স্মরণে জনকের ফেরার দিন

সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের অভ্যূদয় হলেও তখনও পাকিস্তানে বন্দি ছিলেন স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান; উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ছিলেন সদ্য স্বাধীন দেশের মানুষ।

রিয়াজুল বাশার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 Jan 2020, 06:40 PM
Updated : 10 Jan 2020, 03:24 AM

চাপের মুখে পাকিস্তান সরকার মুক্তি দিলে যুদ্ধে বিজয়ের ২৪ দিন পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি নিজের স্বপ্নের স্বাধীন দেশে পা রাখেন জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান।

কাঙ্ক্ষিত সেই মানুষটির বাংলার মাটিতে পা রাখার মধ্য দিয়েই সেদিন বাংলাদেশের স্বাধীনতা পূর্ণতা পেয়েছিল।

তখন থেকে দিনটি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস হিসেবে পালিত হয়ে এলেও ৪৮ বছর পর এবার আয়োজনে ভিন্ন আঙ্গিক নিয়ে এসেছে ‘মুজিববর্ষ’।

বেঁচে থাকলে এই বছরই ১০০ বছর পূর্ণ করতেন জাতির জনক;  আর তাই তার জন্মশতবার্ষিকী ঘটা করে উদযাপনের যে পরিকল্পনা নিয়েছে বাংলাদেশ, তার ক্ষণ গণনা শুরু হবে এই ১০ জানুয়ারি থেকেই।

শুক্রবার বিকালে ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দরে মুজিববর্ষের ক্ষণ গণনার উদ্বোধন করবেন বঙ্গবন্ধুকন্যা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এই ক্ষণ গণনা শেষে আগামী ১৭ মার্চ সূচনা হবে মুজিববর্ষের বছরব্যাপী অনুষ্ঠানের; বছরজুড়ে চলবে সেই আয়োজন। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও থাকবে আয়োজন।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুকে তার ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাড়ি থেকে পাকিস্তানি সেনারা আটক করে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়। ওই রাতেই বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের উপর শুরু হয় বর্বর হামলা।

পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান বঙ্গবন্ধু। তার ডাকে বাঙালি ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তি সংগ্রামে।

নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।

মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর বিশ্ব জনমতের চাপে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তান সরকার। মুক্তির পর তিনি লন্ডন যান। সেখান থেকে ১০ জানুয়ারি দিল্লি হয়ে পৌঁছান ঢাকায়।   

 

সাবেক ছাত্রনেতা, মন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর তোফায়েল আহমেদ স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের তাৎপর্য তুলে ধরতে গিয়ে লিখেছেন, “যতক্ষণ মহান নেতা ফিরে না এসেছেন, ততক্ষণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারেনি। স্বাধীনতা পূর্ণতা পায় ১০ জানুয়ারি, যেদিন জাতির জনক স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে তার স্বপ্নের স্বাধীন সোনার বাংলায় ফিরে এসেছিলেন।”

বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতেই ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল স্বাধীন বাঙলাদেশের প্রথম সরকার গঠন করা হয়। ‘মুজিব নগর সরকার’ নামে পরিচিত সেই সরকারে বঙ্গবন্ধু হন রাষ্ট্রপতি। তার নামেই চলে স্বাধীনতার সংগ্রাম।

বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি করে রাখাটা বাঙালির কাছে যুদ্ধ জয়ের প্রেরণা হয়েছিল বলে মনে করেন বঙ্গবন্ধুর উপর বেশ কয়েকটি গ্রন্থের রচয়িতা ও সম্পাদক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বঙ্গবন্ধুকে যে তারা গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেছে, সেটাও আমাদের জানানো হয়নি। নানা রকম কাহিনী গল্প আমরা শুনছিলাম। শেষ পর্যন্ত আমরা নিশ্চিত হলাম তাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এতে বাঙালি এমনিতেই যুদ্ধ করার জন্য রুখে দাঁড়াল।

“বঙ্গবন্ধু আমাদের মধ্যে নেই, কিন্তু তিনি আমাদের নেতা এবং তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করে গেছেন। তাকে গ্রেপ্তারের পর তিনি আমাদের কাছে আরও বড় এক অনুপ্রেরণা হয়ে থাকলেন। এবং এটাকে ধরে রেখেই বাঙালি নয় মাস যুদ্ধ করে সফল হয়েছে।”

বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়ার পর রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ এনে সাজানোর বিচারের মঞ্চও সাজিয়েছিল পাকিস্তান সরকার।

তোফায়েল আহমেদ লিখেছেন, “মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে অক্টোবর মাসে জাতির জনকের ফাঁসির আদেশ হয়। কিন্তু ষোলোই ডিসেম্বর আমরা বিজয়ী হলে, ইয়াহিয়া খান সেই আদেশ বাস্তবায়ন করতে পারেনি।”

১৯৭২ এর ১০ জানুয়ারি: স্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধু

১০ই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার পর লাখো জনতা সেদিন তাদের প্রিয় নেতাকে তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে খোলা ট্রাকে করে তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) নিয়ে যায়।

বঙ্গবন্ধু সেখানে সদ্য স্বাধীন জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। প্রায় কুড়ি মিনিটের সেই আবেগঘন বক্তৃতায় তিনি বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানে বন্দিদশায় তিনি ফাঁসিকাষ্ঠে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু তিনি জানতেন, বাঙালিকে কেউ ‘দাবায়ে রাখতে’ পারবে না।

“আমার বাংলাদেশ আজ স্বাধীন হয়েছে। আমার জীবনের সাধ আজ পূর্ণ হয়েছে। আমার বাংলার মানুষ আজ মুক্ত হয়েছে।”

স্বদেশ প্রদত্যাবর্তন দিবস ও মুজিববর্ষের ক্ষণ গণনা উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আলাদা বাণী দিয়েছেন।

রাষ্ট্রপতি তার বাণীতে বলেছেন, “দীর্ঘ ৯ মাস ১৪ দিন পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালী কারাগারে বন্দিজীবন শেষে ১৯৭২ সালের এই দিনে জাতির পিতা স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে প্রত্যার্বতন করেন। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হলেও প্রকৃতপক্ষে জাতির পিতার স্বদেশ প্রত্যার্বতনের মধ্য দিয়েই এ বিজয় পূর্ণতা লাভ করে।

“বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ও দিক-নির্দেশনায় দীর্ঘ নয় মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় আমাদের মহান স্বাধীনতা। তাই তার জন্মশতর্বার্ষিকী উদযাপন আমাদের জাতীয় জীবনে এক গৌরবময় অধ্যায়।”

বাবার ছবির সামনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা; বৃহস্পতিবার জাতীয় বস্ত্র দিবসের প্রদর্শনীতে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বাণীতে বলেছেন, “বাঙালির জাতীয় ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক সাহসী অগ্নিপুরুষের নাম। পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ বাঙালি জাতি যুগে যুগে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছে, কিন্তু সফল হতে পারেনি। অবশেষে বিংশ শতাব্দির গোড়ার দিকে মুক্তির দূত হিসেবে জন্মগ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু। তার নেতৃত্বেই বাঙালি জাতি শেষ পর্যন্ত পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে স্বাধীনতা লাভ করে।

“আমি মনে করি, ‘বঙ্গবন্ধু’ সকলের। কাজেই সকলের কাছে তার জীবন ও কর্ম সম্পর্কে তুলে ধরতে সরকারি-বেসরকারি সকল দপ্তর, সংস্থা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল দল ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন জন্মশতবার্ষিকী উদ্‌যাপন সফল করে তুলবে -এ আমার প্রত্যাশা।”

দিবসটি উপলক্ষে শুক্রবার ভোরে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়, বঙ্গবন্ধু ভবনসহ সারাদেশে দলীয় কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। পরে ধানমণ্ডিতে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় দিবসের কর্মসূচি।

সকাল ৭টার দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুল দেন।

এ সময় প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্টের একটি চৌকস দল সশস্ত্র সালাম জানায়। পরে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের নিয়ে দলীয় সভাপতি হিসাবেও শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানান।

 

ক্ষণ গণণা

বিকেল সাড়ে ৪টায় তেজগাঁওয়ের পুরনো বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর ক্ষণ গণনা অনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক কামাল আব্দুল নাসের চৌধুরী এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ১০ জানুয়ারি ক্ষণ গণনা শুরুর অনুষ্ঠানে যেতে পারবেন ১০ থেকে ১২ হাজার সাধারণ নাগরিক।

“জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অর্জন ও আত্মত্যাগের গৌরবগাথা আমরা নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরব জন্মশতবার্ষিকীর আয়োজনে। আমাদের উদযাপন হবে প্রাসঙ্গিক ও তাৎপর্যময়। ১০ জানুয়ারি ক্ষণ গণনার মাধ্যমে শতবর্ষের প্রতীক্ষার মাহেন্দ্রক্ষণ শুরু হবে।”

এই আয়োজনে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের আবহও ‘প্রতীকীভাবে’ ফুটিয়ে তোলা হবে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু যে বিমানে করে দেশে ফিরেছিলেন, সেই আদলের একটি বিমানও ক্ষণ গণনা অনুষ্ঠানে থাকবে।

১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেন শেখ মুজিবুর রহমান। কালক্রমে তার হাত ধরেই বিশ্ব মানচিত্রে নতুন দেশ হিসেবে স্থান করে নেয় বাংলাদেশ।

ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তিনি। মাত্র ৫৫ বছর বয়সের মধ্যে আন্দোলন-সংগ্রামে বহুবার প্রায় ১৩ বছর বা ৪ হাজার ৬৮২ দিন কারাগারে কাটাতে হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে।

১৯৭৫ সালে একদল সেনা কর্মকর্তার হাতে সপরিবারে নিহত হন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের এই নেতা। দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান।