পদ্মায় ‘পাকে’ ফিকে সেতুর স্বপ্ন

দক্ষিণাঞ্চলবাসীকে সড়ক পথে সরাসরি ঢাকায় আনার স্বপ্ন দেখিয়ে যাত্রা শুরু করলেও ‘দুর্নীতির’ জটিলতার আবর্তে মহাজোট সরকারের চার বছরেও শুরু হয়নি সেতুর কাজ।

মুনীরুল ইসলামও সালাহউদ্দিন ওয়াহিদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 Jan 2013, 01:42 AM
Updated : 18 June 2013, 09:19 PM

নদীর বুকে ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতু বানিয়ে দক্ষিণাঞ্চলবাসীকে সড়ক পথে সরাসরি ঢাকায় আনার স্বপ্ন দেখিয়ে যাত্রা শুরু করলেও মহাজোট সরকারের চার বছর গড়ালেও সেই সেতুর কাজ শুরু করা যায়নি এখনো।

দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর ঋণদাতা প্রধান সংস্থা বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে জটিলতার মধ্যে বাকি এক বছরেও বহু প্রতীক্ষিত এই সেতুর কাজ শুরু হবে কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা এখনো কাটেনি।

বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে জটিলতা কাটার আশা সরকারের পক্ষ থেকে করা হলেও শনিবারও সংস্থাটির ওয়েবসেইটে এই প্রকেল্পটির ‘স্ট্যাটাস’ দেখা গেল- ‘ক্লোজড’।

২০১১ সালে সাড়ম্বরে বিশ্ব ব্যাংকসহ ঋণদাতা সংস্থাগুলোর সঙ্গে একে একে চুক্তি করে এই মেয়াদেই সেতুর কাজ শেষ করার ঘোষণা দিয়েছিল সরকার, যাদের নির্বাচনী ইশতেহারের ১৫.২ অনুচ্ছেদে ছিল পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতি।

কিন্তু ওই বছরের শেষ ভাগে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিশ্ব ব্যাংক অর্থায়ন স্থগিত করলে আটকে যায় প্রকল্প। এরপর একে একে ঘটে যায় অনেক ঘটনা।

সরকার দুর্নীতির অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে এলেও গত বছরের মাঝামাঝিতে বিশ্ব ব্যাংকের ঋণচুক্তি বাতিল হলে তাদের ফেরাতে শুরু হয় নানা তৎপরতা। পদত্যাগ করেন মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, ছুটিতে যান প্রকল্পের ইন্টিগ্রিটি অ্যাডভাইজর মসিউর রহমান, সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া।

এরপর বিশ্ব ব্যাংক অর্থায়ন বাতিলের সিদ্ধান্ত বদলালেও শর্ত দেয় দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্তের ভিত্তিতে মামলার। সেই মামলাও হয় গত বছরের ডিসেম্বরে। তবে এরপর এখন পর্যন্ত তাদের কোনো ইতিবাচক সাড়া মেলেনি।

বিশ্ব ব্যাংক ফিরলেও নতুনভাবে সব ঠিকঠাক করে সরকারের এই মেয়াদে সেতুর কাজ শুরু নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন মসিউর রহমান, যদিও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বারবারই আশাবাদী তা শুরুর।

বর্তমানে দেশে খুলনা-বরিশাল ছাড়া অন্য অঞ্চল থেকে রাজধানীতে সরাসরি সড়ক পথে আসা যায়। বাদ থাকা এই অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পদ্মা নদীর ওপর একটি সেতুর।

পদ্মার ওপর সেতু নিয়ে আলোচনা শুরু হয় অনেক আগেই। সেতুটি মাওয়ায় হবে, না কি পাটুরিয়ায় হবে- তা নিয়েও অঞ্চলবাসীর মধ্যে বিভেদ দেখা দেয়। ২০০৪ সালে জাইকা একটি সমীক্ষা চালিয়ে মাওয়া-জাজিরা পয়েন্টে সেতু নির্মাণের পরামর্শ দেয়।

এরপর এই সেতুর বিষয়টি অনেক দিন চাপা থাকলেও ২০০৭ সালে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে এই সেতু নির্মাণের আলোচনা নতুন করে শুরু হয় এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সহায়তায়। তখন একনেকে অুনমোদিত প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার ১৬২ কোটি টাকা।

২০০৯ সালে শেখ হাসিনার সরকার দায়িত্ব নিয়ে নতুন আঙ্গিকে সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা করে। কয়েক দফায় নির্মাণ ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ২৯১ কোটি ডলার। সিদ্ধান্ত হয়, সড়ক ও রেল উভয় যান পারাপার হবে এই সেতুতে; ওপরে চলবে গাড়ি, নিচে চলবে ট্রেন।

২০০৯ সালের ৯ জানুয়ারি সেতুর তদারকি প্রতিষ্ঠান নির্বাচনের দরপত্রের প্রস্তাব অনুমোদন করে ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। ওই বছরের ২ ফেব্রুয়ারি গঠিত হয় মূল্যায়ন কমিটি, এই কমিটি পরে কয়েকদফা বদলায়, আর পরে এই কমিটিতেই বাসা বাঁধে ‘দুর্নীতি’।

এদিকে কয়েক দফায় ব্যয় বাড়ানোর পর ২০১১ সালের ১১ জানুয়ারি ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকায় পদ্মা বহুমুখী সেতু সংশোধিত নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন করে একনেক। এর আগেই নিশ্চিত করা হয় ঋণদাতাদের প্রতিশ্রুতি।

মোট নির্মাণ ব্যয় ২৯১ কোটি ডলারের মধ্যে ১২০ কোটি ডলার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রকল্পের ‘লিড ডোনার’ হয় বিশ্ব ব্যাংক। এডিবি ৬১ কোটি ৫০ লাখ, জাইকা ৪১ কোটি ৫০ লাখ, আইডিবি ১৪ কোটি ডলার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। বাকি অর্থ দেয়ার কথা সরকারের।

২০১১ সালের ২৮ এপ্রিল পদ্মার বুকে ভাষাশহীদ বরকত ফেরিতে হয় বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে আসা সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এনগোজি ওকোনজো ইউয়েলা বলেন, বাংলাদেশের স্বপ্নে অংশীদার হতে পেরে তারা গর্বিত।

দুর্নীতিমুক্তভাবে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের ওপরও জোর দেন বিশ্ব ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। অনুষ্ঠানে উপস্থিত অর্থমন্ত্রী তাকে আশ্বস্ত করেন, স্বচ্ছতার সঙ্গে এই সেতু নির্মাণ করা হবে।

তখন অর্থমন্ত্রীর পাশে হাসিমুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন ওই সময়ের যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, পরে যাকে সমালোচনার মুখে পড়ে মন্ত্রিত্ব ছাড়তে হয়।

২০১১ সালের অক্টোবরের মধ্যে সেতু নির্মাণ কাজের ঠিকাদার নিয়োগের আশ্বাস দিয়ে মুহিত বলেছিলেন, সরকারের দারিদ্র্য বিমোচনের স্বপ্নের অনেকটাই বাস্তবায়ন হবে এই সেতু নির্মাণ হলে।

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, পদ্মা সেতু নির্মাণ হলে মোট দেশজ উৎপাদন এক দশমিক দুই শতাংশ বাড়বে এবং প্রতি বছর শূন্য দশমিক ৮৪ শতাংশ হারে দারিদ্র্য কমবে।

তবে পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে ফিকে হতে থাকে এই সব স্বপ্ন।

পদ্মার ঢেউ কানাডায়

পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার প্রথম খবরটি পাওয়া যায় আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে, যখন কানাডা পুলিশ এসএনসি লাভালিনের দুই কর্মকর্তাকে বাংলাদেশের কয়েকজন কর্মকর্তাকে ঘুষ সাধার অভিযোগে গ্রেপ্তার করে।

বিশ্ব ব্যাংক তখন জানায়, তারা নিজেরাও বিষয়টি খতিয়ে দেখছে।

পদ্মা প্রকল্পে পরামর্শক হিসেবে প্রাকযোগ্য তালিকায় থাকা পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের একটি ছিল কানাডাভিত্তিক লাভালিন। মূল্যায়ন কমিটির মনোনীত এই পাঁচ প্রতিষ্ঠান থেকে একটিকে নির্বাচিত করার কথা ছিল বিশ্ব ব্যাংকের।

বিশ্ব ব্যাংকের মুখপাত্র লেসলি কুইন্টনের উদ্ধৃতি দিয়ে রয়টার্স ওই বছরের ৩ সেপ্টেম্বর জানায়, পদ্মা সেতু প্রকল্পের দরপত্র প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্ব ব্যাংকের কাছ থেকে তথ্য পেয়ে এ তদন্ত শুরু করেছে কানাডীয় কর্তৃপক্ষ।

রয়্যাল কানাডীয় পুলিশ লাভালিনের আন্তর্জাতিক প্রকল্প বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট রমেশ শাহ এবং পরিচালক মোহাম্মদ ইসমাইলকে গ্রেপ্তার করে। মামলাও হয় তাদের বিরুদ্ধে। পরে বাংলাদেশের মামলায়ও আসামি করা হয় এই দুজনকে।

ওই বছরের ১০ অক্টোবর অর্থমন্ত্রী জানান, পদ্মা প্রকল্পে অর্থায়ন স্থগিত করেছে বিশ্ব ব্যাংক।

ঢাকায় বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিনিধি অ্যালেন গোল্ডস্টেইন জানান, ‘দুর্নীতির’ তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত তারা নেবেন না।

সরে যাওয়ার ঘোষণা বিশ্ব ব্যাংকের

বিশ্ব ব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ তোলার পর সরকারের পক্ষ থেকে তা বারবারই নাকচ করা হচ্ছিল। তবে প্রকল্পের কাজ বন্ধই থেকেছে।

এই নিয়ে টানাপড়েনের মধ্যে ২০১২ সালের ২৯ জুন পদ্মা প্রকল্পে অর্থায়নের সিদ্ধান্ত বাতিল করে বিশ্ব ব্যাংক।

চুক্তি বাতিলের পক্ষে বিশ্ব ব্যাংক যুক্তি দেখিয়েছে, এই প্রকল্পে বাংলাদেশের শীর্ষ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির ‘বিশ্বাসযোগ্য’ প্রমাণ মিলেছে।

‘দুর্নীতির’ বিষয়টি বাংলাদেশ সরকারকে জানানো হয়েছে জানিয়ে এক বিবৃতিতে বলা হয়, “বাংলাদেশ সরকারের যথাযথ সাড়া না মেলায় প্রকল্পে অর্থায়ন বাতিল করা হয়েছে।”

পদ্মা প্রকল্পে ‘দুর্নীতির’ তথ্য প্রমাণ ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর এবং ২০১২ সালের এপ্রিল মাসে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং দুর্নীতি দমন কমিশনে দেয়া হয় বলে বিবৃতিতে দাবি করা হয়।

দুর্নীতি দমন কমিশন এর মধ্যে প্রাথমিক অনুসন্ধানের পর ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জানায়, মূল সেতু নির্মাণে প্রাকযোগ্য প্রতিষ্ঠান নির্বাচনে কোনো রকম দুর্নীতি হয়নি। তবে পরামর্শক নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ নিয়ে তদন্ত চলছে।

নিজের অর্থায়নে সেতুর ঘোষণা প্রধানমন্ত্রীর

বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়ন বাতিলের ঘোষণা এলে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখায় সরকার। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে ওয়াশিংটনভিত্তিক বহুজাতিক এই সংস্থার সমালোচনা আসে।

পাশাপাশি নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণের ঘোষণাও দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

২০১২ সালের ৪ জুলাই শেখ হাসিনা সংসদে বলেন, প্রয়োজনে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হবে।

“পদ্মা সেতু করার জন্য দেশে আমাদের ১৬ কোটি মানুষ আছে, ৮০ লাখ প্রবাসী আছে। বাংলার মানুষ সারা জীবন কি অন্যের সাহায্যে চলবে? নিজের পায়ে দাঁড়াবে না? আত্মনির্ভরশীল হবে না? পদ্মা সেতু আমরা করবই।”

বিশ্ব ব্যাংকের সমালোচনা করে তিনি বলেন, “যারা একটি পয়সাও ছাড় করেনি, তারা দুর্নীতির অভিযোগ করে। তাদের ভেতর যে দুর্নীতি তা দেখেন।”

নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর ঘোষণা সারাদেশে যে সাড়া ফেলেছিল, তাতে অভিভূত হন প্রধানমন্ত্রী নিজেও।

বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা টাকা তুলতে থাকে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি মেলে সহায়তার।

তবে এই অর্থ তোলাকে কেন্দ্র করে ওই বছরের ১৬ জুলাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে একজন খুন হলে এই উদ্দীপনায় ভাটা পড়ে।

অর্থমন্ত্রী এভাবে তহবিল তুলতে নিষেধ করেন। খোলা হয় ব্যাংক হিসাব, তাতে অর্থ সহায়তা নেয়া হবে বলে জানানো হয়।

বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে জটিলতার মধ্যে মালয়শিয়ার সঙ্গে পদ্মা সেতু তৈরির আলোচনা এগিয়ে নিয়েছিল সরকার। তবে বিশ্ব ব্যাংক প্রকল্পে ফেরার পর তা আর এগোয়নি।

তবে দুদকের মামলার পর বিশ্ব ব্যাংকের সর্বশেষ অবস্থান না জানার মধ্যে গত ২ জানুয়ারি আকস্মিকভাবেই স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে হাতিরঝিল প্রকল্পের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে সেনাবাহিনীকে পদ্মা সেতুর নকশা প্রণয়ন করতে বলেন।

বিশ্ব ব্যাংককে ফেরাতে পদত্যাগ-ছুটি

নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা এলেও বিশ্ব ব্যাংককে ফেরানোর চেষ্টাও চলতে থাকে। এজন্য তাদের দেয়া শর্তগুলো পূরণের উদ্যোগ নেয় সরকার।

আর এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে ২০১২ সালের ২৩ জুলাই পদত্যাগ করেন আবুল হোসেন। দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর ২০১১ সালেই তাকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছিল।

এরপর তিনি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকলেও ওই পদ থেকেও সরে দাঁড়ান তিনি, তবে বলেন, তার কোনো দোষ ছিল না।

ওয়াশিংটনভিত্তিক সংস্থাটি আবুল হোসেনের অপসারণ চেয়ে আসছিল। তার আগে উইকিলিকসের ফাঁস করা একটি তারবার্তায় দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা আবুল হোসেনের সততা নিয়ে সন্দেহ করছেন।

বিশ্ব ব্যাংক যে চারটি শর্ত দিয়েছিল, তার চতুর্থটি ছিল তদন্ত চলাকালে সরকারি দায়িত্ব পালন থেকে সরকারি ব্যক্তি অর্থাৎ আমলা ও রাজনৈতিকভাবে নিয়োগপ্রাপ্তদের ছুটি দেয়া।

অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, “বিশ্ব ব্যাংকের আবাসিক প্রতিনিধি গোল্ডস্টেইনের (অ্যালেন) দেয়া চারটি প্রস্তাবের মধ্যে চতুর্থটি মেনে নেয়ায় একটু অসুবিধা ছিল। আমরা চেষ্টা করছি, এটাও কীভাবে সমাধান করা যায়।”

এরপর ছুটিতে যান সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মোশাররফ হোসেন। ‘যাব না’ করেও ছুটিতে যান প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা মসিউর রহমান।

মসিউর ছুটিতে যাওয়া পর বিশ্ব ব্যাংক পদ্মা প্রকল্পে ফেরার ঘোষণা দেয়। বিশ্ব ব্যাংককে ফেরাতে সরকার প্রকল্পে অর্থায়নকারী অন্য সংস্থাগুলোর শরণও নিয়েছিল।

মামলা হল, বাদ থাকল আবুল হোসেন

বিশ্ব ব্যাংক ফেরার সময় ‘দুর্নীতি’তে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা চেয়েছিল। আর দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্ত পর্যবেক্ষণের অনুমতিও নিয়েছিল।

তদন্ত এবং প্রকল্পের কাজ একসঙ্গে চালাতে সরকার চাইলেও ২০১২ সালের ২ ডিসেম্বর বিশ্ব ব্যাংক সাফ জানিয়ে দেয়, মামলা না হলে ঋণ মিলবে না।

অ্যালেন গোল্ডস্টেইন বলেন, “দুদককে অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে হবে। এই সেতুকে বাস্তবে পরিণত করার বিষয়টি এখন দুদকের হাতে।”

দুর্নীতি দমন কমিশন প্রাথমিক অনুসন্ধানে দুর্নীতির অভিযোগের সারবত্তা না পাওয়ার দাবি করলেও এরপর গত ১৭ ডিসেম্বর মামলা করে।

দুর্নীতি দমন কমিশন জানায়, ঘুষ লেনদেন না হলেও তার একটি ষড়যন্ত্র হয়েছিল এবং তাতে সাত ব্যক্তির জড়িত থাকার প্রমাণ তারা পেয়েছে।

মামলার প্রধান আসামি করা হয় সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মোশাররফ হোসেনকে।

বাকি ছয় আসামি হলেন- সেতু কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (নদী শাসন) কাজী মো. ফেরদৌস, সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) নির্বাহী প্রকৌশলী রিয়াজ আহমেদ জাবের, ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড প্ল্যানিং কনসালটেন্ট লিমিটেডের উপ ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বাংলাদেশে কানাডীয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এসএনসি লাভালিনের স্থানীয় প্রতিনিধি মোহাম্মদ মোস্তফা, এসএনসি-লাভালিনের সাবেক পরিচালক মোহাম্মদ ইসমাইল, এই সংস্থার আন্তর্জাতিক প্রকল্প বিভাগের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট রমেশ সাহ ও সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট কেভিন ওয়ালেস।

সাবেক মন্ত্রী আবুল হোসেন এবং সাবেক প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরীসহ ২৯ জনকে জিজ্ঞাসাবাদের পর এই মামলায় ওই দুজনকে আসামি করা হয়নি।

আবুল হোসেন ও আবুল হাসানকে আসামি না করার বিষয়ে দুকক জানায়, ঘুষ লেনদেনের ষড়যন্ত্রে তাদের ভূমিকার বিষয়ে অনুসন্ধানে যথেষ্ট সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করা যায়নি।

মামলার পর বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিক্রিয়া

দুদকের মামলার পর জটিলতার অবসান ঘটেছে বলে অর্থমন্ত্রী বলে এলেও বিশ্ব ব্যাংকের পক্ষ থেকে এখনো কোনো ঘোষণা আসেনি।

দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্ত পর্যবেক্ষণে সংস্থাটি লুইস গাব্রিয়েল মোরেনো ওকাম্পোর নেতৃত্বে যে প্যানেল করেছে, সেই প্যানেল ঢাকা থেকে ফিরে যাওয়ার পর এই মামলা হয়।

তবে মামলার আসামি কাদের করা হবে, তা নিয়ে মতভেদ নিয়েই তিন সদস্যের ওই প্যানেল ডিসেম্বরের শুরুতে ঢাকা ছাড়ে।

মামলার পর অ্যালেন গোল্ডস্টেইন ১৭ ডিসেম্বর এক বিবৃতিতে জানান, ওকাম্পো নেতৃত্বাধীন প্যানেল মামলার এজহার পর্যবেক্ষণ করবে। তারপর প্রতিবেদন দেবে।

ওই প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করেই বিশ্ব ব্যাংক সিদ্ধান্ত নেবে, তারা পদ্মা প্রকল্পে থাকবে, না কি থাকবে না।

তবে ৪ জানুয়ারি পর্যন্তও বিশ্ব ব্যাংকের সিদ্ধান্ত ঝুলে ছিল, ফলে সরকারের চার বছর পূর্তির দিনও জানা যাচ্ছে না, পদ্মা প্রকল্পের ভবিষ্যত কী হবে।