“আমাদের কোটি খানেক মধ্যবিত্ত পরিবার রয়েছে, পথশিশু রয়েছে ৩৪ লাখ। একেকটি পরিবার যদি একেকটি পথশিশুর দায়িত্ব নেয়, তাহলে এই সমস্যা থাকবে না,” বলেন দীপু মনি।
Published : 18 Mar 2024, 08:19 PM
সারাদেশে ৩৪ লাখেরও বেশি পথশিশু বাবা-মায়ের যত্ন ছাড়াই জীবনযাপন করছে বলে এক গবেষণায় উঠে এসেছে।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও ইউনিসেফ বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে ‘চাইল্ড সেনসিটিভ সোশ্যাল প্রোটেকশন ইন বাংলাদেশ ফেইজ-২’ প্রকল্পের অধীনে গবেষণাটি পরিচালিত হয়। প্রকল্প বাস্তবায়নে সহযোগিতা করছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও সুইডিস ইন্টারন্যাশনাল ডেভলপমেন্ট এজেন্সি।
সোমবার বিকালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালায় এ গবেষণাপত্রের মোড়ক উন্মোচন করেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী দীপু মনি।
‘বাংলাদেশে পথশিশুদের পরিস্থিতি-২০২৪’ শীর্ষক এ গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চরম দারিদ্র্য, পারিবারিক অস্থিরতা এবং শারীরিক বা মানসিক নির্যাতনের পটভূমি থেকে বেড়ে ওঠা শুরু হয় পথশিশুদের। অর্থনৈতিক চাপ প্রায়ই এসব শিশুকে শ্রমে বাধ্য করে, তাদের শিক্ষার সুযোগ কমিয়ে দেয় এবং দারিদ্র্যের একটি চক্রকে স্থায়ী করে। পিতামাতার অবহেলা, অপব্যবহার এবং পরিত্যাগসহ পারিবারিক কর্মহীনতা সরাসরি তাদের রাস্তায় বেরিয়ে আসতে প্রভাবিত করে।
গবেষণাপত্রে বলা হয়, পথশিশুরা বেঁচে থাকার জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে, যার মধ্যে রয়েছে জনগণের সহানুভূতি চাওয়া, অনানুষ্ঠানিক শ্রমে জড়িত হওয়া এবং কিছু ক্ষেত্রে অবৈধ কার্যকলাপের অবলম্বন করে।
সুপারিশ
১. পারিবারিক ভাঙনের মূল কারণগুলোকে লক্ষ্য করে সামাজিক কল্যাণমূলক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে; অরক্ষিত পরিবারের জন্য অর্থনৈতিক সহায়তা, কাউন্সেলিং এবং শিক্ষায় প্রবেশাধিকার প্রদান করতে হবে।
২. শিক্ষা ও দক্ষতা বিকাশের সুবিধার্থে পথশিশুদের জন্য উপযোগী শিক্ষা এবং বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে।
৩. নারী ও শিশুদের জন্য সুরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী ও প্রসারিত করতে হবে।
৪. আইনি ও সামাজিক সুরক্ষার উন্নতি করতে হবে। পথশিশুদের মধ্যে অপব্যবহার, শোষণ এবং অবৈধ কার্যকলাপ প্রতিরোধ করার জন্য শিশু সুরক্ষা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে হবে, তাদের অধিকার সুরক্ষিত করা নিশ্চিত করতে হবে।
৫. জনসচেতনতা ও অন্তর্ভুক্তি বাড়ানো। জনসচেতনতামূলক প্রচারাভিযান চালু করতে হবে এবং পথশিশুদের পুনর্মিলন ও সমর্থনের জন্য সম্প্রদায়ভিত্তিক সহায়তা ব্যবস্থার জন্য প্রচার করা।
৬. সরকার থেকে তহবিল বাড়ানো; নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ ও প্রতিক্রিয়া জানার ব্যবস্থায় জরুরি বিনিয়োগ প্রয়োজন।
অনুষ্ঠানে দীপু মনি বলেন, গবেষণায় বলা হয়েছে ৩৪ লাখের মতো শিশু সারাদেশে পথশিশু হিসেবে রয়েছে। এই শিশুরা সমাজের অংশ। তাদের জীবনের নিরাপত্তা থেকে শুরু করে সব মৌলিক অধিকার রয়েছে। তারা এসব অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে, এটা কাম্য নয়।
“তবে বাস্তবতা হল বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বেই পথশিশু রয়েছে। যুদ্ধ-বিগ্রহের কারণে অনেক দেশে পথশিশুরা বাড়ছে। আমরা চাই, সারাবিশ্বের শিশুরাই যেন তাদের অধিকার পায়।”
তিনি বলেন, “আমাদের সমাজে দরিদ্রতা এখনও আছে। সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নের কারণে দরিদ্রতা কমে এসেছে। বর্তমানে এদেশে হতদরিদ্রের পরিমাণ ৫ দশমিক ৬ ভাগ। এই সংখ্যা এক সময় শূন্যের কোটায় নেমে আসবে৷
“শুধু দরিদ্রতাই নয়, অন্যান্য যেসব কারণে পথশিশু বাড়ে- সেই কারণগুলো নিয়েও কাজ করতে হবে। শিশুরা যেসব বিপজ্জনক কাজে জড়িত আছে, তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে সরকার কাজ করছে।”
পথশিশুর সংখ্যা কমিয়ে আনতে সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।
সমাজকল্যাণমন্ত্রী বলেন, “আমাদের কোটি খানেক মধ্যবিত্ত পরিবার রয়েছে। পথশিশু রয়েছে ৩৪ লাখ। একেকটি পরিবার যদি একেকটি পথশিশুর দায়িত্ব নেয়, তাহলে এই সমস্যা থাকবে না।
“সরকার এবং এনজিওগুলো কাজ করছেই, এর সঙ্গে সমাজের মানুষেরা এগিয়ে আসলে এসব শিশুদের জীবন বদলে যাবে।”
মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী সিমিন হোসেন রিমি বলেন, “পথশিশুদের জীবনের গল্প বোঝা আমাদের সবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তারা ভালোবাসা ও যত্ন ছাড়া বড় হয়। তাদের জীবনমান উন্নয়নের আমাদের কাজ করতে হবে। সমাজের বিত্তশালীদেরও দান করার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। সরকারের সঙ্গে এসব বিত্তশালীরা এগিয়ে আসলে পথশিশুদের সংখ্যা অনেক কমে আসবে।”
বাংলাদেশে অনেক পথশিশু থাকার তথ্য দিয়ে ইউনিসেফ বাংলাদেশের প্রতিনিধি শেলডন ইয়েট বলেন, “তাদের জীবন আমাদের থেকে অনেক আলাদা এবং কঠিন। এই রিপোর্টের মাধ্যমে এসব শিশুদের প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে। এই রিপোর্টে শুধু চ্যালেঞ্জগুলোই তুলে ধরা হয়নি, বরং চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার উপায়ও বলে দেওয়া হয়েছে।
“পথশিশুরা তাদের দৈনন্দিন জীবনে যে সমস্যাগুলোর সম্মুখীন হচ্ছে তা মোকাবেলার জন্য একটি সমন্বিত নীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়নের জন্য সুপারিশও করা হয়েছে।”
ইউনিসেফ বাংলাদেশের চাইল্ড প্রোটেকশন সেকশন চিফ নাটালি ম্যাক্কলি বলেন, “পথশিশুদের বিষয়ে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। মানুষ যেন এসব শিশুদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়, তার জন্য সচেতনতার প্রয়োজন।
“একইসঙ্গে এসব শিশুদের জন্য সরকারি প্রকল্প নিতে হবে। শিশুদের জীবনমান উন্নয়নে সরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।”
সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবু সালেহ্ মোস্তফা কামালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব নাজমা মোবারক, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব খায়রুল আলম শেখ, সিএসপিবি (ফেইজ-টু) জাতীয় প্রকল্প পরিচালক ছরোয়ার হোসেন।
এর আগে সমাজকল্যাণমন্ত্রী দীপু মনি ইউনিসেফ আয়োজিত ‘অবছায়ায় ধ্বনি’ শীর্ষক সপ্তাহব্যাপী চিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন।
শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালায় (গ্যালারি ৭, ৪র্থ তলা) ১৮ থেকে ২৩ মার্চ এ প্রদর্শনী চলবে।
এতে পথশিশুদের উপর তোলা ছবি, শিল্পকর্ম, পথশিশুদের নির্মিত হস্তশিল্প ও চিত্রাঙ্কনের অডিও ভিজ্যুয়াল প্রদর্শনী ও 'অবছায়ায় ধ্বনি' নাটকও প্রদর্শন করা হবে।