শামীমের দুর্দান্ত ইনিংস ছাপিয়ে রংপুর রাইডার্সকে হারিয়ে বিপিএলের ফাইনালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের সামনে ফরচুন বরিশাল।
Published : 28 Feb 2024, 09:22 PM
ডেভিড মিলারের ব্যাট থেকে উড়ে আসা বল সীমানায় হাতে জমানোর চেষ্টা করলেন শামীম হোসেন। ডাইভও দিলেন শেষ মুহূর্তে। কিন্তু বল তো সীমানার বাইরে! শামীম যখন সেখানে ভূপাতিত, মাঠের ভেতরে তখন উল্লাসে মেতে উঠেছেন মুশফিকুর রহিম ও ডেভিড মিলার। তাদের ডাগ আউটেও আনন্দের জোয়ার। গোটা ম্যাচের প্রতীকি হয়ে রইল তা। অসাধারণ এক ইনিংস খেলে রংপুরকে লড়ার মতো রান এনে দিয়েছিলেন শামীম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার ইনিংস ছাপিয়ে দারুণ জয়ে ফাইনালে পৌঁছে গেল বরিশাল।
বিপিএলের দ্বিতীয় কোয়ালিফায়ার ম্যাচে রংপুর রাইডার্সকে ৬ উইকেটে হারাল ফরচুন বরিশাল।
ফাইনালে ওঠার লড়াই বা কোয়ালিফায়ার ম্যাচ ছাপিয়ে এটি হয়ে উঠেছিল যেন সাকিব আল হাসান ও তামিম ইকবালের দ্বৈরথ। ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সে সেখানে ব্যর্থ দুজনই। তবে দলীয় লড়াইয়ে হাসি তামিমের। শুক্রবার ফাইনালে তাদের প্রতিপক্ষ বিপিএলের রেকর্ড চারবারের চ্যাম্পিয়ন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স।
মিরপুর শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে বুধবার ২০ ওভারে ৭ উইকেট ১৪৯ রান তোলে রংপুরে। ৭৭ রানে ৭ উইকেট হারানো দল দেড়শর কাছে যেতে পারে মূলত শামীমের সৌজন্যে। আট নম্বরে নেমে ২৪ বলে ৫৯ রানের ইনিংস খেলেন তরুণ এই ব্যাটসম্যান।
তবে সম্মিলিত পারফরম্যান্সে সেই রান ৯ বল বাকি থাকতেই টপকে যায় বরিশাল। মুশফিকুর রহিম এক পাশ আগলে রেখে ৩৮ বলে ৪৭ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলে দলকে নিয়ে যান জয়ের ঠিকানায়।
বিপিএল রেকর্ড ৪টি ক্যাচ নেওয়ার পর ব্যাট হাতে এই ইনিংস খেলে ম্যাচের সেরা মুশফিক।
ফাইনালে যাওয়ার দুটি সুযোগেই হেরে গিয়ে বাদ পড়ে গেল প্রাথমিক পর্বে শীর্ষে থাকা রংপুর।
মাঝারি রান তাড়ায় বরিশালের প্রথম তিন ওভার ছিল নিস্তরঙ্গ। সাবধানী ব্যাটিংয়ে শুরু করেন দুই ওপেনার তামিম ইকবাল ও মেহেদী হাসান মিরাজ। চতুর্থ ওভারে আক্রমণে এসে দুজনকেই ফিরিয়ে দেন আবু হায়দার। তুলে মারার চেষ্টায় মিড অফে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন ৮ বলে ১০ রান করা তামিম। মিরাজ এলবিডব্লিউ হন ১৪ বলে ৮ করে।
সেই ধাক্কা অনেকটাই সামাল দিয়ে তৃতীয় উইকেটে ৩৭ বলে ৪৭ রানের জুটি গড়েন সৌম্য সরকার ও মুশফিক।
জুটির শুরুতে মুশফিক ছিলেন আগ্রাসী। নিশামের বলে একটি ছক্কা পান তিনি ব্যাটের ওপরের কানায় লেগে। ওই ওভারে দুটি চারও মারেন তিনি। ধীরস্থির শুরুর পর আবু হায়দারের এক ওভারে এক ছক্কা ও দুই চার মারেন সৌম্য।
বিস্ময়করভাবে, মোহাম্মদ নাবি ও সাকিব আল হাসানকে আক্রমণে আনতে বেশ দেরি করেন রংপুর অধিনায়ক নুরুল হাসান সোহান। দশম ওভারে এসেই জুটি ভাঙেন নাবি। ১৮ বলে ২২ রান করা সৌম্য ফেরেন স্টাম্পড হয়ে।
তখনও ম্যাচ দোদুল্যমান। ১০ ওভারে বরিশালের রান ৩ উইকেটে ৬৯। শেষ ১০ ওভারে প্রয়োজন ৮১ রান।
পরের জুটিতেই ম্যাচ হেলে পড়ে বরিশালের দিকে। মুশফিক ও কাইল মেয়ার্সের জুটিতে ৫০ রান আসে ২৭ বলে।
টুর্নামেন্টে পা রাখার পর থেকেই দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে বরিশাল দলের চেহারা পাল্টে দেওয়া মেয়ার্স এ দিনও ঘুরিয়ে দেন ম্যাচের মোড়। পাঁচে নেমে চোখধাঁধানো তিনটি ছক্কাসহ ১৫ বলে ২৮ রান করেন ক্যারিবিয়ান অলরাউন্ডার।
তিনি বিদায় নেওয়ার পর বাকি পথটুকু অনায়াসেই পাড়ি দেন মুশফিক ও ডেভিড মিলার। ২৪ বলে ৩৩ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটি গড়েন দুজন। ১৮ বলে ২২ রানে অপরাজিত রয়ে যান মিলার।
ফাইনালে অবশ্য মিলারকে পাবে না বরিশাল। বিয়ের জন্য দেশে ফিরে যাবেন দক্ষিণ আফ্রিকান ব্যাটসম্যান।
সপ্তম বোলার হিসেবে একাদশ ওভারে আক্রমণে আসেন বিপিএলের সব আসরের সফলতম বোলার সাকিব। ওই ওভারে ১১ রান দেওয়ার পর আবার বোলিং পান তিনি একদম শেষ দিকে। তার বলে ছক্কা মেরেই ম্যাচ শেষ করে দেন মিলার।
টস হেরে ব্যাটিংয়ে নামা রংপুরের ইনিংসকে পরিষ্কার দুটি ভাগে আলাদা করা যায়- প্রথম ১৫ ওভার আর পরের ৫ ওভার। কিংবা বলা যায়, শামীমের আগে আর শামীমের সময়।
রংপুরের স্কোর এক পর্যায়ে একশ হওয়া নিয়েই ছিল টানাটাননি। ১৫ ওভার শেষে রান ছিল ৭ উইকেটে ৮৩। কিন্তু ২০ ওভার শেষে সেই স্কোর পৌঁছে যায় দেড়শর কাছে। কারণ, তখন ছিলেন শামীম!
টস জিতে বোলিংয়ে নামা বরিশাল শুরু থেকেই চেপে ধরে রংপুরকে। ম্যাচের দ্বিতীয় ওভারেই দুটি উইকেট নেন মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন।
ওভারের প্রথম বলে বিদায় নেন ওপেনিংয়ে নামা শেখ মেহেদি হাসান (২)। ওভারের শেষ বলে আরও বড় ধাক্বা খায় রংপুর। পুল করার চেষ্টায় উইকেট হারান সাকিব আল হাসান (১)।
বেশি কিছুটা সময় উইকেটে থেকে রনি তালুকদার বিদায় নেন ১২ বলে ৮ রান করে। প্রথম ৫ ওভারে ব্যাট থেকে কোনো বাউন্ডারিই আসেনি। ষষ্ঠ ওভারে প্রথম বাউন্ডারি মারেন জিমি নিশাম।
পাওয়ার প্লেতে রংপুর করে ৩ উইকেটে ২৬ রান।
নিশাম পরে টানা তিনটি বাউন্ডারি মারেন কাইল মেয়ার্সকে। এর দুটিই অবশ্য আসে ব্যাটের কানায় লেগে। তবে আরেকপ্রান্তে ছন্দ পেতে ধুঁকছিলেন নিকোলাস পুরান।
দুই প্রান্তে বাঁহাতি ব্যাটসম্যান দেখে অফ স্পিনার মেহেদী হাসান মিরাজকে আক্রমণে আনেন বরিশাল অধিনায়ক। কাজ হয়ে যায় দ্রুতই। মিরাজের প্রথম ওভারেই পুরান বিদায় নেন ১২ বলে ৩ রান করে। পরের ওভারে জেমস ফুলারের শর্ট বলে জিমি নিশাম উইকেটের পেছনে ধরা পড়েন ২২ বলে ২৮ করে।
ফুলার একটু পরে ছেড়ে দেন মোহাম্মদ নাবির সহজ ক্যাচ। তবে সেটি পুষিয়ে দেন এই ইংলিশ পেসার নিজেই। এক ওভারেই ফিরিয়ে দেন নাবি (১৫ বলে ১২) ও নুরুল হাসান সোহানকে (১৭ বলে ১৪)।
রংপুরের রান তখন ৭ উইকেটে ৭৭।
আবু হায়দার ক্রিজে গিয়ে প্রথম বলেই দারুণ এক শটে ছক্কা মারেন সোজা ব্যাটে। তবে এরপর তিনি হয়ে যান দর্শক। খ্যাপাটে হয়ে ওঠেন শামীম।
মিরাজকে দুর্দান্ত রিভার্স সুইপে ছক্কায় উড়িয়ে শামীমের পাল্টা আক্রমণের শুরু। পরের ওভারে ছক্কা ও চার মারেন ওবেড ম্যাককয়কে।
ক্যারিবিয়ান এই বাঁহাতি পেসারের পরের ওভারে সত্যিকারের ধ্বংসলীলা চালান শামীম। রিভার্স স্কুপ করে দুটি ছক্কা মারেন তিনি উইকেটের পেছন দিয়ে, কবজির জোরে আরেকটি ছক্কা মিড উইকেট দিয়ে। ওই ওভারে তিনি বাউন্ডারিও মারেন দুটি।
২৪ রান থেকে এক ওভারেই ছুটে যান তিনি ফিফটিতে। ২০ বলে স্পর্শ করেন পঞ্চাশ, যৌথভাবে যা এবারের বিপিএলের দ্রুততম ফিফটি।
শেষ ওভারে আরেকটি বাউন্ডারিতে শামীম শেষ করেন ৫৯ রান নিয়ে। আবু হায়দারের সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন অষ্টম উইকেট জুটিতে রান আসে ৭২। তাতে শামীমের অবদান ৫৮, আবু হায়দারের ১২।
শেষ ৪ ওভারে রংপুর তোলে ৬০ রান।
তাতে ম্যাচ জমে ওঠার রসদ ছিল। কিন্তু পেশাদার রান তাড়ায় রংপুরকে লড়াই জমাতেই দিল না বরিশাল।
বরিশালের ফ্র্যাঞ্চাইজির এটি চতুর্থ ফাইনাল। ২০১২ আসরে ফাইনালে খেলেছিল বরিশাল বার্নার্স, ২০১৫ আসরে বরিশাল বুলস। এই ফরচুন বরিশাল ফাইনালে খেলে ২০২২ সালে। আগের সব ফাইনালেই তারা হেরেছে। এবার শিরোপার হাতছানি থাকছে আবার।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
রংপুর রাইডার্স: ২০ ওভারে ১৪৯/৭ (রনি ৮, মেহেদি ২, সাকিব ১, নিশাম ২৮, পুরান ৩, নাবি ১২, সোহান ১৪, শামীম ৫৯*, আবু হায়দার ১২*; মেয়ার্স ৪-০-২২-১, সাইফ ৪-০-২৭-২, ম্যাককয় ৪-০-৫৩-০, ফুলার ৪-০-২৫-৩, মিরাজ ২-০-৯-১, তাইজুল ২-০-৯-০)।
ফরচুন বরিশাল: ১৮.৩ ওভারে ১৫২/৪ (মিরাজ ৮, তামিম ১০, সৌম্য ২২, মুশফিক ৪৭*, মেয়ার্স ২৮, মিলার ২২* ; ফারুকি ৪-০-১৬-১, মেহেদি ২-০-২৫-০, আবু হায়দার ৪-০-৩৭-২, নিশাম ১-০-১৬-০, হাসান ৩-০-১৭-০, নাবি ৩-০-২০-১, সাকিব ১.৩-০-১৭-০)।
ফল: ফরচুন বরিশাল ৬ উইকেটে জয়ী।
ম্যান অব দা ম্যাচ: মুশফিকুর রহিম।