কংক্রিটের কোলে সাগর লতার ফুল

১৯৯১ সালের প্রলয়ঙ্ককরী ঘূর্ণিঝড়ে চট্টগ্রাম শহর রক্ষা বাঁধ ভেঙে যায়। এরপর থেকে পতেঙ্গা সৈকতে আর সাগর লতার দেখা মেলেনি।

মিঠুন চৌধুরীমিঠুন চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 Nov 2023, 04:45 PM
Updated : 22 Nov 2023, 04:45 PM

সমুদ্র তীরে ভাঙন ঠেকাতে দেওয়া কংক্রিট ব্লকের ফাঁকে ফাঁকে সবুজ গালিচা পেতেছে সাগর লতারা, তার মাঝে ফুটে আছে গোলাপি-বেগুনি শত শত ফুল।  

চট্টগ্রামের পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত এলাকায় বেড়ি বাঁধের ব্লকে সাগর লতার এমন বাহারি আয়োজন নজর কাড়ছে পথ চলতি মানুষের।

স্থানীয়রা বলছেন, প্রায় দুই দশক পর পতেঙ্গা সৈকত এলাকায় সাগর লতার দেখা মিলেছে। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের আগে এই এলাকায় নিয়মিত সাগর লতার দেখা মিলত।

তবে ১৯৯১ সালের প্রলয়ঙ্ককরী ঘূর্ণিঝড়ে চট্টগ্রাম শহর রক্ষা বাঁধ ভেঙে যায়। এরপর থেকে পতেঙ্গা সৈকতে আর সাগর লতার দেখা মেলেনি।

পতেঙ্গা সৈকত থেকে রানী রাসমনি ঘাট পর্যন্ত সৈকত ঘেষা অংশে এখন আউটার রিং রোড। এই প্রকল্পে নতুন সড়কটির ভিত্তিকে ৩০ ফুট উঁচু ও ৩০০ ফুট প্রশস্ত করে বেড়িবাঁধ হিসেবে নির্মাণ করা হয়েছে। তার উপরেই তৈরি করা হয়েছে সড়কটি।

সাগরের ঢেউয়ের সাথে আসা বালি সৈকতে জমে সৃষ্টি হয় বালিয়াড়ি। নতুন সৃষ্টি হওয়া বালিয়াড়িতে জন্মায় সাগর লতা। আর এই লতা বালিয়াড়িকে স্থায়ীত্ব দিতে সহায়তা করে।

কিন্তু পতেঙ্গা সৈকতে সাগর তলা জন্মানোর সেই চিরাচরিত ঘটনাক্রমটি অনুসৃত হয়নি বলে মনে করছেন এক বিশেষজ্ঞ।

পাথরের ব্লকের ফাঁকে অল্প বালিতে কেন সাগর লতার এমন বিস্তার? শুধু সৈকত সংলগ্ন অংশে নয়, আউটার রিং রোডের বিপরীত পাশের ঢালেও জন্মেছে সাগর তলা।  

এর কারণ ব্যাখ্যা করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেসের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আল-আমীন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সাধারণত সাগর তীরে কোনো অংশে যখন নতুন বালিয়াড়ি হয় তখন সাগর লতা জন্মায়। বালিয়াড়ি ঘিরে সাগর লতা বাড়তে থাকে এবং তা বালিয়াড়িকে স্থায়ীত্ব দেয়। কক্সবাজারসহ অন্যান্য সৈকতে এমনটাই দেখা যায়।

“পতেঙ্গা সৈকতের তীরে পাথরের ব্লকের মাঝে সাগর লতা জন্মানো ও বিস্তারের অন্য কারণ আছে। আউটার রিং রোড তৈরির সময় সাগর তীর ঘেষা অংশ থেকে মাটি তুলে বেড়িবাঁধে দেওয়া হয়েছিল।”

ড. মোহাম্মদ আল-আমীন বলেন, “এতে দুটো বিষয় হয়েছে। প্রথমত সাগর থেকে যে মাটি তোলা হয়েছে, সেই শূন্যস্থান শূন্য থাকবে না। প্রাকৃতিক নিয়মে আশপাশের মাটি সরে সেই শূন্যস্থান ভরাট হবে। তাই ভাঙন ঠেকাতেই আউটার রিং রোডের সৈকতের ধার ঘেঁষা অংশে ব্লক বসাতে হয়েছে।

“আর এসব ব্লকের নিচের মাটি মূলত সাগর তীরের মাটি, যাতে বালির পরিমাণই বেশি। এখন জোয়ারে সাগর থেকে যেসব বালি আসছে তা ব্লকগুলোর মধ্যবর্তী খালি অংশে জমা হচ্ছে। সাগর লতা ওই অল্প বালিতে জন্মালেও যেহেতু গভীরে সাগরের বালি আছে, তাই লতার শেকড় সাগরের বালিই পাচ্ছে। যা সাগর লতার জন্য উপযোগী।”

আউটার রিং রোডের সৈকতের বিপরীতর পাশের ঢালে সাগর লতা জন্মানোর কারণও একই। পুরো আউটার রিং রোডটির ভিত তৈরিতে সাগর থেকে তোলা মাটির ব্যবহার করা হয়েছে।

এর প্রমাণ মেলে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ ২০১৮ সালের জুনে আউটার রিং রোড প্রকল্পের ‘নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদন’ এ।

সেখানে বলা হয়েছে- সাগরের পাড়ের মাটি দিয়ে বাঁধে মাটি ভরাট কাজ করা হয়েছে।

২০২০ সালে এই প্রকল্পের পরিচালক কাজী হাসান বিন শামস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, “সাগর তীরের মাটির সাথে বালি ও কাদার মিশ্রণে প্রতিটি লেয়ার (সড়কের ভিত্তির) তৈরি করা হয়। তারপর সেটি যাচাই করে পরের লেয়ার দেওয়া হয়।”

পতেঙ্গা সৈকতের টানেল সংলগ্ন অংশের একটু পরের অংশ থেকে আকমল আলী রোড পর্যন্ত অংশে পাথরের ব্লকে সাগর লতার দেখা মিলছে। ফুলও ফুটেছে প্রায় পুরো এলাকা জুড়ে।

আর আউটার রিং রোডের সৈকতের বিপরীত পাশের অংশ ঘেঁষে টোল রোড। আকমল আলী ঘাট এলাকা সংলগ্ন আউটার রিং রোডের ঢালে সাগর লতার বিস্তার দেখা গেছে, যা ঢাল বেয়ে নেমে পাশের টোল রোডকে ছুঁয়েছে কোথাও কোথাও। তবে এ অংশে সাগর লতার পরিমাণ তুলনামূলক কম।

অধ্যাপক মোহাম্মদ আল-আমীন বলেন, “সাগর লতার একটা নিজস্ব ইকোলজি আছে। সাগর তীরে পানি-আসা যাওয়া করার পর সেখানে জমা বালি কিছুটা স্থায়ী হলে সেখানে সাগর লতা জন্মায়। সাগর লতা জন্মানোর আগে আসে লাল কাঁকড়া।

“কিন্তু এখানে যেহেতু এই প্রক্রিয়া অনুসরণ হয়নি, তাই বালিয়াড়ি সৃষ্টি বা লাল কাঁকড়া আসার ঘটনা ঘটেনি।”

পতেঙ্গা এলাকার বাসিন্দা সাংস্কৃতিক সংগঠক মাজহারুল আলম তিতুমীর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, পতেঙ্গা সৈকত সংলগ্ন ফুলছড়ি পাড়ার পরে বিস্তৃত মাঠ ছিল একসময়। সেখানে দেশি তরমুজের চাষ হত। পতেঙ্গার তরমুজ নামে এর দেশজোড়া খ্যাত ছিল। মাঠের পরেই ছিলো বালুচর। বালুচর জুড়ে প্রচুর সাগর লতা আর ফুল দেখা যেত।

“৯১ এর ঘূর্ণিঝড়ের পরে আর সাগর লতা দেখা যায়নি। ঘূর্ণিঝড়ে বেড়ি বাঁধ ভেঙে যায়। বালুচর হারিয়ে যায়। এরপর আউটার রিং রোড নির্মাণ শুরু হয়। এতদিন পর আবার সাগর লতা দেখা যাচ্ছে। এটা সুন্দর। মনে হয় অনুকূল পরিবেশ পেয়েছে তাই ফিরছে সাগর লতা।”

সাগর লতার বৈজ্ঞানিক নাম Ipomoea pes-caprea; এটি Convolvulaceae গোত্রের উদ্ভিদ।

ইংরেজিতে সাধারণভাবে বিচ মর্নিং গ্লোরি, রেল রোড ভাইন, সি মর্নিং গ্লোরি ও গোট’স ফুট (ছাগল কুঁড়ি) এবং বাংলায় সাগর কলমি নামেও ডাকা হয়।

সবুজ কার্পেটের মত ছড়ানো লতার মাঝে হালকা বেগুনি রঙের ফুল। ফুলের মাঝের অংশ গাঢ় গোলাপি। আর পাতা অনেকটা ছাগলের খুর বা ঘোড়ার খুরের মত।

উত্তর আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ এবং বাংলাদেশের কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে সাগর লতার দেখা মেলে। কোভিড-১৯ সংক্রমণের সময় লকডাউনের অবকাশে কক্সবাজার সৈকতে নতুন সাগর লতার বিস্তার দেখা গিয়েছিল।

সাগর লতার বেগুনি ও গোলাপি-বেগুনি ফুল প্রজাপতি, মৌমাছি আর বিভিন্ন কীট পতঙ্গকে আকৃষ্ট করে।

ছড়ানো সবুজ লতা মাটিকে সূর্যের তাপ থেকে রক্ষা করে, যাতে মাটি থেকে অতিরিক্ত পানি বাস্পীভূত না হয়। এতে মাটির নিচের উপকারি ব্যাকটারিয়াসহ বিভিন্ন প্রাণির জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে সাগর লতা।