করোনাভাইরাস: স্লোভেনিয়াতে কেমন আছে বিদেশি শিক্ষার্থীরা

রাকিব হাসান রাফি
Published : 19 April 2020, 09:52 AM
Updated : 19 April 2020, 09:52 AM

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো স্লোভেনিয়াতেও ঘটেছে  কোভিড-১৯ সংক্রমণ।  গত ১৯ মার্চ থেকেই প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধ করার জন্য সম্পূর্ণ স্লোভেনিয়াতে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছিলো। তবে এখনও স্লোভেনিয়ার বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান খোলা রাখা হয়েছে। কিছু কারখানা সীমিত পরিসরে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

দেশটিতে সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গত ১৬ মার্চ থেকে পুরোপুরি বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। বন্ধ রাখা হয়েছে সকল ধরনের বাস ও ট্রেন সার্ভিস চলাচল। পরিস্থিতির  উন্নতি না ঘটা পর্যন্ত দেশটির রাজধানী লুবলিয়ানাতে ইয়োজে পুচনিক ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকেও  বিমান চলাচল স্থগিত রাখা হয়েছে।

স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় না রেখে যদি একই স্থানে পাঁচ জনের অধিক জমায়েত হয় তাহলে প্রত্যেককে ৪০০ ইউরো করে জরিমানা করা হবে।

এছাড়াও স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে দেওয়া নির্দেশনা বলা হয়, খুব বেশি প্রয়োজন না হলে কেউ এক মিউনিসিপ্যালিটি থেকে অন্য মিউনিসিপ্যালিটিতেও যাতায়াত করতে পারবে না এবং যে কোনো পাবলিক প্লেসে যাতায়াত করতে হলে সবাইকে মাস্ক ও হ্যান্ড গ্লভস পরতে হবে।

স্লোভেনিয়াতে বসবাসরত অন্য দেশের নাগরিকদের নিজ দেশের নিকটস্থ অ্যাম্বাসি কিংবা কনস্যুলেট অফিসের সাথেও যে কোনো প্রয়োজনে যোগাযোগ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

স্লোভেনিয়াতে যারা অন্যান্য দেশের অভিবাসী রয়েছেন তাদের বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্টভাবে কোনও নির্দেশনা আসেনি। এক সময় যুগোস্লাভিয়ার অধীনে থাকা অন্যান্য দেশ বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা, কসোভো, ক্রোয়েশিয়া, মেসিডোনিয়া, সার্বিয়া, মন্টিনিগ্রো থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ইমিগ্র্যান্ট স্লোভেনিয়াতে বসবাস করেন। তাদের অনেকের নিজস্ব ব্যবসা রয়েছে স্লোভেনিয়াতে। অনেকে আবার এখানে বিভিন্ন ধরনের জীবিকার সাথে জড়িত এবং কেউ বা আবার স্লোভেনিয়াতে বিভিন্ন শিক্ষা-প্ৰতিষ্ঠানে লেখাপড়া করছেন।

স্লোভেনিয়া সরকারের ঘোষণা করা আর্থিক সাহায্যের অংশীদার তারা হতে পারবেন কি না  তা অনেকের কাছেই স্পষ্ট নয়। এদের মধ্যে যাদের এ মুহূর্তে এ পরিস্থিতির জন্য কোনো কাজ নেই কিংবা যাদের রেসিডেন্স পারমিট প্রায় শেষের দিকে তাদের ব্যাপারেও স্পষ্ট কোনো সিদ্ধান্ত স্লোভেনিয়ার সরকারের পক্ষ থেকে এখনও আসেনি।

মুশফিক হাসান স্লোভেনিয়াতে বসবাসরত একজন প্রবাসী বাংলাদেশি শিক্ষার্থী। যিনি ইরাসমাস মুন্ডুস শিক্ষাবৃত্তির আওতায় ইউনিভার্সিটি অব লুবলিয়ানার অধীনে ম্যাকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে মাস্টার্স করছেন।

স্লোভেনিয়াতে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসের প্রভাবে তিনি বেশ শঙ্কিত। স্লোভেনিয়ার সরকার সাময়িক সময়ের জন্য সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করায় তিনি খানিকটা অস্বস্তিত্বেও পড়েছেন।

বিভিন্ন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। তবে  ইউনিভার্সিটি খোলা থাকলে নিয়মিত লাইব্রেরি অথবা গ্রুপ ওয়ার্ক, সরাসরিভাবে কোনো শিক্ষকের অধীনে থেকে কোনো একটি প্রজেক্টে কাজ করার সুবিধা পাওয়া যেত। এখন এই সব সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের।

পরিস্থিতির উন্নতি না ঘটলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সেমিস্টার শেষ করতে পারাটা আদৌ সম্ভব কি না তা নিয়েও বেশ সন্দিহান মুশফিক।

তবে ইউনিভার্সিটির পক্ষ থেকে এ ধরনের পরিস্থিতিতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের সতর্কতামূলক নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে বলে তিনি এখনও হতাশ হয়ে যাননি।

মনিকা জিভেচ রাজধানী লুবলিয়ানাতে ফ্যাশন ডিজাইনিং অ্যান্ড বিউটি থ্যারাপির ওপর ডিপ্লোমা কোর্স সম্পন্ন করছেন। পাশাপাশি তিনি ম্লিনোটেস্ট নামক একটি বেকারি শপে পার্টটাইম কাজ করেন। পরিস্থিতির কারণে এখন কাজে যেতে পারছেন না মনিকা।

ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নিউ জিল্যান্ড, জার্মানি, নেদারল্যান্ডসে আইন আছে একজন স্টুডেন্ট থাকা অবস্থায় সপ্তাহে হয় তো বা বিশ ঘণ্টা কিংবা ত্রিশ ঘণ্টার বেশি কাজ করতে পারবেন না। স্লোভেনিয়ার আইনে এরকম কিছু বলা নেই। এ কারণে স্লোভেনিয়াতে চাইলে একজন শিক্ষার্থী ফুলটাইম কাজও করতে পারেন।

একারণে অনেক কোম্পানি বা রেস্টুরেন্ট বা দোকানের পক্ষ থেকে যখন কোনও একজন শিক্ষার্থীকে চাকরির অফার দেওয়া হয় তখন স্বভাবতই কর্তৃপক্ষ চায় তাকে দিয়ে ফুলটাইম কাজ করাতে। তবে বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর পক্ষে লেখাপড়ার পাশাপাশি ফুলটাইম অর্থাৎ দিনে সাত-আট ঘণ্টা কাজ করে পড়াশুনা করার সুযোগ হয় না।

মনিকা আইডসচিনার একজন বাসিন্দা এবং আইডসচিনা আসলে একটি মফস্বল এলাকা, যার দূরত্ব স্লোভেনিয়ার রাজধানী লুবলিয়ানা থেকে প্রায় ৮২ কিলোমিটার।

এসময় যদি চাকরি চলে যায় তাহলে এটি হবে তার জন্য মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো।

দেশটিতে সংক্রমণের হার তুলনামূলক কম হওয়া নিয়ে মনিকা বলেন, "গোটা স্লোভেনিয়া আসলে ডিসেন্ট্রালাইজড; অর্থাৎ স্লোভেনিয়াতে মানুষের জীবনযাত্রা কেবল মাত্র বড় শহর যেমন লুবলিয়ানা কিংবা মারিবোরের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। পাশাপাশি স্লোভেনিয়ার জনসংখ্যার ঘনত্ব খুবই কম।

"গোটা স্লোভেনিয়া সুউচ্চ পর্বতমালা ও ঘন বন-জঙ্গল দ্বারা আচ্ছাদিত হওয়ায় এখানে জনবসতি অত্যন্ত বিক্ষিপ্ত যার প্রভাবে স্লোভেনিয়াতে সে রকম হারে এখন পর্যন্ত ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতো করোনাভাইরাস বিস্তার লাভ করতে পারেনি।"

বোগদান পেট্রোভিচ স্লোভেনিয়ার  ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছার ফ্যাকাল্টি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ম্যানেজমেন্টের একজন ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট।

তিনি বলেন, সব মিলিয়ে এক ধরনের হতাশার মধ্য দিয়ে দিন পার করছেন।

তবে নিজ দেশ সার্বিয়ার তুলনায় স্লোভেনিয়া এখন পর্যন্ত বেশ স্বস্তিদায়ক পর্যায়ে রয়েছে বলেও জানান বোগদান।

আলেকজান্ডার ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছাতে পরিবেশ বিজ্ঞানের ওপর ব্যাচেলর সম্পন্ন করছেন।

তিনি বলেন,  এখন পর্যন্ত যেহেতু সুস্থ্য রয়েছেন তাই  ব্যক্তিগতভাবে তিনি এখনও নির্ভার।

তবে নিজের দেশ রাশিয়ার সম্ভাব্য পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে বেশ উদ্বিগ্ন আলেকজান্ডার।

আমরা কেউই বলতে পারি না কবে এ মহামারী থেকে পরিত্রাণ মিলবে।  আমরা একটি নতুন ভোরের অপেক্ষায় ঘরবন্দি সময় পার করছি।