কাহিনী সংক্ষেপ: কতো ভাষা এই পৃথিবীতে। বাংলা ইংরেজি ফরাসি জার্মান জাপানি রুশ তামিল তেলেগু মালয় আরবি ফারসি হিন্দি আসামি উড়িয়া হিব্রু-- আরো কতো ভাষা। তাদের কোনোটির সৌন্দর্যে অন্ধ হয়ে যায় চোখ। ...
Published : 23 Jul 2013, 05:19 PM
কাহিনী সংক্ষেপ:
কতো ভাষা এই পৃথিবীতে। বাংলা ইংরেজি ফরাসি জার্মান জাপানি রুশ তামিল তেলেগু মালয় আরবি ফারসি হিন্দি আসামি উড়িয়া হিব্রু-- আরো কতো ভাষা। তাদের কোনোটির সৌন্দর্যে অন্ধ হয়ে যায় চোখ।
কোনোটির ঐশ্বর্যের কাছে নুয়ে আসে মাথা। কোনোটির দর্পের কাছে হার মানতে হয় মুখোমুখি হওয়ার সাথেসাথে। তবু আমাদের কাছে বাঙলার মতো আর কোনো ভাষা নেই। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। আমাদের ভাষা। আমাদের আনন্দ এ ভাষায় নেচে উঠে ময়ূরের মতো। আমাদের সুখ ভোরের রৌদ্র বিকেলের ছায়া আর সন্ধ্যার আভার মতো বিচ্ছুরিত হয় বাংলা ভাষায়। আমাদের বেদনা আর দুঃখ থরোথরো করে ওঠে বাঙলা ভাষায়। আর কোনো ভাষা আমাদের দুঃখে কাতর হয় না। আর কোনো ভাষা পুলকিত শিহরিত মর্মরিত আকুল ব্যাকুল চঞ্চল অধীর হয় না আমাদের সুখে, আমাদের আনন্দে।
হাজার বছর আগে জন্ম হয়েছিলো বাংলা ভাষার। প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা মানুষের মুখেমুখে রূপান্তরিত হয়ে বঙ্গীয় অঞ্চলে জন্ম নিয়েছিলো এক মধুর-কোমল-বিদ্রোহী ‘প্রাকৃত’ ভাষা। নাম তার বাঙলা। তাকে কখনো বলা হয়েছে ‘প্রাকৃত’, কখনো বলা হয়েছে ‘গৌড়ীয় ভাষা’। কখনো বলা হয়েছে ‘বাঙ্গালা’, কখনো ‘বাঙ্গলা’। এখন বলি ‘বাঙলা’ বা ‘বাংলা’।
জন্মের সময় বাঙলা ভাষা স্নেহ পায় নি সমাজপ্রভুদের। কিন্তু তা হাজার বছর ধরে বইছে ও প্রকাশ করেছে কোটিকোটি সাধারণ মানুষের স্বপ্ন ও বাস্তবতা। বৌদ্ধ বাউলেরা এ ভাষায় রচেছেন দুঃখের গীতিকা। বৈষ্ণব কবিরা ভালোবেসেছেন হাহাকার করেছেন এ ভাষায়। মঙ্গলকাব্যের কবিরা এ ভাষায় রচনা করেছেন লৌকিক মঙ্গলগান। এ ভাষায় রচিত হয়েছে আধুনিক মানুষের কতো না উপাখ্যান। এ ভাষার জন্য উৎসর্গিত হয়েছে আমার ভাইয়ের রক্তিম বিদ্রোহী রক্ত। এ ভাষা দীর্ঘশ্বাস ফেললে চন্ডীদাসের কথা মনে পড়ে। তার উলাসে মনে পড়ে মধুসূদনের কথা। এ ভাষার থরোথরো ভালোবাসার নাম রবীন্দ্রনাথ। বিজন অশ্র“বিন্দুর নাম জীবনানন্দ। বিদ্রোহের নাম নজর“ল। বাংলা আমাদের ভাষা। বাংলা ভাষা ছাড়া আমরা নিজেদের কথা কল্পনা করতে পারি না।
কিন্তু কীভাবে জন্ম নিল আমাদের বাংলা ভাষা? ভাষা কি জন্ম নেয় মানুষের মতো? বা যেমন বীজ থেকে গাছ জন্মে, তেমনভাবে জন্ম নেয় ভাষা? না, ভাষা মানুষ বা তর“র মতো জন্ম নেয় না। এখন আমরা যে বাংলা ভাষা বলি, এক হাজার বছর আগে তা ঠিক এমন ছিলো না। এক হাজার বছর পরও ঠিক এমন থাকবে না। বাংলা ভাষার আগেও এ দেশে ভাষা ছিলো। সে ভাষায় এ দেশের মানুষ কথা বলতো, গান গাইতো, কবিতা বানাতো। ভাষার ধর্মই বদলে যাওয়া। মানুষের মুখে মুখে বদলে যায় ভাষার ধ্বনি। রূপ বদলে যায় শব্দের, বদল ঘটে অর্থের। অনেক দিন কেটে গেলে মনে হয়, ভাষাটি একটি নতুন ভাষা হয়ে উঠেছে। বাংলা ভাষার আগেও এ দেশে ভাষা ছিলো। আর সে ভাষার বদল ঘটেই জন্ম হয়েছে বাংলা ভাষার।
বাংলা ভাষার আগে এ দেশে কোন ভাষা ছিল? কোন ভাষা থেকে জন্ম হলো বাংলা ভাষার? কবে সেই ভাষা বদলে গিয়ে বাংলা ভাষার জন্ম হলো? সহজ করে বললে, বাংলা ভাষার আদিপুরুষ ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশ। এগুলোকে আর্যভাষা নামেও ডাকা হতো এক সময়। এই ভাষাবংশের অনেকগুলো শাখার একটি হলো ভারতীয় আর্যভাষা। এই ভাষাই মানুষের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত হতে হতে বদলে যেতে থাকে। এই বদলে যাওয়ার বিভিন্ন পর্যায় আছে। মধ্যভারতীয় আর্যভাষা এমনি একটি পর্যায়। এই পর্যায়ের ভাষাগুলোকে বলা হয় প্রাকৃত ভাষা। এই প্রাকৃত ভাষাগুলোর শেষ স্তরের নাম অপভ্রংশ বা অবহট্ঠ, অর্থাৎ যা খুব বিকৃত হয়ে গেছে। এ অপভ্রংশরাশি থেকেই উৎপন্ন হয়েছে বিভিন্ন আধুনিক ভারতীয় আর্যভাষা- বাংলা, হিন্দি, গুজরাটি, মারাঠি, পাঞ্জাবি, আসামি, উড়িয়া, মৈথিলি প্রভৃতি ভাষা।
গল্প শুনেই বোঝা যাচ্ছে, বইটি আসলেই বাংলা ভাষার জীবনী। ভয় নেই, হুমায়ুন আজাদ বইটি বুড়ো পাঠকদের জন্যে লেখেননি। লিখেছেন কিশোর-তর“ণদের জন্যে, যাদের কাছে বাস্তবও অনেকটা স্বপ্নের মতো। জ্ঞান যাদের কাছে এক রকম আবেগ ও সৌন্দর্য। বইটির পুরো নামই হলো- ‘কতো নদী সরোবর বা বাঙলা ভাষার জীবনী’। যারা বাঙলা ভাষার জীবনী জানতে চায়, জানতে চায় কীভাবে বাঙলা ভাষার জন্ম হলো, কীভাবে বাঙলা ভাষা আজকের সমৃদ্ধ বাঙলা ভাষা হলো, তাদের জন্যই এই বইটি লিখেছেন হুমায়ুন আজাদ।
[বইটির বানানগুলো কেমন যেন অদ্ভুত। কেমন অচেনা অচেনা লাগে। কারণ সেই বানানগুলো প্রচলিত বানানরীতিতে লেখা নয়। আসলে এই বানানগুলো হুমায়ুন আজাদ প্রচলিত রীতিতে লিখতেন না। তিনি যেমন পন্ডিত ছিলেন, তেমনিই ছিলেন বিদ্রোহী। ভাষাবিজ্ঞানে ছিল তার অসাধারণ দক্ষতা। আর তাই নিজে যেই বানানকে শুদ্ধ বলে জানতেন মানতেন, সেটিই ব্যবহার করতেন। সবাই মিলে কোনো বানানরীতি মেনে নিলেও তিনি তার মতের বিরুদ্ধে যেতেন না কোনোমতেই। অবশ্য তার বানানরীতিতে কোনো ভুল নেই। তাই বলে ভুল নেই বাংলা একাডেমির বানানরীতিতেও। তবে একই ভাষায় দুই রকমের বানানরীতি থাকা একদমই ঠিক নয়। তাই সকলেই বাংলা একাডেমি প্রণীত বানানরীতিকেই অনুসরণ করে। বাংলা একাডেমি প্রণীত বানানরীতি অনুসরণ করে কিডস-ও।]
বিডিনিউজটোয়েন্টিফোরডটকম/এনজে/সাগর/এপ্রিল ২৭/১২