কোন পথে ইরান?

প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে চলা টানা বিক্ষোভে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৮৩ জন। গ্রেপ্তার হয়েছেন দুই হাজারের বেশি।

সাঈদ ইফতেখার আহমেদসাঈদ ইফতেখার আহমেদ
Published : 7 Oct 2022, 12:57 PM
Updated : 7 Oct 2022, 12:57 PM

নীতি পুলিশের হেফাজতে ২২ বছরের তরুণী মাশা আমিনের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে ইরানে। নীতি পুলিশ ‘গাশত-এ এরশাদ’ বা ‘গাইডেনস প্যাট্রোল’ নামেও পরিচিত। সরকারের নীতিনির্দেশনা অনুযায়ী নারীরা পোশাক পড়ছেন কিনা সেটা দেখার দায়িত্ব তাদের। তবে শুধু নারীরাই নন, কখনো কখনো পুরুষরাও তাদের হাতে হেনস্থা এবং গ্রেপ্তারের শিকার হন।

১৩ সেপ্টেম্বর ইরানের কুর্দিস্তান থেকে ভাইয়ের সাথে তেহরানে আসা আমিনিকে ‘ঠিকমতো’ হিজাব না পরবার কারণে গ্রেপ্তার করে রাজধানীর নীতি পুলিশ। সুস্থ অবস্থায় গ্রেপ্তার হবার পর পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের কারণে তার Brain dead হয়। এ কারণেই তার মৃত্যু ঘটেছে বলে ডাক্তাররা জানিয়েছেন।

নীতি পুলিশের হাতে হেনস্থা বা নির্যাতনের শিকার হওয়া নৈমত্তিক বিষয় ইরানে। তারপরও আমিনির হত্যাকাণ্ডের বিষয়টিকে পুলিশ নানা ভাবে ধামাচাপা দেবার চেষ্টা করেছে এ ভেবে যে, এটি হয়তো আবার বড় ধরনের বিক্ষোভের জন্ম দিতে পারে। ২০১৯ সালের জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে ব্যাপক বিক্ষোভের স্মৃতি বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইব্রাহীম রাইসি সরকারের মনে রয়েছে। ওই বিক্ষোভ দমনে শতাধিক ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করেছিল দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী।

সব প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এবারের বিক্ষোভ ২০১৯ সালের প্রতিবাদকেও ছাড়িয়ে গেছে। প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে চলা টানা বিক্ষোভে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৮৩ জন। গ্রেপ্তার হয়েছেন দুই হাজারের বেশি। শুধু তাই নয়, গুপ্ত ঘাতকদের দিয়েও বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারীদের হত্যা এবং ভয় দেখান হচ্ছে। অত্যন্ত কঠোর অবস্থান নিয়েও সরকার এখন পর্যন্ত বিক্ষোভকারীদের নিরস্ত করতে পারেনি।

এবারের বিক্ষোভের বৈশিষ্ট্য হলো এতে অংশ নিয়েছেন ধর্ম-জাতি নির্বিশেষে সবাই। রাস্তায় একই সাথে মিছিল করেছেন আরব, কুর্দি, তুর্কি, শিয়া, সুন্নিসহ অমুসলিমরাও। নীতি পুলিশ কর্তৃক নারীদের হেনস্থা করার প্রতিবাদে বিক্ষোভ শুরু হলেও এখন আর সেটা সেখানে থেমে নেই। এখন দাবি উঠেছে সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনির পদত্যাগসহ পুরো ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের। তারা শ্লোগান দিচ্ছেন– নারী, জীবন ও স্বাধীনতা। তারা আওয়াজ তুলেছেন খামেনি কেন্দ্রিক একনায়কতান্ত্রিক স্বৈরশাসনের চির অবসানের।

শুরুটা হয়েছিল এভাবে। আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে ‘ইসলামপন্থার’ রাজনীতির ওপর নির্ভর করে ব্যাপক শাহ বিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয় ৭০-এর দশকে। এতে খামেনির সহযোগী হয়েছিল তৎকালীন প্রভাবশালী মুজাহেদিন-এ-খালক এবং তুদেহ পার্টিসহ (কমিউনিস্ট পার্টি) ডান-বাম নির্বিশেষে প্রায় সব মতবাদের অনুসারী জনগণ। মাসুদ রাজাভী এবং তার স্ত্রী মরিয়ম রাজাভীর নেতৃত্বাধীন মুজাহেদিন-এ-খালক এর আদর্শ ছিল মার্কসবাদ-নারীবাদ-ইসলাম। নুরুদ্দিন কীয়ানুরির নেতৃত্বে তুদেহ পার্টি সোভিয়েত ইউনিয়নের অনুসরণে সমাজতান্ত্রিক ইরান গঠনের লক্ষ্য নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল।

রাজনৈতিক লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য ভিন্ন হলেও খোমেনি, রাজাভী এবং কীয়ানুরির দুটো জায়গায় সাধারণ মিল ছিল, যা তাদেরকে একই রাজনৈতিক মোহনায় মিলিয়েছিল। এ দুটো মিলের- একটি হলো শাহ বিরোধিতা, আর দ্বিতীয়টি হলো তাদের ভাষায় ‘মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের’ বিরোধিতা। তারা দুজন খোমেনিকে শুধু এ দুই বিরোধিতার একজন নির্ভরযোগ্য নেতাই মনে করেননি এমনকি তার নেতৃত্বে ইরানের ইতিবাচক বিকাশ সম্ভব বলেও মনে করেছিলেন। খোমেনির ওপর তাদের আস্থা এতটাই ছিল যে, বিপ্লবের পরপর মার্কিন সাময়িকী ‘নিউজউইকের’ সাথে এক সাক্ষাৎকারে কীয়ানুরি বলেছিলেন "he (Khomeini) is playing a totally progressive part in the development of Iran."

রাজাভী এবং কীয়ানুরির পাশাপাশি অন্যান্য গণতান্ত্রিক এবং ‘ইসলামপন্থিদের’ সমর্থনে শাহকে উৎখাত করতে সমর্থ হন খোমেনি। এটি আধুনিক ইতিহাস প্রথম ‘ইসলামি’ বিপ্লব। এর মধ্যে দিয়ে খোমেনি প্রমাণ করেন যে, প্রাচ্যজাত রাজনৈতিক মতবাদের ওপর নির্ভর করেও গণবিক্ষোভ সংগঠন এবং আধুনিক রাষ্ট্র কাঠামোর দখল নেওয়া সম্ভব।

সুন্নি রাজনৈতিক চিন্তক সৈয়দ রাশিদ রিদা, সাইয়্যেদ কুতব, সাইয়্যেদ আবুল আলা মওদুদী প্রমুখ, ইসলাম ধর্মকে যে আধুনিককালে রাজনৈতিক মতবাদ হিসেবেও ব্যবহার করা যায়– এ ধারণা দেন। এই চিন্তার ওপর ভিত্তি করে তারা ‘ইসলামপন্থার’ রাজনীতির তত্ত্ব দেন– যে তত্ত্ব অনুসারে ইসলাম শুধু ধর্ম নয়, একটি রাজনৈতিক মতবাদও।

সুন্নি রাজনৈতিক চিন্তক বিশেষত কুতব এবং মওদুদীর চিন্তাধারার প্রভাব পড়ে শিয়া রাজনৈতিক তাত্ত্বিক সাইয়্যেদ মুহসিন-উল-হাকিম, আলি শারিয়াতি, আয়াতুল্লাহ খোমেনিসহ আরও অনেকের ওপর। ফলে সুন্নি ‘ইসলামপন্থার’ পাশাপাশি গড়ে ওঠে শিয়া ‘ইসলামপন্থা’। এ ধরনের রাজনীতির চিন্তা সুন্নি চিন্তাবিদরা প্রথম করলেও শিয়াপন্থিদের প্রথম ক্ষমতা দখল বিশ্বব্যাপী সুন্নি ‘ইসলামপন্থি’ রাজনৈতিক কর্মীদের একদিকে ঈর্ষান্বিত, অপরদিকে আশান্বিত করে তোলে। তারা আশাবাদী হয়ে উঠেন এ ভেবে যে, ইরানে যেটা সম্ভব হয়েছে, সেটা তাদের নিজ নিজ দেশেও সম্ভব করা যাবে।

বস্তুত এ জায়গা থেকেই আজকে ইরানে শিয়া ‘ইসলামপন্থি’ শাসকদের বিরুদ্ধে সর্বস্তরের জনগণের যে বিক্ষোভ, তা সুন্নি ‘ইসলামপন্থার’ রাজনীতির অনুসারীদের শঙ্কিত করে তুলেছে– যদিও শিয়া ‘ইসলামপন্থাকে’ তারা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষই মনে করে। যে বিষয়টা সুন্নি ‘ইসলামপন্থিদের’ আতঙ্কিত করে তুলছে তা হলো, আজকে খামেনি নেতৃত্বাধীন রেজিমের পতন ঘটলে, সেটা সুন্নি ‘ইসলামপন্থার’ রাজনীতির ভিত্তিকেও চ্যালেঞ্জ করে বসবে। এমনটা ঘটেছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর 'চীনপন্থি' রাজনীতির ক্ষেত্রে। ওইসময় রাজনীতির ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষ হলেও এ কারণেই ‘চীনপন্থিরা’ চাচ্ছিল না যে, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটুক।

সত্তরের দশকে খোমেনি ক্ষমতায় এসেই প্রথমে মুজাহেদিন-এ-খালক এবং তুদেহ পার্টির নেতাকর্মীদের নির্মূলের উদ্যোগ নেন। এ দুটো দলের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে ফায়ারিং স্কোয়াডে এবং অন্যান্য আইনি/বেআইনি পন্থায় হত্যা করেন তিনি। কীয়ানুরি এবং তার স্ত্রীকে গ্রেপ্তার করে জেলে অমানবিক নির্যাতন করা হয়। কীয়ানুরিকে সোভিয়েত এজেন্ট বলা হয়। রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে তাকে বলতে বাধ্য করা হয় যে, কমিউনিজম একটি ভুল মতবাদ এবং তুদেহ পার্টি করে তিনি ভুল করেছেন। এদের পাশাপাশি খামেনি সব সেক্যুলার গণতন্ত্রী, এমনকি মধ্যপন্থার ইসলামপন্থিদেরও নির্মূলের প্রচেষ্টা চালান।

কীয়ানুরি ধরা পড়লেও রাজাভী পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। তিনি তার মুজাহেদিন-এ-খালককে ইরাকে সরিয়ে নেন। সেখান থেকে তিনি খোমেনি সরকারের অনুসারীদের লক্ষ্য করে সন্ত্রাসবাদী হামলা পরিচালনা করতে থাকেন। এ সমস্ত হামলায় বিপ্লবের সমর্থক এবং সরকারের বেশ কিছু লোক প্রাণ হারায়।

ইরানে তখন চরম টালমাটাল অবস্থা। শাহ সমর্থক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইরান তখন কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। মার্কিন কূটনৈতিকদের জিম্মি হিসেবে আটক রাখা হয়েছে। আমেরিকাসহ পশ্চিমা দুনিয়ার নানাবিধ অবরোধে ইরান বিপর্যস্ত।

খোমেনি যেহেতু মার্কিনবিরোধী তাই তার প্রতি তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের একটা প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিল। কিন্তু খোমেনির তুদেহ পার্টি বিরোধী শক্ত অবস্থান, সোভিয়েত প্রধান ব্রেজনেভকে হতাশ করে। এমন প্রেক্ষাপটে ইরাকের বাথ সোশ্যালিস্ট পার্টির সোভিয়েত ঘেঁষা সেক্যুলার সাদ্দাম হোসেন ইরান আক্রমণ করে বসেন।

‘শত্রুর শত্রু, আমার মিত্র’– এই নীতি অনুসরণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ আক্রমণ ইরানকে শায়েস্তা করবার মোক্ষম মাধ্যম হিসেবে দেখে। সোভিয়েত ইউনিয়নও আক্রমণকে নেতিবাচক বিবেচনা করে না। শিয়া ‘ইসলামী বিপ্লব’ বিরোধী সৌদি আরবও সাদ্দামকে ওইসময় নানা ভাবে সাহায্য-সমর্থন দেয়।

সৌদি আরব এবং দুই পরাশক্তির সমর্থন পেয়ে খুব দ্রুত ইরানের একটা বড় অংশ সাদ্দামের দখলে চলে আসে। এ সময় মুজাহেদীন-এ-খালকও ইরানের বিভিন্ন শহরে সন্ত্রাসবাদী হামলা বৃদ্ধি করে। সংগঠনটির একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো, এর রাজনৈতিক এবং সামরিক– দুটো শাখার প্রায় সবগুলি পদই নারীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং পরিচালিত।

একের পর এক শহর ইরাকের দখলে চলে যাওয়া খোমেনিকে সন্ত্রস্ত করে তোলে। সাদ্দামের চূড়ান্ত লক্ষ্য কী? তিনি ইরানের কতটুকু দখল করতে চান? নাকি তার চূড়ান্ত লক্ষ্য ধর্মভিত্তিক সরকারকে উৎখাত করে ইরাক সংশ্লিষ্ট রাজাভীকে ক্ষমতায় বসান? এসব প্রশ্নের পাশাপাশি ইরানি সেনাবাহিনীর ক্রমাগত ব্যর্থতা ক্ষমতাসীনদের উদ্বিগ্ন করে তোলে। এর সাথে সাথে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় প্রেসিডেন্ট বনি সদর রাতের অন্ধকারে দেশ ছাড়েন। এরকম বেসামাল পরিস্থিতিতে বিপ্লব টিকিয়ে রাখবার মাধ্যম হিসেবে বিরোধীদের ওপর নিপীড়ন বৃদ্ধি করেন খোমেনি। নারীদের ওপর জারি করেন নতুন নতুন নিষেধাজ্ঞা।

ইরানের স্বৈরাচারী শাহ্ মোহাম্মদ রেজা পাহলভি ক্ষমতায় ছিলেন ১৯৪১ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত। তার সময়কালে নারীদের ব্যাপক উন্নয়ন ঘটে। সমাজ ও সংস্কৃতিতে পাশ্চাত্যকরণের ধারা শুরু হয়। নারী-পুরুষের পোশাক, সাজ সজ্জা ইত্যাদি বিষয়ে তখন কোনো রাষ্ট্রীয় বাধ্যবাধকতা ছিল না।

উচ্চশিক্ষা, পেশাগত উৎকর্ষ, ভোটাধিকার, সরকারি দপ্তরের দায়িত্ব, পুরুষের সমান বেতনের আইন, স্বাস্থ্যসেবা ও সন্তান নেওয়া বা না নেওয়ার অধিকার শাহ্‌- এর আমলে নিশ্চিত করা হয়। ১৯৬৭ সালের পারিবারিক সুরক্ষা আইন এবং ১৯৭৫ সালে এ আইনের সংশোধিত রূপ সমতা রক্ষা করে নারীর বিয়ে, বিবাহবিচ্ছেদ এবং নারীর উত্তরাধিকার নিশ্চিত করে। শাহ্‌- এর আমলে বহুবিবাহও বহুলাংশে কমে যায়।

গত শতাব্দীর বিশের দশক থেকে মুসলিম দেশগুলোতে এক গুচ্ছ নেতৃত্বের জন্ম হয় যারা তাদের দেশকে পশ্চিমের সমকক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে চাচ্ছিলেন। জ্ঞান, বিজ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, প্রযুক্তি সবকিছুতে পশ্চিমের যে আধিপত্য, তার বিরুদ্ধে প্রচ্যের জাগরণ ঘটাতে চাচ্ছিলেন। আর এর জন্য তারা যেটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছিলেন সেটা হলো ট্র্যাডিশনাল জীবন-যাপন এবং মূল্যবোধ থেকে বের হয়ে নারী উন্নয়নের চ্যালেঞ্জের দায়িত্ব নেওয়া। এ ধরনের ভিশানারি নেতাদের মধ্যে ছিলেন বাদশাহ আমানুল্লাহ খান, কামাল আতাতুর্ক প্রমুখ। রেজা শাহ্ পাহলভিও এদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।

তবে শাহ্- এর সময় দেশটিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব এবং খবরদারি বৃদ্ধি পায়। ইসরায়েলের পরে তখন ইরান ছিল মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মিত্র। আমেরিকার ক্রমবর্ধমান প্রভাবের ফলে অনেক ইরানি, বিশেষত বামপন্থি এবং ‘ইসলামপন্থিরা’ দেশটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপনিবেশে পরিণত হয়েছে বলে মনে করতেন। শাহ্‌- এর স্বৈরশাসন এবং এ ধরনের ভাবনা ব্যাপক সংখ্যায় জনগোষ্ঠীকে শাহ্ বিরোধী বিক্ষোভে অংশ নিতে উৎসাহিত করে।

এ বিক্ষোভে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল লক্ষণীয়। শাহ্-এর পতনে নারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আয়াতুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে শাহ্ বিরোধী আন্দলনের সময় বোরখাকে তুলে ধরা হয় মার্কিন বিরোধিতার প্রতীক হিসেবে। খোমেনি সমর্থকদের পাশাপাশি তৎকালিন প্রভাবশালী বামপন্থি দলসমূহের নারী কর্মীরাও বোরখা পরে বিক্ষোভে অংশ নিতেন, মার্কিন বিরোধিতার অংশ হিসেবে।

শিয়া ‘ইসলামী বিপ্লবের’ সময় ইরানের নারীরা মনে করেছিলেন শাহ্ পরবর্তী ইরানে হিজাব হবে ‘My Choice’। তারা বুঝতে পারেননি যে হিজাব হয়ে যাবে রাষ্ট্রের চয়েস। তারা মনে করেছিলেন, শাহ্ পরবর্তী ইরান ‘ইসলামিক প্রজাতন্ত্র’ হলেও এটি হবে পাকিস্তানের মতো ‘ইসলামিক প্রজাতন্ত্র,’ যেখানে রাষ্ট্র নারীর পোশাক নিয়ে খবরদারি করবে না। রাষ্ট্রের হাত নারীর শরীর পর্যন্ত প্রসারিত হবে না।

ক্ষমতায় আসবার পরে খোমেনি নিজের হাতে সমস্ত ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার পদ তৈরি করে। ইরানের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় এ পদটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রপতি বা সংসদ নয়, সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার ইচ্ছা অনিচ্ছাই ইরানের রাষ্ট্র ব্যবস্থার শেষ কথা।

খোমেনি নারী-পুরুষ সমানধিকারের বিরোধী ছিলেন। ফলে তিনি ক্ষমতায় এসেই পারিবারিক সুরক্ষা আইন বাতিলের উদ্যোগ নেন। যার ফলে বিপ্লবের পরপরই তাকে নারীদের ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে পড়তে হয় এবং সাময়িকভাবে তাকে এ পদক্ষেপ থেকে পিছিয়ে আসতে হয়। তবে ১৯৮০ সালে ক্ষমতা সংহত করবার পর তিনি বোরখা পরা বাধ্যতামূলক করেন এবং নারীদের সমানাধিকারের সমস্ত ব্যবস্থা রহিত করেন।

পারিবারিক সুরক্ষা আইন বাতিল করে দেবার ফলে নারীরা বিয়ে, বিবাহবিচ্ছেদ এবং সন্তানকে হেফাজতে নেওয়ার অধিকার হারান। ওই সময় থেকে বাল্য বিবাহের হার যেমন বৃদ্ধি পায় তেমনি বহু বিবাহকে উৎসাহ দেওয়া হতে থাকে। 'মুতা বিবাহে'র নামে যৌন বৃত্তিকেও আইনসম্মত করা হয়।

বহু গুরুত্বপূর্ণ পদে নারীদের অধিষ্ঠানের পথ আইনগতভাবে রুদ্ধ করে দিয়ে নারীদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করা হয়। শুধু তাই নয়, নীতিগতভাবে সুন্নি ইসলাম বিরোধী খোমেনি সুন্নি মুসলিম এবং অমুসলিমদের পরিণত করেন তৃতীয় শ্রেণির নাগরিকে। সুন্নিদের পক্ষে সেখানে সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা, রাষ্ট্রপতি, স্পিকার, বিচারপতিসহ অনেক পদেই আইনগতভাবে অধিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব নয়। ইহুদি এবং অন্যান্য অমুসলিমদেরও গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হবার পথ রুদ্ধ করা হয়।

ইরানে বর্তমানে নারীরা যে বিক্ষোভ করছেন, এজন্য সরকার প্রাথমিকভাবে দুষছেন কুর্দিদের, কেননা মাশা আমিনি ছিলেন কুর্দি। কুর্দি অধ্যুষিত অঞ্চলগুলিতে এ জন্য ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে। কুর্দিরা যেহেতু সুন্নি মুসলমান, এজন্য তারা জাতিগত এবং ধর্মীয়, উভয়ভাবেই ইরানে নিপীড়িত। তাই যেসমস্ত সরকার বিরোধী কুর্দি রাজনৈতিক দল এবং গোষ্ঠী ইরাকের কুর্দি প্রধান অঞ্চলে থেকে কার্যক্রম পরিচালনা করছে, তাদের সদর দপ্তর লক্ষ্য করে ইরাকের অভ্যন্তরে ক্ষেপনাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইরান। এছাড়া সরকার দায়ী করছে ইসরায়েল, পশ্চিমা দুনিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে।

ইরান প্রশ্নে পশ্চিমা দুনিয়ার এক ধরনের দ্বিচারী মনোভাব সব সময়েই পরিলক্ষিত হয়েছে। খোমেনি এবং তার অনুসারীরা প্যারিসে থেকেই বিপ্লবে নেতৃত্ব দিয়েছেন। পশ্চিমাদের বন্ধু হিসেবে পরিচিত শাহ্- এর বিরুদ্ধে সবরকম রাজনৈতিক কার্যকলাপ পরিচালনায় সহায়তা করেছে ফ্রান্স।

১৯৫২ সালে মোহাম্মদ মোসাদ্দেগ যখন গণতান্ত্রিকভাবে ইরানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন তখন তাকে ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত করতে ব্রিটেনের অনুরোধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভূমিকা পালন করে, কেননা তিনি তেল সম্পদ জাতীয়করণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। মোসাদ্দেগ সরকারের হাত ধরে যে গণতান্ত্রিক ধারার সূত্রপাত ইরানে হয়েছিল, ওই ধারা অব্যাহত থাকলে ১৯৭৯ সালে খোমেনি ক্ষমতায় আসতে পারতেন না বলে অনেকে মনে করেন।

নারীদের সমঅধিকারের পাশাপাশি বিক্ষোভকারীরা দাবি করছে স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে সেক্যুলার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের। ইরানের বর্তমান অতি রক্ষণশীল প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি ২০২১ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে ভিন্নমতালম্বীদের ওপর দমনের মাত্রা বাড়িয়েছেন। গত বছর দেশটিতে কমপক্ষে ৩৪১ জনকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া নারীদের ওপরও নজরদারি বৃদ্ধি করেছেন রাইসি।

খোমেনি ক্ষমতা গ্রহণের পর বিপ্লব বিরোধীদের দমনে রাইসি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তবে তিনি বর্তমানে এমন এক সময়ে নিপীড়ন বাড়িয়েছেন যখন অর্থনৈতিক সঙ্কটে দেশটির জনগণ জর্জরিত। পূর্বের নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি নতুন করে ৩৬০০ এরও অধিক নিষেধাজ্ঞা ইরানের ওপর আরোপ করা হয়েছে। ফলে খাদ্যদ্রব্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষ দিশেহারা। এতে সাধারণ জনগণের সমস্ত ক্ষোভ গিয়ে পড়ছে সরকারের ওপর। তারা মনে করছে একদিকে সরকার জনগণের মৌলিক অর্থনৈতিক চাহিদা মেটাতে পারছে না, আবার অপরদিকে আরও শক্ত হাতে জনগণের টুঁটি টিপে ধরছে।

ইরান বর্তমানে এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। দেশটির ৮৩ বছর বয়স্ক অসুস্থ ধর্মীয় নেতা খামেনির অবর্তমানে কে এই পদে আসীন হবেন এ নিয়ে ক্ষমতাসীনদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রেসিডেন্ট রাইসি এবং খামেনির ৫৩ বছর বয়সী ছেলে মোজতাব হোসেনী এ পদের অন্যতম প্রার্থী।

এটি পরিষ্কার যে, বিক্ষোভকে শক্ত হাতে দমনের পন্থা নিয়ে রাষ্ট্র এবং সরকারে নিজের ক্ষমতা সংহত করে সর্বোচ্চ ধর্মীয় পদটি নিশ্চিত করতে চাচ্ছেন রাইসি। তাই তিনি নিজের শক্তি প্রদর্শনের উদ্দেশে, ইসলামিক প্রজাতন্ত্র এবং হিজাবের সমর্থনে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বড় সমাবেশে এবং মিছিলের আয়োজন করেছেন।

এ ধরনের গণজমায়েত এবং মিছিল দেশজুড়ে শাহ্ও আয়োজন করেছিলেন তার পতনের পূর্বে। ১৯৭১ সালের শেষ দিকে ঢাকাতেও আমরা পাকিস্তানের সমর্থনে এ ধরনের সমাবেশ দেখেছি। পতনের পূর্বে সামরিক শাসক এরশাদও তার সমর্থনে এ ধরনের সমাবেশ করেছেন। সরকারি মদদে অনুষ্ঠিত এ সমস্ত সমাবেশ পাকিস্তানকে যেমন রক্ষা করতে পারেনি তেমনি স্বৈরশাসকদের পতনও ঠেকাতে পারেনি।

ইরানের নারীরা আজকে আন্দোলন করছেন শুধু ‘Hijab is my choice’ এ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নয়; নারীদের পূর্ণ নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যও। পশ্চিমের মুসলিম নারীরাও আন্দোলন করেছেন হিজাব পরার অধিকার নিয়ে। তারাও বলেছেন, হিজাব হতে হবে তাদের ব্যক্তিগত পছন্দ। এখানে রাষ্ট্রের কিছু বলার থাকবে না। ভারতের কেরালার মুশকানও বলেছেন একই কথা। তিনিও বলেছেন ‘হিন্দুত্ববাদী’ বিজেপি সরকারের নারীদের হিজাব নিয়ে বলার কিছু নেই।

ইরানের নারীরাও ওই একই কথা বলে আসছেন ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের পর থেকেই। কিন্তু যতবারই তারা তাদের অধিকারের দাবিতে রাস্তায় নেমেছেন, ততবারই বলপ্রয়োগ করে রাষ্ট্রযন্ত্র তাদের কণ্ঠ স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছে। কিন্তু কোনো ভয়ভীতিই ইরানের নারীদেরকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। বারবার তারা তাদের অধিকার আদায়ের দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন।

ইরানের নারীরা হয়তো এখনই সফল হবেন না। তবে তারা যেদিন সফল হবেন, ওইদিন তাদের পূর্ণ নাগরিক অধিকারের পাশাপাশি সুন্নী মুসলমান এবং অমুসলিমদেরও সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার পথ ইরানে উন্মুক্ত হবে।