জ্বালানি নিরাপত্তা: দেশে অনুসন্ধানের কোনও বিকল্প আছে?

বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তার কথা বলতে গেলে প্রথমেই যে বিষয়টা আনতে হয় তা হলো আমাদের অভ্যন্তরীণ বা নিজস্ব প্রাকৃতিক জ্বালানি সম্পদ। আমাদের জ্বালানি সম্পদের প্রায় পুরোটাই প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে থেকেই প্রাকৃতিক গ্যাসের অনুসন্ধান এবং উত্তোলন চলছে।

এ কে এম এহসানুল হকএ কে এম এহসানুল হক
Published : 6 August 2022, 10:59 AM
Updated : 6 August 2022, 10:59 AM

বর্তমান বাস্তবতায় পৃথিবীর ‘সুখী’ দেশ তারাই, যাদের জ্বালানি নিরাপত্তা সুরক্ষিত। বিশ্বব্যাপী প্রধান সমস্যাগুলোর মূল অনুসন্ধানে গেলে আমরা দেখতে পাবো মানবসৃষ্ট নানা কারণের ভেতর জ্বালানি অব্যবস্থাপনা বা ‘অপ’ব্যবস্থাপনাই প্রধানত দায়ী। যেহেতু বাংলাদেশ বিশ্বের বাইরে নয় এবং বহুবিধ অভ্যন্তরীণ ও বাইরের প্রভাব অতিক্রম করা অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হয় না। তাই রাষ্ট্র হিসেবে ‘সফল’ হতে আমাদেরও জ্বালানি নিরাপত্তার বিষয়টি খুব গুরুত্বের সাথে পরিকল্পনা করতে হবে। বাংলাদেশের বর্তমান জ্বালানি সংকটের কথা আমরা কমবেশি সবাই জানি, তাই আমি বরং এর সম্ভাব্য সমাধানের দিকেই বেশি মনোনিবেশ করব।

বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তার কথা বলতে গেলে প্রথমেই যে বিষয়টা আনতে হয় তা হলো আমাদের অভ্যন্তরীণ বা নিজস্ব প্রাকৃতিক জ্বালানি সম্পদ। আমাদের জ্বালানি সম্পদের প্রায় পুরোটাই প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে থেকেই প্রাকৃতিক গ্যাসের অনুসন্ধান এবং উত্তোলন চলছে। তাই রাষ্ট্র হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে জ্বালানির পরিপূর্ণ বিকাশের ব্যাপক পরিকল্পনা আমাদের অনেক আগেই নেওয়া দরকার ছিল। সময় যে শেষ হয়ে গিয়েছে তা নয়, তবে অনেকটাই দেরি হয়ে গিয়েছে, যা দেশের তেল-গ্যাস বিশেষজ্ঞরা বহুদিন ধরে বারবার বলে চলছিলেন!

বর্তমানে প্রায় ২৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলনের বিপরীতে দেশের মোট চাহিদা গিয়ে ঠেকেছে প্রায় ৪০০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসে (সূত্র: Petrobangla Aug 2022 Report; ADB Oct 2016 Report)। এই বিপুল ঘাটতির পুরো ব্যাপারটা আমাদের বিশেষজ্ঞরা অনেক আগেই আঁচ করেছিলেন, আর সে কারণেই প্রতিনিয়ত তারা নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করে গিয়েছেন– কখনো সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, কখনোবা টকশোর মাধ্যমে। আমাদের মূল উদ্দেশ্যই ছিল সরকারকে ব্যাপকভাবে প্রাকৃতিক গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বিস্তারিত কর্ম-পরিকল্পনা গ্রহণ করবার জন্য অবহিত করা। সবচেয়ে আতংকের বিষয় হচ্ছে ২০২২ সালে এসে গ্যাসের ঘাটতি (demand shortfall) যেখানে প্রায় ১৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট, সেটা ২০৩০ সাল নাগাদ প্রায় ২৯০০ মিলিয়ন ঘনফুটে পৌঁছতে পারে। গত ২০ বছরে প্রায় ১৩ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস ব্যবহারের বিপরীতে আমরা মাত্র ২ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছি (সূত্র: অধ্যাপক বদরুল ইমাম, ২০২১) যা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে ‘অপ্রতুল’। তর্কের খাতিরে যদি এই হিসেবকেই মানদণ্ড ধরি, তাহলে সবদিক বিবেচনায় আমাদের জ্বালানি অনুসন্ধানের কোনোই বিকল্প নেই। প্রথম ধাপে যেটা হতে হবে ব্যাপকভাবে দেশের সীমানার ভেতরে (স্থল এবং জলভাগে) এবং দ্বিতীয় ধাপে ভবিষ্যতের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আমাদের উচিত হবে রাষ্ট্রীয় তেল-গ্যাস প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি সাপেক্ষে দেশের সীমানার বাইরেও অংশীদারিত্বের (participating at joint ventures in other countries) ভিত্তিতে অনুসন্ধান, উত্তোলন এবং বিপণনে অংশগ্রহণ করার সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করা। আমি মনে করি, আমাদের দেশের বিশেষজ্ঞরা (দেশে এবং দেশের বাইরে) একইভাবে একটি সমন্বিত মনোভাব পোষণ করেন, যার মাধ্যমে অনেকটাই দ্রুততার সাথে এই প্রস্তাবিত ধাপগুলো এখনও সদিচ্ছা থাকলে অতিক্রম করা সম্ভব।

এখন পরবর্তী প্রশ্ন আসবে স্থল এবং জলভাগে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে জ্বালানি অনুসন্ধানে নামার উপযুক্ত জায়গাগুলোর অবস্থান ঠিক কোথায় এবং একইসাথে এটাও জানা গুরুত্বপূর্ণ যে তথাকথিত প্রযুক্তি দিয়ে অনুসন্ধানে আমরা কতটুকু কার্যকর ফল পেতে পারি।

মাটির নিচে ঠিক কোন জায়গায় কতটুকু প্রাকৃতিক গ্যাস (বা তেল) মজুদ থাকতে পারে তা অনেকগুলো কারণের ওপর নির্ভর করে। তার মধ্যে অন্যতম একটি হলো প্রাকৃতিকভাবে তেল বা গ্যাস মাটির নিচে কীভাবে স্তরীভূত হয় (সূত্র: Dr. AKM Eahsanul Haque, https://doi.org/10.1007/s13202-018-0461-4 )।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সবচে লক্ষণীয় বিষয় হলো আমাদের বেশিরভাগ গ্যাসক্ষেত্রই দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত (সূত্র: পেট্রোবাংলা)। এর মূল কারণ বেঙ্গল ডেল্টার (Bengal Delta) ভূতাত্ত্বিক গঠন-কাঠামো এবং বেসিনাল বৈশিষ্ট্য (Structural settings and basinal characterization)।

আরেকটি বিশেষ কারণ হচ্ছে, বেঙ্গল ডেল্টার পাললিক প্রকৃতি (stratigraphic characteristics)। বাংলাদেশে এ যাবত যতো তেল-গ্যাস অনুসন্ধান হয়েছে তার প্রায় পুরোটাই হয়েছে প্রচলিত ভূ-কাঠামোগত বিশ্লেষণ করে (structural analysis), অথচ পাললিক প্রকৃতির বিস্তর অনুসন্ধান এবং বিশ্লেষণ এখনো আমরা সেভাবে করতে পারিনি, যেখানে আমাদের আরও মনোনিবেশ করা দরকার ছিল। এখন থেকেই এই দৃষ্টিকোণ থেকে অনুসন্ধান শুরু করা প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাপেক্স পাবনার মোবারকপুরে ২০১৭ সালে প্রাকৃতিক গ্যাস আবিষ্কার করে যা ছিল বাংলাদেশের জ্বালানি অনুসন্ধান ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক, কেননা এতদিন যে প্রচলিত ভূতাত্ত্বিক কাঠামোতে উত্তর-পূর্বে গ্যাসের সন্ধান এবং মজুদ পাওয়া গিয়েছে, সেগুলো থেকে মোবারকপুরের আবিষ্কার ছিল অনেকাংশেই আলাদা।

এই আবিষ্কারটি হয়েছিল মাটির বেশ নিচে প্রায় ৪২০০ মিটার গভীরে, উচ্চচাপযুক্ত অঞ্চলে। এ থেকে এটা প্রমাণিত হয় (যা বিশেষজ্ঞগণ অনেকদিন থেকেই বলে আসছিলেন) যে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমে, অপেক্ষাকৃত সমতল এলাকাতেও মাটির গভীরে জ্বালানির মজুদের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। ওই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বাংলাদেশের কয়েকটি সম্ভাব্য এলাকায় জরুরী ভিত্তিতে অনুসন্ধানে নেমে পড়া উচিত। এলাকাগুলো হচ্ছে:

  • দেশের মধ্যাঞ্চল (ঢাকার কাছাকাছি গাজীপুর, কিশোরগঞ্জ, নরসিংদী)

  • দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল (পাবনা, ঝিনাইদহ, ফরিদপুর)

  • দেশের দক্ষিণাঞ্চল (পটুয়াখালি, ভোলা, বরগুনা)

  • দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল (ফেনী, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি)

  • দেশের সমুদ্রভাগের অগভীর ব্লক SS-02, 03, 09, 20, এবং গভীর সমুদ্রের ব্লক SS-06, 07, DS-10, 11, 12, 17, বিশেষ করে বেঙ্গল ডিপ সি ফ্যান (deep sea fan) সংলগ্ন এলাকাগুলো (DS-10,11,17)

উপরোক্ত সম্ভাব্য এলাকাগুলোতে জরুরী ভিত্তিতে দ্বিমাত্রিক বা ত্রিমাত্রিক সাইসমিক সার্ভে করে (বা সার্ভে করা হয়ে থাকলে বিশ্লেষণে মনোযোগ দেওয়া) গ্যাসের মজুদের ব্যাপারে বিস্তারিত অ্যানালাইসিস করা উচিত বলে মনে করি। সম্ভাব্যতা যাচাই প্রক্রিয়া ইতিবাচক হলে দ্রুততার সাথে অনুসন্ধান কূপ (exploratory drilling) খনন করে গ্যাসের উপস্থিতি নিরুপণ করতে হবে।

আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং বিভিন্ন গ্যাসক্ষেত্র উন্নয়নের কাজের সাথে সম্পৃক্ততা থেকে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লখ করতে চাই, এ সকল কাজ করার যে টেকনোলজিক্যাল এবং অপারেশনাল এক্সিলেন্স দরকার, আমাদের রাষ্ট্রায়ত্ত জ্বালানি প্রতিষ্ঠানগুলোতে অনেকাংশেই তার অভাব রয়েছে। শুধু ত্রুটি অনুসন্ধানের জন্য নয় বরং সত্যিকার অর্থেই আমাদের কর্মীদের মধ্যে টেকনিক্যাল দক্ষতা, বিশেষ করে ভূতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ক্ষমতার (interpretational skills) বা পেট্রোলিয়াম ইঞ্জিনিয়ারিং দক্ষতার কমতি রয়েছে, যা আমাদের এই তেল-গ্যাস অনুসন্ধান প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করেছে এবং এর সাথে যুক্ত হয়েছে ব্যবস্থাপনাগত কিছু দুর্বলতা। আমি মনে করি, আমাদের রাষ্ট্রায়ত্ত জ্বালানি প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে নিম্নলিখিত কর্ম-পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত:

  • বিশেষায়িতভাবে, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যারা নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত, একইসাথে অভিজ্ঞজনদের মধ্যে যারা নিত্য-নতুন জ্ঞান ও দক্ষতাকে গ্রহণ করতে আগ্রহী এবং যারা টেকনিক্যাল দক্ষতা উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে চলেছেন, তাদের প্রতি সুনজর দিয়ে ভবিষ্যতের কথা ভেবে প্রস্তুত করা।

  • প্রতিটি টেকনিক্যাল ডিপার্টমেন্টে আলাদা মনিটরিং সেল গঠন করা যেতে পারে যারা তেল-গ্যাস অনুসন্ধান থেকে শুরু করে উত্তোলন পর্যন্ত প্রত্যেকটি ব্যাপার রিয়েল-টাইম (real-time) মনিটর করতে পারবেন।

  • রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রতিষ্ঠান-প্রধান হিসেবে শুধু তেল-গ্যাস-জ্বালানি সম্পর্কে সম্যকভাবে অবহিত এমন ব্যক্তিদেরই (technocrat) নিয়োগ দেওয়া উচিত, কোনো আমলাকে নয়। এতদিনে অন্তত এটা বোঝা গিয়েছে যে, আমাদের সম্মানিত আমলাদের কর্মক্ষেত্রে যেমন অন্য সেক্টরের কারও কার্যকর ভূমিকা পালনের সুযোগ কম, ঠিক একইভাবে জ্বালানি খাতের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতেও (বিশেষ করে বাপেক্স বা পেট্রোবাংলা যেগুলো সরাসরি তেল-গ্যাস অনুসন্ধান, মজুদ, উত্তোলন নিয়ে কাজ করে থাকে) একজন আমলার কার্যকর ভূমিকা পালনের সুযোগ কম।

  • আন্ত-ডিপার্টমেন্ট এবং আন্ত-প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পার্টনারশিপ গড়ে তোলা যা টেকনিক্যাল দক্ষতা বৃদ্ধিতে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে।

সর্বোপরি, যেহেতু বাংলাদেশে বেশ কিছু অপ্রচলিত প্রাকৃতিক গ্যাসের (unconventional natural gas prospects) অস্তিত্বের সমূহ সম্ভাবনার ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছে কিন্তু এখনও পর্যন্ত অপরীক্ষিত রয়ে গিয়েছে, যেমন টাইট স্যান্ড রিজার্ভার (tight sand reservoir), উচ্চচাপযুক্ত স্যান্ডস্টোন রিজার্ভার (high pressured sandstone reservoir), থিন-বেড রিজার্ভার (thin-bed reservoir)। এই অপ্রচলিত সম্পদ এবং সম্ভাবনাগুলোই অদূর ভবিষ্যতে আমাদের জ্বালানি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এবং সর্বোপরি জ্বালানি নিরাপত্তায় সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।