কিংবদন্তি সোবার্সের ৫ অমর কীর্তি

ব্যাটিংয়ে তাকে রাখতে হয় সর্বকালের সেরাদের ছোট্ট তালিকায়। শুধু বোলিং দিয়েও জায়গা করে নিতে পারতেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে। ফিল্ডিংয়ে ছিলেন অসাধারণ। সব মিলিয়ে স্যার গ্যারি সোবার্স যেন আদর্শ এক অলরাউন্ডারের প্রতিচ্ছবি। সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে যেমন প্রায় অবিসংবাদিত স্যার ডন ব্র্যাডম্যান, তেমনি সোবার্সকে মনে করা হয় সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার। জীবনের পথচলায় এই ক্যারিবিয়ান কিংবদন্তি পূর্ণ করলেন ৮৪ বছর।

স্পোর্টস ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 July 2020, 06:51 AM
Updated : 28 July 2020, 06:51 AM

১৯৩৬ সালের ২৮ জুলাই বারবাডোজে জন্ম সোবার্সের। শৈশব থেকেই তাক লাগিয়ে গিয়েছিলেন বহুমুখি প্রতিভায়। ফুটবল, বাস্কেটবল ও গলফ খেলেছেন বারবাডোজের হয়ে। তবে ক্রিকেট ছিল তার সবচেয়ে ভালোবাসার জায়গা। ক্যারিয়ার হিসেবেও বেছে নেন প্রিয় খেলাকেই।

১৭ বছর বয়সে সোবার্সের টেস্ট অভিষেক, ২১ বছর বয়সে উপহার দিয়েছেন রেকর্ড গড়া ট্রিপল সেঞ্চুরি। সময় যত গড়িয়েছে, তার অবিশ্বাস্য ক্রিকেট সামর্থ্যের ঝলকে আলোকিত করেছেন ক্রিকেট বিশ্বকে।

বলা হতো, তিনি ‘ক্রিকেটিং জিনিয়াস’, এমন কিছু নেই যার করেননি। স্বয়ং ব্র্যাডম্যান বলেছিলেন, ‘এই পৃথিবীতে বিচরণ করা সেরা শ্রেষ্ঠ ক্রিকেটীয় সত্ত্বা সোবার্স।’

৯৩ টেস্ট খেলে ৮০৩২ রান করেছেন চোখধাঁধানো গড়ে, ৫৭.৭৮। ২৬ সেঞ্চুরির পাশে ফিফটি ৩০টি। এই পরিসংখ্যান তার গ্রেটনেস ফুটিয়ে তোলে বটে, তবে ব্যাটসম্যান সোবার্স ছিলেন আসলে পরিসংখ্যানের চেয়েও বেশি কিছু। সেই পঞ্চাশ-ষাটের দশকেও তিনি ছিলেন দারুণ আগ্রাসী। বিনোদনদায়ী ব্যাটিংয়ে মাতিয়েছেন, অফ সাইডে ছিলেন অবিস্মরণীয়। তার ব্যাটিংয়ে ছিল পেশীশক্তি আর নান্দনিকতার অপরূপ মিশেল।

বল হাতে ক্যারিয়ারে নিয়েছেন ২৩৫ উইকেট। যথারীতি এখানেও, পরিসংখ্যানে ফুটে ওঠে না সবটা। সোবার্স ছিলেন বোলিং বৈচিত্রের আধার। বাঁহাতি অর্থোডক্স স্পিন যেমন করতেন, তেমনি করতেন চায়নাম্যানও। আবার পেস বোলিংয়েও ছিলেন নতুন-পুরোনো, সব বলেই দক্ষ। সুইং ও চাতুর্যে নাকাল করে ছাড়তেন ব্যাটসম্যানদের।

ফিল্ডিংয়ে স্লিপে তিনি সবসময়ের সেরাদের একজন, মাঠের যে কোনা জায়গাতেও দুর্দান্ত। টেস্ট ক্যারিয়ারে নিয়েছেন ১০৯ ক্যাচ।

বলা হয়, কেবল নেতৃত্বেই তিনি সর্বকালের সেরাদের উচ্চতায় নেই। তার নেতৃত্বের কিছু খুঁত চোখে পড়ে অনেকেরই। তবে এখানেও সাফল্য পেয়েছেন বেশ। ৩৯ টেস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে টস করেছেন। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ক্যারিবিয়ানদের প্রথম সিরিজ জয় এসেছিল তার অধিনায়কত্বেই।

সোবার্সের জন্মদিনে তার অসংখ্য স্মরণীয় কীর্তির ভাণ্ডার থেকে তুলে ধরা হলো ৫টি দারুণ অর্জন।

প্রথম সেঞ্চুরিতেই চূড়ায়

১৭ বছর বয়সে টেস্ট অভিষেকের পর থেকে সোবার্স প্রতিভার প্রতি সুবিচার ততটা করতে পারছিলেন না। অভিষেকে ব্যাট করেছেন ৯ নম্বরে। খুব ভালো না করলেও পরের টেস্টে উঠিয়ে আনা হয় ৬ নম্বরে। এরপর ওপেনিং থেকে তিন নম্বর, পাঁচ-ছয়-সাত-আট, বিভিন্ন পজিশনে ব্যাট করেছেন। তবে থিতু হয়েও আউট হয়ে যাচ্ছিলেন বারবার। ফিফটি বা সম্ভাবনাময় শুরুতে রূপ দিতে পারছিলেন না সেঞ্চুরিতে।

অবশেষে যখন সেঞ্চুরি করলেন সোবার্স, সেটিকেই তুলে নিলেন ইতিহাস গড়া উচ্চতায়। ১৭তম টেস্টে এসে প্রথম সেঞ্চুরির স্বাদ পেলেন, পাকিস্তানের বিপক্ষে ১৯৫৮ সালে জ্যামাইকায়। এতদিনের ক্ষুধা মিটিয়ে নিলেন যেন এক ইনিংসেই। ডাবল সেঞ্চুরি ছুঁয়ে, ট্রিপল সেঞ্চুরি পেরিয়েও থামাথামি নেই। শেষ পর্যন্ত দল যখন ইনিংস ঘোষণা করল, সোবার্স অপরাজিত ৩৬৫ রানে। বিশ্বরেকর্ড!

লেন হাটনের ৩৬৪ রানের রেকর্ড ভাঙল প্রায় ২০ বছর পর। ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রানের ইনিংস খেলে চমকে দিলেন সোবার্স। তার এই রেকর্ড টিকে ছিল ৩৬ বছর, ১৯৯৪ সালে যেটি পেরিয়ে যান ব্রায়ান লারা।

তবে ওই ইনিংসের একটি রেকর্ড টিকে আছে এখনও, ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরিকে এত বড় ইনিংসে রূপ দিতে পারেননি আর কেউ। এই রেকর্ডের বয়স পেরিয়ে গেছে ৬২ বছর।

সর্বকনিষ্ঠ ট্রিপল সেঞ্চুরিয়ান

অপরাজিত ৩৬৫ রানের ইনিংসটির এই রেকর্ডও টিকে আছে ৬২ বছর ধরে। পাকিস্তানের বিপক্ষে ইনিংসটি সোবার্স খেলেছিলেন ২১ বছর ২১৩ দিন বয়সে (বয়সের রেকর্ডের ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেওয়া হয় ম্যাচ শুরুর দিন)। এখনও তা সবচেয়ে কম বয়সে ট্রিপল সেঞ্চুরির রেকর্ড।

সোবার্স ভেঙেছিলেন স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের রেকর্ড। সাবেক অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যানের প্রথম ট্রিপল সেঞ্চুরির সময় বয়স ছিল ২১ বছর ৩১৮ দিন। টেস্ট ইতিহাসে আর কেউ ২২ পূর্ণ হওয়ার আগে তিনশ করতে পারেননি। এই শতাব্দিতে সর্বকনিষ্ঠ ট্রিপল সেঞ্চুরিয়ান ভারতের করুন নায়ার, ২০১৬ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে, ২৫ বছর ১০ দিন বয়সে।

৮ হাজারে প্রথম 

টেস্ট ইতিহাসে ৮ হাজার রানের মাইলফলক স্পর্শ করা প্রথম ব্যাটসম্যান সোবার্স। ১৯৭২ সালে ইংল্যান্ডের কলিন কাউড্রেকে ছাড়িয়ে টেস্টে সবচেয়ে বেশি রানের রেকর্ড নিজের করে নেন তিনি। এরপর ক্যারিয়ারের শেষ সিরিজে (১৯৭৪ সালে) পা রাখেন ৮ হাজারের সীমানায়।

টেস্টে সবচেয়ে বেশি রানের সোবার্সের রেকর্ড টিকে ছিল ৯ বছরের বেশি। ১৯৮১ সালে তাকে ছাড়িয়ে যান জেফ বয়কট। তবে ৮ হাজার রান করা ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সোবার্সের ব্যাটিং গড় এখনও ইতিহাসে সর্বোচ্চ।

ছয় বলে ছয় ছক্কা

সোবার্সের সবচেয়ে স্মরণীয় কীর্তিগুলোর শুরুর দিকে রাখা হয় এটিকে। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে এক ওভারে ছয় বলের সবকটিতে ছক্কা মারার প্রথম কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন তিনিই।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের পাশাপাশি নটিংহ্যামশায়ারের হয়ে কাউন্টি ক্রিকেটেও দীর্ঘদিন দাপটে খেলেছেন সোবার্স। ৭ হাজারের বেশি রান করেছেন এই কাউন্টির হয়ে, উইকেট নিয়েছেন ২৮১টি। এই পরিক্রমায়ই ১৯৬৮ সালে গ্ল্যামরগনের পেসার ম্যালকম ন্যাশকে উড়িয়েছিলেন ছয় ছক্কায়।

প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে সোবার্সের পর ওভারে ছয় ছক্কা মারতে পেরেছেন আর কেবল ভারতের রবি শাস্ত্রি।

অলরাউন্ড ঝলক

অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, এক সিরিজে অন্তত ৩০০ রান ও ২০ উইকেটের ‘ডাবল’ সোবার্স করে দেখিয়েছেন তিনবার!

১৯৬২ সালে ভারতের বিপক্ষে ৫ টেস্টের সিরিজে সোবার্স রান করেছিলেন ৪২৪, উইকেট নিয়েছিলেন ২৩টি। পরের বছর ইংল্যান্ডে ৫ টেস্টের সিরিজে ৩২২ রান করার পাশাপাশি উইকেট নিয়েছিলেন ২০টি।

এরপর ১৯৬৬ সালে ইংল্যান্ড সফরে বলতে গেলে একাই হারিয়ে দিয়েছিলেন ইংলিশদের। স্মরণীয় সেই সিরিজে ৫ টেস্টে রান করেছিলেন ৭২২, উইকেট নিয়েছিলেন ২০টি।

ওই সিরিজে সোবার্স ক্যাচও নিয়েছিলেন ১০টি। ৭০০ রান বা ২০ উইকেট তো বহুদূর, এক সিরিজে ৫০০ রান, ১০ উইকেট ও ১০ ক্যাচের ‘ট্রিপল’ নেই ইতিহাসে আর কারও।