‘বাংলাদেশকে জেতানোর চেয়ে তৃপ্তির কিছু আর নেই’

এক সময় তার টি-টোয়েন্টি সামর্থ্য নিয়ে ছিল প্রশ্ন। সেই তিনিই শ্রীলঙ্কায় ত্রিদেশীয় সিরিজে দলকে উপহার দিয়েছেন স্মরণীয় জয়। ক্যারিয়ার জুড়ে জিতেছেন অসংখ্য চ্যালেঞ্জ। দলের প্রয়োজনে নিজের ক্যারিয়ারে অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন হাসিমুখে। আক্ষেপ তবু বিন্দুমাত্র নেই, মাহমুদউল্লাহর কাছে দেশই সবার আগে। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটককে দেওয়া দীর্ঘ একান্ত সাক্ষাৎকারে এই সিনিয়র ক্রিকেটার কথা বললেন তুমুল আলোচিত ত্রিদেশীয় সিরিজ, নিজের ক্যারিয়ারের নানা বাঁক আর এগিয়ে চলা নিয়ে।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 April 2018, 04:34 PM
Updated : 4 April 2018, 04:40 PM

ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনাল হারের পর দুই সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। হারের বেদনা কতটা কমেছে?

মাহমুদউল্লাহ: কম-বেশি বলতে, খুব হতাশার ছিল অবশ্যই। এত কাছে এসেও আবার…! যখন মাঠে ছিলাম, ওই সময়ে দোয়া করছিলাম, এত কাছে এসে আবার যেন হারতে না হয়, কিন্তু হলো না। খারাপ লেগেছে। তবে এখন পেছন ফিরে তাকালে, আমরা যেভাবে লড়েছি, এই টুর্নামেন্টে যেভাবে খেলেছি, সেটিকেও কম পাওয়া মনে হয় না।

শেষ বলে দিনেশ কাতির্কের ছক্কার আগে আপনার নিজের কি মনে হচ্ছিল?

মাহমুদউল্লাহ: সত্যি কথা বললে, আমার মনে হচ্ছিল আমরা জিতব। সৌম্য যেভাবে বোলিং করল, চাপের মধ্যে ওই সময় সেটি ছিল অসাধারণ। মুস্তাফিজের দুর্দান্ত ওভারটি দারুণভাবে ম্যাচে ফিরিয়ে এনেছিল আমাদের। সব মিলিয়ে মনে হয়েছিল, জিতব। দুর্ভাগ্যজনকভাবে রুবেলের ওভারটি ভালো যায়নি।

তবে ওকে বা কাউকে দায় দেওয়ার কিছু নেই। রুবেল তার আগে খুব ভালো বোলিং করেছে। ব্রেট লি পর্যন্ত বলেছে যে তার দেখা টুর্নামেন্টের সেরা বোলার রুবেল। সৌম্য খুব ভেঙে পড়েছিল ম্যাচ শেষে। আমরা চেষ্টা করেছি পাশে থেকে ওকে স্বাভাবিক করতে।

ছক্কার পর ঠিক ওই মুহূর্তের অনুভূতি…?

মাহমুদউল্লাহ: আমি হাঁটু গেড়ে মাথা নিচু করে বসে পড়েছিলাম। মনে হয় না আর কিছু বলতে হবে ওই সময়ের অবস্থা বোঝাতে। ওই অভিব্যক্তিই আসলে সবকিছু প্রকাশ করে।

এক ম্যাচ আগেই শেষের একটি ছক্কা বাংলাদেশের জন্য এসেছিল অপার আনন্দ হয়ে।  আপনি ছিলেন সেই ছক্কার নায়ক। বলটির আগে ভাবনার জগৎটা কেমন ছিল?

মাহমুদউল্লাহ: ওই বলের আগে আমি চেষ্টা করছিলাম যতটা সম্ভব স্থির থাকা যায়। স্থিরতা সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল। তার আগের বলটায় দুই রান নিতে গিয়ে ডাইভ দিয়ে গ্লাভস কিছুটা নষ্ট হয়। তখন আমি গ্লাভস পরিবর্তন আর পানির জন্য ডাক দেই। একটু সময় পাই। যেটা আমাকে স্থির হতে সহায়তা করেছিল।

বলটার আগে আমি ভাবছিলাম যেন, বলটা ঠিকমতো দেখি। কারণ ওই রকম পরিস্থিতিতে অনেক সময় হাত জমে যায়, অনেক নেতিবাচকতা মাথায় আসে। বিশেষ করে আমার যেহেতু আগে বাজে অভিজ্ঞতা ছিল, দু-একবার করতে পারিনি। আমি বলটা খুব জোরেও মারতে চাইনি। বলটা দেখে স্রেফ শটটা খেলেছি। বলটা ব্যাটে লাগার পর, ৩০ গজ পার হতেই আমি বুঝে যাই, ছক্কা হচ্ছে। বাংলাদেশকে ম্যাচ জিতিয়েছি, এর চেয়ে তৃপ্তির কিছু আর থাকতে পারে না।

যতটা বলছেন, ওই সময় অতটা স্থির থাকা কিভাবে সম্ভব হলো?

মাহমুদউল্লাহ: আমার ক্যারিয়ার প্রোফাইল যদি দেখেন, আমি সবসময় স্থিরতায় বিশ্বাস করি, এটিকে নিজের ভেতর রাখার চেষ্টা করি। আমার ব্যক্তিগত প্রোফাইল বলেন বা পেশাদারি, আমার খেলাতেও এটা রাখার চেষ্টা করি। যদিও বলার চেয়ে করা অনেক কঠিন। ওই মুহূর্তগুলোয় স্থির থাকা কঠিন। অনেক ভাবনা মাথায় আসতে থাকে। দেশের খেলা, কোটি কোটি মানুষ দেখছে, দলের চাওয়া, নিজের কাছে প্রত্যাশা, পরিবারের আশা, অনেক চাপ। সুস্থির থাকা কঠিন। তবু চেষ্টা করি।

ছক্কায় গোটা স্টেডিয়াম মাতানোর অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই ছিল, সেদিন ওই ছক্কায় গোটা প্রেমাদাসাকে চুপ করিয়ে দিলেন!

মাহমুদউল্লাহ: এটা নতুন অভিজ্ঞতা সম্ভবত। ওরা একদম স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। আবার ফাইনালে উল্টো অভিজ্ঞতা হয়েছে। ক্রিকেট ব্যাপারটাই এমন। কখনও দেয়, কখনও কেড়ে নেয়।

ওই ছক্কার একটু আগে ফিরে গেলে, মাঠে অনেক কিছু হয়েছে, বিতর্ক কম হয়নি। মাঠে ঘটনার কেন্দ্রে আপনি ছিলেন। এই ম্যাচের পর আপনার কথা এখনও সেভাবে শোনা হয়নি…

মাহমুদউল্লাহ: প্রথম বলটা প্রপার বাউন্সার ছিল। লেগ আম্পায়ার একটি বাউন্সারের সঙ্কেত দিয়েছে, আমি দেখেছি। আমি তখন মু্স্তাফিজকে গিয়ে বললাম, ‘একটি বাউন্সার হয়ে গেছে, তোকে আর বাউন্সার দেবে না। হয়ত ওয়াইড ইয়র্কার বা ইয়র্কার দেবে, কিংবা লেংথ বল। শর্ট বল দিলেও খুব বেশি উচ্চতায় থাকবে না।’ আমি তখন স্ট্রাইক চাচ্ছিলাম, এজন্যই মুস্তাফিজকে বলে দিচ্ছিলাম মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে যে এই ধরনের বল হতে পারে।

কিন্তু ওই বলও বাউন্সার করল। প্রথমটির চেয়ে মনে হয়ত একটু বেশি উচ্চতায় ছিল। লেগ আম্পায়ার সঙ্গে সঙ্গেই ‘নো বল’ ডাকে। মুস্তাফিজ রান আউট হয়, আমি ওপাশে যাই। তখন দেখি পেরেরা (থিসারা) মূল আম্পায়ারকে কিছু একটা বলল। মূল আম্পায়ার গিয়ে লেগ আম্পায়ারকে ওদের ভাষায় কিছু একটা বলেন। এরপর লেগ আম্পায়ার এসে বলেন যে মূল আম্পায়ার প্রথম বলটায় সঙ্কেত দেননি। এজন্য এটা ‘নো’ হবে না।

আমি বললাম, ‘আপনি তো অলরেডি দুটিই সঙ্কেত দিয়েছেন। নো বল কেন হবে না?’ এটিই ছিল মূল ইস্যু। তার পর যেটা হয়েছে, সেটা অতীত। আমি মনে করি না বাংলাদেশের ক্রিকেটে অমন মুহূর্ত আর আসবে। পরিস্থিতির উত্তেজনায়ও অনেক কিছু হয়েছে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার ছিল, আমরা খেলায় ফিরেছি। কারণ আমরা খেলেই জিততে চেয়েছি।

বাইরে থেকে সাকিব যখন আপনাকে ও রুবেলকে উঠে আসতে বলছিল, আপনাকে মনে হচ্ছিল একটু দ্বিধান্বিত। যেন বাইরে যেতে চাচ্ছিলেন না। ব্যাপারটা কি এমন ছিল যে আপনি জানতেন, দিনটি আপনার?

মাহমুদউল্লাহ: সাকিবের ওটা (বাইরে চলে যেতে ডাক) হয়ত মুহূর্তের উত্তেজনায় হয়ে গিয়েছিল। আমি শুধু অপেক্ষা করতে চাইছিলাম। যতটা সম্ভব ধীরস্থির থাকতে চেয়েছিলাম। খেয়াল করেছিলেন কিনা, ব্যাট-গ্লাভস উইকেটের পাশে রেখে আমি বাইরের দিকে যাচ্ছিলাম। সেটাও দরকার ছিল, কারণ ম্যানেজমেন্ট কি বলছে, সেটা শোনার দরকার ছিল।

বিশ্বাস তো ছিল। তবে সত্যি বলতে, অনেক নেতিবাচকতাও আসছিল। এশিয়া কাপের ফাইনাল (২০১২), বেঙ্গালুরুর ম্যাচ (২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ), আরও হাজারটা ভাবনা। এজন্যই মানসিক স্থিরতা দরকার ছিল। আমার মনে হয়, যেভাবেই আসুক, ওই সময়ে ওই বিরতিটা আমাদের জন্য ভালো হয়েছিল। একটু দম নেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম আমরা।

এরপর যখন খেলা শুরু হলো, ৪ বলে ১২ রান দরকার, প্রতিটি বল ধরে বলতে গেলে, প্রথম বলটি ছিল স্টাম্পের অনেক বাইরে, শট খেলতে গিয়ে আপনার এক হাত ছুটেও গিয়েছিল…

মাহমুদউল্লাহ: আগের ওভারেও ইসুরু উদানা ওয়াইড ইয়র্কার চেষ্টা করছিল। তখনও আমি ওই শট চেষ্টা করেছিলাম। বিপিএলেও ইসুরু আমাকে ওয়াইড ইয়র্কার করেছিল। আমি চেষ্টা করছিলাম কাভারের ওপর খেলতে। কিন্তু ব্যাটের কানায় লেগে থার্ডম্যান বা ডিপ পয়েন্টে যাচ্ছিল। ওই বলটায় টাইমিং ভালো হলো। আমি মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম যে ওয়াইড ইয়র্কার হবে। এজন্য হয়ত টাইমিং ভালো হয়েছে। পরে ভিডিও দেখেছি যে ব্রেট লি বলছিল এটি টেস্টেও ওয়াইড হবে।

পরের বলে ঝুঁকিপূর্ণ দুই রান, আপনি রান আউটও হতে পারতেন!

মাহমুদউল্লাহ: কিছু করার ছিল না, আমাকে দুই নিতেই হতো। রান নেওয়ার সময় ‘ইয়েস-নো’ কিছু বলিনি। প্রথম স্টেপ নিয়েই শুধু বলেছি, ‘রুবেল দৌড়া…।’ আমি শুধু জানতাম, বল যেখানেই যাক, আমাকে দুই নিতে হবে। ঠিক করেছিলাম যে মাঝ উইকেট থেকেও যদি ডাইভ দিতে হয়, সেটিই করব। তবে শেষ পর্যন্ত আমার মনে হয়, বল স্টাম্পে লাগলেও হয়ত আমি ক্রিজে চলে গিয়েছিলাম।

পরের বলে স্মরণীয় সেই ছক্কা…

মাহমুদউল্লাহ: সেটি নিয়ে অনেক কিছু তো বললামই। তবে একটা ব্যাপার বলি, আগের দুই বলে আমি যেভাবে শক্ত করে ব্যাট ধরেছিলাম, ওই বলটায় আমি তা করিনি। চেষ্টা করেছি রিল্যাক্স থাকতে। নরম্যাল থেকে স্বাভাবিকভাবে চিন্তা করার চেষ্টা করেছি। বলটা দেখে শুধু টাইমিং করতে চেয়েছি।

এক বল আগে বাইরের বলে ওই চারের কারণে ইসুরু হয়ত আর ওয়াইড ইয়র্কারে যায়নি। মাঠের আয়তনও অনেক বড় ছিল। এজন্য হয়ত স্টাম্পে ইয়র্কার করতে চেয়েছিল। আমি প্রস্তুত ছিলাম সেভাবে। ওই বলে টাইমিংটা ভালো হয়েছিল।

আরেকটা কথা না বললেই নয়, ওই ইনিংসের ক্ষেত্রে সাকিবের বড় ভুমিকা ছিল। সাকিব একটা পাশে ছিল যতক্ষণ, আমি ওকে বলছিলাম যে, ‘তুই থাক, আমরা পারব।’ সাকিবের ওইটুকু সময়ের উপস্থিতি আমাকে দারুণ চাঙা করেছিল।

এক বছর আগে ওই শ্রীলঙ্কা থেকেই আপনাকে ফেরত পাঠানোর আয়োজন হয়েছিল। রঙিন পোশাকের দল থেকে আপনার বাদ দেওয়ার ভাবনা নিয়ে সমালোচনাও হয়েছিল অনেক। সেই শ্রীলঙ্কাতেই এমন নায়কোচিত পারফরম্যান্স। এই পালাবদল কিভাবে সম্ভব হলো?

মাহমুদউল্লাহ: আমি এই সময়গুলোয় ইতিবাচক থাকার চেষ্টা করি। নিজেকে বলি যে হয়ত আমারই কোনো ঘাটতি ছিল। আমি ভালো না খেললে আমার সঙ্গে কিছু হতেই পারে। মেনে নিতে হবে। এই সময়গুলো থেকে অনেক শেখার আছে। যদি শারীরিক ও মানসিকভাবে মানিয়ে নেওয়া যায়, আরও ভালো হয়ে ফেরা যায়। আমি সব সময় সেটাই চেষ্টা করি। ওই নির্দিষ্ট সময়টুকু তাই আমাকে সাহায্য করে আরও ভালোভাবে নিজেকে ফিরে পেতে।

সে সময় মাশরাফি ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলেছি। কোচদের সঙ্গে, আমার কাছের মানুষদের সঙ্গে কথা বলেছি যে কি করা উচিত। সেভাবেই চেষ্টা করেছি।

টি-টোয়েন্টিতে আপনার উন্নতিও চোখে পড়ার মত। ২০১৬ সালে খুলনায় একটি ক্যাম্পে ওই সময়ের কোচ চন্দিকা হাথুরুসিংহের সঙ্গে অনেক কাজ করেছিলেন টি-টোয়েন্টির ব্যাটিং নিয়ে। বদলের শুরু কি ওখান থেকেই?

মাহমুদউল্লাহ: এই ক্ষেত্রে হাথুরুসিংহের বড় একটা কৃতিত্ব ছিল। সে সময় আমার স্ট্রাইক রেট মনে হয় ১০২ কিংবা ১০৫ ছিল। আমিও জানতাম, এই স্ট্রাইক রেট নিয়ে টেকা যাবে না। দলে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও বাড়ছিল। হাথুরুসিংহে তখন বলল যে ‘টি-টোয়েন্টিতে তুমি ছয়ে ব্যাট করবে। সেটির জন্য প্রস্তুত হও।’

আমি তার কাছেই জানতে চাইলাম যে আমার কি করা উচিত। তখন আমি টি-টোয়েন্টিতে শুরু থেকে মারতে মারতাম না। কিন্তু ছয়ে খেলতে হলে শুরু থেকে মারতে হবে। আরও অনেক কিছু বদলানো দরকার ছিল।

খুলনার সেই ক্যাম্প থেকে আমি নতুন করে অনুশীলন শুরু করি। ওই সময় হাথুরুসিংহে সত্যি বলতে অনেক সাহায্য করেছিল। ছয়ে নেমে একটি বা দুটি বলের বেশি দেখার সুযোগ নেই। তার পরই মারতে হবে। আমার তাই নিজের গণ্ডি থেকে বের হওয়া জরুরি ছিল। আমি নিজেকে চ্যালেঞ্জ করেছিলাম। সবার সমর্থনে মনে হয় কিছুটা পেরেছি। এখন প্রথম বল থেকেই মারতে পারি, অন্তত এই বিশ্বাসটা আছে।

ক্রিকেট খেলায় আসলে প্রতি দিন, প্রতিটি ম্যাচ থেকেই শেখার অনেক কিছু আছে। কোনো ভুল একবার করলে আবারও হতেই পারে। কিন্তু ভুলটা বুঝে শোধরানোর চেষ্টা করলে সাফল্যের হারও বাড়ে।

গণ্ডি ছাড়ানোর কথা বলছিলেন। শুধু আপনার নিজের নয়, দেশের ক্রিকেটেও এটা নতুন কিছু। ১৮ বলে ৪৩ রানের ইনিংস, স্যামি-পোলার্ডের মত অমন বিস্ফোরক ফিনিশার নেই বলে এখানে হাহাকার ছিল অনেক। এখন কি অন্তত মনে হয় যে ক্রিকেটিং শট খেলেই হয়ত আপনি অমন কিছু নিয়মিত করতে পারবেন?

মাহমুদউল্লাহ: চেষ্টা করব। জানিনা কতটা পারব। তবে সব সময়ই চেষ্টা করব। প্রতিদিনই চেষ্টা করছি উন্নতির। নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার। যদি নিজের কমফোর্ট জোন নিয়েই প্র্যাকটিস করতে থাকি, সেটা নিয়েই যদি সন্তুষ্ট থাকি, উন্নতি করা যাবে না।

এই ক্ষেত্রে বিরাট কোহলি একটা বড় উদাহরণ। নিজের ওয়ার্ক এথিক বদলে ফেলার পর সে সব জায়গায় দাপট দেখাতে পারছে। কারণ সে দাপুটে ক্রিকেটই খেলতে চেয়েছে। ওর প্র্যাকটিস কিছুটা দেখার সৌভাগ্য হয়েছে আমাদের, ওয়ার্ক এথিক অসাধারণ। ব্যাটিং হোক বা ফিল্ডিং, আগ্রাসন হোক বা দল সামলানো, সবকিছুই দারুণ। ওই ব্যাপারগুলো দেখে অনুপ্রেরণার অনেক কিছু আছে। ক্রিকেটকে কিভাবে দেখা উচিত, কিভাবে উন্নতি করা যায়, সেসব বোঝা যায়।

টি-টোয়েন্টির উপযোগী হতে নিজেকে ভাঙতে হয়েছে আপনাকে। অথচ একটি টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট দিয়েই দেশের ক্রিকেটে সম্ভবত প্রথম নজর কেড়েছিলেন। কর্পোরেট টি-টোয়েন্টির ফাইনাল ছিল সেটি প্রায় এক যুগ আগে…

মাহমুদউল্লাহ: ওই টুর্নামেন্ট আমার ক্যারিয়ারের প্রথম ব্রেক থ্রু বলা যায়। টুর্নামেন্টের আগে আমি ভাবছিলাম যে খেলতে পারব কিনা। তখনও বয়স কেবল ১৯-২০। বড় বড় সব তারকারা ছিলেন। তখন একটা ম্যাচে সুযোগ পাই। পরে সেমি-ফাইনালে দ্বিতীয় সুযোগ পাই। সেই ম্যাচে ১০ বলে ১৮ মতো করেছিলাম। পরে ফাইনালে বিমানের বিপক্ষে ৩০ বলে ৫০ দরকার ছিল, ম্যাচটা জেতাই।

ওই ম্যাচের একটা ছবি এখনও আমার ময়মনসিংহের বাসায় আছে, মাশরাফি ভাইরা সবাই আমাকে তুলে ধরেছে উঁচুতে। যখনই যাই ময়মনসিংহ, ছবিটা দেখি। ভালো লাগে। কয়েকদিন আগেও গিয়ে অনেকক্ষণ দেখেছি। হৃদয়ে আলাদা একটা জায়গা নিয়ে আছে।

সেখান থেকে পরে আন্তর্জাতিক অভিষেক। ১১ বছর হতে চলল আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের, কি মনে হয়, যতটা উচিত ছিল বা সামর্থ্য ছিল, ততটা কি অর্জন করতে পেরেছেন?

মাহমুদউল্লাহ: যদি আমার ক্যারিয়ারের শুরুটা দেখেন, অনেকটা সময় জুড়ে বোলিং অলরাউন্ডারই ছিলাম। দলে আমার ভূমিকা ছিল ৬ বা ৮ ওভার, কখনও ১০ ওভার বোলিং। তারপর সাত-আটে ব্যাটিং। ২০১৪ সালে চার নম্বরে ব্যাট করার সুযোগ পেলাম। ঘরোয়াতে সবসময়ই তো চার-পাঁচেই করতাম। জাতীয় দলে সেই সুযোগ পাইনি কিংবা আমি নিজেই হয়ত সুযোগ সৃষ্টি করতে পারিনি।

যখন সুযোগটা পেয়েছি, তখন নিজেকে বলেছি যে এটা লুফে নিতে হবে। সাত-আট থেকে চার নম্বরে উঠে এসে সফল হতে হলে অনেক কষ্ট করতে হবে। রাতারাতি সফল হওয়া যায় না। অনেক কিছু বদলাতে হয়েছে। এই সময় থেকেই আসলে ব্যাটিংয়ে বেশি মনোযোগ দেওয়ার সুযোগ পাই। সেখান থেকে আবার টি-টোয়েন্টিতে ফিনিশারের ভূমিকা পেলাম। এখানেও নতুন কিছু শেখার, করে দেখানোর ব্যাপার ছিল। নিজেকে বদলাতে হয়েছে। আমার টি-টোয়েন্টির সামর্থ্য নিয়েও হয়ত অনেকের প্রশ্ন ছিল। আমি চেষ্টা করেছি উন্নতির।

দলে ভূমিকার কথা যেটি বলছিলেন, আপনি ব্যাটিং অর্ডারে একটি থিতু জায়গা পেয়েছেন কম সময়ই। দলের প্রয়োজনে আপনার পজিশন নিয়ে টানাহেঁচড়া সবচেয়ে বেশি হয়েছে। রেকর্ড আরও সমৃদ্ধ না হওয়ার এটিই কি কারণ?

মাহমুদউল্লাহ: নিজের রেকর্ড নিয়ে আমি ভাবি না। আমি সবসময় বিশ্বাস করি, যে পর্যায়ের ক্রিকেটই হোক না কেন দলের প্রয়োজন অনুযায়ী খেলতে হবে। দল সবচেয়ে বড়। জাতীয় দলে খেললে তো আরও বেশি। গোটা জাতি, দেশের ব্যাপার। এটিই সবচেয়ে আগে।

দলের জন্য এই যে এতটা ত্যাগ, আপনি কি মনে হয়, বাংলাদেশের ক্রিকেট আপনাকে কিভাবে মনে রাখবে?

মাহমুদউল্লাহ: এটা আমি জানি না… বলতে পারব না। আমার মনে হয়, এই বিষয়ে মন্তব্য করার এখতিয়ারও আমার নেই। এটা আপনারা বলবেন, আমার সতীর্থরা বলবে, ক্রিকেট যারা ভালোবাসে, তারা বলবে। আমার মনে হয় না, আমি এসব নিয়ে কখনও বলতে পারব। আমি শুধু বলতে পারি, যতদিন খেলি, শতভাগ সততা দিয়ে চেষ্টা করব। বাকিটা নিয়ে ভাবনা নেই।

হাজার হাজার রান না থাকলেও বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইনিংসগুলোর কিছু আপনি খেলেছেন। এটি নিশ্চয়ই বড় তৃপ্তির জায়গা?

মাহমুদউল্লাহ: ভালো লাগে অবশ্যই। কখনও যখন বসে ভাবি, বা ইউটিউবে দেখি বা লোকে যখন কাছে এসে বলে যে ওই ইনিংসটা খুব ভালো লেগেছিল, তখন খুব ভালো লাগে। কমপ্লিমেন্ট কার না ভালো লাগে! ইনিংসগুলো আমাকে আরও ভালো করতে অনুপ্রাণিত করে।

২০১৫ বিশ্বকাপের দুই সেঞ্চুরি, কার্ডিফের সেঞ্চুরি বা এবার শ্রীলঙ্কায় ম্যাচ জেতানো ইনিংস, কিংবা অন্য কোনোটি যদি থাকে, নিজর কাছে আপনার প্রিয় ইনিংস কোনটি?

মাহমুদউল্লাহ: বাংলাদেশের জয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে একটা বাউন্ডারি থাকলেও সেটা আমার কাছে স্মরণীয়। সেঞ্চুরি হোক বা ফিফটি, কিংবা ২০ রান ১০ রান, যদি সেটা বাংলাদেশের জয়ে হয়ে থাকে, আর কিছু চাই না আমি। নিজের ইনিংসগুলোর তুলনা আমি করতে পারি না। বাংলাদেশের জয়ে সব ইনিংসই আমার প্রিয়। একটিকে এগিয়ে রাখলে অন্যটির প্রতি অন্যায় হবে। বাংলাদেশ যখন জেতে, সেটির অনুভূতি অন্যরকম। এটির সঙ্গে কিছুর তুলনা হয় না।

এখন যে অবস্থানে দাঁড়িয়ে, ক্যারিয়ার কোন দিকে এগোচ্ছে বলে মনে হয় আপনার? ক্যারিয়ার শেষে নিজেকে কোথায় দেখতে চান?

মাহমুদউল্লাহ: চিন্তা করিনি। আমি দীর্ঘমেয়াদে ভাবি না। একটা সিরিজ বা একটা সময়ে মনোযোগ দেই। এক বছর বা ৬ মাস পর এটা অর্জন করতে চাই, আমি এমন নই। একটা সিরিজ বা সময় নিয়ে ভাবি এবং সেটা নিজের ভেতর রেখে দেই। শেয়ার করি না। চেষ্টা করি মনোযোগ মতো কাজটা করতে।

ক্রিকেট নিয়ে সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন? বিশ্বকাপ জয় বা এমন কিছু?

মাহমুদউল্লাহ: চিন্তা করিনি। সত্যি বলছি, আসলেই চিন্তা করি না।

মনে করুন কার্ডিফের সেই ইনিংসটি, ৩৩ রানে ৪ উইকেট পড়ার পর ম্যাচ জেতানো সেঞ্চুরি, এটা কি ওরকম স্বপ্নের ইনিংসগুলোর মধ্যে পড়ে?

মাহমুদউল্লাহ: অমন কিছু তো আসলে স্বপ্নও ছিল না। আমি আর সাকিব যখন ব্যাটিং শুরু করি, জুটির একশ হওয়ার আগ পর্যন্ত তো দুজনে কথাই বলিনি! তার আগ পর্যন্ত, সাকিব শুধু বলেছে, ‘ভাই, সাবাশ…ঠিক হচ্ছে।’ এটুকুই। যখন জুটির একশ হলো, তখন আমরা পরিকল্পনা করে এগোতে শুরু করলাম। সাকিবের সঙ্গে আমার বোঝাপড়াও খুব ভালো। রানিং বিটুইন দা উইকেট থেকে শুরু করে সবকিছু ভালো। এরপর যত কাছে যাচ্ছিলাম, তখন বেশি কথা বলছিলাম। তখন বলছিলাম যে এখন সুযোগ আছে, হাতছাড়া করা যাবে না। 

দলে ৫ সিনিয়রদের সম্পর্কের গভীরতা আমরা জানি। আপনি ব্যক্তিগতভাবে অন্যদের কাছ থেকে কতটা নেওয়ার চেষ্টা করেন?

মাহমুদউল্লাহ: তামিম, মুশফিক, সাকিব, মাশরাফি ভাই…এমনকি রুবেল, মুস্তাফিজ-আমি এটা বিশ্বাস করি, এই মানুষগুলির দিকে তাকালে অন্য দেশের ক্রিকেটারদের দিকে তাকাতে হবে না আমাদের। আমাদের ড্রেসিং রুমেই এমন সম্পদ আছে যে অনেক শেখা যায়।

যদি মুশফিকের ওয়ার্ক এথিক দেখেন, যেভাবে ট্রেনিং করে, তামিম যেভাবে ট্রেনিং করে, কতটা ফোকাসড সে…সাকিব তো এক নম্বর, ওর চিন্তাশক্তি এতটা ভালো, ম্যাচ পড়তে পারার ক্ষমতা বা মাঠের ভেতরে-বাইরে ক্রিকেটটা ও যেভাবে বোঝে, আমার মনে হয় বিশ্বে খুব কম ক্রিকেটারই ততটা পারে। মাশরাফি ভাই এত ইনজুরির পর এখনও আমাদের মূল বোলার। এইবার ঢাকা লিগেও মরা উইকেটে ৩৮ উইকেট, চাট্টিখানি কথা নয়।

আমাদের ড্রেসিং রুমেই এমন কিছু আছে যে আমরা অনুপ্রেরণা নিতে পারি। আমি ওদের থেকে শেখার চেষ্টা করি। তামিম আর মাশরাফি ভাইয়ের সঙ্গে আমার অনেক কথা হয়, সাকিব-মুশির সঙ্গেও হয়। আমি ওদের থেকে অনেক কিছু নেওয়ার চেষ্টা করি। এখানে ছোট হওয়ার কিছু নেই। নিজের উন্নতির জন্য, দেশের ক্রিকেটের উন্নতির জন্য ভালো হলে সেটিই তো ভালো।

আপনার ভেতর যে তাড়না আছে এবং যে স্থিরতা, ড্রেসিং রুমে পরবর্তী প্রজন্মের ওরা কতটা শিখছে?

মাহমুদউল্লাহ: জানি না। এটা যার যার ব্যাপার। ক্রিকেটের সময়টুকু বাদে আমি সবটুকু সময় পরিবারকে দেওয়ার চেষ্টা করি। সেটা ঘোরা ফেরা হোক, বাচ্চার সঙ্গে খেলা হোক, বাবা-মার সঙ্গে সময় কাটানো হোক, আমি পরিবার অন্তঃপ্রাণ মানুষ। আমি মনে করি সেটা আমাকে পেশাদার জগতে আরও শক্তি জোগায়।

এখন কে কিভাবে কোনটা নেবে, এটা তার ব্যাপার। একেক জন প্রাধান্য দেয় একেকটাকে। কারও সঙ্গে হয়ত কারও মিল হবে না।

দেশের অন্য শীর্ষ ক্রিকেটার দু-চারজনের মতো হয়ত ততটা জনপ্রিয় আপনি নন। আপনার যেমন ধরন, হয়তো আপনি এটা নিয়ে ভাবিত নন। এরপরও, কখনও কখনও ইচ্ছে করে না খুব দর্শকপ্রিয় হতে?

মাহমুদউল্লাহ: নাহ, এই ব্যাপারটি নিয়ে আমি সত্যিই কখনোই ভাবি না।

আবার আপনার ভক্ত যারা আছেন, গর্বভরে আপনাকে আড়ালের নায়ক বলেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই বলেন ‘ডার্ক নাইট’, এসব চোখে পড়ে?

মাহমুদউল্লাহ: অনেক সময় দেখি। সামনে চলে আসে। ভালো লাগে। কেউ যদি এসে কথা বলে, কমপ্লিমেন্ট দেয়, সেসবও ভালো লাগে। তবে সত্যি বলতে এসব আমাকে খুব বেশি ভাবায় না। আমি আমার কাজ নিয়েই থাকতে চাই। খ্যাতি বা জনপ্রিয়তা, সেসব নিয়ে খুব একটা ভাবি না। হলো ভালো, না হলে ক্ষতি নেই।

খুব শান্ত স্বভাবের বা অন্তর্মুখী বলে পরিচিতি আছে আপনার। কিন্তু দলের সবাই বলেন, ড্রেসিং রুমে আপনি উল্টো। সবসময় মাতিয়ে রাখেন, মজা-দুষ্টুমিতে আপনার জুড়ি নেই, আপনাকে ছাড়া আসর জমে না!

মাহমুদউল্লাহ: আমার ধরনটিই এমন। আমি কাছের মানুষদের কাছে খুবই প্রাণখোলা। কাছের মানুষদের কাছে খুবই খোলাসা। একদম মন খুলে থাকি। রাখঢাক নেই। কিন্তু নিজের জোনের বাইরে গেলে আমি নিজেকে একটু রিজার্ভড করে ফেলি। নিজের জগতের বাইরে সেভাবে প্রকাশ করি না নিজেকে। এখন এটাকে চাইলে অন্তর্মুখী বলতে পারেন, কিছু করার নেই। কিন্তু কাছের মানুষদের সঙ্গে আমি মজা, দুষ্টুমি, ফাজলামো যত ধরনের আছে, কিছুই বাদ রাখি না। আমার মনে হয়, দলের সবাই সেটা উপভোগ করে!