধারণ করে দেয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন দেশে বায়ুমানের আদর্শ সীমা বিভিন্ন হয়ে থাকে কেন? এখানে বুঝতে হবে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্ধারিত এই কঠোর সীমা রাতারাতি অর্জন করতে হলে একটি এলাকা/দেশকে বিপুল পরিমাণ নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্যে মোটরযান, শিল্প-কারখানা, ইত্যাদি বন্ধ করে দিতে হবে যা উক্ত এলাকা/দেশের আর্থ সামাজিক অবস্থার উপর মারাত্মক প্রভাব সৃষ্টি করবে। সুতরাং, বায়ুমানের আদর্শ সীমা নির্ধারণে একটি দেশের আর্থ সামাজিক অবস্থাকে বিবেচনায় নিয়ে গবেষণার মাধ্যমে ধাপে ধাপে উক্ত সীমা কঠোরতার দিকে নিয়ে যেতে হবে – যা রীতিমতো চ্যালেঞ্জিং। বাংলাদেশে এ বিষয়ে কোনো গবেষণা নেই। সর্বশেষ ২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অনুকরণে দেশে পরিবেষ্টক বায়ুর আদর্শ মানমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এই দীর্ঘ ১৫ বছরে যুক্তরাষ্ট্রে আদর্শ মানমাত্রা পরিবর্তিত হলেও বাংলাদেশে নিজস্ব কোনো গবেষণা না থাকায় আদর্শ মানমাত্রার কী পরিমাণ পরিবর্তন সম্ভব তা জানা সম্ভব হয়নি এবং কোনো পরিবর্তনও হয়নি। আর পরিবর্তন হবে কিভাবে যেখানে আমরা ১৫ বছর পূর্বে নির্ধারিত মাত্রা এখনো অর্জন করতে সক্ষম হইনি।

বায়ুমান ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি'র উপাদানসমূহ যেমন, বায়ুমান মনিটরিং, ইমিশন ইনভেন্টরি, মডেলিং, ইত্যাদি প্রতিটি বিষয়ই সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণ জটিল বৈজ্ঞানিক কলাকৌশল। বায়ুতে বিশেষ করে সূক্ষ্ণ বস্তুকণা'র মানমাত্রা পরিমাপের জন্য বায়ুর স্যামপ্লিং পদ্ধতি গবেষণা প্রসূত একটি উদ্ভাবন। বায়ুতে একেক সাইজের বস্তুকণা স্যামপ্লিং-এর জন্য যন্ত্রের বায়ু-প্রবেশ নলে একেক রকম বৈজ্ঞানিক কারুকার্য করা হয় যেখানে বায়ু টানের নির্দিষ্ট একটি হারও নির্ধারিত থাকে। বিষয়টি এত সূক্ষ্ণ যে, বায়ুমান মনিটরিং এর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের এনভায়রনমেন্ট প্রটেকশন এজেন্সি নির্দিষ্ট মেথডে পরিচালিত কিছু কোম্পানির যন্ত্রকে বায়ুমান মনিটরিং-এর জন্য উপযুক্ত হিসেবে লিস্টিং করেছে। সার্বক্ষণিকভাবে চলমান বায়ুমান মনিটরিং যন্ত্রসমৃদ্ধ স্টেশনে প্রতি মিনিট বা ১৫ মিনিট অন্তর বায়ুমান ও আবহাওয়ার তথ্য উৎপাদিত হয়। এসব যন্ত্রের সঠিক ব্যবস্থাপনা ও সেখান থেকে গুণমানসম্পন্ন তথ্য উৎপাদন একটি অতি চ্যালেঞ্জিং বিষয়। এবং, উৎপাদিত বিশাল তথ্যভাণ্ডার সংরক্ষণ, ব্যবস্থাপনা ও বিশ্লেষণপুর্বক বায়ুমানের প্রকৃত চরিত্র নির্ণয় করে বায়ুমান নিয়ন্ত্রণে পলিসি রিকমেন্ডেশন প্রণয়ন করার জন্য যথেষ্ট মনযোগ ও গবেষণা প্রয়োজন। কারণ, একই বায়ুদূষক দিনে এক রকম রাতে আরেক রকম, শহরে এক রকম গ্রামে আরেক রকম, সমভূমিতে এক রকম পাহাড়ী এলাকায় অন্য রকম চরিত্র প্রদর্শন করতে পারে। সুতরাং, পর্যাপ্ত গবেষণার ভিত্তিতেই শুধু তথ্যের ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। মনে রাখতে হবে, ভুল তথ্য উৎপাদন কিংবা তথ্যের ভুল ব্যাখ্যা বেঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভুমিকা রাখতে পারে যা রাষ্ট্রের ক্ষতির কারণ হতে পারে।

বায়ুমান মনিটরিংয়ের আধুনিক যন্ত্রপাতি অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং এর অপারেশন ও ব্যবস্থাপনা বেশ কষ্টকর এবং ব্যয়বহুলও। আমাদের মতো দেশে এরকম ব্যয়বহুল যন্ত্র খুব বেশি স্থাপন করা সম্ভব নয়, অথচ বায়ুমান ব্যবস্থাপনার সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য বায়ু মনিটরিং কাভারেজ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। এতদউদ্দেশ্যে, একটি এলাকার সকল সোর্সের নিঃসরণ গণনা ও এর জিআইএস ভিত্তিক ইনভেন্ট্রি করে আবহাওয়ার তথ্যসহ একটি আন্তর্জাতিক মানের ডিসপারশন মডেল ব্যবহার করে উক্ত এলাকার প্রতিটি অংশে বায়ুমান মাত্রা গণনা করা সম্ভব। তবে, পুরো বিষয়টি এত সহজ নয়। মডেল রেজাল্টের মান নির্ভর করে ব্যবহৃত তথ্যের সঠিকতার উপর। উৎস ও দূষক পদার্থের সঠিক হিসাব তো থাকতেই হবে, তার সাথে এলাকাটির ভৌগলিক ফিচার, চারপাশের স্থাপনার ফিচার, এবং সর্বোপরি বায়ুমণ্ডলীয় বাউন্ডারি লেয়ারের সঠিক প্যারামিটারাইজেশন তথ্য উক্ত মডেলে সরবরাহ করতে হবে। বিষয়গুলি অত্যন্ত গবেষণানির্ভর বিশেষ করে কোনো এলাকার বায়ুমণ্ডলীয় বাউন্ডারি লেয়ারের প্যারামিটারাইজেশন করা জটিল গবেষণার অংশ। বর্তমানে বিভিন্ন মিটিওরোলজি মডেলের মাধ্যমে এ কাজটি করা হয় যা যথেষ্ট অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করে। আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত ডিসপারশন মডেলের প্রাথমিক পর্যায়ের গবেষণাও হতে দেখা যায় না। তবে, পিএম. এর রাসায়নিক বিশ্লেষণপূর্বক এর সোর্স অ্যাপোশনমেন্ট সংক্রান্ত একাধিক গবেষণা হয়েছে। এর সাথে বাউন্ডারি লেয়ারের সঠিক প্যারামিটারাইজেশন করে রেগুলেটরি ডিসপারশন মডেল ও কেমিস্ট্রি মডেলের অবকাঠামো তৈরি করে গবেষণা পরিচালিত করলে বায়ুমান ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপুর্ণ তথ্য উৎপাদন ও সরবরাহ করা সম্ভব। এর মাধ্যমে প্রতিটি উৎস পৃথক বা সামষ্টিকভাবে কোন সময়ে একটি এলাকার কোন স্থানে কি পরিমাণ দূষণ সৃষ্টি করে, এমনকি করতে পারে তা নির্ণয় করা সম্ভব। কোন এলাকায়, কোন দিকে, কোন মৌসুমে কী পরিমাণ শিল্প কারখানা বা যানবাহন বা অন্য কোনো উৎসের অনুমোদন দেয়া যেতে পারে তাও এ ধরনের মডেল চালিয়ে বের করা সম্ভব। তবে, এজন্য অবশ্যই প্রশিক্ষিত মডেলার দ্বারা গবেষণা পরিচালিত করতে হবে, যা ইউএসইপিএ'র মডেলিং গাইডলাইনে বেশ জোরালোভাবে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। নতুবা, ভুল তথ্যের ব্যবহার ও তথ্যের বেঠিক ব্যাখ্যা বেঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভুমিকা রাখতে পারে যা রাষ্ট্রের ক্ষতির কারণ হতে পারে।

পরিশেষে বলা যায়, বায়ুমান ব্যবস্থাপনা'র মত জটিল বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে গুণমানসম্পন্ন তথ্য উৎপাদন ও এর সঠিক ব্যাখ্যা প্রয়োজন। একইসাথে, বায়ুমানের টেকসই উন্নতির লক্ষ্যে অবকাঠামো নির্মাণ করে উন্নত গবেষণা অব্যহত রাখার মাধ্যমে আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি বায়ুমান ব্যবস্থাপনা কৌশল প্রণয়ন করে বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।