গম্বুজ তিনটি; বড় গম্বুজটি ঘিরে মিনার আছে আটটি; সব মিলিয়ে মিনার ২০টি।
Published : 19 Mar 2025, 08:29 AM
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন শুরুর দশক তিনেক পরে চট্টগ্রামে উত্তর হালিশহরে মুগল স্থাপত্যরীতিতে শুধু চুন আর সুরকিতে নির্মিত হয় আসগর আলী চৌধুরী জামে মসজিদ, যেটি এখনো টিকে আছে ইতিহাসের স্মারক হয়ে।
১৭৯৫ সালে নির্মিত আসগর আলী চৌধুরী জামে মসজিদে এখনো বছরের ১১ মাস ফজরের নামাজ হয়।
প্রতি শুক্রবার চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকার মানুষ এখানে নামাজ পড়তে আসেন, যেখানে ‘প্রাচীন’ ও ‘আধুনিক’ স্থাপত্যরীতির যুগলবন্দিরও দেখা মেলে।
আট বছর আগে ঐতিহ্যবাহী মসজিদটি সংস্কার করা হয়। সংস্কারের দুবছর আগে প্রাঙ্গণে নির্মাণ করা হয় ‘আধুনিক স্থাপত্যরীতির’ একটি মসজিদও।
উত্তর হালিশহরের চৌধুরীপাড়ায় অছি মিয়া চৌধুরী সড়কে প্রবেশ করতেই পশ্চিম পাশে চোখে পড়ে সীমানা দেয়াল ঘেরা মসজিদটি। আর পূর্ব পাশেই আসগর আলী চৌধুরী জমিদার বাড়ি। বাড়িটি মসজিদের সমসাময়িক।
মসজিদ নিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে কথা হয় জমিদার আসগর আলী চৌধুরী পরিবারের ষষ্ঠ প্রজন্মের উত্তরসূরি গিয়াস উদ্দিন চৌধুরীর।
তিনি বলেন, মসজিদ নির্মাণ করেন আসগর আলী চৌধুরী, উনার বাবা ছিলেন গোলাম হোসেন চৌধুরী।
“আসগর আলী চৌধুরী জমিদারির গোড়াপত্তন করেন। বাড়িটিও তার বানানো। আসগর আলী চৌধুরীর দুই ছেলে- অছি মিয়া চৌধুরী ও গণি মিয়া চৌধুরী। গণি মিয়া চৌধুরী ২২ বছর বয়সে অবিবাহিত অবস্থায় মারা যান।”
গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী বলেন, “অছি মিয়া চৌধুরী পূর্বপুরুষের সম্পত্তি ১৯৩৪ সালে উত্তরসূরিদের নামে একটা ওয়াকফ এস্টেট করে গেছেন। এটি ৫২৩ একরের। পতেঙ্গা, হালিশহর, সুজা কাঠগড়- এ তিন মৌজায় এসব জমি।
“উনার পাঁচ ছেল। অছি মিয়া মারা যাওয়ার পর এই মসজিদ, পুকুর, বাড়ি সবই ওই সম্পত্তি থেকে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। মসজিদ পরিচালনার ব্যবস্থা আছে। এ কাজে বাইরের কারো আর্থিক সহযোগিতা নেওয়া হয় না।”
মসজিদটির সামনের অংশের দেয়ালজুড়ে নকশা। ১০ শতক জায়গার ওপর মসজিদের চার প্রান্তে চারটি বড় নকশাকরা পিলার। প্রতিটির চূড়ায় মিনার আছে।
চারপাশের দেয়ালের মাঝের অংশে আরও দুটি করে ছোট আকারের পিলার আছে। এই আটটি পিলারের শীর্ষেও আছে মিনার।
গম্বুজ তিনটি। বড় গম্বুজটি ঘিরে মিনার আছে আটটি। সব মিলিয়ে মিনারের সংখ্যা ২০টি। মুঘল স্থাপত্যরীতি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো স্থাপনায় গম্বুজ ও মিনারের ব্যবহার, যা আসগর আলী চৌধুরী জামে মসজিদে দেখা যায়।
মসজিদটির স্থাপত্যরীতির বিষয়ে জানতে চাইলে গবেষক জামাল উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটি ১৭৯৫ সালে নির্মিত। তার আগে ১৭৬১ সালে চট্টগ্রাম ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনে আসে। তার কয়েক বছর পরে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়।
“তখন এ অঞ্চলে কেবল ব্রিটিশ যুগ শুরু। তাই মসজিদটি মুঘল যুগের না হলেও এর নির্মাণ কাজে মুঘল স্থাপত্য রীতিকে অনুসরণ করা হয়েছে।”
গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী বলেন, “তখন এই অঞ্চলে নির্মাণকাজের কারিগর আসত রেঙ্গুন-আকিয়াব (মিয়ানমারের দুটি অঞ্চল) থেকে। এই মসজিদ নির্মাণেও সেখান থেকে কারিগর আসার কথা শুনেছি। তবে সে বিষয়ে লিখিত কিছু নেই। সাগর তীরের বসতি হওয়ায় ঝড়-বন্যায় অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে।
“মসজিদের মেঝে তৈরির জন্য ইউরোপ থেকে জাহাজে করে সিমেন্ট আনা হয়েছিল। সেই সিমেন্টের দুটি পিপা (কাঠের ড্রাম) বেঁচে গিয়েছিল। সেগুলো পাথরের মত শক্ত হয়ে বহু বছর পরেও পড়েছিল।”
আসগর আলী চৌধুরী জামে মসজিদের মোয়াজ্জিন আরিফুল ইসলাম বলেন, “পুরনো মসজিদে তিন কাতারে ১০ জন করে ইমামসহ ৩১ জন নামাজ পড়তে পারেন। পুরনো মসজিদটিতে বছরের ১১ মাস ফজরের নামাজ হয়। বাকি চার ওয়াক্তের নামাজ হয় নতুন মসজিদে।
“রমজানে ফজরের নামাজে মানুষ বেশি হয়। তাই রোজার সময় পাঁচ ওয়াক্ত নামাজই নতুন মসজিদে হয়।”
মসজিদটির ভেতরে ঢুকতেই দেখা যায়, সারিবদ্ধভাবে জায়নামাজ বিছানো।
কিন্তু আট বছর আগে মসজিদটি এতটা পরিপাটি ছিল না। জৌলুস হারিয়ে অনেকটা বিবর্ণ হয়ে পড়েছিল তখন। বন্ধ হয়ে গিয়েছিল নামাজ পড়াও।
গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী জানান, “মসজিদটি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, এখন যে অবস্থায় দেখছেন, তা ছিল না। আমরা ঢাকায় প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরে যোগাযোগ করার পর উনারা বিশেষজ্ঞ পাঠিয়েছিলেন।
“প্রায় ৬০ লাখ টাকায় সংস্কার করা হয়। কাজটা উনারা করেছেন, টাকাটা আমরা দিয়েছি। হুবহু যা ছিল, তা করে দিয়েছেন।”
সংস্কার কাজেও চুন আর সুরকি ব্যবহারের তথ্য দিয়ে তিনি বলেন, “মসজিদটির মেঝে নির্মাণের সিমেন্ট আনা হয়েছিল ইউরোপ থেকে। মসজিদে যত কারুকাজ দেখছেন সেগুলো একটিও পোড়ামাটির কাজ নয়। সব চুন সুরকির কাজ।”
মসজিদের উত্তর-দক্ষিণে দুই পাশে দুটি জানালার আকৃতির অবকাঠামো। তা দিয়ে আলো-বাতাস চলাচল করে। ভেতরে প্রতিটি দেয়ালে আছে দুটি করে কুলঙ্গি। ছাদের গম্বুজ ঘিরেও আছে নকশা।
মসজিদের উত্তর পাশেই কবরস্থান। সেখানেই জমিদার আসগর আলী চৌধুরী পরিবারের সদস্যদের শেষ ঠিকানা। কবরস্থানের পাশেই পুকুর। আর সেই পুকুরের পাড় ঘেঁষে নতুন মসজিদটি।
নতুন মসজিদের তিন দিকে জলাধার। উত্তর ও পশ্চিম প্রান্ত খোলা।
স্থানীয় বাসিন্দা নিজামুল হক বলেন, বিভিন্ন এলাকা থেকে অনেকে পুরনো মসজিদটি দেখতে আসেন। নতুন মসজিদটি হওয়ার পর ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূতও এসেছিলেন।