বিল পাস, এইচএসসির ফল প্রকাশের বাধা কাটল

আইন সংশোধন করে সংসদে বিল পাসের মধ্য দিয়ে গত বছরের এইচএসসি ও সমমানের ফল প্রকাশের বাধা দূর হল, যার অপেক্ষায় আছে দেশের পৌনে ১৪ লাখ শিক্ষার্থী।

সংসদ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 Jan 2021, 05:47 AM
Updated : 24 Jan 2021, 07:50 AM

শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি রোববার সংসদে ‘ইন্টারমিডিয়েট অ্যান্ড সেকেন্ডারি এডুকেশন (অ্যামেন্ডমেন্ট) বিল-২০২১’ ‘বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড (সংশোধন) বিল-২০২১’, ‘বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড (সংশোধন) বিল-২০২১’ পাসের প্রস্তাব করেন। পরে তা কণ্ঠভোটে পাস হয়।

এর আগে বিলের ওপর দেওয়া জনমত যাচাই, বাছাই কমিটিতে পাঠানো এবং সংশোধনী প্রস্তাবগুলোর নিষ্পত্তি করেন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী।

শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি গত ১৯ জানুয়ারি সংসদে বিল তিনটি তোলার সময় বলেছিলেন, শিক্ষার্থীদের ফলাফল ইতোমধ্যে প্রস্তুত করা হয়েছে, বিল পাস হলেই তা দ্রুত প্রকাশ করা যাবে।

ফলাফল প্রকাশ হওয়ার পর এই শিক্ষার্থীদের স্নাতক পর্যায়ের বিভিন্ন উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু হবে।

১১টি শিক্ষা বোর্ডের ১৩ লাখ ৬৫ হাজার ৭৮৯ জন শিক্ষার্থীর এবার এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা ছিল ১ এপ্রিল থেকে।

কিন্তু করোনাভাইসের প্রকোপ বাড়তে শুরু করলে ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়। মাসের পর মাস অপেক্ষা করেও পরীক্ষা নেওয়ার মত পরিস্থিতি তৈরি না হওয়ায় গত ৭ অক্টোবর এক সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, পঞ্চম ও অষ্টমের সমাপনীর মত এইচএসসি পরীক্ষাও নেওয়া যাচ্ছে না।

সেদিন তিনি জানান, অষ্টমের সমাপনী এবং এসএসসির ফলাফলের গড় করে ২০২০ সালের এইচএসসির ফল নির্ধারণ করা হবে। জেএসসি-জেডিসির ফলাফলকে ২৫ এবং এসএসসির ফলকে ৭৫ শতাংশ বিবেচনায় নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিকের ফল ঘোষিত হবে।

কিন্তু আইনে পরীক্ষা নিয়ে ফল প্রকাশের বিধান থাকায় গতবছরের ডিসেম্বরের মধ্যে আর ফল প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি।

মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ আইন সংশোধন করে অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে নতুন বছরের শুরুতেই ফল প্রকাশের প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু সংসদ অধিবেশন বসার সময় হয়ে যাওয়ায় অধ্যাদেশের ঝামেলায় না গিয়ে একেবারে সংসদে বিল পাস করার পক্ষে মত দেয় মন্ত্রিসভা। গত ১১ জানুয়ারি ওই আইন তিনটি সংশোধনের প্রস্তাব মন্ত্রিসভার অনুমোদন পায়।

গত ১৯ জানুয়ারি সংসদে বিল তিনটি তোলার পর পরীক্ষা করে সংসদে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়। তিনটি বিলই পরীক্ষা নিরীক্ষা করে সংসদে পাসের সুপারিশ করে বৃহস্পতিবার প্রতিবেদন দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি।

বিলের উদ্দেশ্য ও কারণ সম্পর্কে মন্ত্রী দীপু মনি বলেছেন, “প্রস্তাবিত আইনে বিশেষ পরিস্থিতে অতিমারী, মহামারী, দৈব দুর্বিপাকের কারণে বা সরকার কর্তৃকসময় সময় নির্ধারিত কোনো অনিবার্য পরিস্থিতিতে কোনো পরীক্ষা গ্রহণ, ফল প্রকাশ এবং সনদ করা সম্ভব না হলে সরকার, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপিত আদেশ দ্বারা কোনো বিশেষ বছরে শিক্ষার্থীদের জন্য পরীক্ষা ছাড়াই বা সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষা গ্রহণ করে উক্ত প্রজ্ঞাপনে উল্লিখিত পদ্ধতিতে মূল্যায়ন এবং সনদ প্রদানের জন্য নির্দেশাবলি জারি করার বিষয় উল্লেখ রয়েছে।”

সমালোচনা ও শিক্ষামন্ত্রীর জবাব

বিলটি তিনটি পাসের প্রক্রিয়ায় সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেন বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ও বিএনপির সংসদ সদস্যরা।

বিএনপির হারুনুর রশীদ বলেন, “করোনাকালে বহু শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে। পরীক্ষা থাকলে শিক্ষার্থীরা টেবিলে বসে। একটা পরীক্ষা নেওয়া যেত। অটো পাস দিয়ে দেওয়ায় একটি ভয়াবহ সঙ্কট তৈরি হল। মেধাবীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হল। এ বিষয়ে আরও চিন্তা-ভাবনা করার প্রয়োজন ছিল।”

“আমরা শিশুদের বা অভিবাবকদের ঝুঁকিতে ফেলার জন্য কথাগুলো বলিনি। সবকিছু খোলা। স্বাস্থবিধির জন্য সরকার চেষ্টা করছে। কিন্তু বাস্তবতা এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। মহামারীর বিস্তার থেকে পরিত্রাণ পেয়েছি। শিক্ষা ব্যবস্থাকে স্বাভাবিক করার কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।”

গণফোরামের মোকব্বির খান বলেন, “স্বাস্থ্যবিধি মেনে পাবলিক পরীক্ষাগুলো নেওয়া যেত। এখানে সরকার ব্যর্থ হয়েছে।”

জাতীয় পার্টির মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, “১৯৬১ সালে এ ধরনের অটো পাস দেওয়া হয়েছিল। ওই বছর যারা পাশ করেছিলেন তারা একটা গ্লানি বয়ে বেড়িয়েছেন। একটা বদনাম ছিল। এ বছর একটা সংক্ষিপ্ত আকারে পরীক্ষা নেওয়া যেত।”

অন্যদিকে জাতীয় পার্টির ফখরুল ইমাম বিলটিকে সমর্থন করেন। তবে তিনি প্রশ্ন রাখেন সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হলেও কওমি মাদ্রাসাগুলো খোলা কেন?

বিএনপির রুমিন ফারহানা বলেন, “শিক্ষার্থীরা মূলত পড়াশোনা করে পরীক্ষা সামনে রেখে। ক্লাস, ব্যবহারিক ও বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা থেকে শিক্ষার্থীরা দূরে ছিল। আগের পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে এইসএসসির ফল প্রকাশ করা হলে ইনসাফ নিশ্চিত হবে না। মেধাবীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দেশে কঠোর লকডাউন ছিল না। নামমাত্র সরকারি ছুটি ছিল, সবকিছুই চলেছে। স্বাস্থ্যবিধির বালাই নেই। তাহলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা হল না কেন?”

সংসদ সদস্যদের বক্তব্যের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেন, শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত ছিল। শেষ মুহূর্তে পরীক্ষা বন্ধ করতে হয়েছে। বিশ্বের প্রায় সব দেশেই একই অবস্থা হয়েছে। বেশিরভাগ দেশে বাংলাদেশের মত কাছাকাছি পদ্ধতিতে ফল প্রকাশ করা হয়েছে।

“একেবারে চিন্তা ভাবনা ছাড়া এভাবে ফলাফল প্রকাশ করা হচ্ছে তা নয়। প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষাবিদ, কোভিড-১৯ জাতীয় পরামর্শক কমিটি সবার সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।”

শিক্ষামন্ত্রী বলেন, “অনেকে হঠাৎ করে একটা পর্যায়ে গিয়ে ভাল ফল করে না। একটা ধারাবাহিকতা থাকে। তবে এটাও ঠিক, এসএসসির চেয়ে এইচএসএসিতে একটু কঠিন এবং নম্বর কম পেয়ে থাকে। জেএসসি ও এসএসসির ফলাফলের ভিত্তিতে এইচএসসির ফল দেওয়া হবে। যারা মেধাবী তারা এ দুটো পরীক্ষায় মেধার স্বাক্ষর রেখেই এসেছেন।”

এ বছরের যারা এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থী তারা যে একবছর সরাসরি ক্লাস করতে পারেনি, সে কথাও মনে করিয়ে দেন শিক্ষামন্ত্রী।

তিনি বলেন, “একটি সংক্ষিপ্ত সিলেবাস করা হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে যদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া যায়, পরে কয়েক মাস সংক্ষিপ্ত সিলেবাসের ওপর পাঠ দান শেষে পরীক্ষা নেওয়া যাবে।”

বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড (সংশোধন) বিল পাসের প্রক্রিয়ার সময় বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি নিয়ে প্রশ্ন উঠলে শিক্ষামন্ত্রী তার জবাবে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা হবে। এখন পর্যন্ত চারটি বাদে সবকটি বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ পদ্ধতিতে পরীক্ষার ব্যাপারে একমত হয়েছে।

“পরীক্ষা অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি মেনে হবে। এটি হলে শিক্ষার্থীদের হয়রানি কমবে। অভিভাবকদের খরচ ও হয়রানি কম হবে।”

সংক্ষিপ্ত সিলেবাসের মাধ্যমে চলতি ২০২১ শিক্ষা বর্ষের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা নেওয়ার পরিকল্পনা জানিয়ে দীপু মনি বলেন, “বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে ও সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ফেব্রুয়ারি মাসে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা সম্ভব হবে এটি কার্যকর শুরু হবে।”

তবে বেশিরভাগ শিক্ষার্থী চলতি শিক্ষাবর্ষের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা দিতে ‘চাচ্ছে না’ বলেও মন্তব্য করেন মন্ত্রী।

তিনি বলেন, “আগামী মাসে বা দুমাস বাদে প্যানডেমিক কোথায় কোন অবস্থায় থাকবে তা এখনো বলবার কোনো সুযোগ আসেনি। তবে যে তথ্য আছে তাতে দেখছি আমাদের দেশে সংক্রমণের নিম্নগতি। এতে সরকারের বিরাট সাফল্য রয়েছে।”

সংক্রমণের ‘রিয়েল টাইম’ বিচার বিশ্লেষণ করে সরকার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে জানিয়ে দীপু মনি বলেন, “শিক্ষার্থীদের কোন জায়গায় শিক্ষাজীবন ব্যাহত হচ্ছে, কোন জায়গায় ঘাটতি হচ্ছে, আগামী শিক্ষাবর্ষে কী করে তা পূরণ করব- সমস্ত কিছুই বিবেচনায় নিয়ে আমাদের কাজ করতে হচ্ছে। যার ফলে আমরা নভেম্বর ডিসেম্বর মধ্যে অ্যসাইনমেন্টের দিয়েছি।

“আমরা এখন ঠিক করেছি, এই শিক্ষাবর্ষে (২০২১) কোথায় কোথায় কী ঘাটতি রয়েছে, সেটাকে কী করে পূরণ করব, এই শিক্ষাবর্ষে আমরা কতদিন পেতে পারি, সেটার ওপরও অ্যাসেসমেন্ট করছি। পরবর্তী ধাপে যাওয়ার জন্য ন্যূনতম যে দক্ষতাগুলো অর্জন করতে হবে তা কারিকুলামের মাধ্যমে কতটুকু দিতে পারব তা বিবেচনায় নিয়েই কাজ করে যাচ্ছি।”

২০২০ সালের এইচএসসি পরীক্ষাদের পরীক্ষা না নেওয়া গেলেও তাদের পরীক্ষার পূর্ণ প্রস্তুতিসহ সিলেবাস শেষ হয়ে গিয়েছিল বলে মন্তব্য করেন শিক্ষামন্ত্রী।

তিনি বলেন, “চলতি বছরের (২০২১) যে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা আছে, তারা প্রায় একটি বছর সরাসরি ক্লাসে অংশ গ্রহণ করেনি। অনলাইন কিংবা টেলিভিশনে করেছে। এর একটি অংশ হয়ত একেবারেই বাইরে রয়ে গেছে। এসব কিছু বিবচেনায় নিয়ে আমরা এবারের এসএসসি ও এইচএসসির একটি সংক্ষিপ্ত সিলেবাস প্রণয়ন করেছি। ইতোমধ্যে প্রণয়ন করে তা সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠানো হচ্ছে।

“তার ভিত্তিতে ফেব্রুয়ারি মাসের কোন এক সময় যদি আমরা খুলে দিতে পারি তাহলে সেই সিলেবাসের ওপরে এসএসসির ক্ষেত্রে তিন মাস ও এইচএসসির ক্ষেত্রে চার মাস যদি অন্তত ক্লাস করাতে পারি, তাহলে সেই সিলেবাসের ওপরে পরীক্ষা নিতে পারব। কাজেই যারা পরীক্ষা না নিলে সব শেষ হয়ে যাচ্ছে বলছেন, আশা করি তারাও আশাবাদী হবেন।”

৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে যেতে চায়- এমন জরিপ প্রতিবেদন প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, “আমরা প্রতিদিন এসএমএস, ইমেইলসহ নানা ধরনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে তথ্য পাচ্ছি, তার ক্ষেত্রে আমরা এর উল্টোটা দেখতে পাচ্ছি।

“তারা বলছেন, ‘আমাদের পরীক্ষা দিতে বলবেন না’। তাদের অনেকেই এবারের (২০২১) এসএসসি/এইচএসসি পরীক্ষাও দিতে চায় না। কাজেই এটি নিয়ে নানা রকমের মত আছে। অবশ্যই আমরা শিক্ষাবিদ ও শিক্ষা প্রশাসনের সঙ্গে যারা যুক্ত রয়েছেন, তাদের সকলকে নিয়ে চিন্তাভাবনা করেই অগ্রসর হচ্ছি।”