‘সসম্মানে’ চলে যান, আহ্বান জাবি উপাচার্যকে

উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলামকে ‘সম্মান’ নিয়ে দ্রুত পদত্যাগ করার আহ্বান জানিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 Sept 2019, 01:39 PM
Updated : 19 Sept 2019, 05:20 PM

অধ্যাপক ফারজানা কোনো দাবির মুখে পদত্যাগ না করার ঘোষণা দেওয়ার পর বৃহস্পতিবার ক্যাম্পাসে এক মিছিল শেষে সমাবেশে তার উদ্দেশে এই আহ্বান জানানো হয়।

উপাচার্য পদত্যাগ না করলে আন্দোলনের মাধ্যমে তাকে হটানোর হুমকিও দিয়েছেন আন্দোলনকারী শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।

বুধবার আলোচনা ভেস্তে যাওয়ার পর উপাচার্য ফারজানাকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগের জন্য ১ অক্টোবর পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়ে নানা কর্মসূচি পালন করছে আন্দোলনকারীদের প্ল্যাটফর্ম ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’।

তার অংশ হিসেবে বৃহস্পতিবার বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। শতাধিক শিক্ষক-শিক্ষার্থীর এই মিছিল সমাজ বিজ্ঞান অনুষদ থেকে শুরু হয়ে পুরনো প্রশাসনিক ভবনের সামনে এসে সমাবেশের মধ্য দিয়ে শেষ হয়।

সমাবেশে ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’র মুখপাত্র দর্শন বিভাগের অধ্যাপক রায়হান রাইন বলেন, “উপাচার্য উন্নয়ন প্রকল্পকে ব্যবসাক্ষেত্রে পরিণত করেছেন। তাই নৈতিক স্খলন হওয়ায় তার পদত্যাগ চেয়েছি। উপাচার্যের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে তার বিচার রাষ্ট্রীয় আইনে চাই।”

তিনি বলেন, “আসন্ন ভর্তি পরীক্ষার সময় উপাচার্যকে সব ভবনে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করছি। কারণ এই অভিযোগ উঠার পরে আমাদের কর্মস্থলে আর উপাচার্যকে দেখতে চাই না।”

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করেন গত মাসে।

এর মধ্যেই ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে উপাচার্য ফারজানার কাছে চাঁদা চাওয়ার অভিযোগ ওঠে।

এর পরিপ্রেক্ষিতে ওই দুজনকে সরতে হলেও তারা অভিযোগ অস্বীকার করে উল্টো অধ্যাপক ফারজানার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তোলেন। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতাদের তিনি অর্থ দিয়েছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।

আন্দোলনকারী শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনার ভেস্তে যাওয়ার পর উপাচার্য ফারজানা বুধবার বলেছিলেন, কারও দাবির মুখে তিনি পদত্যাগ করবেন না, রাষ্ট্রপতি নির্দেশ না দিলে তা করতে পারেন তিনি।

অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম

সমাবেশে নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মির্জা তসলিমা সুলতানা বলেন, “এমন গুরুতর অপরাধের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠার পরে আর কোনোভাবেই তিনি এমন সম্মানীয় পদে থাকতে পারেন না।”

দর্শন বিভাগের অধ্যাপক কামরুল আহসান বলেন, “আমরা সরাসরি কখনও বলিনি আপনি দুর্নীতিবাজ, তবে আপনার কার্যক্রমের মাধ্যমে আপনি সেটা প্রমাণ করছেন।

“আমরা এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত চাই। আপনার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে এই অভিযোগ ফৌজদারি আইনে বিচার হওয়ার যোগ্য। যার সাথে আপনার সম্পৃক্ততা থাকলে অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে।”

সমাবেশে শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি আশিকুর রহমান বলেন, “আমরা প্রথম থেকেই বলেছি ছাত্রলীগকে প্রকল্পের টাকা দেওয়া হয়েছে, কিন্তু তারা মানলেন না। পরে টাকাপ্রাপ্ত নেতারা যখন স্বীকারোক্তি দিল, সেটাও মানতে চাইছেন না উপাচার্য।

“জনগণের ট্যাক্সের টাকা ছাত্রলীগ নেতাদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করা হয়েছে। এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা কোনো ভাবেই মেনে নেবে না। আমরা উপাচার্যকে জানাতে চাই, সসম্মানে পদ ছেড়ে দেন, না হলে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা আপনাকে পদ ছাড়তে বাধ্য করবে।”

ছাত্র ইউনিয়ন নেতা রাকিবুল রনি বলেন, “জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব ছাত্রলীগ নেতা চাঁদাবাজি করেছেন, যারা টাকা পেয়েছেন তারা স্বীকার করেছেন যে উপাচার্য ছাত্রলীগ নেতাদের হলে হলে টাকা পৌঁছে দিয়েছেন। এই লজ্জা আমরা আর রাখতে পারি না। 

“জনগণের রক্ত পানি করা টাকা থেকে আপনি লুটপাট করবেন আর হাসি-তামাশা করবেন, তা হতে পারে না। কেবল পদত্যাগের মধ্যেই আপনার রেহাই হবে না, আপনাকে বিচারের মুখোমুখিও হতে হবে।”

সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের নেতা মোহাম্মদ দিদার বলেন, “সমগ্র রাষ্ট্রের জনগণ জেনে গেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য দুর্নীতির সাথে জড়িত। এই অবস্থায় দেশের কেউ চায় না উপাচার্য পদে তিনি থাকুক।”

এদিকে বৃহস্পতিবার বিকালে ঢাকায় গিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের সঙ্গে বৈঠক করেন উপাচার্য ফারজানা। তবে সাংবাদিকদের কোনো প্রশ্নের উত্তর তিনি দেননি।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের প্রশ্নে বলেন, জাহাঙ্গীরনগরে কোনো দুর্নীতি হয়েছে বলে তিনি মনে করেন না।

“অর্থ এখনও ডেসপাস হয় নাই, এখনও কন্ট্রাক্ট শুরু হয় নাই, এখনও তো কিছু হয়নি। অর্থ নিয়ে যে সমস্ত কাহিনী আমরা শুনতেছি- এগুলোতো এখনও সেই পদ্মা সেতুর মত দশা… আমার কাছে মনে হচ্ছে।”

উপ-উপাচার্য আমিরের পদত্যাগ দাবি

অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মধ্যে তার সমর্থক শিক্ষকরা উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক আমির হোসেনের পদত্যাগ দাবি করেছেন।

উপাচার্য সমর্থক শিক্ষকদের সংগঠন ‘বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদ’ বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে দাবি করেছে, উপাচার্যবিরোধী আন্দোলনে অধ্যাপক আমিরের ইন্ধন রয়েছে।

পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক আব্দুল মান্নান চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক বশির আহমেদ স্বাক্ষরিত এই বিবৃতিতে বলা হয়, “বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ রক্ষার দাবির আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে দুর্নীতির ‘কল্পিত’ অভিযোগ এনে শিক্ষকদের একটি অংশ উপাচার্যের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের জাল বুনে যাচ্ছে।

“এর পেছনে সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবির ও উপ-উপাচার্য আমির হোসেনের মদদ রয়েছে, এটা এখন স্পষ্ট।”

বুধবার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে উপাচার্যের বৈঠক বর্জন করেছিলেন উপ-উপাচার্য আমির। তিনি প্রশাসনের বিরুদ্ধে তাকে হয়রানির অভিযোগ তুলেছিলেন।

পরিষদের বিবৃতিতে বলা হয়, “মুঠোফোন সংযোগ বন্ধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সম্পৃক্ততার অভিযোগ এনে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে প্রশাসনের বৈঠকে উপ-উপাচার্য আমির হোসেন অংশ নেননি। এর মাধ্যমে থলের বিড়াল বেরিয়ে এসেছে।”

উপাচার্য সমর্থকদের দাবি, বৈঠকে অংশ না নিয়ে অধ্যাপক আমির বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান সংকট সমাধানের পথ জটিল করে নিজে উপাচার্য হবার পাঁয়তারা করছেন।

এসব অভিযোগের বিষয়ে অধ্যাপক আমির বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আন্দোলনকারীদের সাথে বৈঠকের আগের রাতে আমার মুঠোফোন সংযোগ বন্ধ করা হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এতে মদদ রয়েছে।

“এর আগে উপাচার্য ফারজানা ইসলাম বিভিন্ন সময় আমাকে তার গ্রুপে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু আমি আদর্শচ্যুত হতে চাইনি। তাই আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে এসব অভিযোগ আনা হচ্ছে।”

পদত্যাগের দাবির বিষয়ে তিনি বলেন, “আমাকে উপ-উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন মাননীয় আচার্য। আমার কোনো কর্মকাণ্ডে কারণ দর্শানো কিংবা সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ারও আচার্যের।”

উপাচার্য সমর্থক শিক্ষকদের অভিযোগের বিষয়ে সাবেক উপাচার্য শরীফ এনামুল কবীর কোনো কথা বলতে চাননি। তিনি বলেন, “তারা (উপাচার্য সমর্থক শিক্ষকরা) কী বিবৃতি দিয়েছে, এটা তাদের বিষয়। আমি এ বিষয়ে কিছু বলব না।”