লালদীঘি হত্যা মামলার ৪ আসামি কারাগারে

চট্টগ্রামের লালদীঘি মাঠে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার জনসভার আগে গুলি চালিয়ে ২৪ জনকে হত্যার মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হয়েছে। 

চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 Jan 2020, 12:10 PM
Updated : 20 Jan 2020, 07:33 AM

রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তি উপস্থাপনের পর রোববার চট্টগ্রামের বিশেষ জজ আদালতের ভারপ্রাপ্ত বিচারক চট্টগ্রাম জেলা ও দায়রা জজ মো. ইসমাইল হোসেন এ মামলার চার আসামির জামিন বাতিল করে তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। 

এই চারজন হলেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের সে সময়ের কন্সটেবল মোস্তাফিজুর  রহমান, প্রদীপ বড়ুয়া, শাহ মো. আবদুল্লাহ ও মমতাজ উদ্দিন। 

এর আগে ১৪ জানুয়ারি ঘটনার ৩১বছর পর মামলাটির সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়। সেদিন আদালতে এই মামলার ৫৩ তম সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন আইনজীবী শম্ভুনাথ নন্দী। 

বিশেষ জজ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবি মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সাড়ে ১২টা থেকে ৪টা পর্যন্ত রাষ্ট্রপক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেছি। আদালত সোমবার আসামিপক্ষের যুক্তি উপস্থাপনের দিন ধার্য করেছেন।”

শুনানির বিষয়ে তিনি বলেন, “আদালতে বলেছি- সেসময়ের ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা এ মামলায় সাক্ষ্য দিয়ে আসামিদের চিহ্নিত করেছেন। সেদিন পুলিশ অফিসাররা উপস্থিত থাকার পরও আসামিরা পেট্রোল ইন্সপেক্টর জে সি মণ্ডলের নির্দেশে গুলি চালায়, এতে সাক্ষীদের সামনেই হতাহতের ঘটনা ঘটে।" 

তখনকার চান্দগাঁও থানার ওসি সাহাবুদ্দিনের দেওয়া সাক্ষ্য উদ্ধৃত করে এই আইনজীবী বলেন, “তিনি বলেছেন, ঘটনার আগেরদিন সেসময়ের পুলিশ কমিশনার রকিবুল হুদা লালদীঘি সমাবেশে বল প্রয়োগের কথা বললে অন্য কর্মকর্তারা বিরোধিতা করেছিলেন। তখন রকিবুল হুদা তাদের গালিগালাজ করেন। এতে বোঝা যায়, গুলিবর্ষণ ছিল পূর্ব পরিকল্পিত। এজন্য আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডই আদালতের কাছে প্রার্থনা করেছি।”

আগামী ২৪ জানুয়ারি লালদীঘি গণহত্যার দিনটির ৩২ বছর পূর্ণ হবে। 

১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি বন্দরনগরীর লালদীঘি মাঠে আওয়ামী লীগের জনসভা ছিল। ওই দিন বেলা ১টার দিকে শেখ হাসিনাকে বহনকারী ট্রাকটি আদালত ভবনের দিকে আসার সময় গুলিবর্ষণ শুরু হয়। 

বিভিন্ন সময় এই মামলার সাক্ষীরা আদালতে বলেছেন, ওই দিন পুলিশের গুলিতে মোট ২৪ জন মারা যান। 

গুলিবর্ষণের পর আইনজীবীরা মানববেষ্টনি তৈরির মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীকে রক্ষা করে তাকে আইনজীবী সমিতি ভবনে নিয়ে গিয়েছিলেন। 

গুলিতে নিহতদের কারও লাশ পরিবারকে নিতে দেয়নি তৎকালীন সরকার। হিন্দু-মুসলিম নির্বিচারে সবাইকে বলুয়ার দীঘি শ্মশানে পুড়িয়ে ফেলা হয়। 

হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সামরিক শাসনের অবসানের পর ঘটনার পর ১৯৯২ সালের ৫ মার্চ আইনজীবী মো. শহীদুল হুদা বাদী হয়ে এ মামলা দায়ের করেন। কিন্তু তখনকার বিএনপি সরকারের সময়ে মামলার কার্যক্রম এগোয়নি।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর মামলাটি পুনরুজ্জীবিত হয়। 

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর মামলাটি পুনরুজ্জীবিত হয়। আদালতের আদেশে সিআইডি মামলাটি তদন্ত করে ১৯৯৭ সালের ১২ জানুয়ারি প্রথম এবং অধিকতর তদন্ত শেষে ১৯৯৮ সালের ৩ নভেম্বর দ্বিতীয় দফায় অভিযোগপত্র দেয়া যাতে আসামি করা হয় আট পুলিশ সদস্যকে। 

আট আসামি হলেন- চট্টগ্রামের তখনকার পুলিশ কমিশনার মীর্জা রকিবুল হুদা, কোতোয়ালি অঞ্চলের পেট্রোল ইনসপেক্টর জে সি মণ্ডল, কনস্টেবল আব্দুস সালাম, মোস্তাফিজুর  রহমান, প্রদীপ বড়ুয়া, বশির উদ্দিন, শাহ মো. আবদুল্লাহ ও মমতাজ উদ্দিন। 

এদের মধ্যে রকিবুল হুদা, বশির উদ্দিন ও আব্দুস সালাম মারা গেছেন। জে সি মন্ডল পলাতক আছেন। বাকি চারজন জামিনে ছিলেন।  

মামলার বাদী মো. শহীদুল হুদা মারা গেছেন। মারা গেছেন সর্বশেষ তদন্ত কর্মকর্তা এএসপি আব্দুল কাদেরও। 

২০০১ সালের মে থেকে ২০০৬ সালের ২৩ অগাস্ট এবং ২০০৯ সালের ২৬ জুলাই থেকে ২০১৬ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত এ মামলায় কারও সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি।

২০১৬ সালে মামলাটি চট্টগ্রামের বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতে আসার পর আবার সাক্ষ্যগ্রহণ গতি পায়। 

এরমধ্যে ২০১৬ সালের ২৬ জুন সাক্ষ্য দেন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আওয়ামী লীগ নেতা গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন।

তারপর নিহতের মা শেফালী সরকার, সাংবাদিক অঞ্জন কুমার সেন ও হেলাল উদ্দিন চৌধুরী, সুভাষ চন্দ্র লালা, নিহতের ভাই অশোক কুমার বিশ্বাস, নিহতের মা হাসনা বানু, নিহতের ভাই মাঈনুদ্দিন, আবু সৈয়দ এবং অশোক বিশ্বাস সাক্ষ্য দেন। 

এছাড়াও সাক্ষী হিসেবে আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রাজ্জাক, এম এ জলিল, এম এ মান্নান, আখাতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু এবং আতাউর রহমান খান কায়সারের ছিল। তারা গত কয়েক বছরে মারা গেছেন।

আদালতে দেওয়া সাক্ষ্যে ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বলেছিলেন, ‘শেখ হাসিনাকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে’ সেদিন গুলি চালানো হয়েছিল। ভাগ্যক্রমে তা তার গায়ে লাগেনি। বিনা উসকানিতে সেদিন ‘পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড’ ঘটানো হয়েছিল।

চট্টগ্রামের তখনকার পুলিশ কমিশনার ও মামলার আসামি রকিবুল হুদার নির্দেশে ওই ঘটনা ঘটানো হয় বলে আদালতকে বলেন মোশাররফ।

ওই দিনের ঘটনায় নিহতরা হলেন- মো. হাসান মুরাদ, মহিউদ্দিন শামীম, স্বপন কুমার বিশ্বাস, এথলেবার্ট গোমেজ কিশোর, স্বপন চৌধুরী, অজিত সরকার, রমেশ বৈদ্য, বদরুল আলম, ডি কে চৌধুরী, সাজ্জাদ হোসেন, আব্দুল মান্নান, সবুজ হোসেন, কামাল হোসেন, বি কে দাশ, পঙ্কজ বৈদ্য, বাহার উদ্দিন, চান্দ মিয়া, সমর দত্ত, হাসেম মিয়া, মো. কাসেম, পলাশ দত্ত, আব্দুল কুদ্দুস, গোবিন্দ দাশ ও শাহাদাত।