চট্টগ্রামের বদর কমান্ডার কাসেম

একাত্তরে চট্টগ্রাম শহরে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর নির্যাতনে নেতৃত্বে ছিলেন পাকিস্তান বাহিনীর সহযোগী আল-বদরের স্থানীয় কমান্ডার মীর কাসেম আলী।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 June 2012, 11:22 AM
Updated : 17 June 2012, 11:22 AM
ঢাকা, জুন ১৭ (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)- একাত্তরে চট্টগ্রাম শহরে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর নির্যাতনে নেতৃত্বে ছিলেন পাকিস্তান বাহিনীর সহযোগী আল-বদরের স্থানীয় কমান্ডার মীর কাসেম আলী।
মতিউর রহমান নিজামীর নেতৃত্বাধীন এই বাহিনীর কেন্দ্রীয় কমিটির তৃতীয় শীর্ষ নেতা ছিলেন তিনি।
চট্টগ্রামে আল-বদর বাহিনীর নির্যাতনের শিকার একাধিক ব্যক্তি জানান, মীর কাসেম আলী ছিলেন যুদ্ধকালে স্বাধীনতা বিরোধী ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের সাধারণ সম্পাদক। সভাপতি ছিলেন আলী আহসান মুজাহিদ। জামায়াতে ইসলামীর সহযোগী সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতিও ছিলেন কাসেম।
বদর বাহিনীর হাতে নির্যাতিত ব্যক্তিরা জানান, চট্টগ্রাম শহরের নন্দনকানন টিএন্ডটি অফিসের পিছনের সড়কে একটি হিন্দু পরিবারের মালিকানার ‘মহামায়া ভবন’ দখল করে তার নাম দেয় ডালিম হোটেল। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত এই ডালিম হোটেলেই মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সহযোগীসহ বহু মানুষকে ধরে এনে নির্যাতন করে বদর বাহিনীর সদস্যরা।
চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত ইংরেজি দৈনিক পিপলস ভিউর নির্বাহী সম্পাদক নাসিরুদ্দিন চৌধুরী ওই ডালিম হোটেলে নির্যাতনের শিকার হন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি জানান, ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর আল-বদর বাহিনী ধরে নিয়ে যায় তাকে। তারপর ওই ডালিম হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। সেখানে তার ওপর চলে অমানুষিক নির্যাতন।
“আমাকে ধরে নিয়ে ডালিম হোটেলের একটি কক্ষে অন্য বন্দিদের সঙ্গে চোখ বেঁধে রাখা হয়। প্রচণ্ড মারধর করে আমার কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে তথ্য জানতে চাইতো তারা। ওই হোটেলে সারাক্ষণ বন্দিদের ওপর নির্যাতন আর নির্যাতিতদের চিৎকার-কান্নাকাটি চলতো।
“এই নির্যাতনের মূল পাণ্ডা ছিলেন মীর কাসেম আলী।”
তিনি বলেন, ১৪ বা ১৫ ডিসেম্বর তারা ওই হোটেল ছেড়ে পালিয়ে যায়। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আশপাশের মানুষ এসে হোটেল থেকে আটকদের উদ্ধার করে।
ন্যাপ নেতা সাইফুদ্দিন খানকে একাত্তরের ৩ নভেম্বর স্থানীয় রাজাকার আবুল কালামের নেতৃত্বে একদল লোক মাদারবাড়ি এলাকার বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে ওই ডালিম হোটেলে নিয়ে যায় বলে জানান তার স্ত্রী নূরজাহান খান।
১৭ নভেম্বর থেকে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত সেখানে তার ওপর নির্যাতন চালায় বদর বাহিনী।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ চট্টগ্রাম জেলার নেত্রী নূরজাহান খান জানান, ১৯৭১ সালের নভেম্বরের মাঝামাঝিতে তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়নের নেতা হান্নানা বেগমের ভাই মুক্তিযোদ্ধা জসীম উদ্দিনকে এবং নন্দনকানন এলাকার রাহার পুকুর পাড়ের টাইপ মেশিন দোকানের মালিক জীবনকৃষ্ণ শীলকে ডালিম হোটেলে নিয়ে নির্যাতন করে হত্যা করে বদর বাহিনী।
“দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র ২/৩ দিন আগে ডালিম হোটেলে নির্যাতন কেন্দ্রের সামনে এক যুবকের লাশ পড়ে থাকতে দেখেন সাইফুদ্দিন।”
মীর কাসেম আলী দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই পালিয়ে সৌদি আরব যান। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর জিয়াউর রহমানের আমলে দেশে ফেরেন তিনি।
কাসেম গ্রেপ্তার হওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করে নূরজাহান খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই সব যুদ্ধাপরাধীরা এখন এক এক করে গ্রেপ্তার হচ্ছে-এটা আনন্দের। আমরা তাদের বিচারের অপেক্ষায় আছি।”
তবে বাচ্চু রাজাকার নামে পরিচিত আবুল কালাম আযাদ পালিয়ে যাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।
১৯৭৭ সালের ৬ ফেব্র“য়ারি পাকিস্তানের ইসলামী ছাত্র সংঘের পরিবর্তে ইসলামী ছাত্র শিবির গঠন করা হয়। জামায়াতে ইসলামীর এই ছাত্র সংগঠনের প্রথম কেন্দ্রীয় সভাপতির দায়িত্ব নেন মীর কাসেম আলী। পরে মহানগর জামায়াতের আমীরেরও দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
পরবর্তীতে সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর অর্থনৈতিক সহায়তাপুষ্ট ‘রাবেতা আল ইসলামী’ নামে একটি এনজিওর বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর হন মীর কাসেম।
নয়া দিগন্ত পত্রিকা ও দিগন্ত টেলিভিশনের মালিক প্রতিষ্ঠান দিগন্ত মিডিয়া কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান মীর কাসেম জামায়াতে ইসলামীর অন্যতম অর্থদাতা হিসেবে পরিচিত।
মানিকগঞ্জের হরিরামপুরের মীর কাসেমকে একাত্তরে চট্টগ্রামের মানুষ চিনতো মিন্টু নামে। কলেজছাত্র থাকাকালে সেখানেই তিনি জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। পরে জামায়াতের অঙ্গসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের দায়িত্ব নেন।
মুক্তিযুদ্ধের শেষভাগে যে সব বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয় তার তালিকা তৈরিতেও মীর কাসেম ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম/প্রতিনিধি/এএইচ/২৩১৯ ঘ.