অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘটে অচল নৌপথ

নিয়োগপত্র, ভাতা, চাঁদাবাজি বন্ধ করাসহ ১১ দফা দাবিতে নৌযান শ্রমিকদের অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘটে অচল হয়ে পড়েছে দেশের সব নৌপথ।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 July 2019, 08:23 AM
Updated : 24 July 2019, 09:59 AM

বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের ডাকে বুধবার প্রথম প্রহর থেকে এই ধর্মঘটের কারণে সারা দেশে লাইটার জাহাজ (ছোট আকারের পণ্যবাহী জাহাজ) চলাচল বন্ধ রয়েছে।

ফলে চট্টগ্রাম বন্দরের বর্হিনোঙরে মাদার ভেসেল (বড় আকারের জাহাজ) থেকে পণ্য খালাসও বন্ধ হয়ে গেছে।

মধ্যরাতের পর থেকে সারা দেশে যাত্রীবাহী লঞ্চ চলাচলও বন্ধ রয়েছে। ফলে ভোগান্তিতে পড়েছেন রাজধানীসহ দক্ষিণ জনপদের বিভিন্ন জেলার নৌপথের যাত্রীরা। 

নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক খোরশেদ আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মধ্যরাত থেকে আমরা কর্মবিরতি শুরু করছি। দেশের যেখানে যে নৌযান আছে (নদীতে বা সাগরে) সেটাকে সেখানেই অবস্থান করতে বলা হয়েছে। দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত কর্মসূচি চলবে।”

ফেডারেশনের ১১ দফা দাবির মধ্যে মালিকপক্ষের কাছে সাত দফা এবং সরকারের কাছে চার দফা।

>> প্রত্যেক শ্রমিককে মালিকের পক্ষ থেকে পরিচয়পত্র, নিয়োগপত্র ও সার্ভিস বুক দিতে হবে

>> সামাজিক নিরাপত্তার জন্য জীবন বীমা করাতে হবে

>> সরকারি ব্যবস্থাপনায় প্রভিডেন্ট ফান্ড করতে হবে

>> খোরাকি ভাতা দিতে হবে

>> কর্মকালীন মৃত্যু হলে মৃত ব্যক্তির পরিবারকে ১০ লাখ টাকা দিতে হবে

>> নৌপথে সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজী বন্ধ করতে হবে

>> ভারতগামী জাহাজের ল্যান্ডিং পাস দিতে হবে

>> সমুদ্র ভাতা দিতে হবে

>> মাস্টার ড্রাইভারদের ইনচার্জ ভাতা দিতে হবে

>> মাস্টার ড্রাইভার পরীক্ষার অনিয়ম দূর করতে হবে

>> মেরিন কোর্টের হয়রানি বন্ধ করতে হবে

বিআইডব্লিউটিএ-এর যুগ্ম পরিচালক আলমগীর কবির বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নৌযান শ্রমিকরা ১১দফা দাবিতে সারাদেশে লঞ্চ চলাচল বন্ধ রেখেছে। ফলে গত রাত ১২টার পর ঢাকা সদরঘাট থেকে কোনো লঞ্চ ছাড়ছে না।”

নৌ ধর্মঘটে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা যেন না ঘটে সেজন্য বিভিন্ন এলাকায় কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে বলে জানান বিআইডব্লিউটিএ- এর জনসংযোগ কর্মকর্তা মোবারক হোসেন মজুমদার।

চট্টগ্রাম 

সরকার ও মালিকের কাছে দেয়া ১১ দফা দাবি এক বছর তিন মাসেও পূরণ না হওয়ায় দেশব্যাপী অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি শুরু করেছে নৌযান শ্রমিকরা।

তাদের এ ধর্মঘটের কারণে চট্টগ্রাম বন্দরের বর্হিনোঙরে মাদার ভেসেল থেকে পণ্য খালাস বন্ধ রয়েছে বলে জানান বন্দর সচিব ওমর ফারুক।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন বিভিন্ন রকমের পণ্যবাহী জাহাজ, তেলবাহী ট্যাংকারসহ মোট ৮৩টি মাদার ভেসেল বর্হিনোঙরে খালাসের অপেক্ষায় রয়েছে।

তবে বন্দরের বিভিন্ন জেটিতে থাকা ১৯টি জাহাজ থেকে পণ্য খালাস হচ্ছে। কনটেইনার জেটিতেও স্বাভাবিক কাজ চলছে।

সাগরে মাদার ভেসেল থেকে পণ্য খালাস করে লাইটার জাহাজে করে নিয়ে যাওয়ার হয় দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে। বন্দরের বহির্নোঙরে থাকা মাদার ভেসেল, কর্ণফুলী নদীর ১৬টি ঘাট এবং বিভিন্ন জেটি থেকে লাইটার জাহাজে করে পণ্য পরিবহন করা হয়।

কিন্তু মধ্যরাত থেকে ধর্মঘটের কারণে ৪০০ লাইটার জাহাজ বর্হিনোঙরে অলস বসে আছে বলে লাইটার জাহাজ পরিচালনাকারী সংস্থা ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের (ডব্লিউটিসি) নির্বাহী পরিচালক মাহবুব জানান।

বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের হিসাবে, চট্টগ্রাম থেকে প্রায় দেড় হাজার লাইটার জাহাজ দেশের বিভিন্ন স্থানে চলাচল করে। এসব জাহাজের মালিকানা রযেছে প্রায় আটশ ব্যবসায়ীর হাতে।

আর সারাদেশের সব নৌরুট মিলিয়ে প্রায় ছয় হাজার লাইটার জাহাজ রয়েছে। ধর্মঘটের কারণে এর সবই বন্ধ রয়েছে।  

চট্টগ্রামে দেড় হাজার লাইটারে প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। আর সারাদেশে প্রায় ছয় হাজার লাইটারে শ্রমিকের সংখ্যা দেড় লাখের বেশি।

চাঁদপুর

বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের লাগাতার কর্মবিরতিতে ভোগান্তিতে পড়েছে চাঁদপুরসহ আশপাশের জেলার হাজারো যাত্রী।

ধর্মঘটের কারণে বুধবার ভোর থেকে কোনো লঞ্চ চাঁদপুর ছেড়ে যায়নি। অভ্যন্তরীণ রুটের নৌযানগুলোকে শহরের বিকল্প লঞ্চঘাটে এবং ডাকাতিয়া নদীতে নোঙ্গর করে রাখা হয়েছে। শ্রমিকরা ঘাটে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল করছেন।

শ্রমিকদের কর্মবিরতির কথা জানা না থাকায় চাঁদপুর জেলার ৮ উপজেলা, লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালীর অনেক যাত্রী লঞ্চঘাটে এসে অপেক্ষা করে ফিরে যান।

হাবিবুর রহমান নামে একজন বলেন, “বিষয়টি আগে জানা থাকা থাকলে আমাদের এভাবে ঘাটে এসে দুর্ভোগ পোহাতে হত না।”

মো. হাসান খান নামের আরেকজন বলেন, “আমার যাওয়া জরুরি। লঞ্চ যেহেতু বন্ধ, এখন সড়ক পথেই আমাকে ঢাকা যেতে হবে।”

বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের চাঁদপুর জেলা শাখার সভাপতি হারুনুর রশিদ বলেন, “এর আগে গত এপ্রিল মাসেও আমরা কর্মবিরতি পালন করেছিলাম। তখন আমাদের ৪৫ দিনের মধ্যে দাবি পূরণের আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা কথা রাখেনি।”

চাঁদপুর জেলা নৌযান শ্রমিক লীগের সভাপতি বিপ্লব সরকার বরেন, “নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনসহ ত্রিপক্ষীয় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসার আগ পর্যন্ত লঞ্চ চলাচল বন্ধ থাকবে।”

কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা যেন না ঘটে নৌ পুলিশ সেদিকে নজর রাখছে বলে চাঁদপুর নৌ পুলিশ ফাঁড়ির ওসি আবু তাহের জানান।

খুলনা

দেশের অন্যান্য স্থানের মত খুলনার নৌযান শ্রমিকরাও অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট পালন করছেন।

দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত এ ধর্মঘট অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছেন লঞ্চ লেবার অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম সম্পাদক মো. ফারুক হোসেন মাস্টার।

তিনি বলেন, খুলনা, মোংলা ও নওয়াপাড়ায় জাহাজ, কার্গো, তেলবাহী ট্যাংকার থেকে খালাস ও পণ্য তোলা বন্ধ রয়েছে। লঞ্চও চলছে না। সারা দেশের আট লাখ শ্রমিক এ ধর্মঘট পালন করছেন।

১৫ মাসেও দাবি পূরণ হয়নি

ওই ১১ দফা দাবিতে নৌযান শ্রমিকদের আন্দোলন শুরু হয় গত বছর এপ্রিলে। এরপর শ্রম মন্ত্রী ও মালিক পক্ষসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের সাথে দফায় দফায় বৈঠক হলেও দাবি পূরণে কোনো অগ্রগতি হয়নি।

নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় নেতা নবী আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সব শেষ ১৫ জুলই শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুন্নুজান সুফিয়ানের সঙ্গে তাদের বৈঠক হয়। সে সময় ২২ জুলাই পর্যন্ত সময় চেয়েছিলেন প্রতিমন্ত্রী।

“এরপরও কিছু না হওয়ায় শ্রমিকদের আর বোঝানো সম্ভব হয়নি। কর্মবিরতি শুরু হয়ে গেছে।”

নবী আলম জানান, ২০১৮ সালের ৩০ এপ্রিল নৌ মন্ত্রী, শ্রমমন্ত্রী, নৌ পরিবহন অধিদপ্তর, মালিক সমিতি এবং সরকারি সংশ্লিষ্ট দপ্তরে চিঠি দিয়ে ১১ দফা দাবি পূরণের আহ্বান জানায় নৌযান শ্রমিক ফেডারেশন।

ওই বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর কর্মবিরতি শুরু করলেও এক বৈঠকে মালিক পক্ষ ও সরকার দাবি মেনে নেয়ার আশ্বাস দিলে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত তা স্থগিত করা হয়।

সেই সময়সীমা পেরিয়ে গেলে চলতি বছরের ১৫ এপ্রিল মধ্যরাত থেকে কর্মবিরতি শুরু করে নৌযান শ্রমিকরা।

এরপর ১৬ এপ্রিল বিকেলে শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুন্নুজান সুফিয়ানের নেতৃত্বে শুরু হওয়া বৈঠক শেষ হয় সেদিন মধ্যরাতে। ওই বৈঠকে ৪৫ কার্যদিবসের মধ্যে দাবি মেনে নেয়ার চুক্তি করে মালিকপক্ষ।

ওই সময়সীমাও পেরিয়ে গেলে ২৭ জুন শ্রম পরিচালকের সঙ্গে সভা করে শ্রমিক ও মালিকরা। সবশেষে শ্রম প্রতিমন্ত্রী ১০ জুলাই পর্যন্ত সময় দেন মালিকদের।

এরপর ১৫ জুলাই প্রতিমন্ত্রী নৌযান শ্রমিকদের সঙ্গে সভা করলেও তাতে মালিক পক্ষের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিল না বলে শ্রমিক ফেডারেশনের নেতৃবৃন্দ জানান।

[ঢাকায় আমাদের একজন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম অফিস এবং খুলনা, বরিশাল ও চাঁদপুর প্রতিনিধির দেওয়া তথ্যে এই প্রতিবেদন তৈরি হয়েছে।]