Published : 08 Jan 2020, 07:22 PM
আধুনিক কথাশিল্পের পথিকৃত ফ্রান্স কাফকার 'মেটামরফোসিস' বা রূপান্তর গল্পের মূল চরিত্র যুবক গ্রেগর সামসার কথা আমরা অনেকেই কম বেশি জানি। সেই সামসা শরীরের রূপান্তরে মানুষ থেকে পোকা হয়েছিলেন। কিন্তু তার চিন্তাশক্তি বিবেচনা ও বাস্তবজ্ঞান ছিল একজন সুস্থ মানুষের। এই গল্পের মাধ্যমে কাফকা পুঁজিবাদী শাসক ও শোষক শ্রেণির অকল্যাণমূলক সমাজ ও অর্থনীতির জাঁতাকলে সীমিত আয়ের গ্রেগর হয়ে গেল 'পোকা'। এরপর গ্রেগরের আয়ের উপর নির্ভরশীল তার বোন, মা বাবা সকলে গ্রেগরের রূপান্তরিত পোকার জীবন কেমনে সামাল দেয়? গ্রেগর এখন বন্দি পোকা। কাফকার গল্পটি মোটামুটি এরকম। সময়টা ছিল ১৯১৫ সালের দিকে।
এই বাস্তবতার একশ বছর পেরিয়ে ২০২০ সালে একটি জাতীয় দৈনিকে 'মধুপুরে শুকুরের শিকলবন্দি জীবন' শিরোনামের একটি খবর প্রকাশ পেল সম্প্রতি। এই শুকুর কে? এই শুকুর ছাত্র হিসেবে দারুণ মেধাবী। কৃতিত্বের সঙ্গেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে উচ্চবিদ্যালয়েও ভর্তি হয়েছিল। সমস্যা হল তার বাবা হতদরিদ্র এক দিনমজুর। এটাই তার কাল হয়ে এল।
আর্থিক টানাপড়েনে পড়াশোনা আর চালিয়ে যেতে পারল না। স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে নির্মাণ শ্রমিকের কাজে যোগ দিল। তাতেও ভালই চলছিল। তার কাজে সকলেই খুশি। একদিন কয়েক পরিজন একটা ঠুনকো অজুহাতে শুকুরকে মারধর করে। মাথায় প্রচণ্ড আঘাত লাগে। তারপর তার কথাবর্তা আর আচরণ অস্বাভাবিক হতে শুরু করে। গরীব বাবা মা টাকা পয়সার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারেন না। শেষে যা হবার ছিল না তাই হয়ে গেল। আশেপাশে লোকজন পাগল ডাকা শুরু করে দিল। শুকুর হয়ে গেল বদ্ধ এক পাগল। অসহায় বাবা মা ছেলে হারিয়ে যাবার ভয়ে শেকলে বন্দি করে রাখে- একদিন নয় দুই দিন নয়, একে একে পনের বছর।
দৈনিক যুগান্তরের প্রতিবেদনে টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলায় শেকলে বাঁধা শুকুরের বন্দি জীবনের শুরু ২০০৪ সালে। প্রতিবেদনে শুকুরের গ্রামটিকে অজপাড়া গাঁ বলা হলেও দিগর বাইদ আজ আর সে অর্থে অজপাড়া গাঁ নয়। গ্রামে রয়েছে সরকারি বিদ্যালয়। প্রায় সারাক্ষণ জমজমাট হাটবাজার। যেখানে রয়েছে নানা বাহারি দোকান, বিকিকিনির পসার বসে প্রতিদিন। উপজেলা সদর থেকে গ্রাম অবধি পাকা রাস্তা। এই গ্রামে মসজিদ যেমন রয়েছে, ধার্মিক লোকেরও কমতি নাই। সরকারি চাকুরিজীবী যেমন রয়েছে। তেমন রয়েছেন ব্যাংকার, উকিল, মাস্টার, অধ্যাপক, রয়েছেন ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যও। তাদের মধ্যে আবার ঘুসঘাস খেয়ে একাধিকবার হজ করে আসা পরহেজগার লোকও রয়েছেন। রয়েছে সরকারি দল আওয়ামী লীগ, যুবলীগ আর ছাত্রলীগের নেতায় পাতিনেতায় এক্কেবারে ঠাসা।
এদের কারো নজরেই পড়েনি হতভাগ্য শুকুরের জীবনের এই করুণ দশা। এই গ্রামে ভোটের সময় ভোট চাইতে গেছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য বর্তমান খাদ্যমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক, স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ সভাপতি আবু সাঈদ তালুকদার দুলাল, এমন কি উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ছরোয়ার আলম খান আবু।
গ্রামটিতে ভোট চাইতে গেলে শুকুরের বিষয়টি একবার উপজেলা চেয়ারম্যান আবু খানের নজরে আনা হয়েছিল। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, নির্বাচিত হলে শুকুরের চিকিৎসার ব্যাপারে উদ্যোগ নেবেন। তিনি নির্বাচনে জিতে চেয়ারম্যান হয়েছেন। নির্বাচনের পরে শেকলে বাঁধা শুকুরের জীবনের কথা কি আর তার মনে আছে?
এইবার, আমি আদম সন্তানরূপী অক্ষম এক 'পোকা'র কথা বলি। গালিটা নিজেই নিজেকে দিলাম। আমার জন্মও শুকুরের গ্রামেই। এই পনের বছর ধরেই আমি জীবিত। খবরটা আমিও জানতাম না, যেমন জানেন না মধুপুরের সমাজসেবা কর্মকর্তা ইসমাইল হোসেন। রুটিরুজির পেছনে ছুটে দেশে বিদেশের নানা জায়গায় দৌড়ের উপর থেকে জানতে পারিনি নিজের জন্মগ্রামের শুকুরের যে এই পরিণতি। মাস কয়েক আগে আমার ছোট ভাই ফোন করে জানাল, শুকুরের দুর্দশার কথা। ঘটনা শোনার পর আমি তো থ মেরে গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম বিষয়টা প্রশাসনের কেউ জানে? ছোটভাই বলল, নির্বাচনের আগে উপজেলা চেয়ারম্যাল আবু খান কথা দিয়েছিলেন, শুকুরের জন্যে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিবেন। তিনি কিছু করেননি। আমার ছোট ভাইকে বললাম ভাবতে দে। এই ভাবতে ভাবতেই দিন যায়, উপায় আর পাই না। পরে আমার বন্ধু যুগান্তরের নামকরা সাংবাদিক এসএম শহীদকে ঘটনাটা জানালাম। শহীদের কল্যাণে শুকুরের ছবি আজ জাতীয় পত্রিকায়। আহা! এই জন্যেই কি আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ব্রিটিশ বর্বরদের উদ্দেশে লিখেছিলেন- শিকল পরা ছলরে মোদের শিকল পরা ছল- এই শিকল পরে শিকল তোদের করবরে বিকল। নজরুলের এই প্রকাশ ছিল শত বছর পূর্বে। মেধাবী শুকুরের জীবনে পরিজনের অন্যায়ে যে শেকল, সেটা কি বিকল হবে না? এই অন্যায়ের কি বিচার হবে না? শুকুর কেন শুধু আমাদের বিবেক ও মনুষ্যত্বও কি শেকলে বন্দি নয়?
যে গল্প দিয়ে শুরু করেছিলাম। কাফকার মেটামরফোসিস। গল্পে গ্রেগর মানুষ থেকে পোকা হয়ে চিন্তাশক্তিটা মানুষেরই রাখতে পেরেছিল। আর আমরা শরীরে গড়নে গঠনে মানুষ থেকে বড় বড় ডিগ্রি নিয়ে শরীরে তেলচর্বি জমিয়ে নিজের ভালটা বুঝে যাব, সফল হব, কামিয়াব হব, সেজদায় পড়ব, হজ করব, ঘুস খাব, পত্রিকায় লেখা লিখে নাম ছাপাব- আর শুকুরের জীবন বিনা চিকিৎসায়, শেকলে বাঁধা পড়ে রবে? না! না! এই জীবন আমাদের পোকার জীবনের চেয়ে উত্তম কোন অংশে? ভাবতে ভালই লাগে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে আমরা সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছি। ভাবতে ভাল লাগছেনা?
তবে হলফ করে বলতে পারি কর্তৃপক্ষ যদি শুকুরের মত হতভাগ্যদের ব্যাপারে তথ্যানুসন্ধান শুরু করে- সারাদেশে এরকম আরো অনেক শুকুর বেরিয়ে এলেও অবাক হবার কিছু থাকবে না। যেমন এখন যদি আমাদের মানুষের পরিবর্তে পোকা আখ্যা দেওয়া হয়, অবাক হবার কী আছে শুনি?
কারণ আমরা তো পোকই, জেগেও ঘুমাই, আবার ঘুমালেও জাগতে চাই না! আমরা কি আদতে পোকা হয়ে গেলাম? নিজের গায়ে চিমটি দিয়ে দেখি তো! তবে আমরা চিমটিতেই যেন থেমে না থাকি।
একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক কল্যাণরাষ্ট্রে শুকুরের মত অবস্থায় কি সব ব্যবস্থা থাকে সে বিষয়ে একটু আলোকপাত করতে চাই। প্রথমত শুকুরের উপর যে সামাজিক অন্যায় হয়েছে, তা জানার সঙ্গে সঙ্গে প্রশাসন দায়ীদের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিত। আর শুকুরের চিকিৎসার ব্যবস্থা চলত স্বাস্থ্যবিভাগের নিজস্ব গরজে। সমাজসেবা দপ্তর দায়িত্ব নিত শুকুরের পুনর্বাসনের। শুকুরের মত অবস্থায় পড়া মানুষের দ্বারা কিছু কিছু সভ্যদেশে পরিচালিত হচ্ছে নিজস্ব বেতার কেন্দ্র, নিজস্ব সাময়িকী, থিয়েটারে কত কী! শুধু বলার জন্যে নয়, উদাহরণস্বরূপ কয়েকটি লিঙ্কও দিয়ে দিলাম। আমাদের তো অবকাঠামোর কমতি নাই-হাসপাতাল রয়েছে ইউনিয়ন পর্যন্ত। বিশোয়িত হাসপাতালও রয়েছে বেশ কয়েকটি। দরকার কেবল খাসলতটা পাল্টানো এবং নিজেদের অন্ধ আত্মস্বার্থ ত্যাগ করে ঘুস দুর্নীতি আর লোভের লাগাম টেনে ধরে নিজেদের পোকা হওয়া ঠেকানো। তাতেই হবে।
একটি প্রশ্ন রেখে লেখাটি শেষ করতে চাই। পনের বছর ধরে শেকলে বন্দি মেধাবী ছাত্র শুকুরকে শেকল থেকে মুক্ত করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্যে আমার আপনার সমাজ ও রাষ্ট্রের কি কিছুই করার নাই?