বহুমুখী সঙ্কটে লেবানন, দিশেহারা প্রবাসীরা

স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ির পর ভাগ্যের সন্ধানে ২০১৬ সালে লেবাননে পাড়ি জমিয়েছিলেন গাজীপুরের নীলা শিকদার। আগে থেকে সেখানে থাকা বাবা-মায়ের সঙ্গে মিলে ভালোই আয় রোজগার হচ্ছিল তার।

মাসুম বিল্লাহ নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 August 2020, 06:03 PM
Updated : 20 August 2020, 06:03 PM

শারীরিক সমস্যার কারণে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে দেশে ফিরে আসেন তার মা। কয়েক মাস পর ফিরে আসেন বাবাও। এরপর বিভিন্ন বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করে আয়ের কিছু অংশ বাড়িতেও পাঠাচ্ছিলেন তিনি।

কিন্তু ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে অর্থনৈতিক সংকট শুরু হয় লেবাননে, লাগামহীন মুদ্রাস্ফীতির কারণে পড়তে থাকে লেবানিজ লিরার দাম।

ওই সময়ের আগে ১০০ ডলারের বিনিময় হত দেড় লাখ লেবাননি লিরায়। লিরার দাম কমতে কমতে তিন সপ্তাহ আগে সেই ১০০ ডলারের দাম দাঁড়ায় ৯ লাখ লিরায়। এরপর কিছুটা বাড়ছে লিরার দাম।

কয়েক মাস পেরোতে করোনাভাইরাসের কারণে লকডাউনের শুরু হওয়ায় কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েন নীলা। আগে থেকে জমানো কিছু টাকায় নিজে চলার মধ্যে এ মাসের প্রথম দিকে বিস্ফোরণে কেঁপে উঠল লেবাননের রাজধানী বৈরুত।

“বাবা-মা চলে যাওয়ার পর আমার কষ্টের শুরু। এখন তো আরও বেশি সমস্যায় আমি। দুই বেলা খাইত, এক বেলা খাবার পাই না। অনেক কষ্টে পার হচ্ছে সময়,” বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন নীলা শিকদার।

লেবানন প্রবাসী বাংলাদেশিদের বেশিরভাগেরই অবস্থা এই প্রবাসী নারীর মতো- কাজ না থাকায় কোনো রকমে নিজেকে চালিয়ে নিতেই কষ্ট। দেশে ফেরার জন্য দূতাবাসে নাম নিবন্ধন করেও ফ্লাইটের দেখা নেই।

মুদ্রাস্ফীতির কারণে আর্থিক সংকটের মধ্যে করোনাভাইরাসের আঘাত, সবশেষ ভয়াবহ বিস্ফোরণে ধ্বংসযজ্ঞের সাক্ষী- একের পর এক ধাক্কায় কঠিন সময়ের মুখোমুখি হয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা।

দেশটিতে থাকা প্রবাসীকর্মীরা বলছেন, এখন তাদের একটাই লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে যে কোনোভাবে দেশে ফেরা। ফেরার জন্য ইতোমধ্যে দূতাবাসে নাম নিবন্ধন করেছেন সাড়ে সাত হাজার জন।

মধ্যপ্রাচ্যের সমস্যা সঙ্কুল দেশটিতে থাকা বাংলাদেশিদের হাতে-গোনা কিছু বাদে পুরুষদের বেশিরভাগই পরিচ্ছন্নতাকর্মী আর নারীরা গৃহকর্মী। লকডাউনের সময় তাদের ছিল না কোনো কাজ।

নীলা শিকদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাবা-মা যখন ছিল তখন আমার কোনো চিন্তা ছিল না। আমি রাস্তাঘাট না চিনলেও কোনো সমস্যা ছিল না। এখন আমি যে দূতাবাসে যাব, সেক্ষেত্রে অন্যজনকে সাথে নিতে হয়। কারণ অচেনা আর নিরাপত্তার ভয়।”

কষ্টের বিবরণ দিয়ে তিনি বলেন, “বাঙালি আঙ্কেলদের সহায়তা নিয়ে কোনো মতে চলতেছি। এক আঙ্কেলের বাসায় থাকি। সপ্তাহে ছয় দিন থাকার পর তিনি যেদিন বাসায় আসেন সেদিন অন্য এক মামার বাসায় গিয়ে উঠি।

“জুবাইল এলাকায় যেখানে থাকি, সেখান থেকে দূতাবাসে যেতে লাগে ২০ থেকে ২৫ হাজার লেবানি লিরা। এই টাকাটাই বা কোথা থেকে আসবে?”

আগে ২২ হাজার লিরা দিয়ে ২৫ কেজির এক বস্তা চাল কেনা গেলেও এখন সেখানে দেড় লাখ লিরা লাগছে জানিয়ে নীলা বলেন, “মানুষ খুব কষ্টে আছে। সবার একই অবস্থা। এমন কোনো মানুষ নাই, যে ভালো আছে।”

সঙ্কট শুরুর আগের পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, বাসা বাড়িতে কাজ করে ঘণ্টায় ৪-৫ ডলার পাওয়া যেত। এই আয় ভালোই ছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি পাল্টে গেছে।

দেশে ফেরার আকুতি জানিয়ে নীলা শিকদার বলেন, “আমার এখন একমাত্র চাওয়া দেশে যামু। কিন্তু দেশে যাওয়ার কোনো বাউ করতে পারি নাই। সিরিয়ালই পাচ্ছি না। যে টাকা লাগবে সেটা কোন জায়গা থেকে ম্যানেজ হবে, সেটাও জানি না।”

২০১৬ সালে ভাগ্যের সন্ধানে লেবাননে পাড়ি জমান কিশোরগঞ্জের ভৈরবের রানা আহমেদ। দক্ষ কারিগর হিসাবে ওয়েল্ডিংয়ের কাজ করতেন তিনি।

সে কাজে ভালো আয়- রোজগারের মধ্যে দুই বছরের মাথায় কোম্পানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় একটি আবাসিক হোটেলে পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ নেন তিনি।

২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে সেখানকার রোজগারে টান পড়তে থাকে এবং পরবর্তীতে মার্চে এসে করোনাভাইরাসের কারণে হোটেলের কাজও হারান রানা।

সে দেশে লকডাউনের পর বাড়ি থেকে দেড় লাখ টাকা নিয়ে নিজের খরচ চালিয়েছেন; দিয়েছেন দেশে ফিরতে টিকেটের টাকা এবং অন্যান্য খরচ।

নিদারুণ কষ্টের বর্ণনা দিয়ে রানা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “লিরার দাম পড়তে থাকায় আমাদের কষ্টের শুরু। সবশেষ বিস্ফোরণের পর এই দেশ আরও সংকটে। এর মধ্যে দেশে ফেরার জন্য সিরিয়াল দিয়ে রেখেছি। দেখি, কখন ফিরতে পারি।”

বৈরুত বন্দরে বিস্ফোরণের স্থল থেকে হাঁটা পথে ৮-১০ মিনিটের দূরত্বে এক বাসায় স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকেন প্রবাসী বাংলাদেশি আক্তার হোসেন।

বিস্ফোরণে ঘরের কাচ ভেঙে পড়ে আহত হয়েছেন তিনি; গায়ে আঘাত লেগেছে তার দেড় মাস বয়সী সন্তানেরও। রান্না ঘরে থাকায় আঘাত থেকে রক্ষা পান তার স্ত্রী।

বৈরুতের শহরতলীতে একটি রেস্তোরাঁয় শেফের চাকরি করলেও লকডাউনের কারণে রোজগার হয়ে যায় বন্ধ। অর্থ সংকটের কারণে চলতি বছর দুই দফায় বাড়ি থেকে টাকা নিতে হয়েছে তাকে।

এর মধ্যে বিস্ফোরণের ঘটনা ‘মরার উপর খাড়ার ঘাঁ’ হিসাবে আবির্ভূত হওয়ার কথা তুলে ধরে আক্তার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শুরুতে হাসপাতালে অনেক সিরিয়াল থাকায় ড্রেসিং করিয়ে চলে আসছি। সেলাই করতে হলে কিংবা ভালো চিকিৎসার জন্য টাকার দরকার, সেই টাকাই বা আসবে কোথা থেকে?”

দেশে ফেরার জন্য দূতাবাসে ‘সিরিয়াল দেওয়ার’ চেষ্টা করলেও এখনও তা সম্ভব হয়নি বলে জানান আক্তার, তবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।

১৯৯১ সালে ২৫ জন নারী কর্মীর মাধ্যমে লেবাননে বাংলাদেশি কর্মী যাওয়া শুরু। বিএমইটির হিসাবে, তখন থেকে চলতি বছরের মে পর্যন্ত মোট ১ লাখ ৬৭ হাজার ৫৬৫ জন কর্মী লেবাননে গেছেন। তাদের মধ্যে ১ লাখ ৭ হাজার ২১১ জন নারীকর্মী।

বর্তমানে দেশটিতে প্রায় দেড় লাখ বাংলাদেশি প্রবাসী কর্মী থাকার কথা সরকারের তরফ থেকে বলা হলেও এখন সেখানে কতজন আছেন, তার পরিসংখ্যান নেই।

গত বছরের শেষে লেবাননে রাজনৈতিক সংকটের পর থেকে অনেকে কাজ হারানোর পাশাপাশি কাগজে-কলমেও হয়ে পড়েন অবৈধ। এর মধ্যে কাজ করার সুযোগ হলেও অনেক ক্ষেত্রে গুণতে হয়েছে জরিমানা।

সংকটের মধ্যে সরকারি খরচে ১২৭ জনের পর গত সোমবার বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে ফেরানো হয় আরও ৪১০ জন প্রবাসী বাংলাদেশিকে।

লেবাননে প্রবাসীকর্মীদের মধ্যে যারা বিপদে আছেন, তাদেরকে এভাবে ক্রমান্বয়ে ফেরানো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “১২৭ জনকে আমরা সরকারি খরচে ফেরত এনেছি। ওখানে যারা আছেন, তারা বিকল্প কর্মসংস্থানের চেষ্টা করছেন। ফ্লাইট চালু হলে যারা আসতে চান, তারা আসবেন।”

নিবন্ধন করা সাড়ে সাত হাজার জনের বিষয়ে এক প্রশ্নে সচিব বলেন, “তারা আসবে। তাদের এক্সিট পাস পাওয়ার বিষয় আছে। সেগুলো হচ্ছে। তারা চলে আসতে পারবে।”

মুনিরুছ সালেহীন বলেন, “আমাদের কর্মীদের জন্য প্রথম পরামর্শ হচ্ছে, তারা বিদেশে অনেক কষ্ট করে গিয়েছেন। তারা সেখানে থাকার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন। একান্ত অপরিহার্য ক্ষেত্রে কেউ যদি দেশে আসতে চান, তাদেরকে ফিরিয়ে আনতে আমাদের দূতাবাস ও লেবার উইং প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিচ্ছে, দিয়ে যাবে।”

‘আমাদের মনও ব্লাস্ট করে দিয়েছে’

পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে লেবাননে থাকাকালে গৃহকর্মীর কাজ করে ভালোই চলছিল অনি আমির হোসেনের। তার স্বামীও সে দেশে কয়েক বছর থেকে পরে গ্রিসে গিয়েছেন।

অর্থনৈতিক সংকটের ধাক্কার পর করোনাভাইরাসের কারণে আয়ে টান পড়লেও কোনো মতে অল্প স্বল্প কাজ করে দিন চলছিল অনির। পরিস্থিতি খারাপের দিকে যেতে থাকায় দেশে ফেরার জন্য নিবন্ধন করেছেন তিনি।

করোনাভাইরাস পরীক্ষার পর এখন দেশে ফেরার অপেক্ষায় থাকলেও লেবাননের সংকটে পরিস্থিতি পাল্টে যাওয়ার কথা তুলে ধরেন অনি।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাইরুতে ব্লাস্ট হয়েছে ঠিক, আর এটা আমাদের মনকেও ব্লাস্ট করে দিয়ে গেছে।”

অনেক দিন অপেক্ষার পর এখন দেশে ফেরার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছেন অনি। দূতাবাসের ব্যবস্থাপনায় ফেরার কথা রয়েছে তার।

[প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন লেবানন প্রবাসী সাংবাদিক বাবু সাহা]