কলকাতায় ‘বিভীষিকার’ ৪ ঘণ্টা: বিমান বললো, এটাই ‘নিয়ম’

যাত্রী তোলার পর যান্ত্রিক ত্রুটির সংকেত পাওয়ায় কলকাতার নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেই বসে থাকল বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বোয়িং ৭৩৭। এসি বন্ধ, হাঁসফাঁস গরমে যাত্রীদেরও ভেতরে বসে থাকতে হল প্রায় চার ঘণ্টা।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 July 2022, 09:24 AM
Updated : 20 July 2022, 06:11 AM

যান্ত্রিক ত্রুটি সারিয়ে সোমবার রাত পৌনে ২টার দিকে ১৫৮ জন যাত্রী নিয়ে ঢাকায় নামে উড়োজাহাজটি। ওই ফ্লাইটের যাত্রী চলচ্চিত্র নির্মাতা রেদোয়ান রনির ভাষায়, সেই অভিজ্ঞতা ছিল ‘বিভীষিকাময়’।

ফেইসবুকে তিনি লিখেছেন, “বারবার ইঞ্জিনে ত্রুটি কিন্তু সব যাত্রী তুলে বন্দি করে রেখেছে প্লেনে। ইলেকট্রিসিটি নাই তাই এসিও বন্ধ, গরমে সবাই সিদ্ধ। কিন্তু কোনো যাত্রীকে নামতেও দেয়া হচ্ছে না। বাচ্চা-বয়োজ্যেষ্ঠদের কথা নাইবা বললাম সাধারণ যাত্রীরাই অসুস্থ হয়ে পড়ছে।”

গত কিছু দিনে বার বার জটিলতায় পড়া বিমান এ ঘটনার পর নতুন করে সমালোচনার মধ্যে পড়েছে। যাত্রীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ত্রুটি ধরা পড়ার পর বিমানের ভেতরে ওই গরমের মধ্যে তাদের আটকে রাখার কারণে।

এ বিষয়ে বিমানের জনসংযোগ বিভাগের মহাব্যবস্থাপক তাহেরা খন্দকারের ভাষ্য, ইমিগ্রেশন শেষে উড়োজাহাজে চড়া যাত্রীদের আর নামার সুযোগ থাকে না।

কী ঘটেছিল?

কলকাতা থেকে বিমানের ওই ফ্লাইট ছাড়ার কথা ছিল সোমবার রাত সাড়ে ৮টায়।ওড়ার আগ মুহূর্তে ল্যান্ডিং গিয়ারের সেন্সরে ত্রুটির সংকেত বাতি দেখতে পেয়ে পাইলট উড্ডয়ন স্থগিত করেন।

এরপর দুই দফায় উড়োজাহাজটির ত্রুটি মেরামত করতে প্রায় চার ঘণ্টা লেগে যায়। এসময় বিমানের ভেতরে এসি ছাড়াই বসে থাকতে হয় ১৫৮ যাত্রীকে। চরম গরমে অসুস্থ বোধ করেন কেউ কেউ। পরে যান্ত্রিক ত্রুটি সারিয়ে রাত পৌনে ২টার দিকে ঢাকায় নামে উড়োজাহাজটি।

রেদোয়ান রনি তার ফেইসবুক পোস্টে লিখেছেন, “রাত ৮.৩০টার ফ্লাইট অবশেষে ছাড়লো রাত সাড়ে ১২টায়! তারপর মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মত ঢাকা এয়ারপোর্টে এসে আবার ১ঘণ্টা সব যাত্রীকে অপেক্ষা করিয়ে বেল্টে লাগেজ ছাড়লো। দেখার কেউ কি আছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে? কিভাবে কারা চালায় এই বিমান?”

তার এ প্রশ্নের উত্তর চাওয়া হয়েছিল বিমানের মহাব্যবস্থাপক তাহেরা খন্দকারর কাছে। তিনি বললেন, ড্যাশবোর্ডে সংকেত দেখে ফ্লাইট স্থগিত করেন। তারপর ভারতের জেট এয়ারের প্রকৌশলীদের খবর দেওয়া হয়।

“তারা ওটা প্রাথমিকভাবে মেরামত করে দেন। এরপর উড়োজাহাজটির পাইলট আবারও ওড়ার প্রস্তুতি নিলে একই সংকেত দিতে শুরু করে। এরপর ওই প্রকৌশলীদের আবার ডাকা হলে তারা এবার সেইফটি রুল অনুসারে উড়োজাহাজের পাওয়ার কানেকশনগুলো বন্ধ করে কাজটা করেছেন। সে কারণে পাওয়ার অফ ছিল।

“ফলে তখন এসি কাজ করেনি। এখন প্রকৌশলীরা যতটুকু সময় নিয়েছেন। তবে এটা চার ঘণ্টা না, প্রায় সোয়া তিন ঘণ্টা এরকম ছিল। যাত্রী নিয়ে রাত ১টা ৪২মিনিটে উড়োজাহাজটি ঢাকায় পৌঁছায়।”

তাহেরা খন্দকার বলেন, “এর মধ্যে যাত্রীদের নামানোও যায়নি। ওদের (বিমান বন্দর কর্তৃপক্ষের) একটা বিধিনিষেধ থাকে যে ইমিগ্রেশন শেষে অনবোর্ড হওয়ার পরে যাত্রীদের আর নামতে দেওয়া হয় না।”

বোয়িং ৭৩৭ উড়োজাহাজটি আবার ওড়ার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে জানিয়ে তাহেরা খন্দকার বলেন, মঙ্গলবার বিকেলে সেটি ঢাকা-চট্টগ্রাম-ঢাকার রুটে উড়বে।

বিমানের রক্ষণাবেক্ষণে দুর্বলতা আর অবহেলার অভিযোগ আছে অনেক দিন ধরেই। সাম্প্রতিক সময়ে হ্যাঙ্গারে বিমানের ধারাবাহিক ঠোকাঠুকি, যান্ত্রিক ত্রুটি নিয়ে একাধিক অবতরণের ঘটনায় দেশের বাইরেও সংকটে পড়েছে রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী এয়ারলাইন্সটির ভাবমূর্তি।

সর্বশেষ গত ৩ জুলাই রাতে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের হ্যাঙ্গারে বিমানের একটি বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনারের ডানায় (উইং) বিমানেরই আরেকটি ৭৩৭ উড়োজাহাজের ডানা আঘাত করে।

এর আগে গত ১০ এপ্রিল বিমানবন্দরের হ্যাঙ্গারে বিমানের একটি বোয়িংয়ের আরেকটি বোয়িংয়ের সঙ্গে ধাক্কা লাগলে দুটো উড়োজাহাজই কিছুদিনের জন্য বসে যায়।

সে ঘটনায় গত ১১ মে মুখ্য (প্রিন্সিপাল) প্রকৌশলীসহ পাঁচজনকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করার কথা জানায় বিমান।

এরপর গত ৪ জুন বিমানের দাঁড়িয়ে থাকা একটি বোয়িং ৭৩৭ উড়োজাহাজে বেসরকারি এয়ারলাইন্স ইউএস বাংলার একটি ব্যাগবাহী ট্রলি এসে ধাক্কা দিলে উড়োজাহাজটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিমানের পক্ষ থেকে বলা হয়, ইউএস বাংলা কর্তৃপক্ষ মেরামতের অর্থ দিতে সম্মত হয়েছে।

গত ১৬ জুন বিমানের একটি বোয়িং-৭৮৭ ড্রিমলাইনার উড়োজাহাজ যাত্রী নামানোর পর অঘটনের শিকার হয়। নিয়ম অনুযায়ী বোর্ডিং ব্রিজের সঙ্গে উড়োজাহাজের দরজার সংযোগ না খুলেই সেটি পার্কিংয়ে নেওয়ার জন্য ধাক্কা (পুশব্যাক) দিতে শুরু করেন রক্ষণাবেক্ষণে নিযুক্ত কর্মীরা। এতে কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি জানালেও বিমান কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত কমিটি করে।

ল্যান্ডিং গিয়ারে যত সমস্যা

গত আট মাসের মধ্যে এ নিয়ে তৃতীয়বারের মত ল্যান্ডিং গিয়ারের সমস্যায় পড়ল বিমানের উড়োজাহাজ।

১৬ জুন বিমানের একটি উড়োজাহাজ উড়ন্ত অবস্থায় সমস্যায় পড়ে। ল্যান্ডিং গিয়ারে সমস্যা দেখা দেওয়ার পর ৭৪ জন যাত্রী নিয়ে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ‘টেকনিক্যাল ল্যান্ডিং’ করে বিমানের অভ্যন্তরীণ রুটের ড্যাশ-৮ উড়োজাহাজটি।

এর আগে গত ১ ডিসেম্বর রাতে বিমানের আরেকটি ড্যাশ-৮ উড়োজাহাজ ল্যান্ডিং গিয়ারের সমস্যা নিয়ে চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দরে জরুরি অবতরণ করে।

তার আগে ২০১৯ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ল্যান্ডিং গিয়ারে সমস্যা নিয়ে ঢাকায় জরুরি অবতরণ করে বিমানের বোয়িং ৭৩৭-৮০০ ময়ূরপঙ্খী। সিঙ্গাপুরমুখী উড়োজাহাজটি উড্ডয়নের এক ঘণ্টা পরে ল্যান্ডিং গিয়ারে সমস্যা নিয়ে ঢাকায় নামে।