কোনো দিকে ঝুঁকে পড়ার প্রশ্ন আসে না

বাংলাদেশ কার সঙ্গে কী সম্পর্ক গড়ে তুলবে এবং তা কতদূর অগ্রসর হবে—সেটা তৃতীয় কোনো দেশ ঠিক করে দেবে, এটা কেমন কথা?

মোনায়েম সরকারমোনায়েম সরকার
Published : 29 August 2023, 10:36 PM
Updated : 29 August 2023, 10:36 PM

জোহানেসবার্গে ব্রিকসের যে সম্মেলন হয়ে গেল, তাতে বাঙালির চিরাচরিত সাজপোশাকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতি ছিল লক্ষ্য করার মতো। তিনি এর বিভিন্ন কার্যক্রমে জোরালোভাবেই অংশ নিয়েছেন। সেখানে চীনা নেতা শি জিন পিংয়ের সঙ্গে তাঁর যে বৈঠক হয়েছে, তাও সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, অখণ্ডতা ও অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বাইরের হস্তক্ষেপের প্রশ্নে চীন তার বিরোধিতার কথা আবারও স্পষ্ট করেছে। ভারতের নেতা নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গেও প্রধানমন্ত্রীর দেখা হয়েছে; যদিও আনুষ্ঠানিক বৈঠক হয়নি। রাশিয়ার নেতা ভ্লাদিমির পুতিন সম্মেলনে অংশ না নিলেও দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী এতে অংশ নিয়েছেন। পুতিন অংশ নিলে তাঁর সঙ্গেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেখাসাক্ষাৎ হতো। কিছু মতবিনিময়ও হতো। তবে দেখা না হলেও বাংলাদেশ নিয়ে রাশিয়ার মনোভাব স্পষ্ট। তারা এর মধ্যে একাধিকবার বলেছে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে রাশিয়া হস্তক্ষেপ করবে না। অন্য কোনো দেশের হস্তক্ষেপের চেষ্টারও তারা নিন্দা করে।

বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনের বিষয়ে ভারতও তার মনোভাব গোপন করেনি। ভারত চায়, নির্বাচনটি পরিকল্পনামাফিক শান্তিপূর্ণভাবে হোক এবং এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারা বহাল থাকুক। ভারত বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান নিয়ে স্বভাবতই চিন্তিত। এতে বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারতেরও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। তারা স্বভাবতই এদেশে এমন শক্তির উত্থান চায় না, যারা ভারতের স্থিতিশীলতার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। আমরা জানি, কাদের শাসনামলে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সক্রিয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের জন্য দশ ট্রাক অস্ত্র নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে। শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় ফিরে এসে নিজ দেশের মাটিকে প্রতিবেশী দেশের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের জন্য ব্যবহারের সুযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। সেটাই স্বাভাবিক।

আজকের দুনিয়ায় কোনো প্রতিবেশী রাষ্ট্র এ ধরনের শত্রুতার যোগ দিতে পারে না। ভারতের সঙ্গে অন্যান্য ক্ষেত্রেও সহযোগিতা বাড়িয়ে তোলা হয়েছে। দেশটির সঙ্গে আমাদের ব্যাপক বাণিজ্যিক সম্পর্ক। অনেক পণ্যসামগ্রী আমরা ভারত থেকে সহজে আমদানি করি। সেখান থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করেও নিজেদের প্রয়োজন মেটাচ্ছি। এ নিয়ে বিরুদ্ধবাদীরা অবশ্য অনেক কথাই বলে থাকে। তারা কথায় কথায় ভারতের কাছে দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দেওয়ার অভিযোগ করে। কিন্তু উপযুক্ত তথ্য-প্রমাণ দেখাতে পারে না। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার শাসনামলে ভারত বা কোনো দেশের কাছে বাংলাদেশের স্বার্থ বিসর্জন দেওয়া হবে, এটা চিন্তাই করা যায় না।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সমাজতান্ত্রিক দেশ হওয়া সত্ত্বেও চীনের ভূমিকা ছিল দুর্ভাগ্যজনক। তবে তার মনোভাব ক্রমে বদল হয়েছে। চীন বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান বাণিজ্যিক অংশীদার। ভারতের মতোই অনেক পণ্যসামগ্রী আমরা চীন থেকে আমদানি করি। আমাদের অনেক রপ্তানি পণ্যের কাঁচামাল মূলত চীন থেকে আনা হয়। চীনের একটি প্রধান শক্তির দিক হলো, তারা খুব কম দামেও পণ্য বানিয়ে দিতে পারে। আমরা সে সুবিধা পাচ্ছি। বাংলাদেশের অনেক প্রকল্পে চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো অংশ নিচ্ছে। তাদের ঋণ সহায়তাও আমরা পাচ্ছি। শুধু বাংলাদেশের সঙ্গে যে চীনের সম্পর্ক বিস্তৃত হচ্ছে, তা নয়। মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার অনেক দেশের সঙ্গেও একইভাবে সম্পর্ক বাড়ছে চীনের। এককালের দুর্বল চীন এখন অনেক সবল এবং তাদের অর্থনীতি শক্তিশালী। বর্তমান ধারায় উন্নয়ন অব্যাহত থাকলে চীন কয়েক দশকের মধ্যে বিশ্বের এক নম্বর অর্থনীতি হয়ে উঠবে, এমনটিও মনে করা হচ্ছে। তার অগ্রযাত্রা নিয়ে বর্তমান বিশ্বের এক নম্বর শক্তি বলে বিবেচিত যুক্তরাষ্ট্রকেও চিন্তিত দেখা যাচ্ছে।

চীনের সঙ্গে কোনো দেশের নিছক বাণিজ্যিক সম্পর্ক উন্নত হতে থাকলেও যুক্তরাষ্ট্র চিন্তিত হয়ে পড়ে। বর্তমানে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তার এ ক্ষতিকর মনোভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন নিয়ে তারা এরই মধ্যে যেসব কর্মকাণ্ডে নেমেছে, তার একটি প্রধান কারণ বলে মনে করা হচ্ছে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান সম্পর্ক। বাংলাদেশ কার সঙ্গে কী সম্পর্ক গড়ে তুলবে এবং তা কতদূর অগ্রসর হবে—সেটা তৃতীয় কোনো দেশ ঠিক করে দেবে, এটা কেমন কথা? শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার সে যৌক্তিক বার্তাই দিতে চাইছে তার বিভিন্ন পদক্ষেপে।

ব্রিকস সম্মেলনে চীনা নেতার সঙ্গে শেখ হাসিনার বৈঠক থেকে যে বক্তব্য এসেছে, তাতেও রয়েছে এ বার্তা। যুক্তরাষ্ট্র রুষ্ট হবে বলে একটি স্বাধীন দেশের সরকার কেন বিশেষ কোনো দেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের সুযোগ হাতছাড়া করবে? এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে, যুক্তরাষ্ট্র কি ইরান বা সৌদি আরবের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক উন্নয়ন নিয়েও এভাবে আপত্তি জানায়? আমরা কি এটাও দেখতে পাচ্ছি না যে, চীনের উদ্যোগে দীর্ঘদিনের শত্রুতা ছেড়ে ইরান ও সৌদি আরবের সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়ে উঠছে? যুক্তরাষ্ট্র কি সেটা আটকাতে পারছে? তাহলে বাংলাদেশ সরকারের কর্মকাণ্ডে কেন তাদের এত আপত্তি?

এ আপত্তির কথা সরাসরি না বলে তারা টার্গেট করেছে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনকে। একের পর এক তাদের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা বাংলাদেশে এসে আমাদের নির্বাচন, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে সবক দিচ্ছে। বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতও তৎপর। রাজনৈতিক দল ও তথাকথিত সুশীল সমাজের সঙ্গে তিনি দফায় দফায় বসছেন। কে নির্বাচনে অংশ নেবে, কারা কিভাবে অংশ নেবে, সেটা নিয়েও তিনি মাথা ঘামাচ্ছেন। তাদের দুই কংগ্রেসম্যান এসে এখানে জানতে চান—‘সরকার কি চীনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে?’ চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক যদি অগ্রসর হয়েই থাকে আর তাতে এদেশের জনগণ উপকৃত হয়ে থাকে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের কী বলার আছে?

শেখ হাসিনার টানা তিন মেয়াদের শাসনামলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কও কি উন্নত হয়নি? আমরা তো যুক্তরাষ্ট্রের বাজারেই সবচেয়ে বেশি রপ্তানি করে থাকি। তার মিত্র দেশগুলোও আমাদের বড় বাজার। এদের নেতৃত্বে যেসব উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা রয়েছে, তাদের কাছ থেকে আমরা কি ঋণ গ্রহণ করছি না? বাংলাদেশের বৃহত্তম সেতু—পদ্মা সেতু নির্মাণে অর্থায়ন নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, সন্দেহ নেই। কিন্তু সেখানে তো বাংলাদেশ সরকারের কোনো দোষ ছিল না। তাদের অভিযোগ যে ভিত্তিহীন ছিল, সেটাই বরং প্রমাণ হয়েছে। বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে এরই মধ্যে। এতে করে বিশ্বব্যাংক ও এ ধরনের সংস্থার সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের স্থায়ী কোনো ক্ষতিও হয়নি। বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগও কি থেমে আছে? আমাদের সমুদ্রভাগে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের কাজ পাওয়ার দৌড়ে তাদের কোম্পানিই এগিয়ে রয়েছে বলে জানা যায়। করোনা পরিস্থিতিতে দেশটি যে ভ্যাক্সিন সহায়তা আমাদের দিয়েছে, সেটাও উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশে আশ্রিত বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থীকে মানবিক সহায়তা প্রদানেও যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে। দেশটিতে আমাদের বহু স্বজন বসবাস করছে, অনেক ছাত্রছাত্রী শিক্ষা গ্রহণ করছে এবং তারা সেখান থেকে অর্থকড়িও পাঠাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যেচে সম্পর্ক খারাপ করার কথা বাংলাদেশ ভাবতেই পারে না।

এ অবস্থায় তারা আগামী নির্বাচনকে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ করার যে আহ্বান জানাচ্ছে, তাতেও শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন সরকার বিরক্ত হয়নি। বরং বারবার এ প্রতিশ্রুতিই দেওয়া হচ্ছে যে, নির্বাচনটি সুষ্ঠু হবে। এতে প্রধান সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণের ব্যাপারেও সরকার আন্তরিক। যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচনের আগে ও পরে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখার ওপর জোর দিচ্ছে, যাতে এখানে বিনিয়োগের পরিবেশ ও জনজীবনে স্বস্তি অটুট থাকে। শেখ হাসিনার সরকারও এটা নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর। তাহলে সমস্যা কোথায়?

এ অবস্থায় এমনটি বলা হচ্ছে যে, ব্রিকস সম্মেলনে বাংলাদেশ যে এবার সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়নি—তার কারণ ভারতের কৌশলগত আপত্তি। ভারত নাকি চায়নি, বাংলাদেশ চীনের মনোনীত হিসেবে ব্রিকসের সদস্যভুক্ত হোক। তাতে উদীয়মান এ সংস্থায় চীনা প্রভাব বাড়বে। এ বিষয়ে নাকি যুক্তরাষ্ট্রেরও আপত্তি ছিল। ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সুসম্পর্কের কথা কে না জানে। তারা উভয়ে এ অঞ্চলে চীনের প্রভাব বৃদ্ধি রোধ করতে চায় বলেই অনেকের ধারণা। সেদিক থেকে বাংলাদেশ ব্রিকসের সদস্য না হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র তো আশ্বস্ত হওয়ার কথা। সত্যি বলতে, বাংলাদেশ ব্রিকসের সদস্য হতে খুব তৎপরও ছিল না। আমাদের চেয়ে দুর্বল অর্থনীতির দেশ ইথিওপিয়াও ব্রিকসের সদস্য হয়েছে। এ অবস্থায় সদস্য হওয়ার মানদণ্ড নিয়েও কথাবার্তা হচ্ছে। তবে এ মুহূর্তে বাংলাদেশের বড় বিবেচনার বিষয় হলো, সব বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক শক্তির সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা এবং বিশেষ কারও দিকে ঝুঁকে না পড়া। রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী অচিরেই বাংলাদেশ সফরে আসবেন। তাতেও যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগের কিছু নেই। আমরা বরং চাইব, রাশিয়ার সহায়তায় বাস্তবায়নের শেষ পর্যায়ে থাকা রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজটি তারা এগিয়ে নিতে দেবেন। এতে যুক্তরাষ্ট্রের তো কোনো ক্ষতি নেই। আর আগামী নির্বাচনকে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করাই হওয়া উচিত যুক্তরাষ্ট্রের নীতি।

ব্রিকসের সদস্যপদ পাওয়া, না-পাওয়া