অতীত স্মরণে ভবিষ্যৎ গড়ার মন্ত্রে বাংলাদেশে অক্সফ্যামের ৫০ বছর উদযাপন

দিনব্যাপী এক আয়োজনে পুরোনো সারথিদের সঙ্গে বর্তমানকেও মিলিত করেছিল সংস্থাটি।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 May 2023, 03:52 PM
Updated : 10 May 2023, 03:52 PM

সত্তরের ঘূর্ণিঝড় ও তারপর মুক্তিযুদ্ধের সময় শরণার্থী শিবিরে কাজের সূত্রে বন্ধনের পথ ধরে বাংলাদেশে কার্যক্রমের ৫০ বছর উদযাপন করেছে আন্তর্জাতিক সংস্থা অক্সফ্যাম।

বুধবার ঢাকার হোটেল র‌্যাডিসনে দিনব্যাপী বর্ণিল এই আয়োজনে পুরোনো সারথিদের সঙ্গে বর্তমানকেও মিলিত করেছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক এই সংস্থাটি।

ভারতে শরণার্থী শিবিরে কাজের সময়ে ত্রাণ কর্মসূচির সমন্বয়কারী জুলিয়ান ফ্রান্সিস আর ফিল্ড অফিসার প্রবীর কান্তি চৌধুরীদের সঙ্গে উদযাপন আয়োজনে উপস্থিত হয়েছিলেন এই সময়ে অক্সফ্যামের উদ্যোগের সুবিধাভোগী সুমী আক্তাররা।

অক্সফ্যাম বাংলাদেশের বিশাল কর্মীবাহিনীর পাশাপাশি অংশীদার ও সহযোগীদের এই আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন সরকারের একজন মন্ত্রী ও দুইজন প্রতিমন্ত্রীও।

সকালে জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়ে ‘সেই চেতনায় পুনর্বার’ প্রতিপাদ্য নিয়ে অনুষ্ঠিত উদযাপন আয়োজনের সূচনা করা হয়।

এরপর সকাল সাড়ে ১১টার দিকে বাংলাদেশের অক্সফ্যামের কান্ট্রি ডিরেক্টর আশীষ দামলে’র স্বাগত বক্তব্য দিয়ে বক্তৃতা পর্ব শুরু হয়।

মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে অক্সফ্যামের সঙ্গে বন্ধন তৈরি হওয়ার কথা তুলে ধরে অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, শরণার্থীদের জন্য মানবিক সহায়তা নিয়ে জুলিয়ান ফ্রান্সিসরা যেভাবে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিল, তা সারাবিশ্বের জন্য অনুকরণীয় হয়ে থাকবে।

শরণার্থী শিবিরে কাজে ভূমিকার জন্য অক্সফ্যাম এবং সেই সময়ে শরণার্থী ত্রাণ কর্মসূচির সমন্বয়কারী জুলিয়ান ফ্রান্সিসকে মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু সম্মাননা দিয়েছে সরকার। ২০১৮ সালে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পেয়েছেন ব্রিটিশ নাগরিক জুলিয়ান ফ্রান্সিস।

বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় অক্সফ্যামের ভূমিকার কথা স্মরণ করে ২০৪১ সালে উন্নত বাংলাদেশ গড়ার জন্য সরকারের রূপকল্প বাস্তবায়নে অক্সফ্যামের ভূমিকা প্রত্যাশা করেন তিনি।

মাঠ পর্যায়ে কাজের পাশাপাশি গবেষণার মাধ্যমে পথনির্দেশ তৈরির ক্ষেত্রে অক্সফ্যামের ভূমিকার কথা উল্লেখ করে মোজাম্মেল হক বলেন, “মানবতার পাশাপাশি দারিদ্র্য বিমোচনে দেশের বিভিন্ন উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় অনুসন্ধানমূলক গবেষণার মাধ্যমেও সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনায় অক্সফ্যাম অবদান রেখে যাচ্ছে।”

মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজের পরিবার অক্সফামের সহযোগিতা পাওয়ার কথা অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য।

যুদ্ধদিনের সেই সময় স্মরণ করে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ভারতে আশ্রয় নিয়ে আমার পরিবারও অক্সফ্যামের সাহায্য নিয়েছিল। সেই কঠিন সময়ে দিনাতিপাত করতে হয়েছিল মানুষকে আর আশ্রয় ও সাহায্য নিয়ে এগিয়ে এসেছিল সংস্থাটি।

শরণার্থী ক্যাম্পে সহযোগিতা কার্যক্রমের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে স্বাধীন দেশে কার্যক্রম শুরুর বিষয় অনুষ্ঠানে এক তথ্যচিত্রে তুলে ধরা হয়।

ওই ভিডিওচিত্রে সেই সময়ে কাজের বিভিন্ন কেন্দ্রস্থলে গিয়ে স্মৃতিচারণ ও সহযোগিতা কার্যক্রমের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন একাত্তরে ভারতে ত্রাণ কর্মসূচির সমন্বয়কারী জুলিয়ান ফ্রান্সিস, ফাইন্যান্স অফিসার আশীষ সেন ও ফিল্ড অফিসার প্রবীর কান্তি চৌধুরী এবং গান্ধী পিস ফাউন্ডেশনের প্রোগ্রাম অফিসার মানবেন্দ্র মণ্ডল।

৫০ বছর পূর্তির এই আয়োজনে ওই চারজনের হাতে সম্মাননা তুলে দেওয়া হয়। এ সময় সবাই দাঁড়িয়ে তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেন।

যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে যোগাযোগের জন্য অক্সফ্যামের অর্থায়নে বাংলাদেশে কাবেরি, কস্তুরী ও কামিনী নামে তিনটি ফেরি দেওয়ার কথা তুলে ধরেন জুলিয়ান ফ্রান্সিস।

ভিডিওচিত্রে তিনি বলেন, “রাস্তাঘাট বিধ্বস্ত, ব্রিজ-কালভার্ট সব উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এবং ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছিল সব ফেরি। ওই সময়ে যোগাযোগের জন্য তিনটি ফেরী সরকারকে দিয়েছিল অক্সফ্যাম।

মুক্তিযুদ্ধের পর ঢাকার পথে পদ্মা নদী পাড়ি দেওয়ার সময়ে অক্সফ্যামের নাম খচিত ওই ফেরি পার হওয়ার কথা স্মরণ করেন যশোরের রাজনৈতিক নেতা স্বপন ভট্টাচার্য।

“প্রথম যেই ফেরিতে আমি পদ্মা নদী পার হয়েছিলাম, সেই ফেরিটি অক্সফ্যামেরই ছিল। এভাবে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠনে অক্সফ্যাম কাজ করেছিল।”

বাংলাদেশের ৫০ বছর কার্যক্রমকে ‘আবেগপূর্ণ’ হিসাবে অভিহিত করে স্বাগত বক্তব্যে আশীষ দামলে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় শরণার্থীদের জন্য কাজের মাধ্যমে সৌহার্দ্য ও সহমর্মিতার ফলে সংস্থার কাজে ভিন্নরূপ লাভ করেছিল।

“কাজ করাটাই মূখ্য হওয়ার কারণে আমাদের কী আছে বা কী নেই, সেই ভাবনা ছিল না। মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেতনায় সবাইকে একীভূত করেছিল।”

স্থানীয় উদ্যোগের সঙ্গে বৈশ্বিক চিন্তার মেলবন্ধনে অক্সফ্যামের ভূমিকার কথা তুলে ধরে অনুষ্ঠানে গ্লোবাল ক্যাম্পেইন ফর এডুকেশনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, “অক্সফ্যামের কাজের অন্যতম বড় বৈশিষ্ট্য হল, তারা কখনও বলে না ‘আমি করেছি’। তারা বলে, ‘আমরা করেছি’। এক্ষেত্রে সংস্থাটি অনন্য।”

অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক গোয়েন লুইস, ভারপ্রাপ্ত ব্রিটিশ হাই কমিশনার ম্যাট ক্যানেল, সিপিডির ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ, লন্ডন টি এক্সচেঞ্জের প্রধান নির্বাহী আলিউর রহমান, বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া কবির, অক্সফ্যামের পৃষ্ঠপোষক আজিজুর রহমান, অক্সফ্যামের সাবেক কান্ট্রি ডিরেক্টর সেলিনা শেলী খান বক্তব্য দেন।

বিকালের পর্বে ‘কোকিলারা’ নাটকের খণ্ডাংশ পরিবেশন করেন অভিনেত্রী ফেরদৌসী মজুমদার। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গান পরিবেশন করেন তিমির নন্দী, শাহীন সামাদসহ অন্যরা। সংগীত পরিবেশন করেন সোলসের পার্থ বড়ুয়া, লালন ব্যান্ডের সুমি, শিল্পী সন্ধি ও সভ্যতা।