দুনিয়া জুড়ে চীনা দাপট এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন

বিভুরঞ্জন সরকারবিভুরঞ্জন সরকার
Published : 28 Feb 2021, 04:39 AM
Updated : 28 Feb 2021, 04:39 AM

শুধু জনসংখ্যার বিচারে নয়, অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবেও চীন এখন সবচেয়ে শক্তিধর বড় দেশ, বিশ্ব জুড়ে মোড়লিপনা করার সামর্থ্য দেশটির রয়েছে। শক্তি থাকলে নাকি তা না দেখিয়ে থাকা যায় না। বিশেষ করে টাকা থাকলে তা গোপন করা যায় না। চীনের এখন বিশ্বের যেকোনো দেশের সঙ্গেই টেক্কা এবং টক্কর দেওয়ার শক্তি হয়েছে। আমেরিকার যে দুনিয়া জোড়া দাপট, সোভিয়েত ইউনিয়ন তথা সমাজতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার পতনের পর তা একচেটিয়া হয়েছে। তবে আমেরিকাকে চ্যালেঞ্জ করার শক্তি এখন চীনের হয়েছে। কি অর্থনৈতিক, কি ব্যবসাবাণিজ্য, কি সমর শক্তি – কোনোদিক থেকেই চীন পিছিয়ে নেই। চীনের সঙ্গে তাই আমেরিকার বনিবনা তেমন নেই। চীনকে শিক্ষা দেওয়ার ইচ্ছা যেমন আমেরিকা গোপন করে না, তেমনি আমেরিকাকে দেখে নেওয়ার ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতেও চীনের রাখঢাক নেই।

চীনকে এখন আর কেউ সমাজতান্ত্রিক দেশ মনে করে না, যদিও চীনে ক্ষমতায় আছে কমিউনিস্ট পার্টি। এ-ও এক তাজ্জব করা ব্যাপার। কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় চলা। চীন অবশ্য বরাবরই একটু আলাদা। সে আফিমখোর জাতি হিসেবে হোক কিংবা মাও সে তুংয়ের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং তারপর বর্তমান কাল পর্যন্ত – চীন চলে চীনের মতো করেই। সবার থেকে আলাদা এবং সবার ওপরে থাকাই যেন চীনা বৈশিষ্ট্য। চীনের সঙ্গে অন্য দেশের সম্পর্কও তৈরি হয় চীনা স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে।

চীন তার অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে কাউকে মাথা ঘামাতে দেয় না। তাই বলে অন্যদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাতে কিন্তু ঠিকই চীন ভুল করে না। সারা দুনিয়ায় গণতন্ত্র, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে হৈচৈ, তোলপাড় হলেও চীন ওসব তোয়াক্কা করে না। তারা কথা বলার স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না। ভিন্নমতের কোনো ঠাঁই চীনে নেই। গত ১২ ফেব্রুয়ারি চীন বিবিসি'র বহির্বিশ্ব কার্যক্রমকে সে দেশে নিষিদ্ধ করেছে। চীনের কোনো মানুষ আর বিবিসি বা ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং করপোরেশনের অনুষ্ঠান শুনতে পারবে না। চীনের অভিযোগ, বিবিসি করোনাভাইরাস নিয়ে এবং উইঘুর সম্প্রদায় সম্পর্কে অসত্য খবর প্রচার করছে। কিন্তু চীনের এই গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আমাদের দেশে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া কোনো মহলেই নেই।

উইঘুর মুসলিমদের প্রতি চীন যে আচরণ করছে তাকে গণহত্যা হিসেবে অভিহিত করে কানাডার হাউজ অব কমন্স একটি প্রস্তাব পাস করেছে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পর কানাডা দ্বিতীয় দেশ উইঘুরে চীনা আচরণকে যারা গণহত্যা বলে স্বীকৃতি দিলো। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ভোটদানে বিরত থাকলেও হাউজ অব কমন্সে ২৬৬-০ ভোটে প্রস্তাবটি পাস হয়েছে। বলা হয়েছে, চীন সরকার উইঘুর গণহত্যা অব্যাহত রাখলে ২০২২ সালের শীতকালীন অলিম্পিক বেইজিং থেকে সরিয়ে নিতে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটিকে আহ্বান জানানো হবে। কানাডার বিরোধীদলীয় নেতা বলেছেন, 'আমরা মানবাধিকার ও মানুষের মর্যাদার পক্ষে দাঁড়াব, এমনকি এতে কিছু অর্থনৈতিক সুযোগ ত্যাগ করে হলেও'। অন্যদিকে কানাডায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত পার্লামেন্টের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, এটা চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের সামিল'।

মানবাধিকার কর্মীদের অভিযোগ, চীন গত কয়েক বছর ধরে প্রায় দশ লাখ উইঘুর মুসলিমকে ক্যাম্পে আটক করে তাদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালাচ্ছে। নারীদের ওপর পরিকল্পিত ধর্ষণ, যৌন নির্যাতন এবং জোরপূর্বক বন্ধ্যাকরণ করছে। বিবিসির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে একজন ভুক্তভোগী নারী তার ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, মুখোশ পরা এক বা একাধিক চীনা পুরুষ নারীদের ধর্ষণ করে থাকে। তিনি নিজে তিন বার গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ২০১৪ সালে উইঘুর বিচ্ছিন্নতাবাদীদের চালানো এক হামলার পর চীনা প্রেসিডেন্ট এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে নির্দেশ দিয়েছেন- 'কোনো দয়ামায়া দেখানো চলবে না'। প্রেসিডেন্টের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করা হচ্ছে। উইঘুরে ধর্মীয় স্বাধীনতা হরণ করে গণনজরদারি, বন্দিত্ব, মগজধোলাই, বন্ধ্যাত্বসহ নির্যতন-নিপীড়ন অব্যাহত থাকলেও চীন এসবকে 'উদ্ভট ও মিথ্যা অভিযোগ' বলে খারিজ করছে।

চীন না হয়ে ভারত বা পশ্চিমা কোনো দেশে এভাবে মুসলিম নির্যাতন হলে তার প্রতিক্রিয়া কি এত শীতল হতো? পাকিস্তান এবং বাংলাদেশে ধর্মকে যারা রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করে নানা সময় উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারঙ্গম তারা চুপ থাকতেন না। চীনের ব্যাপারে এই নমনীয়তা কেন? কারণ চীন পাকিস্তানের দীর্ঘদিনের বন্ধু। তবে চীনের বন্ধুত্ব কিন্তু একাত্তর সালে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঠেকাতে পারেনি। একাত্তরে চীন ছিল বাংলাদের বিরুদ্ধে এবং পাকিস্তানের পক্ষে চীনা বুলেট অনেক বাঙালি মায়ের বুক খালি করেছিল। এখন অবশ্য চীন আমাদের বন্ধু দেশ, উন্নয়ন সহযোগী। অনেকগুলো বড় প্রকল্প চীনের সাহায্যে বাস্তবায়ন হচ্ছে। তিস্তা নদীর বাংলাদেশ অংশে নদীটির বিস্তৃত ব্যবস্থাপনা ও পুনরুজ্জীবনে একটি প্রকল্পেও চীন ঋণ সহায়তা দেওয়ার আগ্রহ দেখিয়েছি বলে শোনা গিয়েছে।

তিস্তার পানি বন্টন চুক্তি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই সমস্যা চলছে। ২০১১ সনে তিস্তা চুক্তি সই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধিতার কারণে তা হয়নি। এই বিষয়টি বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে গলার কাঁটা হয়ে রয়েছে। তিস্তা নদীর পানি সংরক্ষণের বিকল্প ব্যবস্থা বাংলাদেশের জন্য জরুরি। এতে চীনা আগ্রহ কি একেবারে রাজনৈতিক স্বার্থশূন্য? মোটেও তা নয়। বরং ভারতকে এক হাত দেখিয়ে দেওয়ার মতলব থেকেই হয়তো চীন তিস্তা প্রকল্পে ঋণ দিতে চায়। দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারে চীনের যে উচ্চাকাঙ্ক্ষা তার প্রধান বাধা ভারত। ভারতের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক সব সময়ই অম্ল। ১৯৬২ সালে ভারত-চীন যুদ্ধও হয়েছে। এই করোনাকালেও লাদাখে দুই দেশের সীমান্ত সংঘর্ষে হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে। উত্তেজনা পুরো প্রশমিত হয়েছে তা নয়। যেকোনো সময়েই পরিস্থিতি আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে।

ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের সোনালী অধ্যায় চলছে বলে বলা হয়ে থাকে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের ভিত্তি রচিত হয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অসামান্য উদার সাহায্য-সহযোগিতার মধ্য দিয়ে। তবে বঙ্গবন্ধু-হত্যা পরবর্তী সময়ে নানা কারণে এই সম্পর্কে শীতলতা তৈরি হলেও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ধারাবাহিকভাবে ক্ষমতায় থাকায় এখন সম্পর্ক উষ্ণ। তবে তিস্তা চুক্তি, সীমান্ত হত্যা, রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান ইত্যাদি ইস্যুতে বাংলাদেশে অস্বস্তি আছে।

এই অবস্থায় চীন তার নিজের স্বার্থেই বাংলাদেশের সঙ্গে নিবিড় বন্ধুত্ব রাখতে চায়। তবে পাকিস্তানের কাছে চীন যেরকম নিঃশর্ত আনুগত্য পেয়ে থাকে বাংলাদেশের কাছ থেকে তেমন পাওয়া সম্ভব নয়। কারো ইচ্ছাপূরণের হাতিয়ার হিসেবে নয়, শেখ হাসিনার সরকারের পররাষ্ট্র নীতি নির্ধারিত হয় দেশের বৃহত্তর স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়েই। শেখ হাসিনার সময়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নিকটতর হয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ভারতের প্রভাব এখন অনস্বীকার্য। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও মানতে হবে যে, মাঠে একা ভারত নেই, চীনও রয়েছে। সেও বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য ক্রমেই অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। চীন থেকে সাবমেরিনসহ যুদ্ধাস্ত্রও কিনছে বাংলাদেশ। এ নিয়ে ভারতের উদ্বেগ নেই তা-ও বলা যাবে না।

এই অঞ্চলে ভারত ও চীন একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী। এই দুই দেশের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করে চলছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গেই তার দুই বড় প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারসাম্য বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে, তাতে ভারতীয় বিশেষজ্ঞরাও বাহবা না দিয়ে পারেননি। তারা বলেছেন এই 'ব্যালেন্সিং অ্যাক্টের' সব কৃতিত্ব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। ভারতের থিংক ট্যাংক গেটওয়ে হাউসের সম্মানিত ফেলো রাজীব ভাটিয়া মন্তব্য করেছেন, একদিকে ভারত সরকারের সঙ্গে আস্থা ও সখ্য নির্মাণ, অন্যদিকে চীন থেকে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সহযোগিতা আদায়, এই দুই বিপরীতমুখী রণকৌশল বাস্তবায়নে হাসিনা 'যথেষ্ট দক্ষতা ও সাফল্য' দেখাতে পেরেছেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন ঘুরে এসেছেন। বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে চীন অনেক দিন থেকেই আমাদের প্রধান অংশীদার। দেশটি থেকে আমরা বছরে প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করে থাকি। এ ব্যাপারে ভারত পিছিয়ে, সেখান থেকে আমাদের আমদানির পরিমাণ ৬ বিলিয়ন ডলারেরও কম। তবে এই দুই দেশে আমাদের রপ্তানির পরিমাণ প্রায় সমান। চীন ও ভারত দুই দেশই আমাদের অবকাঠামো খাতে বড় রকমের ভূমিকা রাখছে। তবে ভারতের নিজের ক্ষমতা সীমিত, চীনের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার সাধ্য তার নেই। বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে চীনের বিনিয়োগ ইতোমধ্যেই ভারতকে কয়েকগুণ ছাপিয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের পর এই দুই দেশের সম্পর্ক আরও গভীরতর হবে, সেটাই স্বাভাবিক।

তবে সেটি ভালো না মন্দ, তা নিয়ে কোনো কোনো মহলে সন্দেহ রয়েছে। সেতু, মহাসড়ক, টানেল ইত্যাদি নির্মাণ বাবদ চীন ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের প্রধান ঋণ প্রদানকারী দেশ হয়ে উঠেছে। আমরা এখন চীনের বিখ্যাত 'বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ'-এর এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই প্রকল্পের অধীনে পৃথিবীর মোট ১৫২টি দেশের মধ্যে সড়ক ও সমুদ্রপথে সরাসরি সংযোগ স্থাপনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে চীন দেদার অর্থ ঢালছে। আমরাও তাদের সে খোলা হাত নীতির সুবিধাভোগী। ২০১৬ সালে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফরের পর যে ২৪ বিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক সাহায্যের চুক্তি হয়েছিল, সে অঙ্ক ধরে বাংলাদেশে চীনের মোট ঋণের পরিমাণ ৩০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। আজ হোক বা কাল, এই অর্থ বাংলাদেশকে ফেরত দিতে হবে। ব্যর্থ হলে গলায় ঋণের যে ফাঁস লাগবে, তা ছাড়ানো খুব সহজ হবে না। প্রতিবেশী শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের অভিজ্ঞতা তো আমাদের সে কথাই বলে।

চীনা অর্থে ও কারিগরি সহায়তায় শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দর নির্মিত হয়েছিল। কিন্তু তার নির্মাণ খরচ বাড়তে বাড়তে এমন এক অবস্থায় দাঁড়ায় যে ঋণের সুদ গুনতেই শ্রীলঙ্কার প্রাণ যাওয়ার জোগাড়। ভাবা হয়েছিল এই বন্দর থেকে বিস্তর আয় হবে, অথচ কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল খুব সামান্যসংখ্যক বাণিজ্যিক জাহাজই এই বন্দরে এসে ভিড়ছে। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়েই শ্রীলঙ্কা ১৫ হাজার একর জায়গাসহ সেই বন্দরের নিয়ন্ত্রণ ৯৯ বছরের জন্য চীনের কাছে ইজারা দিতে বাধ্য হয়। পাকিস্তানের একটি বন্দরও চীনের কাছে ৪০ বছরের জন্য একই কারণে লিজ দিতে হয়েছে।

ঋণ নিয়ে তা শোধ করার এই ব্যর্থতাকে অর্থনীতিবিদেরা নাম দিয়েছেন 'ঋণের ফাঁদ'। যুক্তরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক ব্যাংকসমূহ অনেক দিন থেকেই গরিব দেশকে সাহায্য করার নামে এই ঋণের ফাঁদ পেতে রেখেছে। এখন 'গরিবের বন্ধু' চীনও সেই পথ ধরেছে। আফ্রিকার অনেক দেশই এখন এই ফাঁদে পড়ে হাঁসফাঁস করছে। একই অবস্থা মালদ্বীপ ও ফিলিপাইনের। ৬০ বিলিয়ন ডলারের চীনা ঋণ মাথায় নিয়ে পাকিস্তানও এখন নিজের চুল নিজেই ছিঁড়ছে। এক সরকারি হিসাবে বলা হয়েছে, জ্বালানি খাতে চীনের বিনিয়োগকৃত ২৬ বিলিয়ন ডলারের জন্য আগামী ২০ বছরে পাকিস্তানকে ৪০ বিলিয়ন ডলার গুনতে হবে। ঋণের ফাঁদই বটে!

এই ফাঁদের কথা বাংলাদেশের অজানা নয়। বেল্ট অ্যান্ড রোড ফোরামে অংশ নিতে বেইজিং গিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম 'সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট' পত্রিকার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, চীনের কাছ থেকে অতিরিক্ত ঋণের দাবি বাংলাদেশ কখনোই তুলবে না। সাধ্যের বাইরে ঋণের বোঝা ঘাড়ে চাপলে বিপদ হবে, বাংলাদেশ এ কথা জানে। শাহরিয়ার আলম জানান, নিজের ক্ষমতাতেই বাংলাদেশ পদ্মা সেতুর মতো প্রকল্পে হাত দিয়েছে। অন্যান্য দেশ ও ব্যক্তিগত খাতের সঙ্গে অংশীদারত্বের কথাও বাংলাদেশ ভাবছে। পত্রিকাটি বাংলাদেশের এই রণকৌশলকে চীনকে এড়িয়ে বিকল্প সূত্র থেকে সম্পদ আহরণের উদ্যোগ বলে অভিহিত করেছে।

বাংলাদেশ যে চীন থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রাখতে চায়, তার আরেক বড় প্রমাণ বাংলাদেশের জলসীমায় চীনের গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করতে না পারা। মিয়ানমার থেকে আফ্রিকার জিবুতি পর্যন্ত 'মোতির মালা'র মতো একের পর এক সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করে চলেছে চীন। তার নিজের বাণিজ্যিক ও সামরিক প্রয়োজনে বাংলাদেশের কোথাও না কোথাও নোঙর করার জায়গা খুঁজছে। ভারতেরও একই লক্ষ্য। বাংলাদেশেরও একটা গভীর সমুদ্রবন্দর চাই। সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীনের অংশগ্রহণ প্রায় নিশ্চিত ছিল, কিন্তু ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তিতে সে উদ্যোগ ভেস্তে যায়। পটুয়াখালীর পায়রাতে যে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মিত হচ্ছে, তাতেও নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে এসেছিল চীন। ভারতও চায় সেখানে পা রাখার মতো জায়গা। এই দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর রশি–টানাটানি এড়াতে বাংলাদেশ ঠিক করেছে শুধু এই দুই দেশ নয়, আরও ১০টির মতো দেশকে এই প্রকল্পে অংশগ্রহণে আমন্ত্রণ জানানো হবে। এর ফলে সাপও মরবে, বাংলাদেশের লাঠিও ভাঙবে না।

সমুদ্রবন্দর হোক বা পদ্মা সেতু হোক, যা করবে বাংলাদেশ নিজের স্বার্থেই করবে। ভারত সফরে গিয়ে নয়াদিল্লিতে সাংবাদিকদের এই কথা বুঝিয়ে বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী হাসিনা। তিনি আশ্বাস দিয়েছিলেন বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ নিয়ে ভারতের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। শুধু চীন বা ভারত নয়, পৃথিবীর সব বন্ধুভাবাপন্ন দেশ থেকেই সাহায্য-সহযোগিতা নিতে আগ্রহী বাংলাদেশ। 'আমরা দেশের উন্নয়ন চাই। আমাদের জনগণের কথা চিন্তা করতে হবে। কেননা, তাঁরাই এসব উন্নয়নের সুবিধা ভোগ করবেন।'

চীন চায় আধিপত্য বিস্তার করতে। চীনের অর্থনীতি ভারতের পাঁচগুন বড়। প্রতিরক্ষা খাতে ভারতের চেয়ে চারগুন বেশি খরচ করে চীন। ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোকে চীন কাছে টানার অব্যাহত চেষ্টা করছে। তবে বাংলাদেশে শেখ হাসিনা 'চীনা তাস' ব্যবহার করেছেন বাংলাদেশের স্বার্থে, চীনের সুবিধার জন্য নয় – এটা শেখ হাসিনার সমালোচকরাও অস্বীকার করতে পারবেন না।